আমরা পাঁচ জন শ্যালক্স গ্রুনের কদাকার সময়–পরিভ্রমণ যানটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সন্ধ্যা নেমে এসেছে, এই পুরো এলাকাটিতে কৃত্রিম আলোর কোনো ব্যবস্থা নেই, আবছা অন্ধকারে সময়–পরিভ্রমণ যানটিকে দেখাচ্ছে একটা অশুভ প্রেতপুরীর মতো।
য়োমি নিচু গলায় বলল, কী বীভৎস একটা জিনিস। রিকি আমি চিন্তাও করতে পারি না তুমি কেমন করে এর ভিতরে যাবে।
আমি য়োমির দিকে তাকিয়ে বললাম, আমিও পারি না।
থাক, এখন সেসব কথা তুলে লাভ নেই। নুবা আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, তোমার কাছে ত্রিনিত্রি রাশিমালার ক্রিস্টাল ডিস্কটা আছে?
আমি পকেটে হাত দিয়ে বললাম, হ্যাঁ, আছে।
তাহলে তুমি যাও শ্যালক্স গ্রুনের কাছে।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে যেতে গিয়ে থেমে গেলাম। ঘুরে তাকিয়ে বললাম, যদি আমাদের পরিকল্পনা কাজ না করে তাহলে কী হবে?
নুবা নিচু স্বরে বলল, এখন সেটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই।
কিন্তু যদি কিছু একটা ভুল হয়ে যায়?
হিশান এগিয়ে এসে আমার কাধ স্পর্শ করে বলল, ওই যে উপরে তাকিয়ে দেখ।
আমি উপরে তাকালাম, আকাশে রুপালি একটা গোলক স্থির হয়ে আছে। আমি একটু অবাক হয়ে হিশানের দিকে তাকালাম, কী ওটা?
থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা। যেটুকু আছে সেটা দিয়ে অর্ধেক পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার কথা।
এটা কেন এখানে?
যে তাপমাত্রায় লিটুমিনা–৭২ ভাইরাসকে ধ্বংস করা যায় সেই তাপমাত্রা সৃষ্টি করার এটা হচ্ছে একমাত্র উপায়। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগে সেগুলোকে ধ্বংস করা যাবে কি না সেটা কেউ এখনো জানে না, কিন্তু চেষ্টা করে দেখা হবে।
যদি না যায়?
পৃথিবীর গোপন ভন্টে অসংখ্য শিশুকে শীতলঘরে রাখা আছে। মহাকাশে অসংখ্য মানুষকে, বিজ্ঞানীকে ইঞ্জিনিয়ার শিল্পী সাহিত্যিককে পাঠানো হয়েছে। যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় তারা বেঁচে থাকবে। আবার নূতন করে সভ্যতার সৃষ্টি হবে।
আমি স্থির চোখে হিশানের দিকে তাকিয়ে বললাম, হিশান, সত্যি কি আবার নূতন করে সভ্যতার সৃষ্টি করতে হবে?
না রিকি। নিজের ওপর বিশ্বাস রেখো। তুমি যাও।
ইগা ফিসফিস করে বলল, তোমার যাত্রা শুভ হোক রিকি।
আমি পায়ে পায়ে কদাকার যানটির দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। কাছাকাছি আসতেই একটি গোল দরজা খুলে গেল, শ্যালক্স গ্রুন আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।
ভিতরে গাঢ় অন্ধকার। আমি দেয়াল ধরে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইলাম তবু অন্ধকারে আমার চোখ সয়ে গেল না। এক সময় কাঁপা গলায় ডাকলাম, শ্যালক্স গ্রুন
ভিতরের গাঢ় অন্ধকার থেকে শ্যালক্স গ্রুনের গলার স্বর ভেসে এল, তুমি এসেছ?
হ্যাঁ।
ত্রিনিত্রি রাশিমালা এনেছ আমার জন্যে?
ছোট একটা ক্রিস্টাল ডিস্ক দিয়েছে আমাকে। তার মাঝে ত্রিনিত্রি রাশিমালা থাকার কথা।
তুমি সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে এ রকম হেঁয়ালি করে কেন কথা বলছ?
