রিয়াজ ফিসফিস করে বলল, আপাতত এখানে থামা যাক।
নিশীতা বলল, বেশ।
দুজনে তাদের ব্যাকপ্যাক নামিয়ে বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস নিল।
তারা প্রায় মাইলখানেক ঘুরে এই জায়গায় পৌঁছেছে। পুরো এলাকাটা কাটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে, উপরে হাইভোল্টেজ বিদ্যুতের লাইন এবং নিচে কয়েক জায়গায় লেজার আলোর নিরাপত্তা। কেউ যেন কাছাকাছি আসতে না পারে সেজন্য একটু পরে পরে মিলিটারি আউটপোষ্ট বসানো হয়েছে। রিয়াজ আর নিশীতা দুটো পোস্টের মাঝামাঝি এই জায়গাটা বেছে নিয়েছে।
জায়গাটাতে বেশ কিছু ঝোপঝাড় আছে, পিছনের রাস্তা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ যখন মিলিটারি জিপ বা ট্রাক যায় তখন এই ঝোপগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকা যায়।
রিয়াজ ব্যাগ থেকে একটা গগলস বের করে নিশীতার হাতে দিয়ে বলল, এটা ইনফ্রা রেড গগলস। তুমি চোখে লাগিয়ে পাহারা দাও। অন্ধকারেও দেখতে পারবে।
আপনি কী করবেন?
প্রথমে লেজার নিরাপত্তাটুকু অকেজো করতে হবে, না হয় ভিতরে ঢুকতে পারব না।
নিশীতা গগলসটি চোখে পরতেই তার সামনে চারদিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চারপাশের অন্ধকার জগৎটি তার কাছে হঠাৎ করে অতিপ্রাকৃত মনে হতে থাকে।
রিয়াজ তার ব্যাগ থেকে ছোট দুটি লেজার ডায়োড বের করল। কাঁটাতারের পাশাপাশি এই লেজার রশ্মি রাখা আছে, কোনোভাবে রশ্মিটি বাধাপ্রাপ্ত হলেই সরুত চলে যাবে। লেজার রশিটুকু বোঝার জন্য একটু পরপর ফটো ডায়োড রাখা আছে। রিয়াজ তার লেজার ডায়োডটি অন করে ফটো ডায়োডটির উপরে ফেলে নিরাপত্তা রশ্মিটি ঢেকে ফেলল। রিয়াজ নিশ্বাস বন্ধ করে শোনার চেষ্টা করে দূরে কোথাও এলার্ম বেজে উঠল কি না, কিন্তু সেরকম কিছু শোনা গেল না। রিয়াজ একইভাবে দ্বিতীয় লেজারটি অকেজো করে দিয়ে নিশীতাকে ডাকল, নিশীতা।
কী হল?
লেজার দুটি অকেজো করে দেওয়া হয়েছে।
চমৎকার।
কাঁটাতার কাটার জন্য বড় ডায়াগোনাল কাটারটি বের কর।
নিশীতা ব্যাকপ্যাক থেকে বড় একটা ডায়াগোনাল কাটার বের করে আনে। রিয়াজ সেটা দিয়ে খুব সহজে কাঁটাতারগুলো কেটে একজন মানুষ যাবার মতো একটা ফুটো করে ফেলল। যন্ত্রপাতিগুলো ব্যাকপ্যাকের মাঝে ঢুকিয়ে রিয়াজ বলল, এস নিশীতা।
নিশীতা ভারী ব্যাকপ্যাকটা টেনে কাছে নিয়ে এল, চোখ থেকে ইনফ্রারেড গগলসটা খুলে রিয়াজকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, এই যে, আপনার অন্ধকারে দেখার গগলস।
তুমি আর পরবে না?
না, চোখে দিলে মনে হয় ভূতের দেশে চলে এসেছি।
কিন্তু খুব কাজের জিনিস।
হ্যাঁ, পৃথিবীতে কত ইঁদুর আর চিকা রয়েছে এটা চোখে না দিলে কেউ জানতে পারবে না।
রিয়াজ হাসল, বলল, হ্যাঁ ঠিকই বলেছ।
নিশীতা চুলগুলো পিছনে নিয়ে একটা রাবার ব্যান্ড দিয়ে শক্ত করে বেঁধে মাথায় একটি বেসবল ক্যাপ পরে বলল, চলুন ভিতরে যাওয়া যাক।
চল। রিয়াজ এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তোমার কি ভয় করছে?
নিশীতা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ করছে। না করাটা বোকামি হবে। তাই না?
হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। কিন্তু এ ছাড়া কিছু করার নেই। সারা পৃথিবীতে শুধু আমিই একমাত্র মানুষ যে এই মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে কথা বলার ভাষা জানি। কাজেই আমাকে যেতেই হবে। রিয়াজ তার ব্যাকপ্যাকটি সাবধানে কাছে টেনে নিয়ে বলল, এখন যন্ত্রপাতিগুলো ঠিক থাকলে হয়—টানাহ্যাঁচড়া তো কম হল না।
নিশীতা কোনো কথা বলল না, গভীর রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারে তারকাটা এবং লেজার নিয়ন্ত্রণ ভেদ করে একটি সংরক্ষিত জায়গায় সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ঢুকে যাওয়ার একটি উত্তেজনা আছে। ভিতরে একটি মহাজাগতিক প্রাণীর ঘাঁটিতে তাদের জন্য কী ধরনের ভয়ঙ্কর বিস্ময় অপেক্ষা করছে কে জানে।
রিয়াজ জিজ্ঞেস করল, তুমি আগে ঢুকবে, না আমি? আপনিই ঢোকেন।
রিয়াজ নিচু হয়ে ভিতরে ঢোকার জন্য প্রস্তুত হল, ঠিক তখন নিশীতা গলায় একটা শীতল স্পর্শ অনুভব করে, সাথে সাথে কেউ অনুচ্চ স্বরে কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল, আমার মনে হয় আপনাদের কারোই ভিতরে ঢোকার প্রয়োজন নেই।
নিশীতা পাথরের মতো জমে গেল। রিয়াজ খুব ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না কিন্তু তবু তারা বুঝতে পারল তাদেরকে ঘিরে কয়েকজন মানুষ। দাঁড়িয়ে আছে, তাদের হতে উদ্যত অস্ত্র। সেফটি ক্যাচ টানার শব্দ শুনতে পেল তারা, মানুষগুলো সশস্ত্র, গুলি করতে প্রস্তুত। অনুচ্চ গলার স্বরে আবার কেউ একজন বলল, দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়ান। সন্দেহজনক মানুষদের গুলি করার জন্য আমাদের কাছে স্পষ্ট নির্দেশ আছে।
নিশীতা এবং রিয়াজ দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াল, এখনো তারা নিজেদের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি কাউকে নির্দেশ দিয়ে বলল, ব্যাগ দুটি তুলে নাও।
একজন এসে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ব্যাগ দুটো তুলতে চেষ্টা করতেই রিয়াজ বাধা দিয়ে বলল, সাবধান–প্লিজ সাবধান।
কেন?
