ভ্রাতৃসমৃদ্ধিতে অসহিষ্ণু বৃহস্পতিকে ইন্দ্র সান্ত্বনা
“ঐ সময় সুররাজ ইন্দ্র বৃহস্পতিকে সন্তপ্ত জানিয়া তাঁহার সন্তাপের কারণ অবগত হইবার নিমিত্ত সুরগণসমভিব্যাহারে তাঁহার সমীপে গমনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘সুরাচাৰ্য্য! আপনি ত’ পরমসুখে নিদ্রিত হইয়া থাকেন? আপনার পরিচারকেরা ত’ আপনাকে যথোচিত পরিচৰ্য্যা করে? আপনি ত’ সতত সুরগণের সুখ প্রার্থনা করিয়া থাকেন? দেবতারা ত’ আপনাকে সতত প্রতিপালন করিতেছেন?’
“বৃহস্পতি কহিলেন, ‘সুররাজ! আমি পরমসুখে নিদ্রিত হই। আমার পরিচারকেরা যথোচিত পরিচৰ্য্যাদ্বারা আমার প্রীতি উৎপাদন করিয়া থাকেন। আমি নিরন্তর দেবগণের সুখ প্রার্থনা করি এবং দেবগণও আমাকে প্রতিনিয়ত প্রতিপালন করিয়া থাকেন।’
“ইন্দ্র কহিলেন, ‘সুরাচাৰ্য্য! তবে আপনার মুখশ্রী কি নিমিত্ত পাণ্ডুবর্ণ হইল? আর আপনার শারীরিক ও মানসিক দুঃখেরই বা কারণ কি? আপনি তাহা অকপটে কীৰ্ত্তন করুন। যাহারা আপনার দুঃখের কারণ আমি অবশ্যই তাহাদিগকে বিনষ্ট করিব।’
“বৃহস্পতি কহিলেন, “দেবরাজ! আমি শুনিয়াছি, রাজা মরুত্ত প্রভূত দক্ষিণাদানসহকারে এক যজ্ঞানুষ্ঠান করিতেছে। আমার ভ্রাতা সংবৰ্ত্ত সেই যজ্ঞে দীক্ষিত হইয়াছে। এক্ষণে আমার ইচ্ছা এই যে, সংবৰ্ত্ত মরুত্তের যাজনকাৰ্য্য না করে।’
“ইন্দ্র কহিলেন, ‘সুরাচাৰ্য্য! আপনি দেবগণের পুরোহিত, আপনার সকল কামনাই পূর্ণ হইয়াছে এবং আপনি স্বভাববলে জরামৃত্যু উভয়কেই অতিক্রম করিয়াছেন; অতএব সংবৰ্ত্ত হইতে আপনার কি অপকারের সম্ভাবনা?’
অগ্নির বৃহম্পতি-পৌরোহিত্যে অনুরোধ
“বৃহস্পতি কহিলেন, ‘সুররাজ! তুমি অসুরগণের মধ্যে যাহাদিগের সমৃদ্ধিশালী দেখ, দেবগণের সহিত সমবেত হইয়া তাহাদিগকেই সংহার করিয়া থাক। সুতরাং শত্রুর সমৃদ্ধিদর্শন যে নিতান্ত দুঃখাবহ, তাহা তোমার অবিদিত নাই। সংবৰ্ত্ত আমার প্রধান শত্ৰু, এক্ষণে তাহার সমৃদ্ধিদর্শনই আমার অসুখের কারণ হইয়া উঠিয়াছে। আমার শত্রু পরিবর্দ্ধিত হইবে বিবেচনা করিয়াই আমি এইরূপ বিবর্ণ হইয়াছি। অতএব তুমি এক্ষণে যে-কোন উপায়ে হউক, হয় সংবৰ্ত্ত, না হয় রাজা মরুত্তের নিগ্রহ কর।’
“সুরগুরু এই কথা কহিলে, দেবেন্দ্র অগ্নিকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হুতাশন! তুমি এক্ষণে বৃহস্পতিকে রাজা মরুত্তের নিকট লইয়া গিয়া বল, এই সুরগুরু তোমার যাজনকার্য্যে নিযুক্ত হইয়া তোমাকে অমরত্ব প্রদান করিবেন।’
“দেবরাজ এইরূপ অনুরোধ করিলে অগ্নি তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘দেবরাজ! আমি তোমার বাক্য রক্ষা ও বৃহস্পতির সৎকারের নিমিত্ত দূতবেশে রাজা মরুত্তের নিকট ইহাকে লইয়া চলিলাম।’ এই বলিয়া হুতাশন গ্রীষ্মকালীন প্রচণ্ড বায়ুর ন্যায় বন, উপবনসমুদয় বিমর্দ্দিত করিয়া অচিরাৎ বৃহস্পতির সহিত মরুত্তের নিকট উপস্থিত হইলেন।
“তখন মরুরাজ হুতাশনকে সমুপস্থিত দেখিয়া সংবৰ্ত্তকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহর্ষে! আজ অতি আশ্চর্য্য ব্যাপার অবলোকন করিলাম। হুতাশন স্বয়ং আমার যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হইয়াছেন। অতএব আপনি শীঘ্র উঁহাকে আসন, পাদ্য, অর্ঘ্য ও মধুপর্ক প্রদান করুন।’
“অগ্নি কহিলেন, ‘রাজন্! আমি তোমার বাক্যেই আসন ও পাদ্যাদি প্রাপ্ত হইয়া পরম পরিতুষ্ট হইলাম। ইন্দ্র আমাকে দূতরূপে তোমার নিকট প্রেরণ করিয়াছেন।’
“মরুত্ত কহিলেন, “ভগবন্! দেবরাজ ইন্দ্র ত’ সুখে অবস্থান করিতেছেন? তিনি ত’ আমাদিগের প্রতি সন্তুষ্ট আছেন এবং দেবগণ ত’ তাঁহার আজ্ঞা উল্লঙ্ঘন করেন না?