কারণ আমরা চেষ্টা করছি তোমাকে ধ্বংস করতে।
এক মুহূর্তের জন্যে শ্যালক্স গ্রুন কোনো কথা বলল না, তারপর হঠাৎ সে হা হা করে হেসে উঠল। অত্যন্ত ক্রুর সেই হাসি, আমার শরীর কেমন জানি কাঁটা দিয়ে ওঠে। হাসতে হাসতেই সে বলল, তোমার সাহস দেখে আমি এক ধরনের আনন্দ পাই! ব্যাপারটি ভালো কি না সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ নই কিন্তু ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কৌতুককর। তোমরা কি আমাকে ধ্বংস করতে পারবে?
সেটি ঠিক করা হবে এই কিছুক্ষণের মাঝে।
হঠাৎ করে ঘরের আলো জ্বলে ওঠে, আমি আবার শ্যালক্স গ্রুনকে সামনাসামনি দেখতে পেলাম, একটা দীর্ঘ টেবিলের অন্যপাশে বসে আছে। মাথায় এলোমেলো কালো চুল, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, মনে হয় সেই দৃষ্টি আমার শরীর ভেদ করে যাচ্ছে। একটু মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, কিছুক্ষণের মাঝে তুমি জানতে পারবে?
হ্যাঁ।
কেমন করে?
তোমাকে যে ক্রিস্টাল ডিস্কটি দিয়েছি তার মাঝে যে রাশিমালাটি রয়েছে সেটি একটি অর্থহীন সংখ্যা না সত্যিকারের ত্রিনিত্রি রাশিমালা তুমি সেটা জান না। তোমাকে সেটা আমি নিজে থেকে বলব না, আমি বললেও তুমি বিশ্বাস করবে না। তোমার নিজেকে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তুমি নিশ্চয়ই জান ত্রিনিত্রি রাশিমালার মাঝে একটা অনিশ্চয়তা রয়েছে। যখন তুমি একটি অংশ পরীক্ষা করে দেখবে তখন অন্য একটি অংশ অস্পষ্ট হয়ে যাবে।
শ্যালক্স গ্রুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বললাম, ত্রিনিত্রি রাশিমালার যে অংশ তোমার কাছে অস্পষ্ট সেই অংশটি আমাদের অস্ত্র। আজ থেকে এক শ বছর পর তুমি যখন আবার পৃথিবীতে নেমে আসবে পৃথিবী তখন তোমার জন্যে প্রস্তুত থাকবে।
তুমি মিথ্যা কথা বলছ।
হঠাৎ আমার বুক কেঁপে ওঠে, এই মানুষটি অসম্ভব ধূর্ত। আমি কি সত্যিই তাকে ধোঁকা দিতে পারব? শ্যালক্স গ্রুন আবার চাপা স্বরে বলল, তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলছ, মানুষ মিথ্যা কথা বললে আমি বুঝতে পারি।
আমি চুপ করে রইলাম। শ্যালক্স গ্রুন আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, কিছু একটা পরিকল্পনা তোমাদের আছে সেটা কী আমি এখনো জানি না। তুমি জান আমি যদি চাই আমি সেটা যখন ইচ্ছে জানতে পারব। আমি মানুষকে অসম্ভব যন্ত্রণা দিতে পারি। মনোবিজ্ঞানে আমার মতো চরিত্রের একটি গালভরা নাম রয়েছে।
হঠাৎ আতঙ্কে আমার বুক কেঁপে ওঠে।
আমি জিভ দিয়ে আমার শুকনো ঠোঁটকে ভিজিয়ে বললাম, তুমি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছ?
না, আমি আলাদা করে কাউকে ভয় দেখাতে চাই না। তার প্রয়োজন হয় না। সাধারণ মানুষ এমনিতেই আমাকে ভয় পায়।
আমি শ্যালক্স গ্রুনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কী ভয়ঙ্কর নিষ্করুণ দৃষ্টি। আমার বুকের ভিতর শিরশির করতে থাকে অনেক কষ্টে নিজেকে শক্ত করে আমি বললাম, তুমি কি আমার মুখে আমাদের পরিকল্পনাটি জানতে চাও?