এর মাঝে অসম্ভব ডেলিকেট কিছু ইনস্ট্রুমেন্ট আছে।
কী ইনস্ট্রুমেন্ট?
বলতে পারেন এই দেশ থাকবে না ধ্বংস হয়ে যাবে–এমনকি এই পৃথিবী থাকবে না। ধ্বংস হয়ে যাবে সেটা এর ওপর নির্ভর করছে।
মানুষটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ব্যাগ দুটি খুব সাবধানে নাও। দেখো যেন ঝাঁকুনি না লাগে।
রিয়াজ নিচু গলায় বলল, ধন্যবাদ। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
একটা মিলিটারি জিপে করে ক্যাম্পে নিয়ে আসা পর্যন্ত কেউ আর কোনো কথা বলল না। নিশীতা দেখল তাদেরকে যে ধরে নিয়ে যাচ্ছে সে একজন কমবয়সী মিলিটারি অফিসার। সাথে আরো কয়জন সেনাবাহিনীর সদস্য। প্রায় মাইল দুয়েক গিয়ে জিপটি একটি কলেজ ভবনের সামনে থামল, এটাকে সাময়িক মিলিটারি ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে।
রিয়াজ আর নিশীতাকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে তার দরজা বন্ধ করে দিয়ে মিলিটারি অফিসার তাদের দিকে ঘুরে তাকাল, বলল, আমি ক্যাপ্টেন মারুফ। এই পুরো এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার হাতে দেওয়া হয়েছে। কাজেই আশা করছি আপনারা কী করেছিলেন তার খুব ভালো একটা ব্যাখ্যা আছে।
নিশীতা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ আছে। আপনি যেটুকু চিন্তা করতে পারেন তার চাইতেও অনেক ভালো ব্যাখ্যা আছে। আপনি কতটুকু বিশ্বাস করতে প্রস্তুত রয়েছেন সেটি অন্য ব্যাপার।
মারুফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিশীতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনাকে আমি আগে কোথাও দেখেছি।
আমি একজন সাংবাদিক। বড় বড় মানুষের সাংবাদিক সম্মেলনে মাঝে মাঝে আমাকে টেলিভিশনে দেখিয়ে ফেলে।
হ্যাঁ। ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নাড়ল, আপনাকে আমি টেলিভিশনে দেখেছি।
নিশীতা রিয়াজকে দেখিয়ে বলল, ইনি ড. রিয়াজ হাসান। আপনারা যে এলাকাটা কর্ডন করে আলাদা করে রেখেছেন সেখানে ড. হাসানের একটা কোড ব্যবহার করা হচ্ছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ ভুরু কুঁচকে বলল, ড. হাসান কি ভাইরাসের বিশেষজ্ঞ? তার কোড কি ভাইরাস বিষয়ক?
না। নিশীতা মাথা নাড়ল, ড. হাসান ভাইরাস বিশেষজ্ঞ নয়। তার কোডটি হচ্ছে মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে সম্পর্কিত।
ক্যাপ্টেন মারুফ চমকে উঠল, বলল, আপনি কী বলছেন?
হ্যাঁ। আপনারা এই পুরো এলাকাটা কর্ডন করে রেখেছেন কারণ এখানে একটি মহাজাগতিক প্রাণী আশ্রয় নিয়েছে। এখানে কোনো ভাইরাস নেই।
ক্যাপ্টেন মারুফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি আপনার কথা প্রমাণ করতে পারবেন?
পারব! আমাকে সময় দিলে আপনাকে সবকিছু প্রমাণ করে দিতে পারব। কিন্তু আমাদের হাতে সময় নেই আপনি যদি আমার কথা বিশ্বাস করেন পুরো কাজটুকু অনেক সহজ হয়ে যায়।
আপনারা কী করতে চাইছেন?
আমরা কোয়ারেন্টাইন করে রাখা মানুষগুলোর সাথে কথা বলতে চাই।
কেন?
কারণ তাদের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে সেটি একটি মিথ্যা কথা। তাদেরকে আলাদা করে রাখা হয়েছে কারণ তারা সেই মহাকাশের প্রাণীকে কিংবা প্রাণীর অবলম্বনকে দেখেছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ চমকে উঠে নিশীতার দিকে তাকালেন, তার হঠাৎ রমিজ মাস্টারের কথা মনে পড়ে গেল। সত্যিই সেই মানুষটি একটি ভয়ঙ্কর মূর্তির কথা বলছিল, মানুষটিকে একবারও অপ্রকৃতিস্থ মনে হয় নি।
নিশীতা নিচু গলায় বলল, ক্যাপ্টেন মারুফ, আমাদের হাতে সময় খুব বেশি নেই। আপনি কি এই দেশ এবং এই পৃথিবীর বিরুদ্ধে একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে সাহায্য করবেন?
