০৯. ভাসমান যানটা শহরের উপর ঘুরছে

ভাসমান যানটা শহরের উপর ঘুরছে। খুব উপর থেকে নয়, মাটির কাছাকাছি মানুষজন গাড়ি দালানকোঠা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কেউ তাদের দেখতে পাচ্ছে না, ভারি মজার একটা ব্যাপার। সোমার হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে সবার মনে খুব আনন্দ। ডক্টর জিজি যে আসলে মহাজাগতিক একটা প্রাণী, তার গায়ের রং সবুজ, বিশাল বড় মাথা, বড় বড় চোখ, নাকে দুটি গর্ত এবং কোনো মুখ নেই তবুও কথা বলে যাচ্ছে, হাতে তিনটি করে আঙুল, কোনো কাপড় পরে নেই কিন্তু তবু ন্যাংটা মনে হচ্ছে না এবং এই পুরো ব্যাপারটি প্রায় অসম্ভব একটি ঘটনা; কিন্তু শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাছে কোনোকিছুই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। প্রয়োজনে ডক্টর জিজির শরীরে তারা থাবা দিয়েও দেখছে, তুলতুলে নরম। ঠাণ্ডা একটি শরীর, হাত দিলে প্রথমে একটু চমকে উঠলেও একটু পরে বেশ অভ্যাস হয়ে যায়।

শাহনাজ ডক্টর জিজিকে বলল, ডক্টর জিজি, সোমা আপুকে ভালো করে দেওয়ার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

ডক্টর জিজি বলল, আমরা যখন নিচুশ্রেণীর সভ্যতায় যাই সেখানে কোনো বিষয়ে হাত দিই না। কিন্তু এই ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল–

শাহনাজ চোখ পাকিয়ে বলল, আমাদের সভ্যতা নিচুশ্রেণীর?।

হ্যাঁ। সভ্যতা নিচুশ্রেণীর না হলে কেউ তাদের পরিবেশের এত ক্ষতি করে? এত মানুষকে না–খাইয়ে রাখে? নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ করে এত মানুষকে মেরে ফেলে?

শাহনাজ কী বলবে বুঝতে পারল না। ডক্টর জিজি তো সত্যি কথাই বলেছে, আসলেই তো মানুষ অপকর্ম কম করে নি। একটা নিশ্বাস ফেলে সে বিষয়বস্তু পাল্টে ফেলার চেষ্টা করল, ডক্টর জিজি, তুমি তো সোমা আপুর হাসি রেকর্ড করেছ। সেটা হচ্ছে এক ধরনের হাসি। সোমা আপু হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ, তার মাঝে কোনো খারাপ জিনিস নেই। পৃথিবীতে যে কোনো খারাপ জিনিস থাকতে পারে সেটা সোমা আপু জানেই না, দেখলেও বিশ্বাস করবে না। কাজেই তার হাসিটা হচ্ছে একেবারে খাঁটি আনন্দের হাসি। কিন্তু পৃথিবীতে আরো অন্যরকম হাসিও আছে।

সেটা কীরকম?

যেমন মনে কর আমার কথা। আমি তো সোমা আপুর মতো ভালো না। আমার ভিতরে রাগ আছে, হিংসা আছে, কাজেই আমার হাসি হবে অন্যরকম।

সেটা কীরকম?

যেমন মনে কর ঝিনু মস্তান কিংবা মোরব্বা স্যারের কথা। এই দুইজনকে আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। যদি তাদেরকে কোনভাবে আমি একটু মজা টের পাওয়াতে পারি তা হলে আমার এত আনন্দ হবে যে আমি খিলখিল করে হাসতেই থাকব, সেটাও এক ধরনের হাসি!

অত্যন্ত বিচিত্র!

এর মাঝে তুমি কোন্ জিনিসটাকে বিচিত্র দেখছ?