হ্যাঁ, চাই।
কিন্তু আমি নিজে থেকে বলব না। তোমার সেটা জোর করে বের করতে হবে।
শ্যালক্স গ্রুন দীর্ঘ সময় আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল তারপর হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে বলল, তুমি ত্রিনিত্রি রাশিমালাটি আমার মূল কম্পিউটারে প্রবেশ করাও।
আমি গত দুই দিন এই ব্যাপারটি কেমন করে করতে হয় খুব ভালো করে শিখে এসেছি। শ্যালক্স গ্রুন আদেশ দেয়া মাত্র কাজে লেগে গেলাম। দীর্ঘ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ কাজ। এক সময় সেটি শেষ হল, আমি যোগাযোগ মডিউলটি শ্যালক্স গ্রুনের দিকে এগিয়ে দিয়ে দেয়ালের পাশে সরে দাঁড়ালাম।
আমি ইচ্ছে করলে এখন সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে পারি? যেখানে ইচ্ছে পারমাণবিক বোমা ফেলতে পারি? বাঁধ ভেঙে পানিতে শহর ডুবিয়ে দিতে পারি?
পার।
ইচ্ছে করলে আমি চোখের পলকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলতে পারি?
হ্যা পার। কিন্তু ত্রিনিত্রি রাশিমালার উদ্দেশ্য কিন্তু সেটা নয়। তার উদ্দেশ্য সভ্যতার নিয়ন্ত্রণ। আমি আশা করব তুমি সেটা ব্যবহার করবে বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের মতো।
আমি কীভাবে সেটা ব্যবহার করব সেটা আমাকেই ঠিক করতে দাও।
শ্যালক্স গ্রুন যোগাযোগ মডিউলটি নিজের কাছে টেনে নিয়ে অত্যন্ত সহজ গলায় খুব কাছাকাছি একটা পারমাণবিক বিস্ফোরণের আদেশ দিল। মানুষের জনবসতির উপর এত সহজে কেউ একটি এ রকম ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটানোর আদেশ দিতে পারে নিজের চোখে না দেখলে আমার বিশ্বাস হত না। মুহর্তের মাঝেই প্রথমে তীব্র আলোর ঝলকানি আমাদের চোখ ধাধিয়ে দিল। এক মুহূর্ত পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ, সাথে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন পায়ের নিচে দুলে উঠল। কয়েক মুহূর্ত আশ্চর্য এক ধরনের নীরবতা তারপর হঠাৎ যেন প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে সমস্ত এলাকা উড়ে যেতে শুরু করল।
আমি দেয়াল খামচে ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শ্যালক্স গ্রুনের সময়–পরিভ্রমণ যানের ভিতর অসংখ্য মনিটর তীব্র স্বরে শব্দ করতে শুরু করে, একটি বড় লালবাতি বারবার জ্বলতে এবং নিভতে শুরু করে। কোথাও কিছু একটা ভেঙে গেছে বলে সন্দেহ হতে থাকে।
শ্যালক্স গ্রুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একটা প্যানেলের দিকে তাকিয়ে থাকে, ছোট একটা নোট প্যাডে কিছু একটা হিসেব করে মাথার কাছে ছোট একটা গোল জানালা খুলে বাইরে তাকায় তারপর আবার ঘুরে আমার দিকে তাকাল, তার মুখে এক ধরনের সন্তুষ্টির ছাপ। সে একটু হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমি আগে কখনো পারমাণবিক বোমা ফেলি নি–চমৎকার একটি জিনিস। মুহূর্তের মাঝে তেজস্ক্রিয়তা কতগুণ বেড়ে যায়!
আমি কোনো কথা না বলে ক্রুদ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। শ্যালক্স গ্রুন আমার দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, বিস্ফোরণটি খুব কাছাকাছি করা হল, মনে হচ্ছে এত কাছে না করলেও হত। আমি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম তোমরা আমাকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছ কি না।
আমি দাতে দাঁত ঘষে বললাম, তুমি সেটা নিয়ে কখনো নিশ্চিত হতে পারবে না।
আমার প্রয়োজনও নেই। এই মুহূর্তে আমি শুধু একটা জিনিস নিয়ে নিশ্চিত হতে চাই।
কী?
