ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয় (উপনিষদ)
বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ে বৰ্ণভেদ ক্রমশ শিলীভুত হয়ে যাচ্ছিল; যথাযথ শ্রেণীর উৎপত্তি হয়তো তখনো হয় নি, কিন্তু নিঃসন্দেহে সমাজ দৃঢ়পদে সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছিল। লোহার স্বল্পতা এবং উপযুক্ত সৈন্যবাহিনী, মুদ্রাব্যবস্থা ও পূৰ্ণবিকশিত শ্রেণীবিভক্ত সমাজের উত্থানের পক্ষে সহায়ক সামাজিক-রাজনীতিক গঠন-সংস্থানের অভাব, এ-সমস্তই অৰ্ধ-কৌম ও প্ৰাকমুদ্রা সমাজব্যবস্থার চরিত্রলক্ষণ; খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে সেসমাজের কৃষিকার্যে লোহার স্বল্প পরিমাণ প্রয়োগ করা হত। মৌলিক পরিবর্তনের দিকে প্রবণতার সূত্রপাত হয়েছিল বটে, কিন্তু তখনো তা সম্পূর্ণতা পায় নি। বিশেজ্ঞদের অভিমত এই যে, এ-সময় লোহা ব্যবহারের দ্বিতীয় পর্যায় চলছিল; আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল ও বিহারে যখন কুটীরশিল্প ও কৃষিকার্যে তার প্রয়োগ শুরু হ’ল কারিগর ও কৃষি-শ্রমিকের শ্ৰেণী সামাজিক ও বৃত্তিগতভাবে পুরোহিত ও যোদ্ধা শ্রেণী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। সামাজিক অক্ষমতা ও অর্থনৈতিক দায়ের ভারে জনসাধারণ পিষ্ট হ’ত; একদিকে নির্দিষ্ট সৈন্যবাহিনী ও অন্যদিকে প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রেণী-নিম্পেষণ অব্যাহত রাখা হ’ত–প্ৰশাসন রাজস্ব আদায় করত এবং পরিবার, সম্পত্তি ও সামাজিক শৃঙ্খলার বিধি-লঙ্ঘনকারীর শান্তি বিধান করত।
উপনিষদ সম্পর্কে অন্যতম প্রধান বিতর্ক এই প্ৰশ্নকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে : ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মধ্যে কার বেশি প্রাধান্য। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই ব্ৰাহ্মণ–যাজ্ঞবল্ক্য আবার তাঁদের মধ্যেও অগ্রগণ্য, যেহেতু উপনিষদের মৌল ভাবাদর্শ তিনিই শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং সেইসঙ্গে দীর্ঘতম ও সম্ভবত সর্বাপেক্ষা অধিক তাৎপৰ্যপূর্ণ উপনিষদেরই তিনি রচয়িতা। আবার এই সঙ্গে এও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ক্ষত্ৰিয়রা বিশেষত রাজন্য ও রাজারা, নুতন জ্ঞান বিধিবদ্ধ ও চতুর্দিকে তা প্রচার করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্ৰহণ করেছিলেন; এমন কি, উপনিষদে কখনো কখনো এও শোনা গেছে যে তারা নবলব্ধ জ্ঞানকে গোপন রহস্যরূপে সতর্কভাবে নিজের শ্রেণীর মধ্যেই একান্তভাবে রক্ষা করতে চাইছেন, অক্ষত্রিয়দের কাছে জ্ঞান-বিস্তারে তারা নিতান্ত অনিচ্ছুক। অবশ্য ব্ৰাহ্মণ যুগেই এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের আভাস আমরা পেয়েছিলাম (যেমন, কৌষীতকি ২৬ : ৫; শতপথ, ১১; ঐতরেয় ২ : ১৯)।