একজনকে মজা দেখিয়ে অন্যজনের মজা পাওয়া।

এটা মোটেও বিচিত্র না। এটা সবচেয়ে স্বাভাবিক। এটা দুনিয়ার নিয়ম

শাহনাজের কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ করে ভাসমান যানটি দাঁড়িয়ে গেল। শাহনাজ চমকে উঠে বলল, কী হয়েছে?

মোবারক আলী স্যারের বাসায় এসেছি।

শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, সে কী! কখন এলে? কীভাবে এলে? চিনলে কীভাবে?

আমি সব চিনি, আমি দেখতে চাই তুমি মজা দেখিয়ে কীভাবে মজা পাও।

কিন্তু আমি কীভাবে মজা দেখাব?

সেটা তুমি ঠিক কর।

শাহনাজ নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি বুঝতে পারছ না ডক্টর জিজি। মোর স্যার। আসলে মানুষ না, কোনো দৈত্য–দানব। শুধু ওপরের চামড়াটা মানুষের। আমি যদি তাকে মজা দেখাতে যাই তা হলে আমাকে ধরে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।

ডক্টর জিজি মাথা নাড়ল, বলল, সে যেন তোমাকে খেতে না পারে আমি সেটা দেখব। আমি তোমাকে সবরকম সাহায্য করব।

শাহনাজ চোখ বড় বড় করে বলল, সবরকম?

হ্যাঁ। সবরকম।

আমি যদি বলি, স্যার আপনার নাকটা এক হাত লম্বা হয়ে যাক–তা হলে স্যারের নাকটা এক হাত লম্বা হয়ে যাবে?

 যা। তা হলে আমি তার নাকের মাঝে গিয়ে কোষ বিভাজন অনেক দ্রুত করে দেব যেন তোমাদের মনে হয় নাকটা লম্বা হয়ে গিয়েছে।

শাহনাজ নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, আমি যদি বলি আপনি শূন্যে ঝুলে থাকবেন তা হলে স্যার শূন্যে ঝুলে থাকবে?

হ্যাঁ, আমাকে ছোট একটা স্কাউটশিপ পাঠিয়ে তাকে উপরে তুলে রাখতে হবে।

শাহনাজ হাততালি দিয়ে বলল, ইশ! কী মজা হবে! আমাকে এক্ষুনি নামিয়ে দাও ডক্টর জিজি! শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুকে জিজ্ঞেস করল, ডাবলু, তুই যাবি?

না, শাপু। তুমি যাও আমি এখান থেকে দেখি ডক্টর জিজি কী করে!

শাহনাজ চোখ বড় বড় করে বলল, কী বললি? শাপু? আমার নামটা ছোট করতে করতে এখন শাপু করে ফেলেছিস!

ক্যাপ্টেন ডাবলু হি হি করে হেসে বলল, কেন শাপ, তোমার আপত্তি আছে?

না নেই। আমি দেখতে চাই ছোট হতে হতে শেষ পর্যন্ত কী হয়! শাহনাজ ডক্টর জিজির দিকে তাকিয়ে বলল, এখন আমাকে নামিয়ে দাও। যখন বলব তখন আবার আমাকে তুলে নিও, ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

শাহনাজ ভাসমান যান থেকে নেমে এদিক–সেদিক তাকাল, কেউ তাকে দেখতে পায় নি। যদি দেখত তা হলে ভয়ে চিৎকার শুরু করৎ, একেবারে অদৃশ্য থেকে হঠাৎ একজন মানুষ হাজির হলে ভয়ে চিৎকারই করার কথা। শাহনাজ স্যারের বাসার দরজায় শব্দ করল, প্রায় সাথে সাথেই একজন দরজা খুলে দেয়। শাহনাজদের স্কুলের একটা মেয়ে, তাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, শাহনাজ আপু, তুমি?

হ্যাঁ। মোরব্বা স্যার আছে?