ক্যাপ্টেন মারুফ নিশীতার কথার উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়াল, জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, সেদিকে তাকিয়ে সে হঠাৎ করে ভিতরে একটি বিচিত্র অনুভূতি অনুভব করতে থাকে। শার্টপ্যান্ট পরা এই বিচিত্র মেয়েটির কথাবার্তায় এক ধরনের দৃঢ়তা আছে, বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। মনে হচ্ছে মেয়েটি সত্যি কথাই বলছে। ভাইরাস সংক্রমণের পুরো ব্যাপারটির মাঝে সত্যি সত্যি বড় ধরনের গরমিল আছে, কিছুতেই হিসাব মেলানো যায় না– এটা সে নিজেই লক্ষ করেছে। কিন্তু সে একজন মিলিটারি অফিসার, মিলিটারি অফিসারদের তো নিয়ম মেনে চলতে হয়। কিছু একটা করার আগে তার অনুমতি নিতে হবে, কিন্তু সে জানে তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না। এটি সত্যিই যদি একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে থাকে তা হলে কিছুতেই তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না, বরং ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়ে গেছে জেনে তাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। তা হলে কি সে নিয়ম ভেঙে এই সাংবাদিক মেয়েটি এবং বিজ্ঞানী মানুষটিকে কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে নিয়ে যাবে? একজন মিলিটারি অফিসার হয়ে সে নিয়ম ভঙ্গ করবে?
ক্যাপ্টেন মারুফ একটা নিশ্বাস ফেলল। উনিশ শ একাত্তরে সেনাবাহিনী নিয়ম ভঙ্গ করে বিদ্রোহ করেছিল বলে এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। যারা নিয়ম তৈরি করেছে তারা নিয়মটি খাঁটি করে তৈরি না করলে সেই নিয়ম না ভেঙে কী করবে? ক্যাপ্টেন মারুফ ঘুরে নিশীতা আর ড. রিয়াজের দিকে তাকাল, বলল, ঠিক আছে। চলুন, আপনাদের আমি কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে নিয়ে যাই।
নিশীতা এবং রিয়াজের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তারা উঠে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন মারুফের কাছে এগিয়ে এল। নিশীতা ক্যাপ্টেন মারুফের হাত স্পর্শ করে বলল, ধন্যবাদ। আপনাকে। অনেক ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন মারুফ।
রিয়াজ বলল, তা হলে এক্ষুনি যাওয়া যাক। আমাদের হাতে কোনো সময় নেই।
তিনজন ক্যাম্প থেকে বের হয়ে একটা জিপে উঠে বসে। নিশীতা আর রিয়াজের ব্যাকপ্যাক দুটি পিছনে রাখা হয়েছে, জিপ স্টার্ট করার আগের মুহূর্তে দেখা গেল একজন জুনিয়র মিলিটারি অফিসার ছুটে আসছে। কাছে এসে স্যালুট করে বলল, স্যার, আপনার। কাছে একটা জরুরি ম্যাসেজ এসেছে।
কী আছে ম্যাসেজে?
অফিসার আড়চোখে নিশীতা এবং রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাসেজে বলা হয়েছে এখানে দুজন পলাতক মানুষ এসেছে। একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা। তাদেরকে যেভাবে সম্ভব এ্যারেস্ট করতে।
আর কিছু?
জি। বলা আছে, মানুষগুলো খুব ডেঞ্জারাস। প্রয়োজন হলে দেখামাত্র তাদের গুলি করা যেতে পারে।
বেশ। ক্যাপ্টেন মারুফ জিপ স্টার্ট করে বলল, ম্যাসেজ রিসিভ করে তাদের কনফার্মেশন করে দাও।
কিন্তু স্যার
আমি আসছি।
তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ক্যাপ্টেন মারুফ এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে জিপটিকে বের করে নিয়ে গেল।
জিপটি রাস্তায় ওঠার পর নিশীতা বলল, শুনেছেন, আমাদেরকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ সামনে তাকিয়ে থেকে বলল, তাই সাথে একটা লাইট আর্মস নিয়ে নিয়েছি।
নিশীতা শব্দ করে হেসে বলল, এখন আপনাকে কেউ আর কিছু বলতে পারবে না।
.
প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটা বিল্ডিঙের সামনে ক্যাপ্টেন মারুফ জিপটি থামিয়ে সেখান থেকে নেমে পড়ল। বড় একটি লোহার গেটের সামনে দুজন সশস্ত্র মিলিটারি দাঁড়িয়ে ছিল, ক্যাপ্টেন মারুফকে দেখে তারা এগিয়ে এল, নিচু গলায় কিছু কথাবার্তা হল এবং তারা। গেট খুলে দিল। ভিতরে একটা ছোট ঘরে একটা টেবিলের ওপর পা তুলে একজন মানুষ বসে আছে, ক্যাপ্টেন মারুফ এবং তার সাথে নিশীতা আর রিয়াজকে দেখে সে ভুরু কুঁচকে এগিয়ে এল, ক্যাপ্টেন মারুফকে জিজ্ঞেস করল, এরা কারা?
একজন হচ্ছে সাংবাদিক, অন্যজন সায়েন্টিস্ট।
মানুষটি আঁতকে উঠে বলল, সাংবাদিক? এখানে সাংবাদিক আনা পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নাড়লে, বললেন, হ্যাঁ সে জন্যই এসেছেন।
মানুষটি অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকাল, বলল, কী বলছেন আপনি?
কেন পুরোপুরি নিষিদ্ধ, সেটা বোঝা দরকার। এরা এসেছেন কোয়ারেন্টাইন করা মানুষদের দেখতে।
দেখতে? তারা মারাত্মক ভাইরাসে আক্রান্ত।
এখন পর্যন্ত তাদের কত জন মারা গিয়েছেন?
লোকটি এবারে থতমত খেয়ে বলল, ইয়ে এখনো কেউ মারা যায় নি কিন্তু একজন মহিলা পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে গিয়েছে।
এবারে নিশীতা প্রশ্ন করল, মহিলা কী করছে যে জন্য আপনার মনে হচ্ছে তিনি উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন?
