০৯. রাত্রি তখন প্রায় সোয়া নটা

রাত্রি তখন প্রায় সোয়া নটা হবেই।

কিরীটী অরূপ সুব্রত সুব্রতর গাড়িতেই চলেছিল থানায় অরূপকে নামিয়ে দেবার জন্য।

শমিতা কিরীটীর বিস্ময়কর উক্তির পর সহসা ঘর ছেড়ে ঝড়ের মত বের হয়ে যাবার পর সকলের মধ্যেই যে স্তব্ধতা নেমে এসেছিল, চলমান গাড়ির মধ্যেও সেই স্তব্ধতাই যেন সকলকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

স্তব্ধতা ভঙ্গ করে অরূপই প্রথমে কথা বলল, মিঃ রায়, গগনবিহারী যে তাঁর উইলে শমিতাকে সব কিছু দিয়ে দিয়েছেন আপনি জানতে পারলেন কখন?

কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল, জানতে তো এখনও আমি পারিনি!

তবে যে আপনি বললেন?

সম্পূর্ণ অনুমানের ওপরে নির্ভর করে অন্ধকারে একটা ঢিল নিক্ষেপ করেছিলাম মাত্র।

তবে কথাটা সত্যি নয়! অরূপের কণ্ঠে রীতিমত বিস্ময় যেন প্রকাশ পায়।

সত্যও হতে পারে–মিথ্যাও হতে পারে। অবশ্য সত্যি-সত্যিই যদি তিনি উইল করে থাকেন। তবে আমার ধারণা–

কি?

আমার অনুমানটা হয়ত মিথ্যে নয়, নচেৎ ঐভাবে হঠাৎ তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ জানিয়ে মিস সান্যাল ঘর থেকে বের হয়ে যেতেন না। শুধু তাই নয়, আরও আমার ধারণা, ওঁদের পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বিবাহের স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছিল।

বলেন কি! অরূপ বললে, শমিতা সান্যালের মত একটি মেয়ে গগনবিহারীর মত এক বৃদ্ধকে বিবাহ করতে মনস্থ করেছিলেন? এ যে আমি ভাবতেও পারছি না মিঃ রায়!

ভাবতে তো আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি দিয়ে অনেক কিছুই পারি না অরূপ! তবে অনেক কিছুই ঘটে এ সংসারে, আর ঘটছেও। তাই নয় কি?

কিন্তু–

সামান্য পরিচয়ে মিস সান্যালকে যতটুকু আমি বুঝতে পেরেছি, ওঁরা হচ্ছেন সেই শ্রেণীর স্ত্রীলোক যাঁরা খানিকটা উচ্ছঙ্খলভাবে স্বাধীনচেতা এবং যাঁদের কাছে নিরঙ্কুশভাবে জীবনটা ভোগ করাই একমাত্র লক্ষ্য। এবং তার জন্য তাঁরা অনেক কিছুই হাসিমুখে ত্যাগ করতে পারেন। হয়ত বিবাহের পর স্বামীর সঙ্গে ঐখানেই মিস সান্যালের সংঘাত বেধেছিল–যার ফলে ডিভোর্স।

শমিতার শুনেছি যাঁর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল তাঁর অবস্থাও ভাল, বড় চাকরিও করেন, তাই হয়ত জীবনটাকে পুরোপুরি ভোগ করার জন্য সব চাইতে যে বস্তুটির বেশি প্রয়োজন–অর্থ–তার অভাব ছিল না। এবং শমিতার স্বামীর হয়ত আবার সেটা পছন্দ ছিল না। ফলে যা অবশ্যম্ভাবী ঐ ধরনের স্ত্রীলোকের পক্ষে তাই হয়ে গেল।

সুব্রত ঐ সময় বলে, তোর বন্ধু যোগজীবনবাবুর অবস্থাও তো খারাপ বলে মনে হল না।

যোগজীবনবাবু! কিরীটী বললে, মধ্যবিত্ত গৃহস্থ এবং সঞ্চয়ী ছিলেন। তাই হয়ত ঐ বাড়িটা করতে পেরেছেন। কিন্তু আজ তাঁর অবসর জীবন। শমিতা যে অর্থের সচ্ছলতার আকাঙ্ক্ষী সেরকম সচ্ছলতা যোগজীবনবাবুর কোথায়! থাকা সম্ভবও নয়।

