শৃঙ্খলে যেখানে ফাঁক রয়েছে
অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল আমার। শরীর ঝরঝরে। ঘুমানোর সময়ে শার্লক হোমসকে যেভাবে বসে থাকতে দেখেছিলাম, এখনও বসে রয়েছে সেইভাবে। কেবল বেহালা পাশে রেখে চোখ। ড়ুবিয়ে রয়েছে একটা বইতে। আমার নড়াচড়ার শব্দে মুখ তুলে চাইতেই দেখলাম, দুশ্চিন্তার কালো হয়ে উঠেছে মুখখানা।
বলল, খুব ঘুমিয়েছ। এত কথা বললাম, তবুও ঘুম ভাঙেনি।
কিছুই শুনিনি। নতুন খবর পেয়েছ তাহলে?
না। খুবই মুষড়ে পড়েছি, ওয়াটসন। অবাকও হয়েছি। বিকেলের মধ্যে খবরের আশা করেছিলাম। এইমাত্র এসেছিল উইগিন্স। লঞ্চের চিহ্ন নেই কোথাও। অথচ প্রতিটি ঘণ্টা এখন গুরুত্বপূর্ণ।
আমাকে দিয়ে কিছু হয় তো বল। শরীর ঝরঝরে। আর এক রাতের ধকল সইতে পারব।
না। কিছু করার নেই এখন ঠায় বসে থাকা ছাড়া। বেরোলেই যদি খবর আসে, সে-খবর পেতে দেরি হয়ে যাবে। তোমার মন যা চায় তাই কর, আমাকে বসে থাকতে হবে এখানেই।
আমি তাহলে ক্যাম্বারওয়েলে গিয়ে মিসেস সিসিল ফরেস্টারের খবর নিয়ে আসি। গতকাল সেইরকমই বলেছিলেন।
চোখের মধ্যে হাসি নাচিয়ে হোমস বললে–খবরটা কার নেবে? মিসেস সিসিল ফরেস্টারের?
মিস মর্সটানেরও। জল কদ্দূর গড়াল জানতে চেয়েছিলেন।
আমি হলে বেশি কথা বলতাম না। সেরা মেয়েদের বিশ্বাস করতে নেই–পেটে কথা থাকে না।
মন্তব্যটা অতিশয় খারাপ আঁতে ঘা লাগে। আমি কিন্তু তর্ক করলাম না, দাঁড়ালামও না।
বললাম, ঘণ্টাখানেক কি দুয়েকের মধ্যে ফিরছি।
অলরাইট! গুডলাক। নদীর ওপারেই যদি যাও, তো টোবিকে ফিরিয়ে দিয়ে এসো। ওকে আর দরকার হবে বলে মনে হয় না।
দোআঁশলাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলাম। পিনচিন লেনের বুড়ো প্রকৃতিবিদের হাতে তাকে সঁপে দিলাম, সেইসঙ্গে একটা আধ-গিনি। ক্যাম্বারওয়েলে পৌঁছে দেখলাম রাতের ধকলে শুকিয়ে গেলেও নতুন খবরের প্রত্যাশার সাগ্রহে পথ চেয়ে বসে মিস মর্সটান। আগ্রহ মিসেস ফরেস্টারেরও কম নয়। যা-যা করেছি সব বললাম–বিয়োগান্তক দৃশ্যের সবচেয়ে বীভৎস অংশগুলো চেপে গেলাম। মি. শোল্টোর মৃত্যুর কথা বললাম বটে, কীভাবে তাঁকে মারা হয়েছে তা বললাম না। বাদসাদ দেওয়ার পরেও দেখা গেল আমার কাহিনি তাদের চমকৃত এবং বিস্মিত করেছে।
দারুণ রোমান্স দেখছি। সোল্লাসে বললে মিসেস ফরেস্টার। আহত মহিলা, পাঁচ লাখ পাউন্ডের হিরেমানিক, মিশমিশে নরখাদক, কেঠো পা-অলা দুবৃত্ত। রূপকথায় এদের বদলে থাকে মামুলি ড্রাগন অথবা কুচুটে রাজা।
রাজকন্যের উদ্ধারের জন্যে দু-জন ডানপিটে নাইটও রয়েছেন কিন্তু রোমান্সে, ঝকমকে চোখে আমার পানে তাকিয়ে বললেন মিস মর্সটান।
কী যে বল মেরি, তোমার ঐশ্বর্য উদ্ধার নির্ভর করছে তো এই দু-জনেরই তদন্তের ওপর। কিন্তু তোমাকে তো তেমন উত্তেজিত দেখছি না। রাজ ঐশ্বর্য হাতের মুঠোয় এলে পৃথিবীটা যে তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়বে, সে-খেয়াল আছে?