দেয়ালে মাথা ঠুকছে, চিৎকার করছে।
কেন?
শুধু বলছে আমার ছেলে আমার ছেলে!
কী হয়েছে তার ছেলের?
ভাইরাসের আক্রমণের কারণে তার ধারণা হয়েছে কেউ একজন তার ছেলেকে নিয়ে চলে গেছে।
আপনি কেমন করে জানেন সত্যি সত্যি তার ছেলেকে কেউ নিয়ে যায় নি?
মানুষটি এবারে কেমন যেন হতচকিত হয়ে গেল। নিশীতা তীব্র স্বরে বলল, আপনি পুরুষ মানুষ বলে জানেন না মা আর তার সন্তানের সম্পর্কটা কী রকম। একটা মায়ের ছোট্ট বাচ্চাকে কেউ নিয়ে নিলে তার উন্মাদ হয়ে যাবার কথা। সেটাই স্বাভাবিক। না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।
মানুষটি এবার যুক্তিতর্ক আলোচনা থেকে সরে এল। অনাবশ্যক কঠিন গলায় বলল, আপনাদের এখানে আসার কথা নয়, আপনার সাথে আমার কথা বলারও কথা নয়।
ক্যাপ্টেন মারুফ একটু এগিয়ে এসে বলল, কিন্তু আমার মনে হয় এখন একটু কথা বলা দরকার। কোথাও কোনো ভুলত্রুটি হয়েছে কি না খোঁজখবর নেওয়া এমন কিছু অপরাধ নয়।
মানুষটি নিচু হয়ে তার ড্রয়ারের ভিতরে কিছু একটা খুঁজতে থাকে, জিনিসটা খুঁজে নিয়ে সে যখন সোজা হয়ে দাঁড়াল তখন ক্যাপ্টেন মারুফ দেখতে পেল সেটা একটা রিভলবার, মানুষটি প্রায় চিৎকার করে বলল, হাত তুলে দাঁড়ান তিনজন, তা না হলে আমি গুলি করব, আমার ওপর অর্ডার আছে।
নিশীতা কিংবা রিয়াজ কখনোই এ রকম পরিবেশে পড়ে নি, কী করবে কিছু বুঝতে পারছিল না, কিন্তু ক্যাপ্টেন মারুফকে একটুও বিচলিত হতে দেখা গেল না, শব্দ করে হেসে বলল, তাই নাকি? অর্ডার আছে?
মানুষটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই হঠাৎ করে কিছু একটা ঘটে গেল, নিশীতা আবছাভাবে দেখল ক্যাপ্টেন মারুফের শরীর শূন্যে উঠে গেছে, চোখের পলকে সারা শরীর ঘুরে আবার নিচে নেমে এসেছে কিন্তু সেই মুহূর্তে তার পায়ের এক লাথিতে হাতের রিভলবার ছিটকে গিয়ে পড়েছে দেয়ালে। মানুষটি নিজের হাত ধরে কাতর শব্দ করে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ক্যাপ্টেন মারুফ হেঁটে গিয়ে মানুষটির শার্টের কলার ধরে ফিসফিস করে বলল, একটা শব্দ করলে খুন করে ফেলব।
আমার হাত!
সম্ভবত ফ্রাকচার হয়েছে। চিন্তার কিছু নেই, অর্থোপেডিক সার্জন সেট করে দেবে।
মানুষটি বিস্ফারিত চোখে ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকিয়ে রইল। ক্যাপ্টেন মারুফ বলল, টাই কোয়ান্ডো কারাটের মতোই তবে পা অনেক বেশি ব্যবহার করতে হয়। থার্ড ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট। সময় পাই নি দেখে ফোর্থ ডিগ্রি কমপ্লিট করতে পারি নি!
ক্যাপ্টেন মারুফ বেশ দক্ষ হাতে মানুষটিকে বেঁধে ফেলল। টেবিল থেকে চওড়া ব্ল্যাক টেপ নিয়ে মুখে লাগানোর সময় নিশীতা বলল, আমি লাগাতে পারি?
ক্যাপ্টেন মারুফ একটু অবাক হয়ে বলল, আপনি?
হ্যাঁ। আমি শুধু সিনেমায় দেখেছি এগুলো লাগায়, আসলেও যে লাগানো হয় জানতাম না। আমি দেখি কেমন করে লাগানো হয়!
ক্যাপ্টেন মারুফ টেপটা নিশীতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই। চেঁচামেচি করে লোকজন জড়ো করতে না পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা।
মানুষটি একটা কিছু বলতে চাইছিল তার আগেই নিশীতা তার মুখে ডাক্ট টেপটা লাগিয়ে দিয়ে এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, তার মানে আসলেই এটা কাজ করে।
হ্যাঁ করে। এখন চলুন ভিতরে যাওয়া যাক। ঘরের চাবিটা নিয়ে নিই।
মানুষটার ডেস্কের উপরে একটা চাবির গোছা পাওয়া গেল, সেটা হাতে নিয়ে তিনজন ঘর থেকে বের হয়ে আসে।
সরু একটা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে একটা কলাপসিবল গেট পাওয়া গেল। সেটা ভোলার পর একটা বড় কাঠের দরজা, সেটা খোলার পর দেখা গেল হাসপাতালের মতো একটা লম্বা রুম, দু পাশে সারি সারি বিছানা। বিছানায় কেউ শুয়ে নেই, দরজা থেকে কয়েক হাতে দূরে সবাই কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে, সবার চোখে এক ধরনের তীব্র দৃষ্টি। মানুষগুলো কোনো কথা না বলে ক্যাপ্টেন মারুফ, নিশীতা এবং রিয়াজের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ক্যাপ্টেন মারুফ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবার দিকে একনজর তাকিয়ে বলল, আমরা একটা বিশেষ কাজে আপনাদের সাথে দেখা করতে এসেছি।
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ গলায় শ্লেষ ঢেলে বলল, আপনার ভয় করছে না যে ভাইরাসের আক্রমণ হয়ে যাবে?