শমিতা দেবীও তো চাকরি করেন।

তা করেন কিন্তু সেটা একান্ত দায়ে পড়েই। ভাইয়ের কাছ থেকে সেরকম অর্থ পাওয়া যাবে বলেই। এবং তাই বা তাঁর প্রয়োজনের পক্ষে কতটুকু? সেদিক দিয়ে ভেবে দেখ, গগনবিহারীর স্কন্ধারূঢ় হতে পারলে কত সুবিধা! সামান্য একটু যৌবনের ছলাকলা দিয়েই তাই হয়ত শমিতা প্রৌঢ় কামুক গগনবিহারীকে ধরাশায়ী করেছিল। অবিশ্যি গগনবিহারীকে করায়ত্ত করার আরও কারণ ছিল আমার মনে হয়!

কি? অরূপ প্রশ্ন করে।

প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব তো হবেই না, ঐ সঙ্গে সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশভাবে যে জীবনের সঙ্গে সে অভ্যস্ত সে জীবনও সে নিশ্চিন্তে চালিয়ে যেতে পারবে। ভোগের জীবনে একটানা ভেসে চলতে পারবে। কিন্তু ঐখানেই শমিতা ভুল করেছিল।

ভুল?

হ্যাঁ–গগনবিহারীর চরিত্রের সে সম্যক পরিচয় পায়নি। তাঁর দিকে তাঁর যে হাত প্রসারিত হয়েছিল, অনুরূপ ঘটনা ঘটলে যে সেই হাত দুটি আবার অন্যত্রও প্রসারিত হতে পারে সেটাই বুঝতে হয়ত পারেনি শমিতা। আর খটকা লাগছে আমার ঐখানেই।

খটকা?

হ্যাঁ। শমিতার মত মেয়ের সে কথাটা তো না বোঝার কথা নয়। তবে সে গোড়া থেকেই সতর্ক হল না কেন? কিংবা হয়ত এও হতে পারে, তার নিজের উপরে আত্মবিশ্বাসই তাকে শেষ পর্যন্ত চরম আঘাত হেনেছে।

বুঝলে অরূপ, কিরীটী একটু থেমে বলে, ব্যাপারটা অত্যন্ত জটিল। এবং জেনো, ঐ জটিলতার গিট খুলতে পারলেই তোমার কাছে বর্তমান হত্যারহস্যের সবটুকুই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কিছুই আর ঝাঁপসা অস্পষ্ট থাকবে না, রহস্যাবৃতও মনে হবে না।

গাড়ি ইতিমধ্যে থানার কাছে এসে থেমে গিয়েছিল।

ওরা গাড়ির মধ্যে বসে কথা বলছিল।

আপনি কি বুঝতে পেরেছেন মিঃ রায়, গগনবিহারীর হত্যাকারী কে? হঠাৎ ঐ সময় প্রশ্ন করে অরূপ।

অনুমান করতে পেরেছি বৈকি কিছুটা।

তবে কি শমিতা দেবীই?

এটা অবিশ্যি মিথ্যে নয় যে, কোন কিছুর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে গেলে প্রত্যেক পুরুষ ও নারীই তখন কিছুটা হিংস্র হয়ে ওঠে ঠিকই এবং কাউকে হত্যা করতে হলে বিকৃত একটা মনোবলের প্রয়োজনও হয়। কিন্তু বর্তমান হত্যার ব্যাপারটা–অর্থাৎ যেভাবে নিহত হয়েছেন। গগনবিহারী–সেটার কথা ভুললে তো তোমার চলবে না অরূপ। কে হত্যা করেছে তাঁকে সে কথাটা চিন্তা করার আগে তোমাকে চিন্তা করতে হবে কার পক্ষে গতরাত্রে গগনবিহারীকে হত্যা করা সম্ভব ছিল এবং হত্যার উদ্দেশ্যটাও সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে। নচেৎ ভুলপথে তুমি গিয়ে পড়বে। ভাল কথা, রামদেওর কোন সংবাদ পেলে?