এইরকম একটা চিত্ত চঞ্চলকারী সম্ভাবনার কথা শুনেও মিস মটানের চিত্ত বৈকল্য ঘটল লক্ষ করে মনে মনে একটা গোপন উল্লাস, একটা বিচিত্র রোমান্স অনুভব করলাম। উল্লসিত হওয়া তো দূরে থাকুক। সামান্য মাথা দুলিয়ে জানিয়ে দিলেন ব্যাপারটা তুচ্ছ এবং তার মোটেই আগ্রহ নেই।
বললেন, আমার চিন্তা কেবল মি. থেডিয়াস শোল্টোকে নিয়ে। উনি অনেক করেছেন আমার জন্যে। গোড়া থেকেই যথেষ্ট মায়া-দয়া দেখিয়েছেন, খাঁটি ভদ্রলোকের মতো আচরণ করেছেন। আমাদের উচিত তাঁকে এই জঘন্য মিথ্যে অপবাদ থেকে মুক্ত করা।
সন্ধের আগেই বেরোলাম ক্যাম্বারওয়েল থেকে রাত হয়ে গেল বাড়ি ফিরতে। চেয়ারের পাশে পড়ে আছে বন্ধুর তামাক, পাইপ আর বই–নিজে উধাও। আমার নামে চিঠিপত্র রেখে গেছে কিনা খোঁজ করলাম আশেপাশে, কিন্তু কিছুই পেলাম না।
খড়খড়ি বন্ধ করার জন্যে মিসেস হ্যাডসন ঘরে আসতে জিজ্ঞেস করলাম–মি. শার্লক হোমস কি বেরিয়েছেন?
আজ্ঞে না। নিজের ঘরে রয়েছেন, গলা খাটো করে ওঁর স্বাস্থ্যের জন্যে বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
কেন মিসেস হাডসন?
বড়ো অদ্ভুত লোক। আপনি বেরিয়ে গেলেন, উনিও পায়চারি আরম্ভ করলেন। করেই চললেন। কান পচে গেল পায়ের আওয়াজ শুনতে শুনতে! তারপর শুনলাম নিজের সঙ্গে বকবক করছেন, বিড়বিড় করছেন। সদর দরজায় যতবার ঘণ্টা বাজছে, দৌড়ে এসে সিঁড়ির চাতালে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছেন–কে এল, মিসেস হাডসন? কিছুক্ষণ আগে ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু এখনও ঘরের মধ্যে পায়চারি করার আওয়াজ কানে আসছে। শরীর ভেঙে পড়তে পারে, এই ভয়ে মাথা ঠান্ডা করার একটা ওষুধের কথা বলতে গেছিলাম, কিন্তু এমনভাবে তাকালেন যে পালাবার পথ পেলাম না।
বললাম, দুশ্চিন্তা করবেন না! এভাবে আগেও দেখেছি ওঁকে। মাথায় ছোটোখাটো সমস্যা ঢুকলে এইরকম অস্থির হয়ে যান উনি!