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নাড়ল, বলল, না, করছে না।
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, কেন করছে না?
নিশীতা এগিয়ে এসে বলল, কারণ, আমরা জানি আপনাদের ভাইরাসের সংক্রমণ হয় নি।
মানুষগুলো নিশীতার কথা শুনে চমকে উঠল, এক মুহূর্ত নীরব থেকে একসাথে সবাই কথা বলে উঠতেই ক্যাপ্টেন মারুফ হাত তুলে তাদের থামিয়ে দেয়। মধ্যবয়স্ক মানুষটি একটু এগিয়ে এসে বলল, যদি আমাদের ভাইরাসের সংক্রমণ না হয়ে থাকে তা হলে আমাদের এখানে আটক রেখেছেন কেন? আমাদের যেতে দিচ্ছেন না কেন?
আসলে ঠিক আমরা আটকে রাখি নি।
তা হলে কে আটকে রেখেছে?।
সেটা অনেক বড় একটা কাহিনী–কোনো এক সময়ে আপনারা সবাই এটা জানবেন। এখন আমাদের সময় খুব কম–আমরা যে জন্য এসেছি সেটা সেরে নিই।
রমিজ মাস্টার বলল, কী জন্য এসেছেন?
রিয়াজ বলল, আপনারা ঠিক কী দেখেছেন আমরা সেটা শুনতে এসেছি।
মানুষগুলো আবার একসাথে কথা বলতে শুরু করতেই রমিজ মাস্টার হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, একজন একজন করে বলেন।
মানুষগুলো মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, একজন একজন করে।
রিয়াজ বলল, হ্যাঁ, আসুন দাঁড়িয়ে না থেকে কোথাও বসা যাক।
কমবয়সী একজন বলল, পাশের ঘর থেকে রাহেলাবুকেও ডেকে আনব?
নিশীতা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, উনাকেও ডেকে আনেন।
রিয়াজ জিজ্ঞেস করল, ইনি কি সেই ভদ্রমহিলা যার বাচ্চাকে নিয়ে গেছে?
হ্যাঁ। রমিজ মাস্টার জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে মাথা নেড়ে বলল, রাহেলার অবস্থা খুব খারাপ, মাথা মনে হয় খারাপ হয়ে যাবে।
কমবয়সী মানুষটি গিয়ে রাহেলাকে ডেকে আনল, তেইশ–চব্বিশ বছর বয়সের গ্রাম্য। মহিলা, চেহারার মাঝে এক সময়ে এক ধরনের কমনীয়তা ছিল কিন্তু এখন অনেকটা উন্মাদিনীর মতো। মাথায় রুক্ষ চুল, চোখ লাল, সমস্ত চোখেমুখে এক ধরনের ব্যাকুল। অস্থিরতা। ক্যাপ্টেন মারুফ, নিশীতা আর রিয়াজকে দেখে প্রায় হাহাকার করে বলল, আমার যাদুরে এনে দেন আপনারা। আল্লাহর কসম লাগে—আমার যাদুরে এনে দেন।
নিশীতা রাহেলার হাত ধরে বলল, আপনি একটু শান্ত হোন–আগে একটু শুনি কী হয়েছে। কিছু একটা যদি করতে হয় তা হলে আগে আমাদের জানতে হবে ঠিক কী হয়েছে।
রিয়াজ বলল, হ্যাঁ, আগে আমরা শুনি ঠিক কী হয়েছে। একজন একজন করে শুনি।
মানুষগুলো একজন একজন করে তাদের কথা বলতে শুরু করল। প্রথমে বলল আজহার মুন্সী। রাত্রিবেলা শহর থেকে ফিরে আসছিল, সড়কের কাছে বটগাছের নিচে তার রতন ব্যাপারির সাথে দেখা। রতন ব্যাপারির অনেক দিন থেকে আজহার মুন্সীর এক টুকরো জমির ওপর লোভ। জাল দলিল, কোর্ট–কাছারি করেও খুব সুবিধে করতে পারছে না বলে অন্যভাবে অগ্রসর হতে চাইছে। বটগাছের নিচে জমাট অন্ধকারে তাকে কয়েকজন চেপে ধরল। কিছু বোঝার আগেই তাকে নিচে ফেলে দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। আজহার মুন্সী আতঙ্কিত চোখে দেখে রতন ব্যাপারি ধারালো একটা চাকু নিয়ে এগিয়ে আসছে, ঠিক তখন হঠাৎ খুব একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, আজহার মুন্সী অবাক হয়ে দেখল রতন ব্যাপারির কাছে একটা প্রাণী দাঁড়িয়ে আছে। প্রাণীটি মানুষের মতো কিন্তু মানুষ নয়, অন্ধকারেও কোনো কারণে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, সম্ভবত তার শরীর থেকে এক ধরনের আলো বের হয়। প্রাণীটির চোখ দুটো ছিল তীব্র লাল, মনে হয় যেন দুটো বাতি জ্বলছে। মাথা থেকে অনেকগুলো গুড়ের মতো বের হয়ে আসছে। সেগুলো কিলবিল করে নড়ছে। প্রাণীটা সেই ঔড় দিয়ে রতন ব্যাপারিকে খপ করে চেপে ধরে ফেলল। আজহার মুন্সীকে যে মানুষগুলো মাটিতে চেপে ধরে রেখেছিল তারা ততক্ষণে পালিয়ে গেছে– বটগাছের নিচে এখন তারা দুজন। রতন ব্যাপারি তখন ভয়ে আতঙ্কে তার হাতের চাকু দিয়ে সেই ভয়াবহ প্রাণীটিকে আঘাত করতে থাকে।
গল্পের এই পর্যায়ে এসে আজহার মুন্সী থেমে যায়। রিয়াজ জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হল?
