যে লাইব্রেরী ঘরের মধ্যে সকলে তখন উপস্থিত ছিল, সেই ঘরেরই পশ্চিম কোণে একটা বদ্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে বৃন্দাবনবাবুর দিকে সহসা চোখের ইঙ্গিত করে কিরীটী প্রশ্ন করল একসময়, ঘরের ঐ দরজাটা কিসের বৃন্দাবনবাবু? ঐ দরজা-পথে কোথায় যাওয়া যায়?
এই ঘরের সঙ্গেই ছোট একটা অ্যান্টিরুম মত আছে। সেই অ্যান্টিরুমে যাবারই দরজা ওটা। মধুসূদন সরকারই কথাটার জবাব দিলেন।
আই সি! ওটা কি ব্যবহৃত হত?
কাকাই ওটা ব্যবহার করতেন। এবার জবাব দিলেন বৃন্দাবনবাবু।
সারদাবাবু!
হ্যাঁ। কাকার বাগান ও ফুলগাছের—বিশেষ করে নানাজাতীয় গোলাপের খুব শখ ছিল। ঐ ঘরটার মধ্যে সেই সব গোলাপ গাছে কি সব সার-টার কাকার থাকত।
কৌতূহলী কিরীটী আর দ্বিতীয় প্রশ্ন না করে নিঃশব্দে সেই অ্যান্টিরুমের দরজার দিকে এবার এগিয়ে গেল সোফা থেকে উঠে।
ঘরের দরজা বরাবর গিয়েছে কিরীটী, সহসা পশ্চাৎ দিক থেকে বিমল সেন বলল, মিঃ রায়, আপনার যদি আপত্তি না থাকে তো আমি থানায় এবারে ফিরে যেতে চাই। সেখানে আমার অনেক কাজ জমা হয়ে আছে।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
সন্ধ্যাবেলা ওদিকে আসবেন নাকি?
যাব।
তাহলে একটু না হয় বেলাবেলিই আসবেন, ওখানেই চা খাবেন। বিমল সেন বলে।
বেশ তো।
সুশান্ত, তাহলে কিরীটীবাবুকে আমার ওখানে নিয়ে এস।
যাব। সুশান্ত বললে।
বিমল সেন অতঃপর ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী এবারে বন্ধ দরজাটা ঠেলে অ্যান্টিরুমের মধ্যে প্রবেশ করল।
সুশান্তও তাকে অনুসরণ করল।
বাকি সব লাইব্রেরী ঘরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল।
অ্যান্টিরুমটা আকারে একেবারে খুব ছোট নয়।
লম্বায় প্রায় আট ফুট ও পাশে চার ফুট। এবং ঘরটার মধ্যে প্রবেশ করে পূর্বদিকের জানলাটা খুলে দিতেই পর্যাপ্ত আলোয় ঘরটি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
সেই সঙ্গে কিরীটীর অনুসন্ধানী ও সজাগ দৃষ্টির সামনে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে সমগ্র ঘরের পরিবেশটা।
একটি দেওয়াল-সংলগ্ন কাঁচের দেওয়াল-আলমারি। ঘরের মধ্যে তার সামনে একটি লম্বা ধরনের উঁচু টেবিল।
টেবিলের সামনে একটা বসবার টুল। টেবিলটার উপরে ওয়েয়িং অ্যাপারেটাস, ফানেল, র্যাকে টেস্ট-টিউব, স্পিরিট ল্যাম্প ইত্যাদি নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক টুকিটাকি যন্ত্রপাতি রয়েছে দেখা গেল।
কাঁচের আলমারির মধ্যে নানা আকারের বেঁটে, গোল, মোটা, লম্বা অনেকগুলো শিশি সাজানো।
তার মধ্যে কোনটায় তরল পদার্থ, কোনটায় চূর্ণ প্রভৃতি নানাজাতীয় দ্রব্য দেখা যাচ্ছে।
ঘরের চারিদিকে আর একবার দৃষ্টিপাত করে কিরীটী এগিয়ে গিয়ে এবার দেওয়াল-আলমারির পিতলের কড়া লাগানো পাল্লাটা টানতেই পাল্লা দুটো খুলে গেল।
সামনেই একটা বড় বোতল নজরে পড়ে কিরীটীর।
কালো রঙের বোতলটা। বোতলের গায়ে লেবেল আঁটা। এবং লেবেলের গায়ে বড় বড় অক্ষরে ইংরাজীতে লেখা–রোজ স্প্রেয়িং সলুশন।
কি খেয়াল হল কিরীটীর, বোতলটা একবার হাতে তুলে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো।
তার পাশেই আর একটা বোতলে সাদা চুর্ণ ভর্তি। তার গায়ে লেখা আছে বোন মিল। অর্থাৎ হাড়ের গুঁড়ো। সে বোতলটাও একবার নেড়েচেড়ে দেখে রেখে দিল কিরীটী যথাস্থানে।
তার পাশের শিশিটার গায়ে অ্যামোনিয়াম সালফেট লেবেল আঁটা।
সহসা ঐসময় পশ্চাতে বৃন্দাবন সরকারের কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকালো কিরীটী তার দিকে।
এই ঘরটা কাকার নিজস্ব ল্যাবরেটারী ছিল। বৃন্দাবন সরকার বললেন।
ল্যাবরেটারী!
