মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল টুপুরের। ভুটভুট শব্দ হচ্ছে একটানা। কয়েক সেকেন্ড উৎকর্ণ হয়ে টুপুর শুনল আওয়াজটা। কীসের আওয়াজ? সেই মোটরসাইকেলটা এল নাকি?
সহেলি আর অবনী অকাতরে ঘুমিয়ে। কৌতূহল দমন করতে পারছে না টুপুর, মশারি সরিয়ে সন্তৰ্পণে নামল চৌকি থেকে। রাতের দিকে ভালই ঠাণ্ডা পড়ছে থলকোবাদে, গায়ে একখানা চাদর জড়িয়ে নিল টুপুর। দরজা খুলতে গিয়েও থামল একটু। ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে। কমানো আছে পলতেটা। হ্যারিকেনটা নিতে গিয়েও নিল না, দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে বারান্দায়।
বেরিয়েই অবাক! অদূরে ইনস্পেকশন বাংলোয় আলো জ্বলছে! ইলেকট্রিক লাইট। তার মানে শব্দটা মোটরসাইকেলের নয়, জেনারেটরের। এত রাতে কোন ভি আই পি এল ওই বাংলোয়?
.
চাঁদ এখনও ডোবেনি। পরশু পূর্ণিমা পড়ছে, শুক্লপক্ষের মায়াবী জ্যোৎস্নায় ড়ুবে আছে চারদিক। রেস্টহাউসের লাগোয়া কাঁঠালগাছের গায়ে চিকচিক করছে চাঁদের আলো।
অন্ধকার গাঢ় নয় বলেই বুঝি একটু সাহস পেল টুপুর। পায়ে পায়ে বারান্দার ধারে এল। ডিঙি মেরে দেখছে বাংলোর দিকটা।
আচমকা ফিসফিস স্বর, অ্যাই, তুই বেরিয়েছিস কেন?
ভীষণ চমকে উঠল টুপুর। পাঁচ-সাত হাত দূরে, মহুয়াগাছের নীচে একটা ছায়ামূর্তি!
ছায়া গাছের তলা থেকে সরে আসতেই টুপুরের ধড়ে যেন প্ৰাণ এল। প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছে, মিতিনমাসি, তুমি?
মিতিন ঠোঁটে আঙুল রাখল, চুপ, চুপ।
টুপুর চাপা স্বরে বলল, কারা এসেছে গো?
মিতিনের গলা আরও নীচে, বুঝতে পারছি না। খানিকক্ষণ আগে একটা জিপ এল। ডেকে নিয়ে গেল সারগিয়াকে। তারপর থেকেই তো লাইট জ্বলছে…
কে সারগিয়াকে ডেকে নিয়ে গেল?
দেখতে পাইনি মুখটা। সারগিয়া তো ডাইনিং হলে ঘুমোয়, ওকে রান্নাঘরের দিক দিয়ে এসে ডাকছিল। যখন গেট দিয়ে বেরোচ্ছে, তখন শুধু পেছনটা দেখলাম।
জঙ্গলের কোনও অফিসার?
তা হলে পেছনে গিয়ে ডাকবে কেন? সোজাসুজিই তো হাঁক পাড়তে পারে।
হয়তো ডেকেছে। হয়তো সারগিয়ার ঘুম ভাঙেনি।
উহুঁ। জিপটা যখন ঢুকছিল, তখনই আমি জেগে গেছি। ডাকলে শুনতে পেতাম।
তা হলে সারগিয়াকেই জিজ্ঞেস করে দ্যাখো না।
সারগিয়া নেই। সেও এখন ওই বাংলোতেই। ফেরেনি।
তাই?
হুঁ। ভাবছি একবার গিয়ে দেখলে হয়।
যাবে?
দাঁড়া, গায়ের একটা শাল নিয়ে আসি।
শুধু শাল নয়, মিতিন একখানা টর্চও এনেছে ঘর থেকে। তবে টর্চ জ্বালানোর দরকার হল না, চাঁদের আলোয় ছোট ছোট নুড়িপাথরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
টুপুর চলেছে মিতিনের গা ঘেঁষে। মিতিন নিচু গলায় বলল, পায়ে রবারের চটি আছে তো?