আজহার মুন্সী স্বভাবতই খুব বিচলিত হয়ে আছে, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, এই। জিনিসটা মনে হয় লোহার তৈরি। চাকু দিয়ে প্রত্যেকবার ঘা দিতেই ঠন করে শব্দ হয়। রতন ব্যাপারির শরীরেও মোষের মতো জোর, পাগলের মতো কুপিয়ে যাচ্ছে। কোপাতে কোপাতে মনে হল চাকু দিয়ে সেই লোহার শরীর কেটে ফেলল। গলার কাছাকাছি কেটেছে। কাটতেই সেদিক দিয়ে সাবানের ফেনার মতো সবুজ রঙের আঠালো জিনিস বের হতে শুরু করল। তখন হঠাৎ সেখানে ইঁদুরের মতো একটা প্রাণী লাফ দিয়ে বের হয়ে এসে রতন ব্যাপারিকে কামড় দিয়ে ধরল।
আজহার মুন্সী আবার থেমে গিয়ে জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। রিয়াজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আজহার মুন্সীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তারপর?
সেই ইঁদুরের মতো ছোট্ট জন্তুটা পাখির মতন শব্দ করতে করতে রতন ব্যাপারির শরীরের ভিতর ঢুকে গেল।
নিশীতা অবাক হয়ে বলল, শরীরের ভিতরে ঢুকে গেল?
হ্যাঁ।
তারপর?
রতন ব্যাপারি তখন ধড়াম করে মাটিতে পড়ে গিয়ে চিৎকার করছে। আর সেই প্রাণীটা তার শরীরের ভিতর কিলবিল করে নড়ছে। রতন ব্যাপারি গরুর মতো চিৎকার করতে করতে এক সময় নীরব হয়ে গেল।
তারপর?
আজহার মুন্সী একটা নিশ্বাস দিয়ে বলল, আমি তো ভেবেছি আমি শেষ। মাটিতে হাত বাধা হয়ে পড়ে আছি, আর সেই মূর্তিটা আমার কাছে এগিয়ে এসেছে। নিচু হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে, কেমন জানি একটা ওষুধের মতো গন্ধ শরীরে। আমি দেখতে পেলাম শরীরের ভিতরে কী যেন নড়ছে, মনে হয় সেই ইঁদুরের মতো প্রাণীগুলো।
তারপর?
আজহার মুন্সী বলল, তখন আবার সেটা দাঁড়িয়ে গেল, তারপর ঘুরে চলে গেল।
রিয়াজ জিজ্ঞেস করল, আপনি তখন কী করলেন?
আমি অনেক কষ্ট করে হাতের বাঁধন খুলে উঠে দাঁড়িয়েছি। রতন ব্যাপারির অবস্থা দেখার জন্য তার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। দেখি তার শরীরটা কাঁপছে।
কাঁপছে?
হ্যাঁ। আমার তখন ভয় লেগে গেল।
কী করলেন তখন?
ভাবলাম উঠে দৌড় দেই। ঠিক তখন রতন ব্যাপারির চোখ খুলে গেল। আপনি বিশ্বাস করবেন না চোখ দুটো টর্চ লাইটের মতো জ্বলছে। আমি তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম ঠাস্ শব্দ করে মাথার কাছে একটা ফুটো হয়ে সেদিক দিয়ে সাপের মতো কী একটা জিনিস বের হয়ে এল।
আজহার মুন্সী কয়েক মুহূর্তের জন্য থামল; তারপর একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি তখন আমার জান নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে এসেছি।
রতন ব্যাপারির কী হল?
একবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম সে টলতে টলতে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আগের মূর্তিটা যেদিকে গিয়েছে সেদিকে। সেও দানব হয়ে গেছে।
রিয়াজ একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, এই প্রসেসটার একটা নাম আছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ জানতে চাইল, কোন প্রসেসটার?
মহাজাগতিক প্রাণী এসে যখন লোকাল প্রাণীর শরীরকে ব্যবহার করে।
কী নাম?
এলিয়েন হোষ্টিং। এলিয়েন হোষ্টিং খুব ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এর অর্থ এই প্রাণী ইচ্ছে করলে পুরো পৃথিবী দখল করে ফেলতে পারবে।
নিশীতা হাতের ঘড়ি দেখে বলল, ড. হাসান, আমাদের হাতে কিন্তু সময় নেই।
হ্যাঁ, আমরা অন্যদের কথাও শুনে নিই। এর মাঝেই কিন্তু একটা প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে।
নিশীতা জিজ্ঞেস করল, কী প্যাটার্ন?
প্রথম কেসটা তুমি যেটা বলেছিলে সেখানে এলিয়েন হোস্টিং করেছিল একজন টেররিস্টকে। এখানেও এলিয়েন হোষ্টিং করেছে একজন মার্ডারারকে, অন্ততপক্ষে যে মার্ডার করতে চাইছিল সেই মানুষকে!
