ভরশূন্য পরিবেশে চলাচল করার অভ্যাস না থাকার কারণে শীতল ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে য়ুহার বেশ অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল। পাশাপাশি এগারোটা ক্যাপসুল সাজানো আছে, ভেতরে আবছা অন্ধকার, যন্ত্রপাতির মৃদুগুঞ্জন ছাড়া সেখানে কোনো শব্দ নেই।
য়ুহা ক্যাপসুলগুলো পরীক্ষা করে, কেমন করে এর ভেতরে শীতল হয়ে থাকা মানুষগুলোকে জাগিয়ে তোলা যাবে সে জানে না। তাকে বলা হয়েছে ক্যাপসুলগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ কাজেই বাইরের সাথে যোগাযোগ কেটে দিলে ক্যাপসুল গুলো কোনো উপায় না দেখে নিশ্চয়ই ভেতরের মানুষটিকে জাগিয়ে দেবে। বিষয়টা হয়তো বিপজ্জনক কিন্তু নিশ্চয়ই কার্যকর। য়ুহা হাতের অস্ত্রটি নিয়ে একটা একটা করে ক্যাপসুল পরীক্ষা করে রায়ীনার ক্যাপসুলের পাশে এসে দাঁড়াল। স্বচ্ছ ঢাকনার ভেতর দিয়ে রায়ীর শীতল দেহটি দেখা যাচ্ছে, দেখে মনে হয় না এটি একটি জীবন্ত মানুষ, মনে হয় পাথরের ভাস্কর্য। য়ুহা ক্যাপসুলের পাশে সুইচগুলো পরীক্ষা করে, কোনো একটি লিভার টেনে কোনো একটা সুইচ টিপে দিলেই ভেতরের মানুষটি জেগে উঠবে সে রকম কিছু খুঁজে পেল না। তাই সে ক্যাপসুলের ভেতর থেকে বের হয়ে যাওয়া নানা ধরনের টিউব, বৈদ্যুতিক তার, অপটিক্যাল ক্যাবলগুলো খুঁজে বের করল। যদি সে এগুলো কেটে দেয় তাহলে নিশ্চয়ই ক্যাপসুলটি পুরোপুরি দায়িত্ব নিয়ে রায়ীনাকে জাগিয়ে তুলবে। বিষয়টি নিশ্চয়ই খুব বিপজ্জনক কিন্তু য়ুহার কিছু করার নেই। এই মহাকাশযানের প্রতিটি মুহূর্ত এখন প্রতিটি মানুষের জন্যে বিপজ্জনক।
য়ুহা হাতের অস্ত্রটি ক্যাবলগুলোর দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে ধরলঘরের ভেতর একটা বিস্ফোরণের শব্দ হয়, কালো ধোঁয়া এবং আঁঝালো গন্ধে সারা ঘর ভরে ওঠে। য়ুহা কাশতে কাশতে একটু পেছনে সরে এলো। চেষ্টা করেছে ছোটখাটো একটা বিস্ফোরণ ঘটাতে কিন্তু তারপরও সেটি পুরো ঘরটিকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। বিস্ফোরণের শব্দে কৌতূহলী হয়ে ক্রুরা এখানে চলে এলে একটা ঝামেলা হয়ে যাবে।
য়ুহা একটা ক্যাপসুলের পেছনে লুকিয়ে থেকে নিঃশব্দে অপেক্ষা করে। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে সে কাউকে দ্রুত ভেসে আসতে দেখল না দেখে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করে। রায়ীনার ক্যাপসুলের ওপর একটা লাল বাতি নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে জ্বলতে এবং নিভতে শুরু করেছে। সাথে সাথে একটা কর্কশ এলার্ম বাজতে থাকে। য়ুহা ক্যাপসুলটির ভেতরে তাকালো, হালকা একটা সাদা ধোয়া ধীরে ধীরে বের হতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত কী হবে সে এখনো জানে না। রায়ীনার দেহটি সত্যি সত্যি জেগে উঠবে না কী প্রক্রিয়াটি শেষ করতে না পারার কারণে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায় ছটফট করে মেয়েটির মৃত্যু ঘটে যাবে সেটি সে এখনো জানে না। ক্যাপসুলে হেলান দিয়ে য়ুহা নিঃশব্দে বসে থাকে। একজন মানুষের দেহ চরম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রা থেকে জীবনের উতায় ফিরিয়ে আনতে নিশ্চয়ই একটু সময়ের দরকার।
য়ুহা দেখতে পেল খুব ধীরে রায়ীনার মুখের রং ফিরে আসছে। এক সময় সে দেখতে পায় তার হৃৎস্পন্দন শুরু হয়েছে এবং খুব ধীরে ধীরে নিঃশ্বাসের সাথে সাথে তার বুক উপরে উঠতে এবং নিচে নামতে শুরু করেছে। য়ুহা ঠিক বুঝতে পারল না, সে কী ক্যাপসুলের উপরের ঢাকনাটি খুলবে না কি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে।
রায়ীনা ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। জ্ঞান ফিরে পাবার পর সে তার হাতের আঙুলগুলো চোখের সামনে নিয়ে এসে সেদিকে তাকিয়ে থাকে ঠিক অচেতন হবার আগে সে যে জিনিসটি নিয়ে ভাবছিল দেখে মনে হয় সে ঠিক সেই জিনিসটি নিয়েই ভাবতে শুরু করেছে। এর মাঝখানে যে একটি বড় সময় পার হয়ে গেছে মনে হচ্ছে সে সেই বিষয়টিই বুঝতেই পারছে না। য়ুহা ক্যাপসুলের ঢাকনার ওপর ঝুঁকে পড়ে হাত দিয়ে শব্দ করল, রাহীনা তখন খানিকটা হতচকিতের মতো মাথা ঘুরিয়ে তাকালো, তারপর উঠে বসার চেষ্টা করল। য়ুহা উপরের ঢাকনাটি খুলে দিতেই ভেতর থেকে এক ব্যালক ঠান্ডা বাতাস বের হয়ে আসে। রায়ীনা য়ুহার দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে, তাকে দেখে মনে হয় সে ঠিক কিছুই বুঝতে পারছে না। য়ুহা নিচু গলায় ডাকল, রায়ীনা–
রায়ীনা চোখের কাছে হাত নিয়ে য়ুহাকে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল, তুমি কে?