হুঁ।
টোয়ে ভর রেখে হাঁট। শব্দ না হয়।
হুঁ।
পাশে পাশে থাক। ভয় পাস না।
হুঁ।
তিরিশ-পয়ত্রিশ গজ নুড়ি বিছানো পথ তুরতুরিয়ে পেরিয়ে গেল দুজনে। আস্তে করে গেট ঠেলে ঢুকল বাংলোর হাতায়। সামান্য ক্যাঁচ শব্দ হয়েছিল, ওইটুকু আওয়াজকেই যে কী প্রকট মনে হল! একটুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে আবার নিঃশব্দ অভিযান।
একটামাত্র ঘরে আলো জ্বলছে। দরজা বন্ধ। জানলার একটা পাট খোলা। পরদা টানা আছে জানলায়। ভেতরে দু-তিনজনের কণ্ঠস্বর।
আশ্চর্য, লোকগুলো পরিষ্কার বাংলায় কথা বলছে।
জানলার কোণে এসে দাঁড়িয়েছে মাসি বোনঝি। পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিল একবার।
চাপা স্বরে কথাবার্তা চলছিল অন্দরে। হঠাৎ একটা চড়া গলা শোনা গেল, আমাকে দোষ দিচ্ছ কেন? ওড়িশা থেকে কি আমি হাতিদের ট্রেল করে এনেছি? দুশো-আড়াইশো কিলোমিটার রাস্তা এল হাতিগুলো, তোমরা কেউ ছুঁতেও পারলে না, এখন দায় আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছ?
চেল্লাচ্ছ কেন? গণ্ডগোল তো তুমিই পাকালে। নিজেই বড় মুখ করে বললে, এটা নাকি তোমার বাঁয়ে হাত কা খেল!
সব নিশানা কি সবসময়ে ঠিকঠাক হয়?
তা হলে দুম করে ফায়ার করলে কেন? নয় আরও এক দুদিন ওয়েট করতাম।
অপেক্ষা করার সময় কোথায়? ওদিকে সিংহমশাইও অস্থির হয়ে উঠেছেন।
তুমি একটি অপদার্থ। তোমার জন্যই টাকাটা হাতছাড়া হবে। এমন একটা ঢ্যাঁড়সকে লাথি মেরে গ্রুপ থেকে বের করে দেওয়া উচিত।
মুখ সামলে, মুখ সামলে। আমি যদি ঢ্যাঁড়স হই, তুই কী? চিচিঙ্গের চামচে চামচিকে।
চোপ। এবার তৃতীয় কণ্ঠ মুখর হল। স্বরটা রীতিমত জলদগম্ভীর, তোরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করবি? না চুপচাপ শুনবি প্ল্যানটা?
ও কেন এইভাবে কথা বলছে?
বেশ করব বলব। হাজারবার বলব।
ফের ঝগড়া? এবার কিন্তু তোদের দুজনকেই…
ভারী গলা থেমে গেল। বাকি দুজনও চুপ।
জানলার পাল্লা আর দরজার ফাঁকটুকু দিয়ে মিতিন দেখল সারগিয়া ঢুকেছে ঘরে। দুহাতে দুটো পকোড়া ভর্তি কাচের প্লেট। টেবিলে মদ আর সোডার বোতল, সেগুলোকে সরিয়ে পকোড়ার প্লেট রাখল টেবিলে। ওপাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে ফিরেছে। হাতে জলের জগ আর তিনখানা গ্লাস। জগ গ্লাস টেবিলে রেখে দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ।
ভারী গলার লোকটা বলল, কেয়া মাংতা? ভাগ হিঁয়াসে।
সারগিয়া বিনীতভাবে বলল, অউর কুছ চাহিয়ে সাব?
নেহি। তু যাকে সো যা। হামলোগ অউর আধা ঘণ্টা ঠহেরেঙ্গে। হামলোগ যানে কে বাদ জেনারেটার অফ কর দেনা। ঠিক হ্যায়?
সারগিয়া তবু দাঁড়িয়ে আছে।
ভারী গলার লোকটা পার্স থেকে টাকা বার করে বাড়িয়ে দিল, লে। পাঁচশো রুপিয়া হ্যায়, চলেগা?