কথাটা হালকা করে দিলাম বটে, কিন্তু আমার নিজের মনে তা পাষাণ হয়ে চেপে রইল। উবেগ আরও বাড়ল যখন সারারাত পাশের ঘরে শুনলাম চাপা ধুপধুপ শব্দ–একনাগাড়ে পায়চারি করছে শার্লক হোমস। বেচারি! নিষ্ক্রিয় থাকলেই অবস্থা ওর কাহিল হয়–এত ছটফটানি তো সেইজন্যেই, লড়ে মরছে নিজের মনের সঙ্গে।
সকাল হল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে বলল হোমস। মুখ কালো, উদ্ভান্ত। গালে জুরতপ্ত ফুটফুটে দাগ।
বললাম, নিজেকে মারছ। কাল সারারাত তোমার কুচকাওয়াজের আওয়াজ শুনেছি।
না হে, ঘুমোতে পারিনি একদম। নারকীয় এই বাধাটা কুরে কুরে খাচ্ছে ভেতর থেকে। এত বড়ো বড়ো বাধা পেরিয়ে আসার পর এই একটা ছোট্ট বাধায় হোঁচট খেয়ে পড়ার মতো দুর্ভাগ্য আর নেই। অসহ্য! লঞ্চের খবর পেয়েছি, লঞ্চে যারা রয়েছে, তাদের খবরও জানা হয়ে গিয়েছে তা সত্ত্বেও আর কোনো খবর পাচ্ছি না। অন্যান্য ভাবেও খবর আনবার ব্যবস্থা করেছি আমার সাধ্যমতো সব বন্দোবস্তই হয়েছে। নদীর দু-পাড় তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে, কিন্তু খবর পাওয়া যায়নি লঞ্চের। মিসেস স্মিথও খবর পাননি স্বামীর! এ থেকে শেষ পর্যন্ত একটাই সিদ্ধান্ত দাঁড়ায়–তলা ফুটো করে লঞ্চ ডুবিয়ে দিয়েছে হারামজাদারা, কিন্তু আমার আপত্তি আছে এ-সিদ্ধান্তে।
এমনও হতে পারে তো যে মিসেস স্মিথ ইচ্ছে করেই ভুল খবর দিয়ে আমাদের বিপথে চালিয়েছে?
আমার তা বিশ্বাস হয় না। ও-সম্ভাবনা নাকচ করতে পার। খবর নিয়ে জেনেছি সত্যিই ওইরকম দেখতে একটা লঞ্চ আছে?
মোহনার দিকে এগিয়ে উৎসের দিকে যায়নি?
সে-কথাও আমি ভেবেছি। একটা তল্লাশি দল পাঠিয়েছি–রিচমন্ড পর্যন্ত দেখে আসবে। তাতেও যদি লঞ্চের খোঁজ না-পাওয়া যায় তো নিজেই বেরোব–লঞ্চের বদলে লঞ্চের আরোহীদের তল্লাশ করব। তার আগে অবশ্য খবর আসবে–আসতেই হবে।
কিন্তু এল না। উইগিন্সের তরফ থেকেও নয়–অন্যান্য কারো মারফতও নয়। নরউড ট্র্যাজেডি নিয়ে নিবন্ধ বেরিয়েছে সবক-টা পত্রিকাতেই। সব কাগজই এক সুরে বাপান্ত করেছে। বেচারি থেডিয়াস শোল্টোর। নতুন খবর কেউ দিতে পারেনি। শুধু জানা গেল পরের দিনই আকস্মিক মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের জন্যে করোনারের জুরি নিযুক্ত হবে এবং তদন্ত আরম্ভ হবে। সন্ধের দিকে ক্যাম্বারওয়েল গিয়ে মহিলা দু-জনকে সারাদিনের ব্যর্থতার খবর জানিয়ে বাড়ি ফিরে দেখলাম প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে ভীষণ মনমরা হয়ে বসে শার্লক হোমস। আমার প্রশ্ন-টশ্ন শুনেও শুনল না, জবাব যা দিল, তা না-দেওয়ারই শামিল! সমস্ত সন্ধেটা কী এক নিগূঢ় রাসায়নিক বিশ্লেষণ নিয়ে ব্যস্ত রইল। বিশ্লেষণের শেষে এমন একটা বিটকেল গন্ধ বেরোল ঘর থেকে যে বাড়ি ছেড়ে প্রায় বেরিয়ে আসতে হল আমাকে। মাঝরাতে শুনলাম টেস্টটিউব ঠোকাঠুকির ঠুনঠুন শব্দ–অর্থাৎ দুর্গন্ধ-কারক এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে এখনও বিভোর আমার বন্ধু।
খুব ভোরেই চোখ খুলে চমকে উঠলাম বিছানার পাশে সেজেগুজে হোমসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। পরনে খালাসিদের মোটা পোশাক পুরু, খাটো ওভারকোট আর গলা ঘিরে কর্কশ, লাল স্কার্ফ।
বলল, ওয়াটসন, চললাম নদীর দু-পাশে খোঁজ নিতে। সারারাত ভেবেছি এই নিয়ে এ-ধাঁধা থেকে বেরোনোর একটা পথই মাথায় এসেছে। সম্ভাবনাটা বাজিয়ে দেখতে চাই।
আমিও নিশ্চয় যাচ্ছি তোমার সঙ্গে?