আমি য়ুহা।
আমার কী হয়েছে? আমি ভালো করে কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন?
তুমি এই মাত্র শীতলঘর থেকে জেগে উঠেছ তাই। য়ুহা সাহস দিয়ে বলল, কিছুক্ষণের মাঝেই তুমি পুরোপুরি জেগে উঠবে।
রায়ীনা তরল গলায় বলল, আমার নিজেকে খুব হালকা লাগছে–মনে হচ্ছে আমি ভাসছি।
য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, আমরা এখন ভরশূন্য পরিবেশে আছি তাই তোমার নিজেকে হালকা লাগছে।
রায়ীনা খানিকটা অপ্রকৃতস্থের মতো হাসার শব্দ করে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও-আমি ভেসে বেড়াব! ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে।
মেয়েটা এখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি, কথাবার্তায় এখনো খানিকটা অসংলগ্ন। য়ুহা রিয়ানার হাত ধরে তাকে খুব সাবধানে ক্যাপসুলের ভেতর থেকে বের করে আনে। রায়ীনা দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে ভারশূন্য পরিবেশে শুয়ে পড়ার ভঙ্গি করতে করতে আদুরে গলায় বলল, আমি কত দিন ঘুমাইনি আমাকে একটু ঘুমাতে দাও!
য়ুহা রিয়ানার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, রিয়ানা, আসলে তুমি অনেক দিন থেকে ঘুমাচ্ছ। সত্যি কথা বলতে কি তোমার এখন ঘুম থেকে ওঠার সময়। খুবই জরুরি, তুমি জেগে ওঠার চেষ্টা করো।
জেগে উঠব?
হ্যাঁ।
কেন জেগে উঠব?
এই মহাকাশযানটির এমন খুব বড় বিপদ। তুমি তাড়াতাড়ি জেগে উঠো, আমি তোমার সাথে এটা নিয়ে কথা বলতে চাই রায়ীনা।
রায়ীনা ভুরু কুঁচকে য়ুহার দিকে তাকিয়ে মনে হয় পুরো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করে। ঠিক এ রকম সময় য়ুহা দরজার কাছে মৃদু একটা শব্দ শুনতে পায়। সে মুখ তুলে তাকাতেই চমকে ওঠে। ক্যাপ্টেন ক্ৰবের সাথে কমান্ডের বেশ কয়েকজন ক্রু বাতাসে ভেসে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সবাই একটা ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে তার দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছে। য়ুহা কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না, শুনতে পেল, কমান্ডের একজন হিংস্র গলায় বলছে, হাতের অস্ত্রটা ছেড়ে দিয়ে দুই হাত শূন্যে তুলে স্থির হয়ে দাঁড়াও য়ুহা।
য়ুহা এক মুহূর্তের জন্যে চিন্তা করল। সে কী একবার শেষ চেষ্টা করবে? চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই, এতজন সশস্ত্র অভিজ্ঞ সামরিক কমান্ডের ক্রুয়ের বিরুদ্ধে সে একা কিছুই করতে পারবে না। তাই সে অস্ত্রটা ছেড়ে দিল, সাথে সাথে সেটা ভাসতে ভাসতে উপরে উঠে গেল। য়ুহা হাত দুটো উপরে তুলে স্থির হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। কমান্ডের মানুষটি এবারে রায়ীনাকে লক্ষ করে বলল, তুমিও দুই হাত শূন্যে তুলে স্থির হয়ে দাঁড়াও, তা না হলে আমি তোমাকেও হত্যা করতে বাধ্য হব।
রায়ীনা মানুষটির দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলল, তুমি আমার সাথে এ রকম রাগ হয়ে কথা বলছ কেন?
য়ুহা অনেকটা কৈফিয়ত দেয়ার মতো করে বলল, আসরোয়ানা এখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি—এখনো খানিকটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে আছে।
ক্যাপ্টেন ত্রুব শীতল গলায় বলল, য়ুহা। তুমি কী জান, তোমাকে যেন আমি কঠিন একটা শাস্তি দিতে পারি শুধু এটা নিশ্চিত করার জন্যে আমি মহাকাশযানটাকে আরো কিছুক্ষণ বাঁচিয়ে রাখব?
য়ুহা কোনো কথা বলল না, শুধু রায়ীনা একটা বাচ্চা মেয়ের মতো খিল খিল করে হেসে উঠল। যেন ক্যাপ্টেন ত্রুব খুব মজার কথা বলেছে।