না।

আর একটা কথা—

বলুন?

সুবীরবাবুর জবানবন্দিটা ও সেই সঙ্গে শমিতা দেবীর ও রুক্মিণীর জবানবন্দিটারও ভাল করে খোঁজখবর নাও। কারণ আমার ধারণা ওরা তিনজনেই মিথ্যে বলেছে।

শমিতা দেবী যে মিথ্যে বলেছেন সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু সুবীরবাবু আর রুক্মিণী–

কেউই সব সত্যি প্রকাশ করেনি।

রামদেওটার খোঁজ পেলে হয়ত অনেক কিছুই জানা যাবে।

খোঁজ পেলেও জেনো, সেও হয়তো সহজে মুখ খুলবে না। শোন অরূপ, আরও একটা কাজ তোমায় করতে হবে।

বলুন।

ভাল করে খোঁজ নিয়ে দেখ সত্যিই গগনবিহারী কোন উইল করে গিয়েছেন কিনা? তাঁর আইন–পরামর্শদাতা কে ছিলেন? তাঁর খোঁজ পেলে হয়তো তাঁর কাছেই খোঁজটা পাবে। সত্যিই যদি উইল একটা হয়ে থাকে তো জেনো এই হত্যা-মামলায় সেই উইলের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। কিন্তু আর না। আজ চলি–রাত অনেক হল।

ভাবছি ঐ রুক্মিণীকে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে আসব। ও মাগী নিশ্চয়ই জানে রামদেও কোথায় গিয়েছে বা আছে।

তাড়াহুড়ো করে কিছু করো না। ঘটনাকে তার স্বাভাবিক গতিতেই চলতে দাও। ঘটনার স্বাভাবিক গতি আপনা থেকে অনেক কিছুই জানিয়ে দেয়। ঘটনার ধর্মই তাই।

অতঃপর অরূপ গাড়ি থেকে নেমে গেল।

আর ওরা কিরীটীর গৃহের দিকে চলল।

.

যোগজীবন পাথরের মতই যেন বসেছিলেন।

কিরীটীর শেষ কথাগুলো ও শমিতার ঐ ধরনের ব্যবহার যোগজীবনকে যেন অকস্মাৎ একটা পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিয়েছিল।

একমাত্র বোন ঐ শমিতা। বয়সেও তাঁর চাইতে অনেক ছোট ও বলতে গেলে সন্তানের মতই। চিরদিনই তাই একটু বেশী প্রশ্রয় ও ভালবাসাই সে পেয়ে এসেছে যোগজীবনের দিক থেকে। ভালবেসে নিজের পছন্দমত বিয়ে করেছিল শমিতা এবং সে বিবাহে তাই কোন বাধা দেননি যোগজীবন।

ভালবাসার বিবাহবন্ধনও টিকলো না, ডিভোর্স হয়ে গেল।

ঘর ভেঙে গেল।

প্রথমটায় ভেবেছিলেন যোগজীবন সব দোষটাই বুঝি শমিতার স্বামী অমলেন্দুরই। সে-ই নিশ্চয়ই মানিয়ে নিতে পারেনি–যার ফলে ভালবাসার বন্ধনটাও ছিঁড়ে গেল। তাছাড়া কে-ই বা আপনজনের দোষ দেখে বা দেখতে চায়! তাই শমিতার দিক থেকে যে কোন দোষ থাকতে পারে সেটা তিনি ভাবতেই চাননি।

ভুলটা ভাঙতে যোগজীবনের খুব দেরি হল না। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে শমিতা তাঁর গৃহে এসে উঠবার পর কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন অমলেন্দুর দোষ যতটুকুই থাকুক না কেন বিচ্ছেদের ব্যাপারে ঘর বেঁধে কোথাও সুখে বাস করবার মেয়ে নয় শমিতা।

আত্মসুখপরায়ণ, উচ্ছল, বিলাসী জীবনের প্রতিই ঝোঁক বেশী শমিতার।

মনে মনে দুঃখ পেয়েছিলেন যোগজীবন, কিন্তু তবু মুখে কিছু বলতে পারেননি।

শমিতা চাকরি করে। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত ক্লাবে হৈ-হৈ করে কাটায়, সেখানে মদ্যপানও করে। কোনটাই তাঁর পছন্দ ছিল না, কিন্তু তবু বোনকে মুখ ফুটে কিছু বলেননি।