রমিজ মাস্টার গলা উঁচু করে বলল, আমি যেটা দেখেছি সেটাও এ রকম কেস। সেখানেও আমাকে মানুষটা মার্ডার করতে চাইছিল।
উপস্থিত অন্য মানুষগুলো হঠাৎ সবাই একসাথে কথা বলার চেষ্টা করল, সবারই বলার মতো এই ধরনের গল্প রয়েছে। রিয়াজ হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিল, বলল, একজন একজন করে শোনা যাক।
এর পরের ঘটনাটি বর্ণনা করল তিনজন মিলে। তাদের নাম হান্নান, ইদরিস আর সোলায়মান। সম্পর্কে এরা ফুপাতো এবং মামাতো ভাই, বাজারে মালা ফ্যাশন নামে তাদের একটা কাপড়ের দোকান আছে। এলাকার বখে যাওয়া চাঁদাবাজ সবুজ আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মালা ফ্যাশনে এসে মোটামুটি নিয়মিতভাবে চাদাবাজি করে। এদের অত্যাচারে ছোট–বড় সব ব্যবসায়ী একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। শেষে আর কোনো উপায় না দেখে সবাই মিলে একত্র হয়ে একদিন তাদের ধরে পুলিশে দিয়ে দিল। আসল সমস্যার শুরু হল তখন পুলিশ টাকাপয়সা খেয়ে তাদের ছেড়ে দিল। সবুজ আর সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে তখন ঠিক করল এর প্রতিশোধ নেবে। হান্নান, ইদরিস আর সোলায়মানদের খুন করে ফেলবে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এক রাতে তারা যখন বাড়ি ফিরে আসছে, জলার কাছাকাছি একটা নির্জন জায়গায় সবুজ তার দলবল নিয়ে তাদের ধরে ফেলল। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে কিল ঘুসি লাথি মেরে তাদেরকে জলার ধারে নিয়ে এসে দাঁড় করায়। সবুজ তার রিভলবার বের করে গুলি করার জন্য, ঠিক তখন একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, হঠাৎ করে সবুজের দলবলের সবাই কিছু একটা দেখে চিৎকার করে পালিয়ে যেতে শুরু করল। হান্নান, ইদরিস আর সোলায়মান পিছন দিকে তাকিয়ে দেখে জলার ভিতর থেকে কিম্ভুতকিমাকার একটা মূর্তি উঠে আসছে। এটা দেখতে অনেকটা মানুষের মতো কিন্তু পুরোপুরি মানুষ নয়, মাথা থেকে অনেকগুলো শুড়ের মতো কিছু ঝুলছে। চোখ দুটো থেকে লাল আলো বের হয়ে আসছে। একটা হাতের ভিতর নানা রকম যন্ত্রপাতি, দেখে মনে হয় একই সাথে মানুষ, যন্ত্র এবং পশু।
এই মূর্তিটাকে দেখে সবুজ সেটাকে গুলি করতে করে কিন্তু তার কিছুই হয় না, মূর্তিটা এক পা এক পা করে এগুতে থাকে। শেষ মুহূর্তে সবুজও ভয় পেয়ে যায়। সে ছুটে পালিয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু হঠাৎ করে মূর্তিটার হাতের ভিতর থেকে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কিছু একটা বের হল, সবুজ তাতে আটকা পড়ে যায়। সেই মূর্তিটা তখন সবুজের কাছে এগিয়ে যায়, তখন হঠাৎ তার শরীরের ভিতর থেকে ছোট ছোট সরীসৃপের মতো প্রাণী বের হয়ে আসে, সেগুলো কিলবিল করে সবুজের শরীরের ভিতরে ঢুকে যায়। সবুজ বিকট স্বরে চিৎকার করতে থাকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কী হয়েছে দেখার জন্য। তিনজনের কারোই আর সাহস হয় না, কোনোমতে তারা তাদের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে।
রিয়াজ চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করল, আপনারা বলছেন আপনারা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন–কিন্তু কথাটি কি সত্যি? সেই মূর্তিটা তো ইচ্ছে করলে আপনাদেরও হাই ভোল্টেজ শক দিয়ে ধরে ফেলতে পারত। পারত না?
পারত। মানুষ তিনজন মাথা নেড়ে বলল, ইচ্ছা করলেই পারত। কিন্তু সেটা করে নি।
আমরা আগেও এই প্যাটার্ন দেখেছি। এই মূর্তি বা এলিয়েন বা মহাজাগতিক প্রাণীটা শুধুমাত্র মার্ডারার বা ক্রিমিনালদের শরীরে আশ্রয় নিচ্ছে সাধারণ মানুষদের ছেড়ে দিচ্ছে। তাদের কোনো ক্ষতি করছে না।
না, মিথ্যা কথা। রাহেলা চিৎকার করে ডুকরে কেঁদে উঠল, আমার যাদু কি অপরাধ করেছে? সাত দিনের একটা মাসুম বাচ্চাকে তা হলে কেন নিয়ে গেল?
উপস্থিত সবাই মাথা নাড়ল, বলল, এটা সত্যি কথা।
প্রায় সবার বেলাই এটা সত্যি যে তারা দেখেছে কোনো একটা খুনি বা সন্ত্রাসী ঠিক যখন বড় কোনো অপরাধ করতে যাচ্ছে ঠিক তখন তাকে আক্রমণ করছে, শুধু একটি ব্যতিক্রম, সেটি হচ্ছে রাহেলার শিশুর ব্যাপারটি। ঠিক কী ঘটেছে সেটা জানার জন্য নিশীতা এবং রিয়াজকে খুব কষ্ট করতে হল। রাহেলা ঠিক করে কথাই বলতে পারছিল না–একটু পরে পরে ডুকরে কেঁদে উঠছিল। অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত তার মুখ থেকে ঘটনার যে বর্ণনা পাওয়া গেল, সেটি এ রকম :
সন্ধেবেলা রাহেলা তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে। বাচ্চার বয়স মাত্র সাত দিন কোলের মাঝে আঁকুপাকু করে কাঁদছে এবং রাহেলার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এই ছোট শিশুটা গত নয় মাস তার শরীরের ভিতরে বিন্দু বিন্দু করে বড় হয়ে উঠেছে। এই শিশুটির জন্মের পর তার দৈনন্দিন প্রতিটি মুহূর্ত এখন এই শিশুটিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এত ছোট একজন মানুষ কীভাবে একজনের জীবনের সবটুকু পরিবর্তিত করে ফেলতে পারে সেই বিষয়টি নিয়ে রাহেলা যখন মনে মনে খুব অবাক হয়ে যাচ্ছিল তখন সে উঠানের পাশে হাস্নাহেনা গাছের কাছে সরসর করে পাতার শব্দ শুনতে পেল–তাদের পোষা কুকুর ভেবে ঘুরে তাকাতেই রাহেলার সমস্ত শরীর আতঙ্কে জমে গেল। হাস্নাহেনা গাছের নিচে মানুষের আকৃতির একটা জীব দাঁড়িয়ে আছে। জীবটির শরীর ধাতব, চোখ দুটো অংগারের মতো লাল হয়ে জ্বলছে।