মেয়েটি মুখে আঙুল দিয়ে বলল, শ–স–স–স, স্যার শুনতে পাবে।

শুনলে শুনবে। আমি আর ভয় পাই না। স্যার কোথায়?

ঐ ঘরে, ব্যাচে পড়াচ্ছে আমাদের।

চল যাই, স্যারের সাথে দেখা করতে হবে।

শাহনাজ পাশের ঘরে গিয়ে দেখতে পেল একটা বড় ঘরে অনেকগুলো মেয়ে গাদাগাদি করে বসে আছে, সামনে একটা চেয়ারে পা তুলে কুৎসিত ভঙ্গিতে বসে থেকে একটা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে স্যার নাক খুঁটছে। শাহনাজকে দেখে স্যার ভুরু কুঁচকে বললেন, কে?

আমি স্যার।

মোবারক স্যার খেঁকিয়ে উঠলেন, আমিটা আবার কে?

আমার নাম শাহনাজ। আপনার ছাত্রী।

ও। স্যার নাক খুঁটতে খুঁটতে জিজ্ঞেস করলেন, কী চাস?

অনেক দিন থেকেই আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

কী কথা?

আপনি যে ক্লাসে কিছু পড়ান না, সবাইকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন সেটা খুব অন্যায়।

শাহনাজের কথা শুনে মোবারক স্যারের চোয়াল স্কুলে পড়ল, খানিকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না, মাছকে পানি থেকে ডাঙায় তুললে যেভাবে খাবি খেতে থাকে সেভাবে খাবি খেতে লাগলেন। তারপর নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস বের করে বললেন, কী বললি?

আমি বলেছি যে আপনি যে ক্লাসে কিছু পড়ান না, সবাইকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন সেটা খুব অন্যায়।

মোবারক স্যার যেখানে বসে ছিলেন সেখানেই বসে থেকে কীভাবে যেন লাফিয়ে উঠলেন, উত্তেজনায় তার লুঙ্গি খুলে গেল এবং কোনোভাবে সেই লুঙ্গি ধরে চিৎকার দিয়ে বললেন, তবে রে পাজি মেয়ে। বদমাইশির জায়গা পাস না

অন্য যে কোনো সময় হলে ভয়ে শাহনাজের জান উড়ে যেত, কিন্তু আজ অন্য ব্যাপার, সে ভয় পেল না। বরং মুখটা হাসি–হাসি করে বলল, আপনি আরো বড় বড় অন্যায় কাজ করেন স্যার! পরীক্ষার আগে ছাত্রীদের কাছে থেকে টাকা নিয়ে তাদের পরীক্ষার প্রশ্ন বলে দেন। সেটা আরো বড় অন্যায়।

তবে রে শয়তানী বলে মোবারক স্যার শাহনাজের দিকে একটা লাফ দিলেন। কিন্তু তখন খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার হল, মনে হল মোবারক স্যার অদৃশ্য একটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ে গেলেন। কোনোমতে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে তাকালেন এবং ঠিক তখন একটা মেয়ে কোথায় জানি হাসি চাপার চেষ্টা করতে করতে শেষ পর্যন্ত না পেরে ফিচ করে একটু হেসে ফেলল। মোবারক স্যার চারদিকে মুখ ঘুরিয়ে একটা হুংকার দিয়ে বললেন, চোপ, সবাই চোপ!

শাহনাজ নরম গলায় বলল, শব্দটা হচ্ছে চুপ। বাংলায় চোপ বলে কোনো শব্দ নেই।

তবে রে বদমাইশি– বলে মোবারক স্যার শাহনাজের উদ্দেশে আরেকটা লাফ দিলেন, কিন্তু আবার অদৃশ্য দেয়ালে আঘাত খেয়ে নিচে আছাড় খেয়ে পড়লেন। বেশকিছু মেয়ে লাফিয়ে সরে গিয়ে ঠিকভাবে আছাড় খাবার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা করে দিল। শাহনাজ তখন দুই পা অগ্রসর হয়ে বলল, স্যার খামোকা আমাকে ধরার চেষ্টা করবেন না। পারবেন না। এর চাইতে অপরাধ স্বীকার করে ফেলেন।

মোবারক স্যারের কপাল ফুলে উঠেছে, সেখানে হাত বুলাতে বুলাতে হিংস্র চোখে বললেন, কী বললি তুই?