জি সাব! হাঁ সাব।
সারগিয়া বেরিয়ে যাচ্ছে, ভারী গলা পিছু ডাকল, সুন?
জি সাব?
উয়ো বাত ইয়াদ নেহি রাখনা। ভুল যা। হামলোগ বুরা আদমি নেহি হ্যায় রে। জরা মস্তি করেঙ্গে, ব্যস।
এবার আর জি হাঁ কিছু বলল না সারগিয়া। চুপচাপ বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
মিতিন একজনেরও মুখ দেখতে পাচ্ছিল না। তিনজনে তিনটে বেতের চেয়ারে বসেছে, জানলার দিকে পিছন করে। দুজনের গায়ে চামড়ার জ্যাকেট, একজন ফুলস্লিভ সোয়েটার। সোয়েটার পরাটাই দলপতি, সে বসেছে মাঝখানে। বাকিরা দুপাশে।
ডানদিকের লোকটা বোতল খুলে গ্লাসে গ্লাসে মদ ঢালছে। ওপেনার দিয়ে ফটাস ফটাস সোডা খুলল। মেশাচ্ছে মদে।
দলপতি হাতে গ্লাস তুলে নিতেই অন্য দুজনও পানীয় নিয়েছে হাতে। গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়ে চিয়ার্স বলে উঠল।
টুপুর মিতিনের কানে কানে বলল, এইমাত্র ঝগড়া হচ্ছিল না?
মিতিন টুপুরের ঠোঁটে হাত চাপা দিল, চুপ।
দলপতির ভারী গলা গমগম করল আবার, ভাল করে প্ল্যানটা শুনে নাও। এটাই লাস্ট চান্স। আর যেন কোনও ভুলচুক না হয়। আমাদের হাতে আর দুদিন মাত্র সময় আছে। পরশু রাতের মধ্যে কাজ হাসিল করতেই হবে।
ডানদিকের লোকটা বলল, পারব। ও যদি না গুবলেট করে।
কেউ কাউকে দোষ দেবে না। টাকা সমান পাচ্ছ, টিম হয়ে কাজ করো। লিগিরদা গিয়ে তিনজনকে তিনটে পজিশান নিতে হবে। নুন ঢেলে দিয়ে তুমি চলে যাবে টিলার মাথায়। আঙুল তুলে ডানদিকের লোকটাকে নির্দেশ দিল দলপতি। বাঁদিকের লোকটার পিছে একটা হাত রেখে বলল, তুমি থাকবে জঙ্গলের সাইডে।
আর আপনি?
আমি টাওয়ারে। তোমরা মিস করলে ফাইনাল শট তো আমাকেই মারতে হবে।
দাঁত দুটো কীভাবে নিয়ে যাওয়া হবে?
সে ভাবনা তোমাদের নয়। ওটা আমার আর সিংহমশায়ের ওপর ছেড়ে দাও।
আমি জানি। ডানদিকের লোকটা ফস করে বলল, রাউরকেলা থেকে কনসাইনমেন্ট বুক করা আছে।
তুমি একটু বেশিই জেনে ফেলেছ হালদার। ভারী স্বর চাবুকের মতো শোনাল, তুমি জানো, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জানা আমি পছন্দ করি না?
ভুল হয়ে গেছে স্যার। মাফ করে দিন।
তোর তো সবসময়ে ভুল হয়। আড়াইশো কিলোমিটার ছুটেও একটা হাতির লেজ ছুঁতে পারি না।
আবার ঝগড়া? দলপতি ধমকে উঠল। বাঁদিকের লোকটাকে বলল, শোনো গোলদার, আজকে হাতি মরল তো ভাল। তুমি বেঁচে গেলে। নইলে কাল আমি তোমার ওপরেই টিপ প্র্যাকটিস করব।
যদি হাতি আজ আদৌ না আসে?