না। আমার প্রতিনিধি হিসেবে এখানে থাকলেই বরং অনেক বেশি কাজ দেবে। কালরাতে উইগিন্স হতাশ হয়ে পড়লেও আমার হিসেব মতো আজকে খবর আসার নামে আসা সব টেলিগ্রাম আর চিঠি খুলে তুমি পড়ো–তেমন সব খবর পেলে নিজের বিচারবুদ্ধি খাটিয়ে যা করবার, করবে। ভরসা রাখতে পারি তোমার ওপর?
নিশ্চয় রাখতে পারো।
মনে হয় টেলিগ্রাম পাঠাতে পারবে না কোথায় থাকব নিজেও জানি না–তোমাকেও বলতে পারব না। কপাল ভালো থাকলে বেশিক্ষণ বাইরে বাইরে ঘুরতে হবে না। ফিরে আসার আগেই একটা-না-একটা খবর পাবই।
ব্রেকফাস্ট খেতে বসলাম–তখনও কোনো খবর এল না হোমসের দিক থেকে। স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা খুলে দেখি রহস্যাবৃত কেসটা সম্পর্কে নতুন খবর বেরিয়েছে।
খবরটা এই :
আপার নরউড ট্র্যাজেডি সংক্রান্ত কেসটিকে যতটা সহজ ভাবা গিয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে তার চাইতে অনেক জটিল অনেক রহস্যময়। নতুন পাওয়া প্রমাণ অনুসারে মি. থােডিয়াস শোন্টোর পক্ষে এই হত্যাকাণ্ডে কোনোক্রমেই জড়িত থাকা সম্ভব নয়। কাল রাতে তাকে এবং হাউসকিপার মিসেস বার্নস্টোনকে হাজত থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত অপরাধীদের মোক্ষম সূত্র নাকি পুলিশের হাতে এসেছে এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সুদক্ষ অফিসার অ্যাথেলনি জোন্স তার সুবিখ্যাত প্রাণপ্রাচুর্য এবং বুদ্ধিপ্রাচুর্যসহ এই সূত্র অনুসারে অপরাধী অন্বেষণ করছেন। যেকোনো মুহূর্তে আরও ধরপাকড়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
মনে মনে ভাবলাম, মন্দ কী! বন্ধুবর শোল্টো তো বেঁচে গেল। নতুন সূত্রটা অবশ্য কী বুঝতে পারছি না। তবে পুলিশ যখন নাকানিচোবানি খায় আর হরদম ভুল করে, তখন সব ক-টা ভুলই এক ধাঁচে ঢালা হয়।
কাগজটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে দিতেই হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ স্তম্ভে একটা বিজ্ঞাপনে চোখ পড়ল। বিজ্ঞাপনটা এই :
হারিয়েছি। গত মঙ্গলবার রাত তিনটে নাগাদ অরোরা স্টিমলঞ্চে বেরিয়েছে মাঝি মর্ডেকাই স্মিথ এবং তার ছেলে জিম। স্টিমলঞ্চের রং কালো, দু-পাশে লাল পটি। ফানেল কালো, সাদা ব্লেড। জেটিতে মিসেস স্মিথের কাছে অথবা ২২১ বি, স্ট্রিটে মি. স্মিথের এবং অরোরা লঞ্চের খবর পৌঁছে দিলে নগদ পাঁচ পাউন্ড পুরস্কার দেওয়া হবে।
নিশ্চয় হোমসের কাজ। বেকার স্ট্রিটের ঠিকানাই তার প্রমাণ। বেশ চালাকি করেছে হোমস। পলাতকরা দেখে ভাববে স্বাভাবিক কারণেই উদবিগ্ন হয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে নিখোঁজ স্বামীর স্ত্রী।