আমি বলছি যে আপনি যে প্রাইভেট পড়ানোর নাম করে ছাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদেরকে পরীক্ষার প্রশ্ন বলে দেন, কিছু শেখান না–সেটা স্বীকার করে নেন।

তুই কে? তোর কাছে কেন আমি স্বীকার করব?

শাহনাজ সব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা সব সাক্ষী। আমি কিন্তু স্যারকে একটা সুযোগ দিয়েছি। দিই নি?

মেয়েরা আনন্দে সবগুলো দাঁত বের করে জোরে জোরে মাথা নাড়ল। শাহনাজ মোবারক স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার এখনো সময় আছে। আপনি যদি অপরাধ স্বীকার করেন, আপনাকে এবারের মতো মাফ করে দেওয়া হবে। আর যদি স্বীকার না করেন, মিথ্যা কথা বলেন, খুব বড় বিপদ হবে।

কতবড় সাহস তোর? আমাকে বিপদের ভয় দেখাস!

জি স্যার। মিথ্যা কথা বললেই আপনার নাকটা এক হাত লম্বা হয়ে যাবে।

মোবারক স্যার চিৎকার করে বললেন, আমি মিথ্যা কথা বলি না। স্যারের কথা শেষ হবার আগেই সড়াৎ করে একটা শব্দ হল আর সবাই অবাক হয়ে দেখল স্যারের নাকটা লম্বা হয়ে পেট পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে। গাদাগাদি করে বসে থাকা মেয়েগুলো ভয় পেয়ে চিৎকার করে সবাই পিছনে সরে এল। শাহনাজ হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বলল, আমি বলছিলাম না? আপনি আমার কথা শুনলেন না!

মোবারক স্যার একেবারে হতভম্ব হয়ে নিজের নাকের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তাকে দেখে মনে হতে লাগল একটা সাপ বুঝি নাককে কামড়ে ধরেছে। ভয়ে ভয়ে তিনি লম্বা নাকটা ধরলেন, তারপর একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে সেটাকে খুলে ফেলার চেষ্টা করলেন এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন, সত্যি সত্যি তার নাক লম্বা হয়ে গেছে।

গাদাগাদি করে বসে থাকা মেয়েগুলোর ভিতর থেকে একজন হঠাৎ আবার ফিচ করে হেসে ফেলল। হাসি ভয়ানক সংক্রামক একটি জিনিস, ফিচ শব্দটি শুনে আরো অনেকে ফিচ ফিচ করে হাসতে শুরু করল। প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর বেশ জোরে। শাহনাজ অনেকক্ষণ চেষ্টা করে আর নিজেকে সামলাতে পারল না, খিলখিল করে হাসতে শুরু করল।

মোবারক স্যার নিজের লম্বা নাকটা ধরে হতভম্বের মতো বসে রইলেন, কয়েকবার কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে থেমে গেলেন। শাহনাজ হাসি থামিয়ে বলল, স্যার, আপনি যেসব। অন্যায় করেছেন সেগুলো একটা একটা করে বলতে থাকেন, তা হলে আপনার নাক এক ইঞ্চি করে ছোট হয়ে যাবে।

সার কাঁদো–কাদো গলায় বললেন, সত্যি হবে?