“অগ্নি কহিলেন, ‘রাজন্! পুরন্দর পরমসুখে অবস্থান করিতেছেন। তিনি তোমার প্রতি পরম পরিতুষ্ট রহিয়াছেন। দেবতারাও তাঁহার আজ্ঞা উল্লঙ্ঘন করেন নাই। তিনি এক্ষণে তোমার নিকট বৃহস্পতিকে সমর্পণ করিতে আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন। অতঃপর এই সুরগুরু বৃহস্পতি তোমার যাজনক্রিয়া সম্পাদন করিয়া তোমাকে অমরত্ব প্রদান করুন।’
মরুত্তের বৃহস্পতি-পৌরোহিত্য প্রত্যাখ্যান
“মরুত্ত কহিলেন, ‘মহাত্মন্! মহর্ষি সংবৰ্ত্ত আমার যাজনক্রিয়া সম্পাদন করিতেছেন। অতএব আমি বৃহস্পতির নিকট কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিতেছি যে, উনি অমর পুরন্দরের পুরোহিত হইয়া এক্ষণে মৃত্যুবশবর্ত্তী মরুত্তের পৌরোহিত্য না করেন।
“তখন অগ্নি কহিলেন, ‘রাজন! যদি তুমি বৃহস্পতিকে পৌরোহিত্যে বরণ কর তাহা হইলে নিশ্চয়ই যশস্বী হইয়া অত্যুৎকৃষ্ট মনুষ্যলোক ও প্রজাপতিলোকসমুদয় পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে এবং সুরপতি ইন্দ্রের প্রসাদবলে স্বর্গমধ্যে কোন উৎকৃষ্ট লোকই তোমার অপ্রাপ্য থাকিবে না।
‘অগ্নি এইরূপে মরুত্তকে প্রলোভিত করিতে আরম্ভ করিলে মহর্ষি সংবৰ্ত্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া হুতাশনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “অনল! তুমি অচিরাৎ প্রস্থান কর। আর কখন মরুত্তরাজার নিকট বৃহস্পতিকে লইয়া এ স্থলে আগমন করিলে আমি নিশ্চয়ই ক্রোধদৃষ্টিপাতে তোমাকে ভস্মাবশেষ করিব।’ মহর্ষি সংবৰ্ত্ত এই কথা কহিলে হুতাশন তাঁহার বাক্যে একান্ত ভীত ও নিতান্ত ব্যথিত হইয়া বৃহস্পতির সহিত তথা হইতে প্রস্থানপূর্ব্বক দেবসভায় সমুপস্থিত হইলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহাকে দর্শন করিবামাত্র সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হুতাশন! আমি মরুরাজার নিকট বৃহস্পতিকে সমর্পণ করিতে তোমাকে প্রেরণ করিয়াছিলাম, তুমি কি নিমিত্ত উহাকে লইয়া তথা হইতে প্রত্যাগমন করিলে? যজ্ঞদীক্ষিত নরপতি মরুত্ত তোমাকে কি কহিয়াছে, তাহা ব্যক্ত কর।
‘‘অগ্নি কহিলেন, ‘দেবরাজ! নরপতি মরুত্ত আপনার বাক্যে সম্মত হয় নাই। সে কৃতাঞ্জলিপুটে বৃহস্পতিকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। আমি বৃহস্পতিকে পৌরোহিত্যে গ্রহণ করিবার নিমিত্ত মরুত্তকে বারংবার অনুরোধ করিয়াছিলাম, কিন্তু সে কিছুতেই সম্মত হইল না। সে কহিল, সংবর্ত্ত আমার যাজনক্রিয়া সম্পাদন করিবেন। বৃহস্পতি যজ্ঞ করিলে যদি আমার উৎকৃষ্ট মনুষ্যলোক ও প্রজাপতিলোকমুদয় লাভ হয়, তথাপি আমি সুরগুরুদ্বারা যজ্ঞ সম্পাদন করিব না।’
ইন্দ্রক্রোধ—শাপভয়ে অগ্নির দৌত্যে অনিচ্ছা
‘ইন্দ্র কহিলেন, ‘হুতাশন! তুমি পুনৰ্ব্বার মরুত্তরাজার নিকট গমন করিয়া তাহাকে আমার অনুরোধ বিজ্ঞাপন কর। যদি সে তাহাতেও আমার বচন রক্ষা না করে, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই তাহাকে বজ্রপ্রহার করিব।’
