মানবীয় ভাষায় প্রেমের এই সর্বোচ্চ আদর্শ প্রকাশ করা অসম্ভব। উচ্চতম মানব-কল্পনাও উহার অনন্ত পূর্ণতা ও সৌন্দর্য অনুভব করিতে অক্ষম। তথাপি সর্বদেশের নিম্ন ও উচ্চ ভাবের প্রেমধর্মের সাধকগণকে তাঁহাদের প্রেমের আদর্শ বুঝিতে বা বুঝাইতে চিরকালই এই অনুপযোগী মানবীয় ভাষা ব্যবহার করিতে হইয়াছে। শুধু তাহাই নয়, বিভিন্ন প্রকারের মানবীয় প্রেমই এই অব্যক্ত ভগবৎ-প্রেমের প্রতীকরূপে গৃহীত হইয়াছে। মানব ঐশ্বরিক বিষয়সমূহ নিজের মানবীয় ভাবেই চিন্তা করিতে পারে, এবং সেই পূর্ণ কেবল আমাদের আপেক্ষিক ভাষাতেই আমাদের নিকট প্রকাশিত হইতে পারে। সমুদয় জগৎ আমাদের নিকট যেন সীমার ভাষায় লেখা অসীমের কথা। এই কারণেই ভক্তেরা ভগবান্ ও তাঁহার উপাসনা-বিষয়ে লৌকিক প্রেমের লৌকিক ভাষা ও শব্দসমূহ ব্যবহার করিয়া থাকেন।
পরাভক্তির কয়েকজন শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাতা এই দিব্য প্রেম বিভিন্ন উপায়ে বুঝিতে বা বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন। ইহার মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থাকে ‘শান্ত ভক্তি’ বলে। যখন মানুষের হৃদয়ে প্রেমাগ্নি প্রজ্বলিত হয় নাই, বাহ্য অনুষ্ঠানমূলক প্রতীকোপাসনা অপেক্ষা একটু উন্নত সাধারণ শান্ত ভালবাসার উদয় হইয়াছে মাত্র, উহাতে তীব্রবেগসম্পন্ন প্রেমের উন্মত্ততা মোটেই নাই, তখন ঐ ভাবকে ‘শান্ত ভক্তি’ বলে। দেখিতে পাই, জগতে কতক লোক আছেন, তাঁহারা ধীরে ধীরে সাধনপথে অগ্রসর হইতে ভালবাসেন, আর কিছু লোক আছেন, তাঁহারা ঝড়ের মত বেগে চলিয়া যান। ‘শান্ত-ভক্ত’ ধীর শান্ত নম্র। তদপেক্ষা একটু উচ্চতর ভাব—‘দাস্য’; এ অবস্থায় মানুষ নিজেকে ঈশ্বরের দাস ভাবে। বিশ্বাসী ভৃত্যের প্রভুভক্তিই তাঁহার আদর্শ।
তার পর ‘সখ্য-প্রেম’—এই সখ্য-প্রেমের সাধক ভগবানকে বলিয়া থাকেন, ‘তুমি আমার প্রাণের সখা।’১৪ এরূপ ভক্ত ভগবানের কাছে হৃদয় উন্মুক্ত করে, যেমন মানুষ বন্ধুর নিকট নিজের হৃদয় খোলে, এবং জানে—বন্ধু তাহার দোষের জন্য তাহাকে কখনই তিরস্কার করিবে না, বরং সর্বদায় সাহায্য করিতে চেষ্টা করিবে। বন্ধুদ্বয়ের মধ্যে যেমন একটা সমান সমান ভাব থাকে, সেইরূপ সখ্য-প্রেমের সাধক ও তাঁহার সখারূপ ভগবানের মধ্যে একটা সমভাবের আদান প্রদান চলিতে থাকে। সুতরাং ভগবান্ আমাদের হৃদয়ের অতি সন্নিহিত বন্ধু হইলেন—সেই বন্ধুর নিকট আমরা