হবে স্যার, চেষ্টা করে দেখেন। শাহনাজ একগাল হেসে বলল, আর যদি সেটা না করতে চান তা হলে ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন, অপারেশন করে ছোট করে দেবে।

স্যার শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নাক মুছতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন এখন আর আগের মতো নাক মুছতে পারছেন না, এবারে শুঁড়ের মতো নাকের ডগা মুছতে হচ্ছে। শাহনাজ ঘরে গাদাগাদি করে বসে থাকা মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা স্যারকে সাহায্য কর। একটা বড় লিস্ট করে দাও, স্যার সেই লিস্ট দেখে একটা একটা করে বলবেন। ঠিক আছে?

মেয়েগুলো আনন্দে মুখ ঝলমল করে একসাথে চিৎকার করে বলল, ঠিক আছে, শাহনাজ আপু।

শাহনাজ মোবারক স্যারের ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই তাকে টুক করে টেনে ডক্টর জিজির ভাসমান যানে তুলে নিল। সেখানে উঠে শাহনাজ দেখতে পেল ক্যাপ্টেন ডাবলু পেটে হাত দিয়ে খিকখিক করে হাসছে এবং ডক্টর জিজি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে আছে। শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

ঐ দেখ।

শাহনাজ দেখতে পেল মোবারক স্যার জবুথবু হয়ে বসে আছেন। মেয়েরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। একজনের হাতে একটা রুলার, সে নাকটাকে লম্বা করে টেনে ধরে মাপছে। অন্যেরা একটা লিস্ট তার সামনে ধরে রেখেছে, তিনি একটা একটা করে সেটা পড়ছেন। শাহনাজ দৃশ্যটা দেখে আবার হি হি করে হেসে উঠল। ডক্টর জিজি মাথা নেড়ে বলল, অত্যন্ত বিচিত্র!

সে যন্ত্রপাতিতে হাত দিতেই ভাসমান যানটি মৃদু একটা ভোঁতা শব্দ করে হঠাৎ করে ঘুরে গেল, মুহূর্তে চারদিক ঝাঁপসা হয়ে যায়। শাহনাজ বলল, এখন বাকি আছে শুধু ঝিনু মস্তান। তাকে একটা শিক্ষা দিতে পারলেই কেস কমপ্লিট।

ঝিনু মস্তান? ডক্টর জিজি শাহনাজের মুখের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ। এমন টাইট দেব যে সে জন্মের মতো সিধে হয়ে যাবে!

তুমি কি নিশ্চিত যে তাকে তুমি টাইট দিতে চাও?

হ্যাঁ। যেদিন আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়েছিল সেদিন কী করেছিল জান? ঘুসি মেরে আমার নাকটা চ্যাপ্টা করে দিয়েছিল। মহা গুণ্ডা।

ডক্টর জিজি বলল, তা হলে কি আমি তোমাকে তার কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দেব?

হ্যাঁ। আর মনে আছে তো আমি যেটাই বলব সেটাই করবে।

ঠিক আছে।

শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে বলল, ডাবলু, তুই নামবি এবার?

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল, বলল, না। এখান থেকে দেখায় মজা বেশি।

কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ করে ভাসমান যানটা একটা শব্দ করে থেমে গেল এবং শাহনাজ আবিষ্কার করল সে কাওরানবাজারের কাছাকাছি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টর। জিজি তাকে খুব কায়দা করে নামিয়েছে কেউ কিছু সন্দেহ করে নি। কিন্তু ঝিনু মস্তানের কাছে না নামিয়ে তাকে রাস্তায় নামিয়ে দিল কেন কে জানে। ডক্টর জিজি অবশ্য ভুল করার। পাত্র নয়, এই রাস্তার মাঝে নামিয়ে দেবার নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে। শাহনাজ এদিক সেদিক তাকাল এবং হঠাৎ করে ভয়ানকভাবে চমকে উঠল। ফুটপাত থেকে একটু দূরে রাস্তায় একটা রিকশায় ঝিনু মস্তান বসে আছে, তাকে ঘিরে তিনজন সত্যিকারের মস্তান। একজনের হাতে একটা জংধরা রিভলবার, অন্যজনের হাতে একটা বড় চাকু, তিন নম্বর মস্তানের হাতে একটা লোহার রড। কাছেই একটা স্কুটার দাঁড়িয়ে আছে, মস্তানগুলো মনে হয় এই স্কুটার থেকেই নেমেছে। লোহার রড হাতে মস্তানটি তার রড দিয়ে রিকশার সিটে প্রচণ্ড জোরে একটা আঘাত করল, মনে হয় ভয় দেখানোর জন্য। রিভলবার হাতে মস্তানটি তার রিভলবারটি ঝিনু মস্তানের দিকে তাক করে খনখনে গলায় চিৎকার করে বলল, দে ছেমড়ি, গলার চেইনটা দে।