“অগ্নি কহিলেন, ‘রাজন! গন্ধর্ব্বাধিপতি ধৃতরাষ্ট্র তথায় গমন করুন। আমার তথায় গমন করিতে শঙ্কা হইতেছে। ব্রহ্মচারী মহর্ষি সংবৰ্ত্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া আমাকে কহিয়াছেন যে, যদি তুমি পুনরায় মরুত্তরাজার নিকট বৃহস্পতিকে সমর্পণ করিতে আগমন কর, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই ক্রোধদৃষ্টিপাতে তোমাকে ভস্মাবশেষ করিব।’
‘ইন্দ্র কহিলেন, ‘হতাশন। তুমিই সকলকে দগ্ধ করিয়া থাক। তোমা ভিন্ন দাহকর্ত্তা আর কেহই নাই। তোমার সংস্পর্শে সমুদয় লোক ভীত হয়; অতএব সংবৰ্ত্ত যে তোমাকে ভস্ম করিবেন, এ কথায় আমার শ্রদ্ধা হইতেছে না।’
‘‘অগ্নি কহিলেন, ‘দেবেন্দ্র! আপনি অসংখ্য সৈন্যদ্বারা সসাগরা পৃথিবী ও সমুদয় স্বর্গলোক পরিবেষ্টিত করিতে পারেন, তবে বৃত্তাসুর কিরূপে আপনার স্বর্গলোক অপহরণ করিয়াছিল?
‘ইন্দ্র কহিলেন, ‘হুতাশন! আমি সামান্য যুদ্ধে ঐরাবতকে প্রেরণ, শত্রুদত্ত সোমরস পান ও দুৰ্ব্বলের প্রতি বজ্র নিক্ষেপ করি না। আমি স্বীয় বাহুবলে পৃথিবী হইতে কালকেয়গণকে, অন্তরীক্ষ হইতে দানবগণকে এবং স্বর্গ হইতে প্রহ্লাদকে দূরীভূত করিয়াছি। অতএব মর্ত্যলোকমধ্যে কোন্ ব্যক্তি আমার সহিত শত্রুতাচরণ করিয়া অপ্রহার করিতে সমর্থ হইবে?’
“অগ্নি কহিলেন, ‘রাজন্! আপনি শর্য্যাতিরাজার যজ্ঞ স্মরণ করুন। মহর্ষি চ্যবন ঐ যজ্ঞে ঋত্বিক হইয়া যখন অশ্বিনীকুমারদিগের সহিত সোমরস পান করেন, তখন আপনি তাঁহাকে নিষেধ করিয়াছিলেন; কিন্তু তিনি আপনার বাক্যে কর্ণপাতও করেন নাই। ঐ সময়ে আপনি সেই মহর্ষিকর্ত্তৃক অপমানিত হইয়া তাঁহাকে ঘোরতর বজ্রপ্রহার করিতে উদ্যত হইলেন; কিন্তু কোনক্রমেই তদ্বিষয়ে কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। মহর্ষি চ্যবন ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তপোবলে অনায়াসে আপনার বাহু স্তম্ভিত করিয়া মদ নামে এক ভীষণমূৰ্ত্তি অসুরের সৃষ্টি করিলেন। সে অসুরের বিকটমূৰ্ত্তিদর্শনে তৎকালে আপনাকে নেত্ৰদ্বয় নিমীলিত করিতে হইয়াছিল। ঐ অসুরের অধর পৃথিবী ও ওষ্ঠ স্বর্গলোক স্পর্শ করিয়াছিল। তাহার শতযোজনবিস্তৃত ঘোরতর সহস্র দন্ত, রজতস্তম্ভসদৃশ দুইশত যোজনবিস্তীর্ণ, দংষ্ট্রাচতুষ্টয়-দর্শনে তত্ৰত্য সকলেরই মনে ভয়সঞ্চার হইয়াছিল। সেই অসুর আপনার বিনাশাসনায় ঘোরতর শূল উদ্যত করিয়া আপনার প্রতি ধাবমান হয়। সেই সময় আপনি সেই বিকটমূৰ্ত্তি অসুরকে অবলোকন করিয়া যারপরনাই ভীত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে মহর্ষির শরণাপন্ন হইয়াছিলেন। অতএব হে দেবেন্দ্র! ক্ষত্রিয়বল অপেক্ষা ব্ৰহ্মবল শ্রেষ্ঠ এবং ব্রাহ্মণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর আর কেহই নাই। আমি ব্রহ্মাতেজ বিলক্ষণ অবগত আছি; অতএব আমার সংবৰ্ত্তকে পরাজয় করিতে কিছুতেই বাসনা হয় না।”