ইদানীং গগনবিহারীর সঙ্গে অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠতার কথাটাও যে কানে আসেনি তাঁর তাও নয়, সেটাও তাঁর কানে এসেছিল এবং তার জন্য শমিতার উপরে যতটা নয় তার চাইতে বেশী বিরক্ত হয়েছিলেন যোগজীবন গগনবিহারীর উপরেই।

ইচ্ছা হয়েছিল দু-একবার গগনকে কথাটা বলেন–গগন, ব্যাপারটা বড় দৃষ্টিকটু লাগছে–কিন্তু তাও বলেননি।

সমস্ত ব্যাপারটার কুশ্রীতা তাঁর রুচিবোধকে পীড়িত করলেও কেন যেন মুখ ফুটে কাউকেই কিছু বলতে পারেননি।

তাঁর সহজ সৌজন্য ও স্বাভাবিক রুচিবোধ তাঁকে নিরস্ত করেছে।

কিন্তু আজ কিরীটী যা স্পষ্ট করে সবার সামনে বলে গেল, তারপর লজ্জায় যেন মাথাটা আর তিনি তুলতে পারছিলেন না। কেবলই মনে হচ্ছিল, ছিঃ ছিঃ ছিঃ!

একেই তো আত্মীয়স্বজনরা সব সময়েই নানা ধরনের ইঙ্গিত করে শমিতার চরিত্র সম্পর্কে। এই ব্যাপার জানাজানি হবার পর তারা নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে এবার নিশ্চয়ই।

হঠাৎ চমক ভাঙল যোগজীবনের পদশব্দে। দেখলেন সাজগোজ করে শমিতা বের হয়ে যাচ্ছে।

উঠে দাঁড়ালেন যোগজীবন। ডাকলেন, শমি!

শমিতা ঘুরে দাঁড়াল।

এত রাত্রে কোথায় আবার বেরুচ্ছ?

দরকার আছে–শমিতা বললে।

যতই দরকার থাক এখন যেও না এই রাত্রে।

কি ব্যাপার বল তো দাদা? রাত্রে কি আজ আমি প্রথম বেরুচ্ছি? শমিতা একটু যেন ক্ষুণ্ণ হয়েই প্রশ্নটা করে।

যা বললাম তাই শোন। যোগজীবনের কণ্ঠস্বর গম্ভীর।

আমার কাজ আছে বলে আর দাঁড়াল না শমিতা। সদর গেটের দিকে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে চলল।

যা ইতিপূর্বে কখনও হয়নি, যোগজীবন যেন দপ্ করে জ্বলে উঠলেন। কঠিন কণ্ঠে ডাকলেন, শোন শমিতা! দাঁড়াও!

শমিতা ঘুরে দাঁড়াল এবারে।

বারান্দার আলো শমিতার সঙ্গে পড়েছে। পরনে একটা দামী শাড়ি ও গায়ে একটা অনুরূপ ব্লাউজ। সাধারণতঃ যেভাবে বেশভূষা করে শমিতা বের হয় সেই রকমই বেশভূষা, হাতে একটা ব্যাগ। পায়ে ফ্ল্যাট-হীল জুতো।

আমি বারণ করলুম বেরুতে তবু বের হবে?

কয়েক পা এগিয়ে এসেছেন যোগজীবন তখন ওর সামনে।

আমার কাজ আছে বললাম তো।

না। এখন তোমার বেরুনো হবে না! পূর্ববৎ কঠিন কণ্ঠস্বর যোগজীবনের।

শমিতা যোগজীবনের মুখের দিকে তাকাল। শমিতার মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছে। সে শান্ত গলায় যোগজীবনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে বেরুতেই হবে।

না! তোমার অনেক উচ্ছঙ্খলতাই আমি সহ্য করেছি এতদিন, আর আমি সহ্য করব না। বেরুনো তোমার হবে না। আর আমার কথা অমান্য করে তুমি যদি বের হও তো জানবে–

বল। থামলে কেন? তাহলে কি?