শাহনাজ ঝিনু মস্তানের দিকে তাকাল, ক্লাসে তাকে তারা ঠাট্টা করে মস্তান বলে ডাকত কিন্তু এখন সত্যিকারের মস্তানের সামনে তাকে কী অসহায় লাগছে! ঝিনু তার গলা থেকে চেনটা খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভয়ে তার হাত কাঁপছে বলে খুলতে পারছে না। চাকু হাতে মস্তাটা ক্রমাগত নড়ছে আর চোখের কোনা দিয়ে এদিক–সেদিক তাকাচ্ছে, সে অধৈর্য হয়ে হঠাৎ লাফিয়ে ঝিনুর গলার চেনটা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল। চেনটা ছিঁড়ে তার হাতে এসে যায় কিন্তু তাল সামলাতে না পেরে ঝিনু রিকশা থেকে হুমড়ি খেয়ে নিচে এসে পড়ল।

শাহনাজ চারদিকে তাকাল, রিকশাটা ঘিরে দূরে দূরে মানুষজন দেখছে, কেউ ভয়ে কাছে আসছে না। ঝিনু রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে, মুখ বিকৃত করে যন্ত্রণাটা সহ্য করে ওঠার চেষ্টা করছে! মস্তানগুলো এদিক–সেদিক তাকাতে তাকাতে স্কুটারে ওঠার জন্য ছুটতে শুরু করেছে, তখন শাহনাজ ছুটে যেতে শুরু করে। চিৎকার করে বলল, ঐ ঐ মস্তানের বাচ্চা মস্তান, যাস কোথায় পালিয়ে? খবরদার যাবি না।

অন্য যে কেউ এ ধরনের কথা বললে মস্তানরা কী করত জানা নেই, কিন্তু শাহনাজের বয়সী একটা মেয়ের মুখে এ রকম একটা কথা শুনে মস্তানগুলো ঘুরে দাঁড়াল। রিভলবার

হাতে মস্তানটি তার রিভলবার তাক করে বলল, চুপ ছেমড়ি। একেবারে শেষ করে ফেলব।

শাহনাজ চুপ করল না, চিৎকার করতে করতে ঝিনুকে টেনে তুলে বলল, ওঠ ঝিনু, তাড়াতাড়ি ওঠ। এই মস্তানগুলোকে বানাতে হবে।

ঝিনু তখনো কিছু বুঝতে পারছে না, অবাক হয়ে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে আছে। শাহনাজ তখন চিৎকার করতে করতে মস্তানগুলোর দিকে ছুটে যেতে থাকে, খবরদার নড়বি না মস্তানের বাচ্চা মস্তানেরা, শেষ করে ফেলব, খুন করে ফেলব।

মস্তানগুলো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না যে এইরকম পুঁচকে একটা মেয়ে তাদেরকে এতটুকু ভয় না পেয়ে এ রকমভাবে তাদের কাছে ছুটে আসছে! রিভলবার হাতে মস্তানটির আর সহ্য হল না, সে তার রিভলবারটি শাহনাজের দিকে তাক করে মুখ খিঁচিয়ে কুৎসিত একটা গালি দিয়ে গুলি করে বসল। গুলোটা অদৃশ্য একটা দেয়ালে আঘাত করে তাদের দিকে ফিরে গেল—-সেটা অবশ্য উত্তেজনার কারণে মস্তানেরা টের পেল না।