সুদীর্ঘ দিনটা যেন আর শেষ হতেই চায় না। দরজায় খটাখট টোকা মারার আওয়াজ বা রাস্তায় পায়ের শব্দ শুনলেই ভেবেছি এই বুঝি ফিরে এল হোমস, নয়তো জবাব এল বিজ্ঞাপনের! বই নিয়ে পড়তে চেষ্টা করলাম, কিন্তু মন দিতে পারলাম না। বার বার মন ছুটে গেল পলাতক দুই শয়তান শিরোমণি এবং বিচিত্র তদন্তের দিকে। বন্ধুবরের যুক্তির শৃঙ্খলের গোড়ায় গলদ নেই তো? প্রকাণ্ড আত্মপ্রবঞ্চনায় ভুগছে না তো বেচারি? কল্পনাপ্রিয় চঞ্চল মন দিয়ে ভুল যুক্তির ওপর নড়েচড়ে ইমারত রচনা করে বসেনি তো? অবশ্য ওকে কখনো ভুল করতে দেখিনি। তাহলে বলব অকাট্য যুক্তিবাজকেও মাঝে মাঝে ঠকে যেতে হয়। অতি বিশুদ্ধ ওর যুক্তিপ্রবাহ এবং সেইজন্যেই ভুল করা স্বাভাবিক আসলে হয়তো তা অনেক সোজা, অনেক মামুলি এবং রয়েছে নাগালের মধ্যেই। অন্য দিক দিয়ে বিচার করলে, সাক্ষীসাবুদ সব আমিও দেখেছি, কোন কোন যুক্তির ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে এসেছে হোমস–তাও শুনেছি স্বকর্ণে। পরের পর অনেক ঘটনা ঘটেছে, অনেক বিচিত্র পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি, অনেক ব্যাপার নেহাত তুচ্ছও মনে হয়েছে, কিন্তু প্রতিটি অকিঞ্চিৎকর ঘটনা অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে অবশ্যম্ভাবী এক পরিণতির দিকে। কাজেই নিজের মনের সঙ্গে চোখ ঠেরে লাভ নেই–হোমসের ব্যাখ্যা ভুল এমন ধারণা আমার পক্ষেও করা সম্ভব নয় এবং আমি বিশ্বাস করি শার্লক হোমস ভেবেচিন্তে মাথা খাটিয়ে যে অনুমিতি খাড়া করেছে তা নির্ভেজাল সত্য এবং অতীব চমকপ্রদ ও চাঞ্চল্যকর।।
বিকেলে তিনটের সময়ে দারুণ জোরে বেজে উঠল দরজার ঘণ্টা। ভারিক্কি গলার আওয়াজ শুনলাম হলঘরে এবং সচমকে দেখলাম ঘরে ঢুকছেন স্বয়ং অ্যাথেলনি জোন্স। আপার নরউডে যেমন হম্বিতম্বি এবং সর্দারি দেখেছিলাম তার লক্ষণ দেখা গেল না এখনকার চেহারায়। উপস্থিত বুদ্ধি নিয়ে অধ্যাপকের মতো কাটছাঁট ভাষায় জ্ঞান দিয়েছিল যে এখন তার চোয়াল ঝুলে পড়েছে, বিনয়ে যেন মাটি স্পর্শ করছে এবং হাবভাবে ক্ষমা প্রার্থনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
গুড-ডে স্যার; গুড-ডে। মি. শার্লক হোমস বেরিয়েছেন নাকি?
হ্যাঁ। কখন ফিরবে তাও জানি না। অপেক্ষা করতে পারেন। চেয়ার নিয়ে বসুন, এই নিন চুরুট।
ধন্যবাদ, আপত্তি নেই। বিরাট লাল রুমাল বার করে মুখ মুছতে মুছতে বলল জোন্স।
হুইস্কি আর সোডা চলবে?
আধ গেলাস দিন। বড্ড গরম–এ সময়ে এত গরম বাড়ে না। দুশ্চিন্তা আর খাটাখাটনিও বেড়েছে তেমনি। নরউড কেসে আমার থিয়োরি তো আপনি জানেন?
