০৯. রহস্যের ব্যাপার

সুদৰ্শন বুঝতে পেরেছিল বর্তমান রহস্যের ব্যাপারে সে অন্ধকারে হাতড়ে ফিরলেও কিরীচীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে কোন একটা কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই।

রহস্যের ব্যাপারে তার বিশেষ অনুভূতিটা কোন একটা পথ খুঁজে পেয়েছে।

সুদৰ্শন তাই আর দেরি করে না।

দুটো ভ্যানে দুজন পুলিস অফিসার তখুনি পাঠিয়ে দেয় মণিশঙ্কর ও স্বামীনাথনকে আনবার জন্য।

এক ঘণ্টার মধ্যেই দুজনকে নিয়ে পুলিস অফিসার দুজন লালবাজারে পৌঁছে গেল। কিন্তু তার আগেই কিরীটী পৌঁছে গিয়েছিল।

কি হল, এলেন তোমার সম্মানিত অতিথিরা? কিরীটী প্রশ্ন করে।

আনতে গেছে বসুন—

দুজনকে কিন্তু আলাদা ঘরে রাখবে।

আলাদা?

হ্যাঁ, আলাদা ভাবে প্রশ্ন করব–কেউ যেন কাউকে না দেখতে পায়।

বেশ তাই হবে।

সমীরণবাবুকেও প্রয়োজন হবে!

তাকে এ ঘরে আনাব?

না-এখন না, সময় হলে বলব।

সুদৰ্শন সেই মতই ব্যবস্থা করে।

 

প্রথমেই সুদৰ্শন কিরীটীর নির্দেশানুযায়ী মণিশঙ্করকে ডেকে পাঠাল।

মণিশঙ্কর ঘরে ঢুকেই বললে, কি ব্যাপার-এভাবে এখানে হঠাৎ পাকড়াও করে নিয়ে এলেন?

সুদৰ্শন নয়—জবাব দিল কিরীটী, বসুন মিঃ ঘোষাল। আমাদের কিছু জিজ্ঞাস্য আছে!

মণিশঙ্কর চোয়ারটা টেনে নিয়ে বলল, বলুন শুনি!

আমরা জানতে পেরেছি—ইদানীং বেশ কিছুদিন ধরেই আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার মনকষাকষি চলছিল, কথাটা কি সত্যি?

মূল্যবান এ খবরটি কার কাছ থেকে পেলেন?

যেখান থেকেই পাই না কেন, কথাটা মিথ্যে নিশ্চয়ই আপনি বলতে পারেন না।

কেন বলতে পারব না—একশোবার বলব মিথ্যে।

মিথ্যে?

হ্যাঁ, যে বলেছে সে সম্পূর্ণ মিথ্যাই বলেছে। We never had any misunderstanding or quarrel!

কিরীটী এবারে প্রশ্ন করে, বেশ বেশ। আপনার স্ত্রীকে আপনি খুব ভালবাসতেন न्श्यािष्ट्राझे?

আপনি বোধ হয় জানেন না, আমাদের লাভ-ম্যারেজ!

জানি-আর এ-ও জানি অনেক ভালবাসার বিয়েতেই অনেক সময় চিড় ধরে, ধরছে হামেশাই—

আমাদের সেরকম কিছু হয়নি।

ইদানীং আপনার, মানে আপনার বন্ধু সমীরণবাবুকে ঘিরে আপনার স্ত্রীর প্রতি একটা সন্দেহের ধোঁয়া সৃষ্টি হয়নি। আপনি বলতে চান?

সমীরণ আমার বন্ধু—অত ছোট মন আমার নয়।

তবে সমীরণবাবু ইদানীং আপনার ফ্ল্যাটে আর যেতেন না কেন? আগে আগে তো খুব যাওয়া-আসা ছিল!

তা আমি কেমন করে বলব?

আপনি কিছুই জানেন না?

না।

ওঃ, ভাল কথা, কাল ও পরশু রাত্রে আপনার বেশ ভাল ঘুম হয়েছিল নিশ্চয়ই?