আমাদের জীবনের সব কথা খুলিয়া বলিতে পারি, আমাদের অন্তরের গভীরতম প্রদেশের গুপ্তভাবগুলি তাঁহার নিকট জানাইতে পারি। সম্পূর্ণ ভরসা আছে যে, তিনি যাহাতে আমাদের মঙ্গল হয়, তাহাই করিবেন। এই ভাবিয়া আমরা একেবারে নিশ্চিন্ত হইতে পারি। এ-অবস্থায় ভক্ত ভগবানকে তাঁহার সমান মনে করেন। ভগবান্ যেন আমাদের খেলার সাথী, আমরা সকলে যেন এই জগতে খেলা করিতেছি। ছেলেরা যেমন খেলা করে, যেমন মহামহিমান্বিত রাজামহারাজাগণও যেমন নিজ নিজ খেলা খেলিয়া যান, সেইরূপ প্রেমময় ভগবান্ও নিজ জগতের সহিত খেলা করিতেছেন। তিনি পূর্ণ, তাঁহার কিছুরই অভাব নাই। তাঁহার সৃষ্টি করিবার প্রযোজন কি? আমরা কার্য করি, তাহার উদ্দেশ্য কোন অভাবপূরণ, আর অভাব বলিতেই অসম্পূর্ণতা বুঝায়। ভগবান্ পূর্ণ, তাঁহার কোন অভাব নাই। কেন তিনি এই নিয়ত কর্মময় সৃষ্টি লইয়া ব্যস্ত থাকেন? তাঁহার উদ্দেশ্য কি? ভগবানের সৃষ্টির উদ্দেশ্য-বিষয়ে আমরা যে-সকল উপন্যাস কল্পনা করি, সেগুলি গল্প-হিসাবে সুন্দর হইতে পারে, কিন্তু ঐগুলির অন্য কোন মূল্য নাই। বাস্তবিক সবই তাঁহার লীলা বা খেলা। এই জগৎ তাঁহার খেলা—ক্রমাগত এই খেলা চলিতেছে। তাঁহার পক্ষে সমুদয় জগৎ নিশ্চয়ই শেষ পর্যন্ত একটি মজার খেলামাত্র। যদি তুমি দরিদ্র হও, তবে দারিদ্র্যকেই একটি কৌতুক বলিয়া উপভোগ কর; যদি ধনী হও, তবে ঐ অবস্থাও আর একটি তামাশারূপে সম্ভোগ কর। বিপদ আসে তো বেশ মজা, আবার সুখ আসিলে মনে করিতে হইবে, এ আরও মজা। সংসার একটি ক্রীড়াক্ষেত্র—আমরা এখানে বেশ নানারূপ কৌতুক উপভোগ করিতেছি—যেন খেলা হইতেছে, আর ভগবান্ আমাদের সহিত সর্বদাই খেলা করিতেছেন, আমরাও তাঁহার সহিত খেলিতেছি। ভগবান্ আমাদের অনন্তকালের খেলার সাথী, কেমন সুন্দর খেলা খেলিতেছেন! খেলা সাঙ্গ হইল—এক যুগ শেষ হইল। তারপর অল্পাধিক সময়ের জন্য বিশ্রাম—তারপর আবার খেলা আরম্ভ—আবার জগতের সৃষ্টি! যখন ভুলিয়া যাও সবই খেলা, আর তুমিও এ-খেলার সহায়ক, তখনই—কেবল তখনই দুঃখকষ্ট আসিয়া উপস্থিত হয়; তখনই হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়, আর সংসার তোমার উপর প্রচণ্ড শক্তিতে চাপিয়া বসে। কিন্তু যখনই তুমি এই দু-দণ্ড জীবনের পরিবর্তনশীল ঘটনাবলীতে সত্যবুদ্ধি ত্যাগ কর, আর যখন সংসারকে লীলাভূমি ও নিজদিগকে তাঁহার লীলাসহায়ক বলিয়া মনে কর, তখনই তোমার দুঃখ চলিয়া যাইবে। প্রতি অণুতে তিনি খেলা