হ্যাঁ, একবার বলেছিলেন বটে।
থিয়োরিটা নতুন করে খাড়া করতে বাধ্য হলেন। মি. শোন্টোকে জালে ফেলার পর ফুস করে তলার ফুটো দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। এমন একটা অন্যত্রস্থিতি প্রমাণ করে দিলেন যা নাকচ করা গেল না। ভাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর ইস্তক একজন না একজন তাকে দেখেছে চোখের আড়াল হয়নি একবারও। কাজেই ছাদে উঠে ঠেলা দরজা খুলে ফুটো দিয়ে উনি ঘরে ঢোকেননি। কেসটা বড়ো জটিল, আমার সুনাম ক্ষুণ্ণ হতে বসেছে। তাই সাহায্য পেলে বর্তে যাব।
মাঝে মাঝে সাহায্যের দরকার সবারই হয়। বললাম আমি।
খসখসে গোপন কণ্ঠে বললে জোন্স, আপনার বন্ধু মি. শার্লক হোমস সত্যিই বড়ো আশ্চর্য মানুষ। ওঁকে হারানো যায় না। অনেক কেসে ওঁকে দেখেছি, কিন্তু সুরাহা করতে পারেননি এমন কোনো কেসের খবর আমার জানা নেই। ওঁর কার্যপদ্ধতি উলটোপালটা ধরনের গতানুগতিক নয়, সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান আচমকা–তা সত্ত্বেও বলব পুলিশের খাতায় নাম লেখালে বড়ো অফিসার হতে পারতেন, কথাটা পাঁচ কান হলেও কিছু এসে যায় না আমার। আজ সকালে আবার একটা টেলিগ্রাম পেলাম ওঁর কাছ থেকে শোল্টো রহস্যের নতুন সূত্র নাকি পেয়েছেন। এই দেখুন টেলিগ্রাম।
পকেট থেকে তারবার্তা বার করে আমার হাতে দিলেন জোন্স। দুপুর বারোটার সময়ে পপলার ডাকঘর থেকে পাঠানো টেলিগ্রাম। এখুনি বেকার স্ট্রিটে যান। আমি না-থাকলে বসে থাকুন, না-ফেরা পর্যন্ত। শোল্টো গুপ্তঘাতকবাহিনীর নাগাল ধরে ফেলেছি। শেষ দৃশ্যে হাজির থাকার ইচ্ছে থাকলে আজ রাতে আসতে পারেন আমার সঙ্গে।
বললাম, ভালোই তো। আবার দেখছি নাগাল ধরে ফেলেছে।
তাই বলুন, উনি তাহলে ভুল করেছেন। সহর্ষে বলল জোন্স, খুশি চাপতে পারল না হাবভাবে।যত উঁদেই হই না কেন, মাঝে মাঝে মুখ থুবড়ে পড়তে হয় আমাদের সবাইকেই। এটাও তেমনি উড়োেখবর হতে পারে। তাহলেও অফিসার হিসেবে আমার কর্তব্য সব সূত্রের শেষ পর্যন্ত দেখা। দরজায় কে এসেছে দেখুন। মি. হোমস ফিরলেন মনে হচ্ছে।
সিঁড়িতে গুরুভার পদশব্দ শোনা গেল। সেইসঙ্গে জোরে জোরে সাঁ-সাঁ করে নিশ্বাস ফেলার এবং গলার মধ্যে ঘড়ঘড় শব্দ। পায়ের মালিক যেন একদম হাঁপিয়ে গেছে। দু-একবার দাঁড়িয়েও গেল–পা যেন আর চলছে না–সিঁড়ি ভাঙতে যেন আর পারছে না। তারপর কষ্টেসৃষ্টে এসে পৌছল দরজায় এবং ঢুকল ভেতরে। আওয়াজের সঙ্গে মিলে যায় লোকটার চেহারা। বয়স হয়েছে, পরনে সমুদ্রচারী নাবিকের পুরোনো পোশাক। খাটো, পুরু ওভারকোট, গলা পর্যন্ত বোতাম আঁটা। পিঠ বেঁকিয়ে গেছে, হাঁটু ঠকঠক করে কাঁপছে এবং হাঁপানি রুগির মতো নিশ্বাস নিচ্ছে–যন্ত্রণায় বুক যেন ফেটে যাচ্ছে। ওক কাঠের ইয়া মোটা একটা মুগুরের ওপর দিয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে দুধ বেঁকিয়ে বাতাস টানতে লাগল ফুসফুসের মধ্যে। চিবুক ঢাকা রঙিন স্কার্ফের ফাক দিয়ে মুখ বলতে দেখা গেল শুধু একজোড়া তীক্ষ্ণ্ণ কৃষ্ণ চক্ষু, কার্নিশের মতো ঠেলে-বেরিয়ে-আসা নিবিড় সাদা ভুরু এবং সুদীর্ঘ ধূসর গালপাট্টা। সব মিলিয়ে চেহারাটা মর্যাদাসম্পন্ন দক্ষ সমুদ্রচারী নাবিকের বয়স হয়েছে, অভাবে পড়েছে।
কী চাই? শুধোলাম আমি।
বুড়োরা যেভাবে ধীরে কিন্তু খুঁটিয়ে আশপাশ দেখে নেয়, সেইভাবে চারদিকে চেয়ে বৃদ্ধ বললে, মি. শার্লক হোমস আছেন?