ঘুম! হঠাৎ যেন কেমন থতিয়ে যায়। মণিশঙ্কর।

হ্যাঁ, ঘুম। শুনলাম। আপনি দুই রাত্রিই বেশ নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছেন! কি, জবাব দিচ্ছেন না কেন? ঘুমেননি?

আমার কি ঘুমোবার মত মনের অবস্থা?

তবু বেশ নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছেন বলেই খবর পেয়েছি!

দেখুন আপনার প্রশ্নের মাথা-মুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না!

ভালবেসে যাকে বিয়ে করলেন—আর যে নিজের সন্তান কয়েক ঘণ্টা আগে মাত্র নৃশংসভাবে খুন হয়েছে সে দৃশ্য দেখার পরও ঘুমের ব্যাঘাত আপনার ঘটল না রাত্রে–আপনার ভালবাসারই অকাট্য প্রমাণ বটে!

ব্যঙ্গের মত যেন শোনাল কিরীটীর কণ্ঠস্বর।

মণিশঙ্কর কোন জবাব দেয় না। কেমন যেন অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।

বেশ, এবারে বলুন পরশু আপনার জবানবন্দিতে দু-দুটো মারাত্মক মিথ্যা কথা কেন বলেছেন?

মিথ্যা কথা বলেছি!

হ্যাঁ-প্রথমতঃ যে চাবিটা আপনার স্ত্রীর আঁচলে থাকার কথা সেটা আপনার পকেটে এল কি করে?

ওটা তো ড়ুপ্লিকেট চাবি!

মিথ্যা কথা।

না, মিথ্যা নয়-তার কারণ–

আপনার কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা, হত্যার দিন অর্থাৎ পরশু দুপুরে আপনি যখন ফ্ল্যাটে আসেন তখুনি কোন এক সময় আপনার স্ত্রীর আচল থেকে আপনি চাবির রিংটা খুলে নিয়েছিলেন।

কি করে বুঝলেন?

যা সত্য তাই বলছি—

বেশ, কেন-আমি তার অচল থেকে চাবির রিংটা খুলে নেব?

কারণ হত্যা-ব্যাপারটার সঙ্গে একটা বাৰ্গালারিও জড়িয়ে আছে, সেটাই প্রমাণ করাবার চেষ্টা ও ইচ্ছা ছিল আপনার।

আ—আমি—

তারপর আপনি বলেছেন, বেলা দুটো বেজে দশ মিনিটের সময় আপনি ফোন পেয়ে অফিস থেকে ছুটে যান ট্যাক্সি নিয়ে বাড়িতে—

বলেছি তো!

তাও মিথ্যা।

মিথ্যা?

হ্যাঁ, তার আগেই একবার আপনি ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন-বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে।

আপনার কি মাথা খাবাপ হয়েছে? ঐ সময় আমি অফিসে কাজ করছিলাম—

বের হননি। আপনি অফিস থেকে একবার গত পরশু বেলা এগারোটা নাগাদ বলতে চান?

কিরীটীর প্রশ্নটা এত স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণ যে মণিশঙ্করকে যেন কয়েকটা মুহুর্তের জন্য কেমন থমকে দেয়।

হ্যাঁ-বের হয়েছিলাম মৃদু গলায় জবাব দেয় মণিশঙ্কর, গোটা এগারোর সময়।

কখন ফিরেছিলেন আবার?

বেলা বারোটা নাগাদ।

না তার অনেক পরে আপনি ফিরেছেন।–বেলা দেড়টায়।

মোটেই নয়-আমি অফিসেই ছিলাম।

না, ঐ সময়টা আপনি অফিসে ছিলেন না।

ছিলাম না বুঝলেন কি করে?

বুঝেছি। কারণ তার সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে। এবারে বলুন কোথায় গিয়েছিলেন ঐ সময় আর কেনই বা ফিরতে আপনার অত দেরি হল?

অফিসের কাজে-মানে অফিসের একটা কাজে আমায় একটু বেরুতে হয়েছিল, এখন মনে পড়ছে।

মনে পড়েছে তাহলে! তাহলে বলুন। এখন, কোথায় বের হয়েছিলেন?

ডালহৌসিতেই অন্য একটা অফিসে।

সেটা কোথায় এবং কোন অফিসে?