করিতেছেন। তিনি খেলা করিতে করিতে পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র প্রভৃতি নির্মাণ করিতেছেন। তিনি মনুষ্যহৃদয়, প্রাণী ও উদ্ভিদ্সমূহের সহিত খেলা করিতেছেন। আমরা যেন তাঁহার হাতে দাবাবোড়ের ঘুঁটি, একটি ছকে বসাইয়া তিনি যেন সেগুলি চালিতেছেন। তিনি আমাদিগকে প্রথমে একদিকে, পরে অপরদিকে সাজাইতেছেন—আমরাও জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তাঁহারই খেলার সহায়ক। কি আনন্দ! আমরা তাঁহার খেলার সহায়ক।
পরবর্তী ভাবকে ‘বাৎসল্য’ বলে। উহাতে ভগবানকে পিতা না ভাবিয়া সন্তান ভাবিতে হয়। এটি কিছু নূতন রকমের বোধ হইতে পারে, কিন্তু উহার উদ্দেশ্য ঈশ্বর সম্বন্ধে আমাদের ধারণা হইতে ঐশ্বর্যের ভাবগুলি দূর করা। ঐশ্বর্য-ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই ভয় আসে। ভালবাসায় কিন্তু ভয় থাকা ঠিক নয়। চরিত্র-গঠনের জন্য ভক্তি ও আজ্ঞাবহতা অভ্যাস করা আবশ্যক বটে, কিন্তু একবার চরিত্র গঠিত হইয়া গেলে প্রেমিক যখন শান্ত-প্রেমের একটু আস্বাদ পান, আবার প্রেমের তীব্র উন্মত্ততাও কিছু আস্বাদ করেন, তখন তাঁহার আর নীতিশাস্ত্র, বিধিনিয়ম প্রভৃতির কিছুমাত্র প্রয়োজন থাকে না। ভক্ত বলেন, আমি ভগবানকে মহামহিম, ঐশ্বর্যশালী, জগদীশ্বর দেবদেবরূপে ভাবিতে চাই না। ভগবানের ধারণা হইতে এই ভয়োৎপাদক ঐশ্বর্যভাব দূর করিবার জন্য তিনি ভগবানকে নিজ শিশুসন্তান-রূপে ভালবাসেন। মাতাপিতা সন্তানকে ভয় করেন না, তাহার প্রতি তাঁহাদের ভক্তিও হয় না। সন্তানের কাছে তাঁহাদের প্রার্থনা করিবারও কিছু থাকে না। সন্তান সর্বদাই গ্রহীতা, সন্তানের প্রতি ভালবাসার জন্য মাতাপিতা শত শতবার শরীর ত্যাগ করিতে প্রস্তুত। তাঁহাদের একটি সন্তানের জন্য তাঁহারা সহস্র জীবন উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত। এই ভাব হইতে ভগবানকে বাৎসল্যভাবে ভালবাসা হয়। যে-সকল ধর্মসম্প্রদায় বিশ্বাস করেন, ভগবান্ নরদেহে অবতীর্ণ হন, তাঁহাদের মধ্যেই এই বাৎসল্যভাবে উপাসনা স্বাভাবিক। মুসলমানদের পক্ষে ভগবানকে বাৎসল্যভাবে উপাসনা করা অসম্ভব, তাঁহারা ভয়ে এ-ভাব হইতে দূরে সরিয়া যাইবেন। কিন্তু খ্রীষ্টান ও হিন্দু সহজেই ইহা বুঝিতে পারেন, কারণ তাঁহাদের মাতৃক্রোড়ে যীশু ও কৃষ্ণের শিশুমূর্তি রহিয়াছে। ভারতীয় নারীগণ অনেক সময় নিজদিগকে শ্রীকৃষ্ণের মাতা বলিয়া চিন্তা