০৯. রুখ ক্রীনার চোখের দিকে তাকাল

রুখ ক্রীনার চোখের দিকে তাকাল, ক্রীনা একমুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে  নেয়। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল সেটি সে রুখকে দেখতে দিতে চায় না। রুখ ক্রীনার মুখের উপর থেকে তার কালো চুল সরিয়ে নরম গলায় বলল, আবার দেখা হবে ক্রীনা।

ক্রীনা মাথা নেড়ে বলল, দেখা হবে?

এখানে না হলে অন্য কোথাও।

অন্য কোথাও?

কখনো না কখনো তো বিদায় নিতে হতই। আমরা না–হয় একটু আগেই নিচ্ছি।

ক্রীনা কোনো কথা বলল না, রুখের দিকে একনজর তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয়।

কত সময় তোমাকে পেয়েছি সেটা তো বড় কথা নয়। তোমাকে পেয়েছি সেটা বড় কথা। রুখ দূর্বলভাবে হেসে বলল, মানুষ হয়ে জন্মালে মনে হয় খানিকটা দুঃখ পেতেই হয়। তাই না?

ক্রীনা মাথা নেড়ে নিচু গলায় বলল, আমি দুঃখিত রুখ। আমি খুব দুঃখিত যে তুমি আর আমি মেতসিসে মানুষ হয়ে জন্মেছি। আমরা যদি হাজার বছর আগে পৃথিবীতে মানুষ হয়ে জন্মাতাম

কিছু আসে–যায় না ক্রীনা। একমুহূর্তের ভালবাসা আর সহস্র বছরের ভালবাসা আসলে একই ব্যাপার। আমাকে বিদায় দাও ক্রীনা

ক্রীনা জোর করে নিজেকে শক্ত করে মুখ তুলে দাঁড়ায়। তাদের ঘিরে মানুষের চেহারায় রয়েড আর বুদ্ধিমান এনরয়েডরা দাঁড়িয়ে আছে, মানুষ থেকে বুদ্ধিমান এই যন্ত্রগুলোকে সে নিজের শোকটুকু বুঝতে দেবে না। সে হাত দিয়ে গভীর ভালবাসায় রুখের মুখমণ্ডল স্পর্শ করে নরম গলায় বলল, বিদায় রুখ। যদি ঈশ্বর বলে কেউ থাকেন তিনি তোমাকে রক্ষা করুন।

রুখ নিচু হয়ে ক্রীনার চুলে নিজের মাথা ডুবিয়ে প্রায় হঠাৎ করে ঘুরে দাঁড়াল, তার সামনে কিছু অমসৃণ পাথরের মাঝখানে আয়নার মতো এক স্বচ্ছ নীলাভ একটি পরদা। মহাজাগতিক প্রাণী মেতসিসের সাথে যোগাযোগের জন্যে এই মহাজাগতিক দরজা সৃষ্টি করেছে। এই স্বচ্ছ নীলাভ পরদার ভিতর দিয়ে রুখকে যেতে হবে। তার অন্য পাশে কী আছে রুখ জানে না। সেখানে তাকে কী করা হবে সেটাও সে জানে না। এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত জগৎ। রুখ নিজেকে শক্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। নীলাভ স্বচ্ছ পরদার সামনে এসে সে একমূহুর্ত অপেক্ষা করে, মনে হয় সে বুঝি একবার ঘুরে তাকাবে, কিন্তু সে ঘুরে তাকাল না। লম্বা পদক্ষেপে সে নীলাভ স্বচ্ছ পরদার মাঝে প্রবেশ করল, মনে হল কিছু একটা যেন হঠাৎ করে তাকে গ্রাস করে নিল, টেনে ভিতরে নিয়ে গেল। স্বচ্ছ নীলাভ পরদায় একমুহূর্তের জন্য একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়, বারকয়েক কেঁপে উঠে সেটা আবার স্থির হয়ে যায়।

ক্রীনা অনেক চেষ্টা করেও চোখের পানিকে আটকে রাখতে পারল না। হঠাৎ করে আকুল হয়ে কেঁদে উঠল।

রয়েড এক পা এগিয়ে এসে বলল, তুমি চাইলে আমরা তোমার স্মৃতিকে মুছে দিতে পারি।

আমার এই স্মৃতিটুকুই আছে। সেটাও তোমরা মুছে দিতে চাও?

তুমি কি রুখকে দেখতে চাও?

ক্রীনা চমকে উঠে বলল, কী বললে?

আমি জানতে চাইছি, তুমি কি রুখকে দেখতে চাও?

সে কোথায়?

মহাজাগতিক প্রাণী মেতসিসের ভিতরে এই দরজাটা খুলেছে। এখান দিয়ে তারা কিছু একটা গ্রহণ করে, সেটাকে পরীক্ষা করে তারপর আবার ফিরিয়ে দেয়।

কোথায় ফিরিয়ে দেয়? ক্রীনা আর্তস্বরে চিৎকার করে বলল, কখন ফিরিয়ে দেয়?

এই মেতসিসে ঠিক এরকম আরেকটি দরজা খুলেছে সেদিক দিয়ে ফিরিয়ে দেয়। কখন ফিরিয়ে দেয় সেই প্রশ্নটির উত্তর খুব সোজা নয়। আমরা একটুকরা পাথর দিয়েছিলাম সেটা দুই হাজার বছর রেখে ফেরত পাঠিয়েছে!

দুই হাজার বছর? এটা কী করে সম্ভব? এই মেতসিস তার যাত্রা শুরু করেছে মাত্র। সাত শ বছর আগে।

সম্ভব, আমরা কার্বন ডেটিং করে বের করেছি।

জীবন্ত কাউকে পাঠিয়েছ কখনো?

জীবন্ত প্রাণীকে এরা সাধারণত বিশ থেকে পঁচিশ বছর রাখে।

ক্রীনা হাহাকার করে বলল, বিশ থেকে পঁচিশ বছর?

হ্যাঁ। প্রথম প্রথম জীবন্ত প্রাণীকে তারা ঠিক করে বিশ্লেষণ করতে পারত না। একজন মানুষ ফিরে আসত পরিবর্তিত।

পরিবর্তিত?

হ্যাঁ। মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ওলটপালট হয়ে যেত। তারা বিকৃত হয়ে ফিরে আসত। বিকৃত এবং মৃত।

ক্রীনা ভয়–পাওয়া–চোখে রয়েডের দিকে তাকিয়ে রইল।

ইদানীং তারা মনে হয় জীবন্ত প্রাণীকে মোটামুটি ঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে, শেষ মানুষটি জীবন্ত ফিরে এসেছে। বৃদ্ধ কিন্তু জীবন্ত।

ক্রীনা হতচকিতের মতো বলল, তার মানে একসময় রুখও ফিরে আসবে? জীবন্ত?

হ্যাঁ। আমার তাই বিশ্বাস।

সেটি কত দিন পরে?

কেউ জানে না। আমাদের এখানে সাথে সাথেই ফিরে আসে। কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডের মাঝে, কিন্তু এর মাঝে তার দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়।

কী বলছ তুমি? ক্রীনা চিৎকার করে বলল, কী বলছ?

আমি ঠিকই বলছি।

তার মানে তার মানে–রুখ এর মাঝে মেতসিসে ফিরে এসেছে?

আমি নিশ্চিত।

কোথায় আছে সে? কেমন আছে? বেঁচে আছে?

রয়েড রহস্যময় ভঙ্গি করে হাসল, বলল, তুমি নিজেই দেখবে। চল।