হাডসন অ্যাণ্ড মেটার অফিসে।

সেখান থেকে পনের মিনিট বাদেই তো আপনি বের হয়ে আসেন।

হঠাৎ মণিশঙ্কর যেন আর একটা ধাক্কা খেল। কেমন যেন বিব্রত ও হতচকিত মনে হয় তাকে।

পরম বিস্ময়ের সঙ্গে সুদৰ্শন কিরীটীর মণিশঙ্করকে প্রশ্ন ও তার জবাবগুলো শুনছিল। কিরীটী মণিশঙ্করের মুখের দিকে তার শেষ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে তখনো স্থির দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

মিঃ ঘোষাল আমার প্রশ্নের জবাবটা এখনো পাইনি!

মণিশঙ্কর চুপ।

আমি জানি মিঃ ঘোষাল, পরশু গোটা এগারোর সময় আপনি অফিস থেকে বের হয়ে হাডসন অ্যান্ড মেটার অফিসে গেলেও সেখান থেকে আপনি আপনার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন।

না আমি যাইনি।

গিয়েছিলেন। আপনি-বলুন কেন গিয়েছিলেন?

আমি যাইনি।

আপনার গলার স্বর—আপনার মুখ বলছে আপনি গিয়েছিলেন, আর আমাদের অনুমান যে মিথ্যা নয়। তার প্রমাণ একজন আপনাকে দেখেছিল। ঐ সময় ফ্লট থেকে বের হয়ে আসতে।

কে-কে দেখেছে!

মিঃ স্বামীনাথনকে এ ঘরে আনাও তো সুদৰ্শন।

সুদৰ্শন কিরীটীর নির্দেশে উঠে গিয়ে বাইরে দণ্ডায়মান সার্জেণ্টকে বললে পাশের ঘর থেকে স্বামীনাথকে ডেকে আনতে।

মিঃ ঘোষাল, কিরীটী আবার বলে, সত্য আর গরলকে কখনো চেপে রাখা যায় না। কোনদিন-না-কোনদিন তা প্রকাশ হয়ে পড়েই।

কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করুন, মণিশঙ্কর বলে ওঠে, আমি আমার স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যা করিনি!

কিন্তু আপনি গত পরশু এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে আপনার সি. আই টির ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন। কিরীটী শান্ত গলায় আবার বলে।

ঐ সময় স্বামীনাথন একজন সার্জেন্টের সঙ্গে ঘরে এসে ঢুকল।

মণিশঙ্করবাবু, একে আপনি চেনেন?

হ্যাঁ, চিনি?

কে উনি?

আমার স্ত্রীর দেশের লোক।

আপনার স্ত্রী অর্থাৎ বিজিতা দেবী তাহলে ওঁকে ভাল করেই চিনতেন?

চিনত।

মধ্যে মধ্যে আপনাদের ফ্ল্যাটে উনি আসতেন?

স্বামীনাথন তীব্র গলায় প্রতিবাদ জানায়, ইট’স এ ড্যাম লাই! মিথ্যা–

মিঃ স্বামীনাথন!

ইয়েস!

আপনি কতদিন ওঁদের ফ্ল্যাটের উপরের তলায় আছেন? কিরীটী প্রশ্ন করে স্বামীনাথনকে।

মাত্র দিন-পনের হবে।

তার আগে কোথায় ছিলেন।

পোলক স্ট্রীটের একটা ফ্ল্যাটে।

কতদিন ছিলেন সেখানে?

প্রায় বছর দুই হবে।

হঠাৎ সেখান থেকে ঐ সি. আই টির ফ্ল্যাটে উঠে এলেন কেন?

ফ্ল্যাটটা ভাল-ভাড়া কম—বেশ সুবিধা—তাই।

তাই, না বিজিতা দেবীর সঙ্গে যাতে সব সময় দেখাসাক্ষাৎ হতে পারে সেইজন্যই ওখানে উঠে এসেছিলেন?

না, সেজন্য নয়; যেজন্য উঠে এসেছিলাম। সে তো বললাম।

বিজিতা দেবীর সঙ্গে আপনার অনেক দিনের আলাপ?

একই শহরে পাশাপাশি বাড়িতে অনেকদিন আমরা ছিলাম।

কলকাতায় কতদিন আছেন?