না, তার তরফে আমি আছি। কিছু খবর দেবার থাকলে আমাকে দিতে পারেন। তার সঙ্গেই কথা বলতে চাই।
বললাম তো তার তরফে আমি আছি। কথাটা কী নিয়ে? মর্ডেকাই স্মিথের লঞ্চের ব্যাপারে?
হ্যাঁ। আমি জানি লঞ্চ কোথায়, আমি জানি উনি যাঁদের খুঁজছেন তারা কোথায়। আমি জানি গুপ্তধন কোথায়। সব জানি আমি।
তাহলে বলুন আমাকে। আমি জানিয়ে দেব মি. হোমসকে।
যা বলবার ওকেই বলব, খিটখিটে একগুঁয়েমির সুরে বললে বৃদ্ধ! খুব বুড়ো হলে সব মানুষ এইভাবে কথা বলে।
তাহলে বসতে হবে ফিরে না-আসা পর্যন্ত।
না, না কাউকে খুশি করার জন্যে পুরো একটা দিন নষ্ট করতে আমি পারব না। মি. হোমস যদি না-থাকেন তো খুঁজেপেতে ওঁকেই সব খবর জেনে নিতে হবে। আপনাদের দু-জনকেই দেখে সুবিধের মনে হচ্ছে না কোনো কথাও তাই বলব না।
দরজার দিকে টলতে টলতে এগোল বৃদ্ধ–তার আগেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল অ্যাথেলনি জোন্স।
দাঁড়ান, যে-খবর আপনি এনেছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই আপনার ইচ্ছে না থাকলেও আটকে রাখব মি. হোমস ফিরে না-আসা পর্যন্ত।
দরজার দিকে গেল বৃদ্ধ–কিন্তু পাল্লায় পিঠ দিয়ে জোন্সকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝল বৃথা চেষ্টা।
মুগুরের মতো লাঠি ঠুকতে ঠুকতে বললে চিৎকার করে এ কী নোংরা ব্যাপার। আমি এসেছি একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে। জীবনে দেখিনি আপনাদের, কেন এভাবে আটকে রাখছেন আমাকে?
আপনার সময় যা নষ্ট হবে, তা উশুলও হয়ে যাবে, বললাম আমি। আসুন, এই সোফায় বসুন। বেশি দেরি হবে না।
সোফায় বসল বৃদ্ধ–দু-হাতে ন্যস্ত রইল গোমড়া মুখখানা। চুরুট খেতে খেতে ফের কথা শুরু করলাম আমি আর জোন্স। আচমকা কানের কাছে শোনা গেল হোমসের গলা।
আমাকেও একটা চুরুট দিলে পারতে।
চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম দু-জনেই। সত্যিই প্রশান্ত সকৌতুক মুখে পাশে দাঁড়িয়ে হোমস।
হোমস! বললাম সবিস্ময়ে, তুমি! কিন্তু বুড়োটা গেল কোথায়?
এই তো সেই বুড়ো, স্তুপীকৃত সাদা চুল দেখিয়ে বললে হোমস। এই দেখ সে~–গালপাট্টা, পরচুলা, ভুরু–সব। ছদ্মবেশটা নিখুঁত হয়েছে জানতাম, কিন্তু এত ভালো হয়েছে। বুঝিনি অগ্নিপরীক্ষায় পাশ করে গেলাম।
ভারি পাজি তোক তো আপনি। ভীষণ খুশি হয়ে সোল্লাসে বললে জোন্স। পাক্কা অভিনেতা হতে পারতেন মশায়–কালেভদ্রে এমন নট জন্মায়। কাশিখানা অবিকল মেহনতি কাশি, ঠকঠক করে শুধু পা কাঁপানোর পুরস্কারই পেতেন হপ্তায় দশ পাউন্ড। তবে যাই বলুন
কেন, খটকা লেগেছিল আপনার চকচকে চোখ দেখে। বেরোতে তো দিইনি ঘর থেকে। কেমন?
