চিহ্ন বিনা নাহি চেনা যায় সুগ্রীবেরে।
চিহ্ন দিতে শ্রীরাম কহেন লক্ষ্মণেরে।।
লক্ষ্মণ দিলেন পুষ্পমালা তার গলে।
করিলেন সাত বীর যাত্রা শুভকালে।।
রাজ্যলোভে সুগ্রীব মারিতে সহোদরে।
আগে আগে চলিল বিলম্ব নাহি করে।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ যান হাতে ধনুঃশর।
তাহার পশ্চাৎ চলে ইতর বানর।।
মৃগ পক্ষী বনচর দেখে স্থানে স্থান।
লক্ষ লক্ষ হস্তী দেখে পর্ব্বত প্রমাণ।।
বনের ভিতর দেখে অতি বিচক্ষণ।
মুনির আশ্রম মাঝে কদলীর বন।।
শ্রীরাম বলেন, মিত্র অদ্ভুত কদলী।
কাহার সৃজন এই আশ্রম মণ্ডলী।।
সুগ্রীব বলেন, হেথা ছিল সপ্ত মুনি।
করিত কঠোর তপ লোকমুখে শুনি।।
তারা দশ হাজার বৎসর অনাহারে।
করি তপ সশরীরে গেল স্বর্গপুরে।।
সকলে বন্দেন গিয়া আশ্রম-মণ্ডল।
যাহারে বন্দিলে হয় সর্ব্বত্র মঙ্গল।।
সুগ্রীব বলিল, রাম হও সাবধান।
কালিকার মত যেন না হয় বিধান।।
আপন শপথে মিত্র আজি হও পার।
অবশ্য করিব আমি সীতার উদ্ধার।।
আমার বচন মিথ্যা না ভাবিহ মনে।
সীতা উদ্ধারিব আমি মারিয়া রাবণে।।
শ্রীরাম বলেন, তুমি ভূষিত মালায়।
বালিকে বধিব আজি, বাঁচাব তোমায়।।
বালিকে দেখিবামাত্র চালাইব শর।
পুনরায় বালি আজি না যাইবে ঘর।।
সপ্ত তাল বিন্ধিলাম আমি যেই বাণে।
সেই বাণ স্মরিয়া নিশ্চিন্ত হও মনে।।
মিথ্যা না বলিব, সত্য না করিব আন।
বালি রাজা নিতান্ত হারাবে আজি প্রাণ।।
সিংহনাদ ছাড়িল সুগ্রীব বালি-দ্বারে।
আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়ে যেন মহীধরে।।
পাইয়া রামের বল সুগ্রীব প্রবল।
সিংহনাদে কাঁপাইল ধরা রসাতল।।
সিংহনাদে রুষিল বানররাজ বালি।
সম্মুখে যাহারে দেখে তারে দেয় গালি।।
মুখখান মেলে যেন জ্বলন্ত আঙরা।
চন্দ্র সূর্য্য জিনিয়া চক্ষুর দুই তারা।।
সত্তর যোজন তনু আড়ে পরিসর।
তিন শত যোজন দীঘল কলেবর।।
যদি বাঞ্ছা হয়, হয় নকুল প্রমাণ।
কখন আকাশ যোড়া হয় পরিমাণ।।
লাঙ্গুল করতে পারে যোজন পঞ্চাশ।
উভ যদি করে, তবে পরশে আকাশ।।
তারা মহাদেবী তার অতি বুদ্ধি ধরে।
বালিকে বারণ করে যাইতে সমরে।।
কোপ সম্বরহ, রণে না কর গমন।
আমার বচন শুন জীবন-কারণ।।
একদিন যুদ্ধে যার বৎসর বিশ্রাম।
কি সাহসে আইসে সে করিতে সংগ্রাম।।
যুদ্ধে ভঙ্গ দিয়া যেই যুঝিতে হাঁকারে।
হইলে পণ্ডিত লোক অবশ্য বিচারে।।
আপনা পাসর তুমি, মত্ত হও কোপে।
ভাবিতে তোমার কর্ম্ম ভয়ে প্রাণ কাঁপে।।
যুদ্ধে না যাইও প্রভু শুন মোর বাণী।
আজিকার যুদ্ধে আমি অমঙ্গল গণি।।
কালি গেল তব স্থানে সুগ্রীব হারিয়া।
কি বলে আইল আজি প্রবল হইয়া।।
অবশ্য কাহার ঠাঁই পাইয়াছে বল।
নতুবা আসিবে কেন, নিজে সে দুর্ব্বল।।
যুদ্ধে না যাইহ তুমি থাক অন্তঃপুরে।
ডাকিছে সুগ্রীব দ্বারে, ডাকুক বাহিরে।।
সূর্য্যবংশে রাজা ছিল দশরথ নাম।
রাজপুত্র দুই ভাই লক্ষ্মণ শ্রীরাম।।
পিতৃসত্য পালিতে হইল বনবাসী।
বল্কল পরিধান, শিরে জটা, সে সন্ন্যাসী।।
রাজ্য হারাইয়া তারা ভ্রমে বনে বনে।
মিলিয়াছে তারা বুঝি সুগ্রীবের সনে।।
রাজ্যভ্রষ্ট সুগ্রীব বিবিধ বুদ্ধি ধরে।
সহায় করিয়া বুঝি আইল রামেরে।।
যদ্যপি এমত হয়, তবে বড় ভার।
নাহি দেখি অদ্য যুদ্ধে মঙ্গল তোমার।।
ভাল মন্দ হউক সে তবু সহোদর।