বছর তিনেক।

তার আগে?

মাদ্রাজে একটা অফিসে চাকরি করতাম।

বিজিতা দেবী শান্তিনিকেতনে চলে আসার পর আপনাদের পরস্পরের মধ্যে চিঠিপত্রের দেওয়া-নেওয়া ছিল?

ছিল।

মধ্যে মধ্যে শান্তিনিকেতনে গিয়েছেন?

গিয়েছি, দুবার।

সমীরণ দত্ত—বিখ্যাত গাইয়েকে আপনি চেনেন?

চিনি।

আপনি বিজিতা দেবীকে ভালবাসতেন—তাই না?

স্বামীনাথন মাথাটা নীচু করে।

বলুন, এতে লজ্জা পাবার কিছু নেই। ভালবাসার মধ্যে কোন অপরাধ নেই।

স্বামীনাথন তবু কোন জবাব দেয় না।

কিরীটীর হঠাৎ নজরে পড়ল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মণিশঙ্কর ঘোষাল স্বামীনাথনের মুখের দিকে।

বলুন! কিরীটী আবার বলে।

বাসতাম। কিন্তু—, থেমে গেল স্বামীনাখন!

কি, থামলেন কেন, বলুন?

যেদিন জানতে পেরেছিলাম মণিশঙ্করকে সে ভালবাসে, সেইদিন থেকেই নিজেকে আমি গুটিয়ে নিয়েছিলাম।

তাই যদি হবে তো ঐ একই ফ্ল্যাটে অত কাছাকাছি আবার এসে উঠেছিলেন কেন মিঃ স্বামীনাথন? কিরীটী প্রশ্নটা করে ওর মুখের দিকে তাকাল।

আজ বুঝতে পারছি। ভুল করেছি।

ভুল?

তাই। হয়তো আমি ওইভাবে ওখানে এসে না উঠলে তাকে আজ আমন পৈশাচিক নৃশংস মৃত্যু বরণ করতে হত না।

মিঃ স্বামীনাথন, গত পরশু বেলা দশটা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন? কিরীটী এবারে প্রশ্ন করল।

আগেই তো বলেছি, আমি পরশু কলকাতার বাইরে ছিলাম। স্বামীনাথন বললে।

কিন্তু আমি যদি বলি আপনি মিথ্যে বলছেন!

মিথ্যে?

হ্যাঁ, ওই সময়টা আপনি আপনার ফ্ল্যাটেই ছিলেন।

না, না-আই ওয়াজ আউট অফ ক্যালকাটা!

না—স্টীল ইউ আর ডিনাইং দি ফ্যাক্টস! এখনো সত্য বলুন?

আ-আমি আগের দিনই সকলে বের হয়ে যাই—

হয়তো গিয়েছিলেন, তবে আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো গত পরশু আবার ফিরে এসেছিলেন। দেখুন। মিঃ স্বামীনাথন, হাজারটা মিথ্যে দিয়েও একটা নিষ্ঠুর সত্যকে আপনি চাপা দিতে পারবেন না। পুলিসের পক্ষে জানা অসম্ভব হবে না। সত্যিই ওই সময়টায় আপনি কোথায় ছিলেন, আজ বা কাল তারা সেটা জানতে পারবেই। হত্যাকারী যে-সময় বিজিতা দেবী ও তার শিশুসন্তানকে হত্যা করে বের হয়ে যায়, আপনি তাকে সিঁড়িতে দেখেছিলেন। তাই নয় কি? চুপ করে থাকবেন না, বলুন speak out!

হ্যাঁ, একজনকে আমি দেখেছি।

তাহলে গত পরশু সময়টাতে আপনি ফ্ল্যাটেই ছিলেন?

না।

ছিলেন না?

না, আমি পৌনে একটা নাগাদ ফিরে এসে যখন সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠেছি তখন একজনকে দ্রুত আমার পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে দেখেছিলাম।

কে সে?

ঠিক চিনতে পারিনি।

তার পরনে কি ছিল?

সুট পরা ছিল।

লম্বা না বেঁটে?

লম্বাই হবে সে।

সত্যিই তাকে আপনি চিনতে পারেন নি?

না।