শাহনাজ মস্তানগুলোর কাছে এসে নিজের দুই হাতের তর্জনী বের করে ছোট বাচ্চারা যেভাবে রিভলবার তৈরি করে খেলে সেভাবে খেলার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলল, এই যে ছারপোকার বাচ্চারা–ভেবেছিস শুধু তোর রিভলবার আছে, আমার নেই? এই দ্যাখ আমার দুই রিভলবার, গুলি করে বারটা বাজিয়ে দেব কিন্তু।

মস্তানগুলো অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে রইল, এখন তাদের সন্দেহ হতে শুরু করেছে যে মেয়েটি সম্ভবত পাগল। তারা আর সময় নষ্ট করল না, স্কুটারের দিকে ছুটে যেতে শুরু করল। শাহনাজ তখন রিভলবারের ভঙ্গিতে ধরে রাখা তর্জনীটি স্কুটারের দিকে তাক করে বলল, গুলি করলাম কিন্তু, তারপর মুখ দিয়ে শব্দ করল, ডিচুম।

সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে স্কুটারটা মাটি থেকে লাফিয়ে উপরে উঠে গেল। মস্তান তিনটি চমকে উঠে ঘুরে শাহনাজের দিকে তাকায়, এই প্রথমবার তাদের মুখে ভয়ের চিহ্ন ফুটে ওঠে।

শাহনাজ দুই হাতের দুই তর্জনী তাক করে বলল, কী আমার সোনার চানেরা, বিশ্বাস হল যে আমি গুলি করতে পারি? এই দেখ বলে শাহনাজ আবার কাউবয়ের ভঙ্গিতে দুই হাত দিয়ে ডিচুম করে গুলি করতে থাকে, আর কী আশ্চর্য প্রত্যেকবার গুলি করার সাথে স্কুটারটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে থাকে।

ঝিনু এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে পুরো ব্যাপারটি দেখছিল, এবার সে পায়ে পায়ে শাহনাজের কাছে এগিয়ে এল। শাহনাজ বলল, হা করে দেখছিস কী? গুলি কর।

ঝিনু বলল, গুলি করব? কীভাবে?

শাহনাজ নিজের হাতকে রিভলবারের মতো করে বলল, এই যে এইভাবে।

তা হলেই গুলি হবে?

হ্যাঁ। এই দেখ– বলে সে আবার ডিচুম ডিচুম করে কয়েকটা গুলি করল। সত্যি সত্যি সাথে সাথে কয়েকটা বিস্ফোরণ হল। ঝিনু অনিশ্চিতের মতো নিজের হাতটাকে রিভলবারের মতো করে স্কুটারের দিকে তাক করে গুলি করার ভঙ্গি করল, সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে স্কুটারটা লাফিয়ে ওঠে। ঝিনু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে একবার নিজের হাতের দিকে, আরেকবার স্কুটারটার দিকে তাকাল সত্যি সত্যি নিজের আঙুল দিয়ে সে গুলি করে ফেলেছে সেটা এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না।

বিস্ফোরণ এবং গুলির শব্দ শুনে তাদের ঘিরে মানুষের ভিড় জমে গেছে। মস্তানগুলো কী করবে বুঝতে পারছে না, পালিয়ে যাবার জন্য রিভলবার তাক করে একদিকে ছুটে যাবার চেষ্টা করল, কিন্তু অদৃশ্য একটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল। তাদেরকে অদৃশ্য একটা দেয়াল ঘিরে রেখেছে সেটা এখনো বুঝতে পারছে না।

শাহনাজ ঝিনুকে বলল, আয় এখন মস্তানগুলোকে বানাই।

ঝিনু তার হাতের অদৃশ্য রিভলবারের দিকে তাকিয়ে বলল, এইটা দিয়ে গুলি করলে মরে যাবে না?