তা হলে তুমি কাল সারাদিন টিপ প্র্যাকটিস করবে।
আর কোনও কথা হচ্ছে না। নীরবে পানীয় শেষ করছে তিনজন। গলাগপ পকোড়া খাচ্ছে।
মিতিন নিথর দাঁড়িয়ে থাকা জিপটাকে দেখতে গেল। নড়তে বারণ করল টুপুরকে।
জিপের দরজা খোলা। মিতিন ড্যাশবোর্ড হাতড়াচ্ছে। কিছু কাগজ বার করে টর্চের আলোয় পড়ছে। দুটো কাগজ শালের আড়ালে চালান করে বাকিগুলো রেখে দিল ড্যাশবোর্ডে। ফের ফিরেছে জানলায়।
পানীয় শেষ। সোডা খতম। পকোড়া সাবাড়। তিন মক্কেল উঠে দাঁড়িয়েছে। অনুচর দুজন আড়মোড়া ভাঙল।
টুপুরকে টেনে নিয়ে মিতিন দ্রুত সরে এল বাংলোর পাশে। একেবারে দেওয়াল ঘেঁষে, অন্ধকার ছায়ায়। গাছের ছায়ার চেয়েও এখানে অন্ধকার অনেক বেশি গাঢ়।
একে একে বেরিয়ে এসেছে তিন মূর্তি। চাঁদের আলোয় টুপুর স্পষ্ট দেখতে পেল দলপতির মুখখানা। সেই ঝিনিকপানির মোটরসাইকেল আরোহীটা, যে মুরগি দুটোর ঘাড় মুচড়ে দিয়েছিল। তাই কি ভারী গলাটা চেনা চেনা লাগছিল? দোকানে এসে সিগারেট নিচ্ছিল, মুহুর্তের জন্য হলেও গলাটা কানে এসেছিল টুপুরের।
পিছনের আরোহীটাও আছে। ওই গোলদার। এর স্বর অবশ্য টুপুর অনেক আগেই চিনে ফেলেছে। মেঘাতুবুরুতে শোনা উদ্ধত বাচনভঙ্গি কি সহজে ভোলা যায়।
তবে হালদারকে সে আগে দেখেনি। ওই লোকটা ওড়িশা থেকে হাতিটাকে ধাওয়া করে এসেছে?
এই তিন শয়তাই হাতিটাকে মারার ষড়যন্ত্রী? ইস, লোক তিনটেকে যদি এক্ষুনি ধরে গারদে পুরে ফেলা যেত!
হালদার আর গোলদার টলছে অল্প অল্প। দুজনের হাতেই দুটো করে খালি বোল।
গোলদার একটা বোতল ছুড়ে দিল সামনের খাদে।
অমনই হালদারও একটা বোতল ছুড়েছে। উল্লসিত হয়ে বলল, আমারটা তোর চেয়ে দূরে গেছে।
কী করে বুঝলি?
বোঝাবুঝির কী আছে! আমার কবজির জোর তোর চেয়ে ঢের বেশি। বলেই গোলদার দ্বিতীয় বোতলটাও ছুড়ে দিল, দ্যাখ। আবার দ্যাখ।
দলপতি জিপে উঠে পড়েছে। স্টিয়ারিং-এ বসে হুঙ্কার চুড়ল, কী ছেলেমানুষি হচ্ছে? দুটোকেই আমি এবার…
সুড়সুড় করে গাড়িতে চলে গেল দুই শাগরেদ। যে গেট দিয়ে মিতিন টুপুর ঢুকেছিল, সেটা ছাড়াও আর একটা গেট আছে বাংলোর। ওই গেট পেরিয়েই আজ লিগিরদা গিয়েছিল তারা। তিন শয়তানের জিপও ওই রাস্তাই ধরল, প্রচণ্ড স্পিড তুলে মিশে গেল জঙ্গলে।
দরজা হাট করে খোলা। হরিণপায়ে ঘরটায় ঢুকল মিতিন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ চোখ গেছে বটল-ওপেনারটার দিকে। হাতির খুঁড়ের শেপ। টেবিলে পড়ে আছে।
জিনিসটা হাতে তুলে নিতেই ঝুপ করে আলো নিভে গেল।
টুপুর হাত খামচে ধরল মিতিনের, কী হবে এখন?