হ্যাঁ, ঐরকমই খানিকটা। এ বাড়ির পিছনে মস্ত বড় একটা নিজের হাতে তৈরী ফুলের বাগান আছে মিঃ রায়, আপনি দেখেননি। আর ঐ বাগানে বেশীর ভাগই হচ্ছে নানাজাতীয় গোলাপের গাছ। অনেক টাকা খরচ করে দেশ-দেশান্তর থেকে নানা জাতের গোলাপ গাছ বহুদিন ধরে সংগ্রহ করে ঐ বাগানে লাগিয়েছিলেন।
হুঁ। তাহলে দেখছি আপনার কাকা সারদাবাবুর গোলাপ গাছের একটা রীতিমত নেশা ছিল বলুন? কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
হ্যাঁ, ঐ একটি ও বই পড়া—এ দুটি নেশাই তাঁর ছিল। তার মধ্যে আবার গোলাপ গাছের নেশাটা ছিল একটু বেশী। নানা বই পড়ে পড়ে নানা ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে, নিজেই তাঁর এই ল্যাবরেটারী ঘরে বসে, গোলাপ গাছের সার তৈরী করে সেই সব সার তার সব গাছের গোড়ায় দিতেন।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলে, তাই দেখছি, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সার তৈরী করে তিনি কাজে লাগাতেন। হ্যাঁ ভাল কথা বৃন্দাবনবাবু, আপনার কাকা লেখাপড়া কতদূর করেছিলেন?
ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স।
অতঃপর কিরীটী ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, চলুন এ ঘরটা আমার দেখা হয়ে গিয়েছে।
পুনরায় হলঘরেই অর্থাৎ পূর্বেকার লাইব্রেরী ঘরেই সকলে ফিরে এল।
মধুসূদন সরকার ঐসময় লাইব্রেরী ঘরে ছিলেন না।
বৃন্দাবনবাবুর দিকে তাকিয়েই কিরীটী বললে, শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই যে বৃন্দাবনবাবু, তিনি তো শুনেছি এখানেই আছেন
হ্যাঁ, তবে কাকার মৃত্যুর পর থেকে তিনি ঘর থেকে বড় একটা বেরও হন না, কারও সঙ্গে কথাবার্তাও বলেন না। ডেকে পাঠাব কি এ ঘরে?
কোন্ ঘরে আছেন তিনি?
এ ঘরেরই পাশের ঘরে তিনি থাকেন।
বেশ, একটিবার খবর পাঠান যে আমি তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই, তার অসুবিধা না হলে।
বৃন্দাবন সরকার ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
মিনিট দশেকের মধ্যেই বৃন্দাবন সরকার ফিরে এলেন, চলুন মিঃ রায়।
কিরীটী ঐসময় দাঁড়িয়ে খোলা জানলার সামনে বাইরের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে পাইপ টানছিল, বৃন্দাবন সরকারের ডাকে ফিরে তাকালো।
তাঁর ঘরেই তিনি আছেন, সেখানেই চলুন।
চলুন। বলে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে বৃন্দাবন সরকারের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, একটি কথা বৃন্দাবনবাবু–
বলুন?
ওঁর সঙ্গে যখন আমি কথা বলব, তখন একমাত্র সুশান্তবাবু ছাড়া সেখানে অন্য কেউ থাকেন আমার ইচ্ছা নয়।
মুহূর্তকাল বৃন্দাবন সরকার চুপ করে রইলেন। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, বেশ তাই হবে, তবে একটা রিকোয়েস্ট জানাব আপনাকে।
নিশ্চয়ই, বলুন!
কাকার মৃত্যুতে উনি বড় শক পেয়েছেন, সেই কারণেই আজ পর্যন্ত ওঁকে আমরা কেউই এখান থেকে যাবার কথা পর্যন্ত বলিনি…
ও!
হ্যাঁ, উনি নিজে থেকে যেদিন যাবেন যাবেন—তাই বলছিলাম এমন কোন কথা ওঁকে জিজ্ঞাসা করবেন না যাতে করে উনি মনে ব্যথা পান বা ওঁর কোনরূপ বিরক্তির কারণ ঘটে।
মুহূর্তকাল বৃন্দাবন সরকারের মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে মৃদকণ্ঠে কিরীটী বললে, তাই হবে। চলুন।