করেন; খ্রীষ্টান জননীগণও নিজদিগকে খ্রীষ্টের মাতা বলিয়া চিন্তা করিতে পারেন। ইহা হইতে পাশ্চাত্যের লোকেরা ঈশ্বরের মাতৃভাব সম্বন্ধেও জানিতে পারিবেন; আর ইহা তাঁহাদের বিশেষ প্রয়োজন। ভগবানের প্রতি ভয়ভক্তিরূপ কুসংস্কার আমাদের অন্তরের অন্তস্তলে দৃঢ়মূল হইয়া আছে। এই ভয়মিশ্রিত ভক্তি, ঐশ্বর্য ও মহিমার ভাব প্রেমে একেবারে নিমজ্জিত করিয়া দিতে অনেক দিন লাগে।
মানবীয় ভাবের আর একটি রূপে ভগবৎ-প্রেমের আদর্শ প্রকাশিত হইয়াছে, উহার নাম ‘মধুর’-ভাব, সর্বপ্রকার ভাবের মধ্যে উহাই শ্রেষ্ঠ। এ- সংসারে প্রকাশিত সর্বোচ্চ প্রেমের উপর উহার ভিত্তি—আর মানবীয় অভিজ্ঞতায় যত প্রকার প্রেম আছে, তাহার মধ্যে উহাই উচ্চতম ও প্রবলতম। স্ত্রী-পুরুষের প্রেম যেরূপ মানুষের সমুদয় প্রকৃতিকে ওলট-পালট করিয়া দেয়, আর কোন্ প্রেম সেরূপ করিতে পারে? কোন্ প্রেম মানুষের প্রতিটি পরমাণুর মধ্য দিয়া সঞ্চারিত হইয়া তাহাকে পাগল করিয়া তুলে?—তাহার নিজের প্রকৃতি ভুলাইয়া দেয়?—মানুষকে হয় দেবতা, নয় পশু করিয়া ফেলে? দিব্য প্রেমের এই মধুরভাবে ভগবান্ আমাদের পতি। আমরা সকলে স্ত্রী বা প্রকৃতি, জগতে পুরুষ আর কেহ নাই। একমাত্র পুরুষ আছেন—তিনিই, আমাদের সেই প্রেমাস্পদই একমাত্র পুরুষ। পুরুষ নারীকে এবং নারী পুরুষকে যে ভালবাসা দিয়া থাকে, সেই ভালবাসা ভগবানকে অর্পণ করিতে হইবে।
আমরা জগতে যত প্রকার প্রেম দেখিতে পাই, যাহা লইয়া আমরা অল্পাধিক পরিমাণে খেলাই করিতেছি, ভগবান্ই সেগুলির একমাত্র লক্ষ্য। তবে দুঃখের বিষয়, যে অনন্ত সমুদ্রে এই প্রেমের প্রবল স্রোতস্বতী অবিরতভাবে প্রবাহিত হইতেছে, মানব তাহা জানে না; সুতরাং নির্বোধের ন্যায় সে মানুষরূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুতুলের প্রতি উহা প্রয়োগ করিতে চেষ্টা করে। মানব-প্রকৃতিতে সন্তানের প্রতি যে প্রবল স্নেহ দেখা যায়, তাহা কেবল একটি সন্তানরূপ ক্ষুদ্র পুতুলের জন্য নয়; যদি তুমি অন্ধভাবে ঐ একটিমাত্র সন্তানের উপরই উহা প্রয়োগ কর, তবে সেজন্য তোমাকে বিশেষ কষ্ট পাইতে হইবে। কিন্তু ঐ কষ্টবোধ হইতেই তোমার এই বোধ আসিবে, তোমার ভিতর যে-প্রেম আছে, তাহা যদি কোন মনুষ্যে প্রয়োগ কর, তবে শীঘ্রই হউক বা বিলম্বেই হউক, মনে দুঃখ ও বেদনা পাইবে। অতএব আমাদের প্রেম সেই পুরুষোত্তমকেই দিতে হইবে—যাঁহার বিনাশ নাই, যাঁহার কখনও কোন পরিবর্তন