মিতিন টর্চ জ্বেলে শান্ত গলায় বলল, ঘাবড়াচ্ছিস কেন? সারগিয়া জেগে আছে। জিপ বেরিয়ে যেতেই জেনারেটার বন্ধ করেছে। চল, সারগিয়ার কাছে যাই।
রেস্টহাউস অবধি যেতে হল না, সারগিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বাংলোর হাতাতেই। রান্নাঘরের পাশে রাখা জেনারেটার বন্ধ করেই হনহনিয়ে রেস্টহাউস থেকে আসছিল সারগিয়া। বোধহয় বাংলোর দরজায় তালা মারতে।
মিতিন টুপুরের মুখোমুখি পড়ে ভূত দেখার মতো চমকেছে সারগিয়া। তোতলাচ্ছে, আআআপনারা? ইইইধার?
উত্তর দিল না মিতিন। কড়া গলায় পালটা প্রশ্ন করল, টাকার লোভে তুমি যাকে-তাকে সরকারি বাংলো খুলে দিলে? জানো, কমপ্লেন করলে তোমার চাকরি চলে যাবে?
সারগিয়া মাথা নামাল। কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, টাকার লোভে আমি করিনি দিদি। সচ্।
বিলকুল ঝুট। আমি তোমায় টাকা নিতে দেখেছি।
বিশ্বাস করুন দিদি, ওরা আমায় তুলে এনেছিল। রিভলভার দেখিয়ে। পকোড়া ভেজে দেওয়ার জন্য জোর করল। সারগিয়া ঝপ করে বসে পড়ল মিতিনের পায়ের কাছে, অত রুপিয়া আমি চাইনি দিদি, ওরা আমায় দিল। আমি গরিব আদমি, আমারও লোভ লেগে গেল, না বলতে পারলাম না।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। ওঠো। মিতিন খানিকটা নরম হয়েছে। বলল, ওদের চেনো?
জিন্দেগি মে এই পহেলা বার দেখা।
সত্যি বলছ?
ঝুট বললে আমার জবান খসে যাবে।
ওরা কী জন্য এসেছিল তুমি জানো?
নেহি দিদি। ওরা আমার সামনে কুছু বলছিল না।
হুম। মিতিন কী যেন একটু ভাবল। তারপর বলল, কাল আমি একটা জরুরি চিঠি দেব তোমার হাতে। সোজা গিয়ে রেঞ্জ অফিসে দিয়ে আসবে।
জি।
কেউ যেন চিঠির কথা জানতে না পারে। বিট অফিসার দীননাথ সহায়ও না।
জি।
জানলে কিন্তু তোমারই ক্ষতি হয়ে যাবে, মনে রেখো।
আমার নামে কমপ্লেন করবেন না তো দিদি?
না। তুমি যাও।
সারগিয়া চোখ মুছতে মুছতে বাংলোর দিকে চলে গেল।
মিতিন একটুক্ষণ দেখল সারগিয়ার চলে যাওয়া। তারপর টুপুরকে বলল, কী বুঝলি?
টুপুরের মায়া হচ্ছিল সারগিয়ার ওপর। বলল, সারগিয়াকে কিন্তু ইনোসেন্টই মনে হল মিতিনমাসি। জোর করে রিভলভার দেখিয়ে তুলে আনলে ও বেচারা কী করে?
যদি অবশ্য সারগিয়ার ভার্সন সত্যি হয়।
তুমি সারগিয়ার কথা কি বিশ্বাস করছ না?
করছি বটে। করছি নাও বটে। জঙ্গলে এত বড় একটা অপারেশন হচ্ছে, অথচ কোনও বনকর্মী জানে না, এমনটা হওয়া কি সম্ভব? একাধিক কর্মীও যুক্ত থাকতে পারে।
টুপুর ভেবেচিন্তে বলল, আমার মনে হয় দীননাথ সহায় এর মধ্যে থাকলেও থাকতে পারেন। দেখতে একটু বেশিই ভালমানুষ।
আর কেউ?
আর কে হতে পারে?