সহোদর সনে যুদ্ধ অযোগ্য বিস্তর।।
ক্ষান্ত হও মহারাজম কাজ নাই রাগে।
সুগ্রীব সহিত রাজ্য কর একযোগে।।
সকলে রাজত্ব করে, সুগ্রীব বঞ্চিত।
সহিতে না পারে দুঃখ, ভাবে বিপরীত।।
আমার বচন তুমি না করিহ হেলা।
অহঙ্কারে না যাইহ সংগ্রামের বেলা।।
আর এক কথা প্রভু করি নিবেদন।
পিতৃসত্য হেতু রাম আইলেন বন।।
কৈকেয়ী বিমাতা তাঁরে দিল সত্যভার।
কনিষ্ঠেরে রাজ্যে রাম দেন অধিকার।।
শত্রু হৈয়া যেই জন পাঠাইল বনে।
তাহারে করেন রাজা কিসের কারণে।।
তোমার বাপের বেটা, কনিষ্ঠ সোদর।
দুই ভাই রাজ্য কর হৈয়া একত্তর।।
বালি বলে না ভাবিহ তারা চন্দ্রমুখী।
সুগ্রীব মরিলে রণে নহি আমি দুঃখী।।
দানব মারিতে আমি গেলাম পাতালে।
রাখিলাম সুড়ঙ্গের দ্বারে সে চণ্ডালে।।
বৃক্ষ প্রস্তরেতে সে সুড়ঙ্গ-দ্বার ঢাকে।
আমার মহিষী হরে, জাতি নাহি রাখে।।
তোমার কথায় তারে না মারিব প্রাণে।
হাতে গলে বান্ধি দিব, তোমা বিদ্যমানে।।
তারা বলে শুন রাজা করি নিবেদন।
সুগ্রীবের দোষ নাই দোষী পাত্রগণ।।
পাত্রগণে রাজ্য দিল হইয়া সন্তোষ।
সুগ্রীব হইল রাজা, তার নাহি দোষ।।
করহ আমারে ক্ষমা, রাখহ বচন।
আজিকার দিন তুমি না করহ রণ।।
ক্ষিতি খান খান হয়, পর্ব্বত উপাড়ে।
চন্দ্র সূর্য্য আদি শ্রীরামের বাণে পোড়ে।।
রামেরে সহায় করি যদি সে আইসে।
তবে বল প্রাণনাথ রক্ষা পাবে কিসে।।
বালি বলে, বল কেন অসত্য বচন।
মারিবেন শ্রীরাম আমারে কি কারণ।।
পরের কথায় কি করিবেন অধর্ম্ম।
রামকে না ভয় করি, শুন তার মর্ম্ম।।
সত্যবাদী রাম, বড় সত্যধর্ম্মে মন।
সত্যের কারণে তিনি আইলেন বন।।
কখন রামের সঙ্গে মোর নাহি বাদ।
তিনি কেন করিবেন মিথ্যা বিসম্বাদ।।
আমি দোষী নহি, রাম রুষিবেন কিসে।
পুনঃ পুনঃ কহ কেন রাম বুঝি আসে।।
তবে যদি সুগ্রীব-সাহায্যে আসে রাম।
তবু নাহি দিব ভঙ্গ করিব সংগ্রাম।।
রুষিয়া চলিল বালি সিংহের গর্জ্জনে।
না রহিল তারা মহাদেবীর বচনে।।
যাত্রাকালে তারাদেবী করিল মঙ্গল।
কিন্তু তার নেত্রে জল করে ছল ছল।।
অন্তরে জানিয়া তারা কান্দিল বিস্তর।
এবার নিস্তার নাহি, সমর দুস্তর।।
বাহির হইয়া বালি চতুর্দ্দিকে চায়।
একা সুগ্রীবেরে মাত্র দেখিবারে পায়।।
বালি সুগ্রীবের যুদ্ধে লাগে হুড়াহুড়ি।
হুড়াহুড়ি দুই জনে করে বেড়াবেড়ি।।
বেড়াবেড়ি দুই জনে করে জড়াজড়ি।
জড়াজড়ি দুইজনে করে মারামারি।।
কেহ কারে নাহি পারে উভয়ে সোসর।
দুই জন মল্লযুদ্ধ একটি প্রহর।।
সুগ্রীব হইতে বালি দ্বিগুণ প্রখর।
একটি চাপড়ে তারে করিল কাতর।।
বাল বজ্রমুষ্টি যে মারিল তার বুকে।
অচেতন সুগ্রীব, শোণিত উঠে মুখে।।
সুগ্রীবের অচেতন দেখিয়া সম্মুখে।
শ্রীরাম ঐষিক বাণ যুড়েন ধনুকে।।
সশঙ্ক সুগ্রীব প্রায় করে পলায়ন।
আড়ে থাকি রাম বাণ করেন ক্ষেপণ।।
দশদিক আলো করি সেই বাণ ছুটে।
বজ্রাঘাত সম বাণ বালি-বক্ষে ফুটে।।
বুক ধরি বাল রাজা করে হাহাকার।
কোন্ জন করিল এ দারুণ প্রহার।।
বুকে পৃষ্ঠে ভার সে নাড়িতে নারে পাশ।
এক বাণে পড়ে বালি, ঘন বহে শ্বাস।।
পড়িলেক বালি রাজা ইন্দ্রের নন্দন।
গায়ের ভূষণ খসে, অঙ্গের বসন।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের থাকিল বিষাদ।
ধার্ম্মিক রামের কেন হইল প্রমাদ।।