নাই, যাঁহার প্রেমসমুদ্রে জোয়ার-ভাঁটা নাই। প্রেম যেন তাঁহার প্রকৃত লক্ষ্যে উপনীত হয়, যেন উহা ভগবানের নিকট পৌঁছায়—যিনি প্রকৃতপক্ষে প্রেমের অনন্ত সমুদ্রস্বরূপ, প্রেম যেন তাঁহারই নিকট পৌঁছায়। সকল নদীই সমুদ্রে গিয়া পড়ে, একটি জলবিন্দুও পর্বতগাত্র হইতে পতিত হইয়া নদীতে থামিতে পারে না, ঐ নদী যত বড়ই হউক না কেন! অবশেষে সেই জলবিন্দু কোন না কোনরূপে সমুদ্রে যাইবার পথ করিয়া লয়। ভগবান্ই আমাদের সর্বপ্রকার ভাবাবেগের একমাত্র লক্ষ্য। যদি রাগ করিতে চাও, ভগবানের উপর রাগ কর। তোমার প্রেমাস্পদকে তিরস্কার কর, বন্ধুকে ভর্ৎসনা কর; আর কাহাকে তুমি নির্ভয়ে তিরস্কার করিতে পার? মর্ত্য-জীব তোমার রাগ সহ্য করিবে না; প্রতিক্রিয়া আসিবেই। যদি তুমি আমার উপর ক্রুদ্ধ হও, আমিও অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে তোমার উপর ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিব, কারণ আমি তোমার ক্রোধ সহ্য করিতে পারিব না। তোমার প্রেমাস্পদকে বলো, ‘তুমি আমার কাছে কেন আসিতেছ না? কেন তুমি আমাকে এভাবে একা ফেলিয়া রাখিয়াছ?’ ভগবান্ ছাড়া আর কিসে আনন্দ আছে? ছোট ছোট মাটির টিপিতে আর কি সুখ? অনন্ত আনন্দের ঘনীভূত ভাবকেই অন্বেষণ করিতে হইবে—ভগবান্ই এই আনন্দের ঘনীভূত ভাব। আমাদের সকল ভাবাবেগ যেন তাঁহারই সমীপে উন্নীত হয়। ঐগুলি তাহারই জন্য অভিপ্রেত; লক্ষ্যভ্রষ্ট হইলে ঐগুলি নীচভাবে পরিণত হয়; সোজা লক্ষ্যস্থলে অর্থাৎ ঈশ্বরের নিকট পৌঁছিলে অতি নিম্নতম বৃত্তি পর্যন্ত রূপান্তরিত হয়। মানুষের শরীর ও মনের সমুদয় শক্তি যেভাবেই প্রকাশিত হউক না কেন, ভগবান্ই উহাদের একমাত্র লক্ষ্য—‘একায়ন’। মনুষ্যহৃদয়ের সব ভালবাসা—সব প্রবৃত্তি যেন ভগবানের দিকেই যায়; তিনিই একমাত্র প্রেমাস্পদ। এই হৃদয় আর কাহাকে ভালবাসিবে? তিনিই পরম সুন্দর, পরম মহীয়ান—সৌন্দর্যস্বরূপ, মহত্ত্বস্বরূপ। তাঁহা অপেক্ষা সুন্দর জগতে আর কে আছে? তিনি ব্যতীত স্বামী হইবার উপযুক্ত জগতে আর কে আছে? জগতে ভালবাসার উপযুক্ত পাত্র আর কে আছে? অতএব তিনিই যেন আমাদের স্বামী হন, তিনিই যেন আমাদের প্রেমাস্পদ হন।