দেখা যাক। ভাবছি। মিতিন হাঁটতে শুরু করল রেস্টহাউসের দিকে। থামছে। হাঁটছে। থামছে। হঠাৎ বলল, আমাদের একটা ডিসিশান কিন্তু খুব ভাল হয়েছে। লোকগুলো আজ রাত্তিরে কোনওভাবেই হাতিটাকে কবজা করতে পারবে না।
টুপুর হিহি হেসে উঠল, ইস, নুনের বস্তা দেখতে না পেয়ে নিৰ্ঘাৎ চুল ছিড়বে। লিডারটা রাগের চোটে হালদার গোলদারকে না মেরেই দেয়।
উহুঁ, কিচ্ছু করবে না। যতক্ষণ না কাজ শেষ হচ্ছে ততক্ষণ হালদার গোলদারের টিকিটিও ছোঁবে না।
লোক দুটো কিন্তু বেশ বোকা-বোকা আছে। চাইন্ডিশ আচরণ করছিল।
ওই ধরনের হাফ-উইট অনুচরই শয়তানদের বেশি পছন্দ। ওই সদারটি অতি ধুরন্ধর। রাবণ। জানে নির্বোধ লোকদের দিয়ে বেশি নিষ্ঠুর কাজ করানো যায়।
বহুক্ষণ পর হাওয়া উঠেছে একটা। জঙ্গলের দিক থেকে শব্দ করতে করতে রেস্টহাউসের কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ল বাতাস। নেড়ে দিচ্ছে ইউক্যালিপটাসের ঝুঁটি।
উঁচু গাছটাকে দেখতে দেখতে মিতিন বলল, রাবণ প্ল্যানটা একা ছকেনি। সঙ্গে একজন মেঘনাদও আছে। তাকে সামনে দেখা যায় না, প্রত্যেক অপারেশনেও সে নেই, কিন্তু হাতির দাঁত সেই লোকটার মাধ্যমেই চালান যাবে।
টুপুর চোখ পিটপিট করল, কে সে?
শুনিসনি, রাবণ এক সিংহমশায়ের কথা বলছিল?
হ্যাঁ। হ্যাঁ। টুপুর উত্তেজিত মুখে বলল, কিন্তু সিংহটা কে বলো তো? জামদার সিংহ?
মিতিন ক্ষণকাল নীরব। ধীর পায়ে রেস্টহাউসের চালে উঠল। চাতালে একটা কুকুর শুয়ে। পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় তুলল কুকুরটা, তারপর আবার মুখ জেছে পায়ের ফাঁকে। কুকুরটাকে টপকে বারান্দায় উঠল মিতিন। বলল, পুরুষোত্তম সিংহ লোকটা খুব স্ট্রাইকিং। জঙ্গলের হাড়হদ্দ চেনেন, একসময়ে ক্র্যাকশট ছিলেন, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে। শিকারি, অথচ অ্যানিম্যাল সাভার।
তুমি কি পুরুষোত্তমবাবুকে সন্দেহ করছ?
সন্দেহের তালিকায় তাঁকে রাখার কারণ আছে কি না ভাবছি।
বিকাশ সিংহকে ধরছ না কেন? লোকটা জঙ্গল থেকে ফিরল, পরদিন আবার নাকি মনোহরপুর যাবে। হাতিগুলোও তো মনোহরপুরের দিক দিয়েই ঢুকেছে।
মন্দ বলিসনি। এ পয়েন্টটাও খতিয়ে দেখা দরকার।
টুপুর উৎসাহিত মুখে বলল, হয়তো হাতির পাল এসেছে শুনেই বিকাশবাবু হাতির দাঁত চুরির প্ল্যানটা ছকেছেন।
কেন?
টাকার লোভ। যাদের যত বেশি আছে, তারা তো তত বেশি চায়।
মিতিন কিছু বলল না। মুঠো খুলে টর্চ জ্বালিয়ে বট-ওপেনারটা দেখছে। ঘুরে টুপুরকে বলল, যা, এবার গিয়ে শুয়ে পড়।
ধুস, আর ঘুম আসবে না।
উহুঁ, ঘুমটা খুব জরুরি। কাল অনেক ছোটাছুটি আছে। মিতিন কেমন দূরমনস্ক, কাল কুমডি ক্যানসেল। সকালেই একবার মেঘাতুবুরু যেতে হবে।