হ্যাঁ। রবার বুলেট দিয়ে করতে হবে।

ঝিনু মুখ হাঁ করে বলল, রবার বুলেট?

হ্যাঁ, এই নে। শাহনাজ ঝিনুর হাতে কাল্পনিক রবার বুলেট ধরিয়ে দেয়। ঝিনু কী করবে বুঝতে পারছিল না। শাহনাজ গম্ভীর গলায় বলল, ভরে নে। তারপর নিজে তার রিভলবারে রবার বুলেট ভরে নেওয়ার ভঙ্গি করে সেটি মস্তানদের দিকে তাক করল, সাথে সাথে মস্তানদের কুৎসিত মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়। শাহনাজ সময় নিয়ে গুলি করল এবং অদৃশ্য গুলির আঘাতে একজন মস্তান নিচে ছিটকে পড়ল। তার মনে হল প্রচও ঘুসিতে কেউ তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। এতক্ষণে ঝিনুও তার অদৃশ্য রিভলবারে অদৃশ্য রবার বুলেট ভরে নিয়েছে, সে দ্বিতীয় মস্তানটির দিকে তাক করতেই মস্তানটি হঠাৎ দুই হাজাড় করে হাঁটু ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়। ঝিনু মস্তানের তবু মায়া হল না, সে অদৃশ্য রিভলবারের ট্রিগার টেনে ধরতেই দ্বিতীয় মস্তানটিও ধরাশায়ী হয়ে গেল। স্কুটারের ড্রাইভার এবং রড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মস্তানটি এখনো নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিল, মজা–দেখা মানুষেরা এখন তাদের দিকে ছুটে আসতে রু করে। শাহনাজ নিচু গলায় বলল, এখন পালা, বাকিটা পাবলিক ফিনিশ করবে।

দাঁড়া, আমার চেনটা নিয়ে নিই শুয়ে কাতরাতে থাকা মস্তানটির কাছে গিয়ে ঝিনু তার মাথায় অদৃশ্য রিভলবার ধরে বলল, আমার চেন।

মস্তানটি কোনো কথা না বলে সাথে সাথে পকেট থেকে তার চেনটা বের করে দিল। ঝিনু চেনটা হাতে নিয়ে শাহনাজকে বলল, চল্। পালাই।

তারপর দুজন ঘুরে ফুটপাত ধরে ছুটতে থাকে। রাস্তার মোড়ে ঘুরে গিয়ে দুজন একটা ছোট গলিতে ঢুকে পড়ে। ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে দুজন একটা দেয়ালের পাশে দাঁড়াল। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপর জোরে জোরে হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে শাহনাজের চোখে পানি এসে গেল, সে চোখ মুছে ঝিনুকে বলল, এখন বাড়ি যা, ঝিনু মস্তান!

ঝিনু শাহনাজকে ধাক্কা দিয়ে বলল, আমাকে মস্তান বলছিস? তুই হচ্ছিস সবচেয়ে বড় মস্তান!

শাহনাজ কিছু বলল না, চোখ মটকে বলল, আমাকে যেতে হবে।

কোথায়?

শাহনাজ হাতের অদৃশ্য রিভলবার দুটি দেখিয়ে বলল, এই অস্ত্রগুলো ফেরত দিতে হবে  না।

ঝিনু নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, আমারটা?

রেখে দে।

এখনো কাজ করবে?

শাহনাজ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, জানি না। গুলি থাকলে কাজ করবে।

ঝিনু তার হাতের অদৃশ্য রিভলবারে অদৃশ্য গুলি আছে কি না সেটা দেখার চেষ্টা করতে লাগল, শাহনাজ কোথায় কোনদিকে অদৃশ্য হয়ে গেছে সেটা বুঝতেও পারল না।