আমার এখানে আর থাকা চলবে না।

শমিতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েকটা মুহূর্ত তার গলা দিয়ে কোন স্বরই বের হয়।

না। কেবল অপলক চেয়ে থাকে যোগজীবনের মুখের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, বেশ, তাই হবে। আমি এখুনি তোমার বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি।

শমিতা কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না। সোজা সিঁড়ি বেয়ে পরক্ষণেই ফ্ল্যাট–হীল জুতোর খটখট শব্দ তুলে উপরে চলে গেল।

তিনতলায় নিজের ঘরে ঢুকে একটা সুটকেস টেনে নিয়ে ক্ষিপ্র হাতে কিছু জামাকাপড় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সুটকেসের মধ্যে ভরে আলমারি খুলে টাকা নিয়ে সুটকেসটা হাতে ঝুলিয়ে আবার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল।

যোগজীবনের সামনে দিয়েই খটখট করে ফ্ল্যাট-হীল শব্দ তুলে শমিতা বের হয়ে গেল।

যোগজীবন দাঁড়িয়ে রইলেন। একটি কথাও আর বললেন না।

শমিতার জুতোর শব্দটা ক্রমশঃ মিলিয়ে গেল।

সহসা যোগজীবনের চোখের কোল দুটো যেন জ্বালা করে ওঠে। দরজাটায় খিল তুলে দিয়ে যোগজীবন এসে আবার বাইরের ঘরের সোফাটার উপর বসলেন।

যোগজীবনের মনে পড়ে স্ত্রী প্রভাবতীর কথা ঐ মূহর্তে। বলতে গেলে শমিতা তাঁর সন্তানের বয়েসী–মা–বাবার শেষ বয়েসের সন্তান।

যোগজীবনের অনেক বছর পরে শমিতা জন্মেছিল। প্রভাবতী তখন বৌ হয়ে ওঁদের বাড়িতে এসেছেন–তাঁর একটি কন্যাসন্তানও হয়েছে।

শমিতার জন্মের পরই তাঁর মা যে শয্যা নিয়েছিলেন, আর উঠে বসেননি। চার বৎসর। রোগভোগের পর মারা গিয়েছিলেন। তার পরের বৎসর যোগজীবনের বাবারও মৃত্যু হয়।

স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালবাসতেন যশোদাজীবন। যোগজীবনের বাবা স্ত্রীর মৃত্যুর শোকটা সামলে উঠতে পারলেন না। |||||||||| শমিতার সকল দায়িত্ব এসে পড়ল ওঁদেরই উপর। বাচ্চা শমিতা মাত্র চার বছরের মেয়ে তখন।

যোগজীবনের নিজের প্রথমা কন্যা-সন্তানের চাইতেও দু বছরের ছোট বয়সে।

পিসি ভাইঝি একসঙ্গে মানুষ হতে থাকে। মাঝখানে প্রভাবতীর আর একটি সন্তান হয়েছিল, কিন্তু মৃত। প্রভাবতীর আর কোন সন্তান হয়নি।

কন্যা সবিতার সঙ্গেই নামে নাম মিলিয়ে প্রভাবতী ছোট্ট ননদিনীর নাম রেখেছিলেন শমিতা।

সবিতার যখন সতেরো বছর বয়স তখন বিবাহ হয়ে গেল। লেখাপড়ায় তার মন ছিল না–লেখাপড়া সে করেনি। কিন্তু অসাধারণ বুদ্ধিমতী ছিল শমিতা।

শমিতা তখন স্কুল ফাইনাল পাস করে আই. এ. পড়ছে কলেজে।বিবাহের পর সবিতাকে তার স্বামী সঙ্গে করে সুদূর মালয় দেশে চলে গেল।

শমিতারও বিয়ের চেষ্টা করছিলেন যোগজীবন কিন্তু শমিতা বেঁকে বসল। বললে, না, বি. এ. পাস না করে সে বিবাহ করবে না।

প্রভাবতী বললেন, আহা থাক। সবিতার বিয়ে হয়েছে, কোথায় কোন্ দূর দেশে চলে গেছে। দু বছর তিন বছরের আগে আসবেও না। থাক, ওর বয়েসই বা এমন কি হয়েছে? পাস–টাস করুক, তারপর না হয় বিয়ে দেওয়া যাবে।