চুরুট ধরিয়ে হোমস বললে, সারাদিন এই ধড়াচুড়ো নিয়েই কাজ করছি। অপরাধী মহলের অনেক রথী মহারথী আজকাল আমার মুখ দেখেই চিনে ফেলে বিশেষ করে এই বন্ধুটি আমার কিছু কীর্তিকাহিনি নিয়ে গল্প ছাপবার পর থেকেই ঘটেছে এই কাণ্ড। তাই ওদের। মহলে যখন যাই যুদ্ধজয়ের অভিলাষ নিয়ে, একটু ভোল পালটানোর দরকার হয়। টেলিগ্রাম পেয়েছিলেন?
পেয়েই তো এসেছি।
আপনার কেস কদ্দুর?
অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে। দু-জন কয়েদিকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছি, বাকি দু-জনের বিরুদ্ধেও কোনো প্রমাণ পাচ্ছি না।
মন খারাপ করবেন না। যে দু-জন গেছে, তার বদলি অন্য দু-জন পাবেন। কিন্তু আমার কথামতো চলতে হবে। পুলিশ অফিসার হিসেবে সব কৃতিত্ব আপনিই পাবেন কিন্তু আমার হুকুম মেনে চলতে হবে। রাজি?
পাকড়াও, যদি করে দিতে পারেন শয়তানদের, যা বলবেন তাই শুনব।।
বেশ, বেশ। প্রথমেই দরকার খুব জোরে ছুটতে পারে এমন একটা পুলিশবোট স্টিম লঞ্চ–ঠিক সাতটার সময়ে হাজির থাকবে ওয়েস্টমিনিস্টার স্টেয়ারে।
ও আর এমন কথা কী। চব্বিশ ঘণ্টাই ওখানে একটা লঞ্চ মোতায়েন থাকে। তাহলে টেলিফোনে পাকা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি!
তারপরই চাই গাঁট্টাগোট্টা দু-জন লোক মারপিট যদি হয়?
ও-রকম লোক জনা দু-তিন বোটেই থাকে। আর?
আসামিদের পাকড়াও করলেই গুপ্তধন আসবে। আমার বিশ্বাস, অর্ধেক হারে মালিকের ওপর যার স্বত্ব, সেই ভদ্রমহিলাটির হাতে রত্নপেটিকা স্বহস্তে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারলে আমার এই বন্ধুটি যৎপরোনাস্তি খুশি হবে। যাঁর জিনিস তিনিই খুলবেন হিরের বাক্স। ঠিক কিনা, ওয়াটসন?
মাথা নেড়ে জোন্স বললে, খুবই উলটোপালটা ব্যাপার। অবশ্য সবই যখন দেখছি উলটোপালটা তখন না হয় এটাকেও চোখ ঠেরে ছেড়ে দেওয়া যায়। তবে হ্যাঁ, গুপ্তধন প্রথমে সরকারের হাতে যাবে। তদন্ত শেষ হলে যাবে মালিকের হাতে।
অবশ্য, অবশ্য। তাও ম্যানেজ করা যাবে। আর একটা পয়েন্ট। জোনাথন স্মলের মুখ থেকে আমি এ-ব্যাপারে দু-একটা খুঁটিনাটি জেনে নিতে চাই। আপনি তো জানেন খুঁটিনাটির ওপরেই জোর দিই আমি। পুলিশি জবানবন্দি নিন গে আপত্তি নেই। কিন্তু আমার এই ঘরে বা অন্যত্র আমাকে সুযোগ দিতে হবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার। আপনার নোক অবশ্য পাহারায় থাকবে–যাতে না-পালায়। রাজি?
আরে মশাই, আপনি এখন গুরু–পুতুল নাচানোর সব সুতো একাই ধরে বসে আছেন। কে এই জোনাথন স্মল তাই জানি না–এ-রকম নামে কোনো লোক আছে এমন প্রমাণ এখনও পাইনি। সে-লোককে যদি আপনি পাকড়াও করেন, নিন না তার ইন্টারভিউ, আমার আপত্তি নেই।
পাকা কথা। আর কিছু?
শুধু একটা ব্যাপার। আমাদের সঙ্গে ডিনার খেতে হবে আপনাদের। আধ ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে যাবে! ঝিনুক আর মেঠো মোরগের সঙ্গে সাদা মদ। ওয়াটসন, তুমি কিন্তু ভায়া গেরস্থালির কাজে আমার প্রতিভার কদর করনি কখনো।