অনেক সময় দেখা যায়, দিব্যপ্রেমে মাতোয়ারা ভক্তগণ এই ভগবৎপ্রেম বর্ণনা করিতে গিয়া সর্বপ্রকার মানবীয় প্রেমের ভাষাই ব্যবহার করিয়া থাকেন, উহাকেই যথেষ্ট উপযোগী মনে করেন। মূর্খেরা ইহা বুঝে না—তাহারা কখনও ইহা বুঝিবে না। তাহারা উহা কেবল জড়দৃষ্টিতে দেখিয়া থাকে। তাহারা এই আধ্যাত্মিক প্রেমোন্মত্ততা বুঝিতে পারে না। কেমন করিয়া বুঝিবে? ‘হে প্রিয়তম, তোমার অধরের একটিমাত্র চুম্বন! যাহাকে তুমি একবার চুম্বন করিয়াছ, তোমার জন্য তাহার পিপাসা বর্ধিত হইয়া থাকে। তাহার সকল দুঃখ চলিয়া যায়। সে তোমা ব্যতীত আর সব ভুলিয়া যায়।’১৫ প্রিয়তমের সেই চুম্বন—তাঁহার অধরের সহিত সেই স্পর্শের জন্য ব্যাকুল হও—যাহা ভক্তকে পাগল করিয়া দেয়, যাহা মানুষকে দেবতা করিয়া তুলে। ভগবান্ যাঁহাকে একবার তাঁহার অধরামৃত দিয়া কৃতার্থ করিয়াছেন, তাঁহার সমুদয় প্রকৃতিই পরিবর্তিত হইয়া যায়। তাঁহার পক্ষে জগৎ অন্তর্হিত হয়—তাঁহার পক্ষে সূর্য-চন্দ্রের আর অস্তিত্ব থাকে না, সমগ্র জগৎপ্রপঞ্চই সেই এক অনন্ত প্রেমের সমুদ্রে বিগলিত হইয়া যায়। ইহাই প্রেমোন্মত্ততার চরম অবস্থা।
প্রকৃত ভগবৎ-প্রেমিক আবার ইহাতেও সন্তুষ্ট নন। স্বামী-স্ত্রীর প্রেমও তাঁহার নিকট তত উন্মাদক নয়। ভক্তেরা অবৈধ (পরকীয়) প্রেমের ভাব গ্রহণ করিয়া থাকেন, কারণ উহা অতিশয় প্রবল। উহার অবৈধতা তাঁহাদের লক্ষ্য নয়। এই প্রেমের প্রকৃতি এই যে, যতই উহা বাধা পায়, ততই উগ্রভাব ধারণ করে। স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা সহজ স্বচ্ছন্দ—উহাতে কোন বাধাবিঘ্ন নাই। সেই জন্য ভক্তেরা কল্পনা করেন, যেন কোন নারী তাঁহার প্রিয়তম পুরুষে আসক্ত, এবং তাঁহার পিতা, মাতা বা স্বামী ঐ প্রেমের বিরোধী। যতই ঐ প্রেম বাধাপ্রাপ্ত হয়, ততই উহা প্রবল ভাব ধারণ করিতে থাকে। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে কিরূপ লীলা করিতেন, কিরূপে সকলে উন্মত্ত হইয়া তাঁহাকে ভালবাসিত, কিরূপে তাঁহার কণ্ঠস্বর শুনিবামাত্র গোপীরা—সেই ভাগ্যবতী গোপীরা সবকিছু ভুলিয়া—জগৎ ভুলিয়া, জগতের সকল বন্ধন, সাংসারিক কর্তব্য, সংসারের সুখদুঃখ ভুলিয়া—তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিত, মানবীয় ভাষা তাহা প্রকাশ করিতে অক্ষম। মানুষ—মানুষ, তুমি ভগবৎ-প্রেমের কথা বলো, আবার জগতের সব অসার বিষয়ে নিযুক্ত থাকিতেও পার; তোমার কি মন মুখ এক? ‘যেখানে রাম আছেন, সেখানে কাম থাকিতে পারে না। যেখানে কাম, সেখানে রাম থাকিতে পারেন না; এই দুইটি কখনও একত্র থাকে না। আলো এবং অন্ধকার (রবি ও রজনী) কখনও একসঙ্গে থাকে না।’১৬