আমি যেন নিরাপদে আরো এক শ বছর ভবিষ্যতে যেতে পারি।
আমি কোনো কথা না বলে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
শ্যালক্স গ্রুন নিচু গলায় বলল, তুমি আমাকে সাহায্য করবে। আমার দুটি কুরু ইঞ্জিন পাল্টে নূতন দুটি ইঞ্জিন লাগিয়ে দেবে, আমি জানি তুমি সেটা করে দেবে। কেন জান?
কেন?
শ্যালক্স গ্রুন দীর্ঘ সময় কোনো কথা বলল না। তার বড় চেয়ারটি ঘুরিয়ে সে সোজাসুজি আমার দিকে তাকাল। তার মুখটি হঠাৎ কেমন জানি বিষণ্ণ দেখাতে থাকে, সে এক ধরনের ক্লান্ত গলায় বলল, আমি বড় নিঃসঙ্গ।
হঠাৎ আমার বুক কেঁপে ওঠে। য়োমির কথা মনে পড়ল আমার–অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটা পরীক্ষা করবে শ্যালক্স রুন। এটাই কি সেই পরীক্ষা?
শ্যালক্স গ্রুন তার হাত তুলে খুব মনোযোগ দিয়ে আঙুলগুলো পরীক্ষা করতে করতে বলল, আমার একজন সঙ্গী প্রয়োজন। আমি বড় একা। তাছাড়া দীর্ঘদিন আমি কোনো রমণীর দেহ স্পর্শ করি নি।
আমি চমকে উঠলাম, চাপা গলায় চিৎকার করে বললাম, কী বলতে চাইছ তুমি?
আমি তোমার ভালবাসার মেয়েটিকে আমার সাথে নিয়ে যাব। কী নাম মেয়েটির?
মনে হল হঠাৎ আমার মাথার মাঝে একটা ছোট বিস্ফোরণ হল। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না–হাঁটু ভেঙে বসে পড়লাম, মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম, না–না–না–
কী নাম মেয়েটির?
না-না-
শ্যালক্স গ্রুন হঠাৎ তীব্র স্বরে চিৎকার করে ওঠে, কী নাম মেয়েটির?
ত্রিশা।
ত্রিশা! কী সুন্দর নাম!
আমি দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকি। হঠাৎ সবকিছু আমার কাছে অর্থহীন হয়ে আসে, বিশাল শূন্যতায় আমার বুকের মাঝে হা হা করে ওঠে! হায় ঈশ্বর! তুমি এ কী করলে?
শ্যালক্স গ্রুন নরম গলায় বলল, উঠে দাঁড়াও তুমি। আমার খুব বেশি সময় নেই। কাজ শুরু করে দাও।
শ্যালক্স গ্রুন আমার দিকে যোগাযোগ মডিউলটি এগিয়ে দেয়। আমি তবু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
এক শ বছর পর আমি ত্রিশাকে ফিরিয়ে দেব। তুমি ইচ্ছে করলে শীতলঘরে এক শ বছর অপেক্ষা করতে পার। আমার কাছে এসো, আমি তখন তোমার হাতে ত্রিশাকে তুলে দেব। কথা দিচ্ছি।
আমি হিংস্র চোখে শ্যালক্স গ্রুনের দিকে তাকিয়ে থাকি। ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কণ্ঠনালী চেপে ধরে মানুষটিকে শেষ করে দেয়ার একটি অদম্য ইচ্ছে আমার মাথার মাঝে পাক খেতে থাকে।
কিন্তু আমি জানি আমি সেটা করতে পারব না। পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জীবন সে তার বুকের মাঝে একটি সিলাকিত কার্বনের ক্যাপসুলের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে। একটি ছোট ভুলে সেই জীবন হারিয়ে যেতে পারে। আমি অসহায় আক্রোশে একটি দানবের দিকে তাকিয়ে রইলাম।