শমিতা যখন এম. এ পড়ছে সেই সময় হঠাৎ স্ট্রোকে প্রভাবতী মারা গেলেন। শমিতা এম. এ পাস করল, তারপর এক বেসরকারী কলেজে অধ্যাপিকার কাজ নিল।

যোগজীবন মধ্যে মধ্যে বিয়ের কথা বলতেন কিন্তু জোরজারি করতেন না। কারণ মৃত্যুর সময় প্রভাবতী স্বামীকে বলে গিয়েছিলেন, বিয়ের ব্যাপারে ওকে যেন চাপাচাপি না করা হয়। সেটাও এক কারণ ছিল আর শমিতা চলে গেলে একা পড়বেন, তাও এক কারণ ছিল।

তারপর হঠাৎ একদিন শমিতা অমলেন্দুকে সঙ্গে করে এনে তাঁর সামনে দাঁড়াল। তার এক সহকর্মী বান্ধবীর ভাই।

ভাল বংশের ছেলে, শিক্ষিত, ভাল চাকরি করে। দেখতেও সুশ্রী।

ইদানীং শমিতার ব্যাপারে একটু চিন্তিতই যেন হয়ে উঠেছিলেন যোগজীবন। শমিতার স্বভাবের মধ্যে কেমন যেন একটা উচ্ছলতা দেখা দিয়েছিল। তার চাল–চলনে, বেশভূষায়–সব কিছুতেই।

এমন কি বোনের বেশভূষার দিকে তাকাতেও যেন যোগজীবনের কেমন লজ্জা হত।

কিন্তু তবু কিছু তিনি বলেননি কোনদিন বোনকে।

কেমন যেন মায়া হয়েছে, কেমন যেন একটা সংকোচ বোধ করেছেন।

ঐ ঘটনার বছরখানেক আগে রিটায়ার করেছিলেন যোগজীবন কাজ থেকে।

শমিতা অমলেন্দুকে দেখিয়ে বললে, তাকে বিবাহ করবে। তারা পরস্পর পরস্পরকে কথা দিয়েছে।

যদিও এক জাত নয় তথাপি যোগজীবন সে বিবাহে অমত করেননি শমিতা সুখী হবে ভেবে।

বিবাহ হয়ে গেল।

শমিতা একদিন চলে গেল স্বামীর ঘরে।

কলকাতায় এক বনেদী অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে অমলেন্দু। কলকাতাতেই শ্যামবাজার অঞ্চলে বাস করে। মধ্যে মধ্যে দুজনে আসত যোগজীবনের সঙ্গে দেখা করতে।

যোগজীবন তখন নিজের বাড়ির একতলাটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু শমিতা এসে মধ্যে মধ্যে দু’একদিন থাকত বলে তিনতলাটা ভাড়া দেননি। সেটা খালিই পড়ে ছিল।

দুটো বছরও গেল না বিবাহের পর, ডিভোর্স হয়ে গেল শমিতা ও অমলেন্দুর।

শমিতা যোগজীবনের কাছে ফিরে এল আবার এক শীতের মধ্যরাত্রে।

সেই সময়ই শমিতা মরালী সঙঘ নামে ক্লাবটা গড়ে তোলে। এবং কিছুদিন পরে শমিতা আবার চাকরি নিল অন্য একটা কলেজে।

ডিভোর্স করে ফিরে আসবার পর যেন শমিতা আরও বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল দিনকে দিন।

ক্লাব, পার্টি, হৈ–চৈ, নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান–সর্বক্ষণ ঐ সব নিয়েই মেতে রইল।

যোগজীবন মনে মনে ভাবলেন, আহা থাক। যাতে সুখী হয় তাই করুক।

কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে যোগজীবনের, সেদিন অমন করে রাশটা ছেড়ে না দিলে বোধ হয় এত বড় কলঙ্ক তাঁকে মাথায় নিতে হত না।

যাক চলে গিয়েছে, ভালই হয়েছে।

আর শমিতার মুখদর্শনও তিনি করবেন না।