রাহেলা তার বাচ্চাটিকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে পিছন দিকে ছুটে যেতে গিয়ে আবিষ্কার করল ঠিক তার পিছনেও এ রকম একটা জীব দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের আকৃতির এই জীবটির মাথা থেকে কিলবিল করে সাপের মতো কিছু একটা নড়ছে।
রাহেলা তখন তার ডানে বামে তাকাল এবং দেখল সেখানেও ঠিক একই রকম কয়েকটা জীব দাঁড়িয়ে আছে। জীবগুলো তখন খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তাকে গোল হয়ে ঘিরে ফেলতে লাগল। রাহেলাকে কেউ বলে দেয় নি কিন্তু সে বুঝতে পারল এই জীবগুলো তার বাচ্চাকে কেড়ে নিতে আসছে। সে তখন তার বাচ্চাটাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে চিৎকার করে বলল, –না–না–কেউ আমার কাছে আসবে না, খবরদার।
কিন্তু জীবগুলো ভ্রূক্ষেপ করল না, খুব ধীরে ধীরে তাদের হাতগুলো উপরে তুলে এগিয়ে আসতে লাগল। রাহেলা তখন বাচ্চাটাকে বুকে চেপে ছুটে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর জীবগুলো তাদের শুড় দিয়ে তাকে ধরে ফেলল। রাহেলা বাচ্চাটাকে বুকে চেপে ধরে প্রাণপণ চেষ্টা করল ছুটে যেতে কিন্তু প্রাণীগুলোর শরীর লোহার মতো শক্ত আর বরফের মতো শীতল। তাকে নিচে ফেলে তার বুক থেকে বাচ্চাটাকে কেড়ে নিল। রাহেলা আঁচড়ে–কামড়ে প্রাণীটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল কিন্তু প্রাণীগুলো তাকে ঝটকা মেরে নিচে ফেলে দিয়ে হেঁটে চলে গেল। রাহেলা উন্মাদিনীর মতো পিছনে পিছনে ছুটে যেতে চাইছিল কিন্তু তার চিৎকার শুনে লোকজন ছুটে এসে তাকে ধরে রেখেছিল বলে সে যেতে পারে নি। পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে সে অচেতন হয়ে গিয়েছিল।
কথা বলা শেষ করে রাহেলা আবার দুই হাতে মুখ ঢেকে আকুল হয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল। নিশীতা রাহেলাকে শক্ত করে ধরে রাখে, ঠিক কী ভাষায় তাকে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে। পারে না।
রিয়াজ গম্ভীর মুখে হেঁটে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। একটু পরে ক্যাপ্টেন মারুফ আর নিশীতা তার পাশে এসে দাঁড়াল। রিয়াজ ঘুরে ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ক্যাপ্টেন মারুফ, আপনার কি এখনো এই ব্যাপারটি নিয়ে কোনো সন্দেহ আছে?
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নাড়ল, বলল, না, নেই।
তা হলে কি আপনার কাছে আমি আরো একটু সাহায্য পেতে পারি?
কী সাহায্য?
আমাকে কি আপনার জিপে করে আপনি এই মহাজাগতিক প্রাণীর আস্তানায় নিয়ে যাবেন?
নিশ্চয়ই নিয়ে যাব। আপনি জানেন সেটি কোথায়?
রিয়াজ মাথা নাড়ল, বলল, না জানি না।
তা হলে?
নিশীতার কাছে একটি সেলুলার টেলিফোন আছে
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু এখানে নেটওয়ার্কে সিগন্যাল নেই, সেলুলার ফোন কাজ করবে না।
রিয়াজ হাসার ভঙ্গি করে বলল, সেটা নিয়ে ভাববেন না। নিশীতার সেলুলার ফোনের ব্যাটারির চার্জ অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে, তার পরেও সেখানে সময়মতো ফোন আসছে। কোথায় যেতে হবে আমাদের বলে দিচ্ছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ অবাক হয়ে বলল, কে বলে দিচ্ছে?
এপসিলন।
এপসিলন? সেটা কে?
নিশীতা বলল, ড, হাসানের একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম।
কম্পিউটার প্রোগ্রাম?
রিয়াজ ইতস্তত করে বলল, কোনো একটি প্রাণী আমার এই প্রোগ্রামটি ব্যবহার করে আমাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না—
আমরাও ঠিক বুঝতে পারছি না শুধু একটি জিনিস জানি–আমরা একেবারে একা নই।
চমৎকার। চলুন তা হলে যাই
চলুন।
ঘর থেকে বের হওয়ার সময় রাহেলা পাগলের মতো ছুটে এসে তাদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলল, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?
রিয়াজ একটু ইতস্তত করে বলল, আমরা যাচ্ছি ঐ প্রাণীগুলোর আস্তানায়।
রাহেলা চোখ বড় বড় করে বলল, আমি যাব আপনাদের সাথে।
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নেড়ে বলল, আপনি কেমন করে যাবেন?
নিশীতা বলল, আমরা এখনো জানি না কেমন করে যাব। সেখানে কী হবে আমাদের কোনো ধারণা নেই।
রাহেলা মাথা নেড়ে কাতর গলায় বলল, না, আমি যাব। আমি আমার যাদুর কাছে যাব। আল্লাহর কসম লাগে আমাকে নিয়ে যান
ক্যাপ্টেন মারুফ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, রিয়াজ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে রাহেলা, আপনি যদি আমাদের সাথে যেতে চান আসুন।
নিশীতা একটু অবাক হয়ে রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু
কিন্তু কী?
রাহেলা সবকিছু নিয়ে এত অস্থির হয়ে আছে, তাকে এভাবে নেওয়া কি ঠিক হবে? রিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে বলল, আমার ধারণা এই পৃথিবীকে যদি কেউ বাঁচাতে পারে তা হলে সেটি রাহেলাই পারবে। আর কেউ পারবে না।