আরুণি যখন রাজা প্রবহণ জৈবলিকে এই নিগূঢ় তত্ত্বজ্ঞান দানের অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তখন রাজা দ্ব্যর্থহীনভাবে তাকে জানিয়েছিলেন, এই বিদ্যা আরুণিই ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে প্রথম লাভ করছেন (ছান্দোগ্য ৪ : ৩ : ৭)। পাঁচজন ব্ৰাহ্মণ ব্রাহ্মণকুলোদ্ভব উদালক আরুণির কাছে ব্ৰহ্মজ্ঞান অর্জনের জন্য গিয়েছিলেন; কিন্তু নিজের অপৰ্যাপ্ত জ্ঞান সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলে আরুণি তাদের ক্ষত্রিয় রাজা অশ্বপতির নিকট নিয়ে গেলেন। অর্থাৎ চিন্তাবিদরূপে ক্ষত্ৰিয় অশ্বপতি ছিলেন ব্ৰাহ্মণ আরুণির তুলনায় অগ্ৰণী (ছান্দোগ্য ৫ : ১১)।
রাজন্যরূপে তৎকালীন উন্নতিশীল ভূপতিদের সঙ্গে ক্ষত্রিয়দের নিবিড় সম্পর্ক ছিল; তাঁরা হয় রাজাদের সঙ্গে আত্মীয়তাসূত্রে বদ্ধ ছিলেন, নয়ত তাঁরা ছিলেন রাজসভা বা রাজপরিষদের অন্যতম সদস্য। অহংকারী ব্ৰাহ্মণ বালাকির জ্ঞানের গর্ব কিভাবে ক্ষত্রিয় রাজা অজাতশত্রু চুৰ্ণ করেছিলেন, বৃহদারণ্যক উপনিষদে (২ : ১ : ১৫) তার মনোজ্ঞ বিবরণ রয়েছে। আবার, ঐ গ্রন্থে দেখি, পুত্র শ্বেতকেতুর ব্যৰ্থতার কথা জেনে গৌতম রাজা প্ৰবহণ জৈবলির কাছে তত্বজ্ঞান লাভের জন্য শিষ্যত্ব গ্ৰহণ করছেন (তদেব, ৬ : ২ : ৮)। এসব বৃত্তান্ত থেকে আমাদের মনে হয় যে, অন্তত প্রাথমিক স্তরে তত্ত্বজ্ঞানে ক্ষত্রিয়দের একাধিপত্য ছিল। শতপথ ব্রাহ্মণের একটি তাৎপৰ্যপূর্ণ বৃত্তান্তের (৫ : ৩ : ৬ : ৭) কথা আমাদের মনে পড়ে, যেখানে রাজা জনকের বিতর্কসভায় যোগদানে ইচ্ছক ব্ৰাহ্মণদের প্রতি যাজ্ঞবল্ক্য এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন যে, ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়ের কাছে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত হতে পারেন।
স্পষ্টত জীবনের বহু ক্ষেত্রে সে-যুগে ক্ষত্রিয়দের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এমন এক সময় ক্ষত্রিয়দের ভূমিকা প্রাধান্য অর্জন করেছিল যখন ক্ষমতাশালী রাজারা প্রতিবেশী অঞ্চলগুলি অধিকারের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাছাড়া, দেশের সীমাতিযায়ী ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আবশ্যিক হয়ে উঠেছিল–ভ্ৰাম্যমান বণিকদের যাত্ৰাসঙ্গীরূপে একমাত্র বেতনভোগী ক্ষত্ৰিয় প্রহরীরা সেই নিরাপত্তা বিধানে সমর্থ ছিল। সমাজে ক্ষত্রিয়দের ক্রমোত্থানের ব্যাখ্যা এবং শক্তিবৃদ্ধি করার প্রয়োজনে উপযুক্ত প্রত্নকথা আবিষ্কৃত হয়েছিল (যেমন বৃহদারণ্যক, ১ : ৪ : ১১)। অবশ্য এই প্ৰত্নকথায় যেহেতু ব্ৰাহ্মণ কর্তৃক ক্ষত্রিয়কে পূজা-মর্যাদাদান কিংবা ব্ৰাহ্মণকে ক্ষত্ৰিয়ের গর্ভ-রূপে বর্ণনা করা হয়েছে, তাই আমরা ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের পারস্পরিক সহাবস্থান ও দ্বন্দ্ব দুয়েরই আভাস পাই। আবার ব্ৰাহ্মণকে ক্ষত্রিয়ের শক্তির উৎস বা চূড়ান্ত আশ্রয় রূপে বর্ণনা করার মধ্যে দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের পরবর্তীকালের প্রচেষ্টাও ব্যক্ত হয়েছে। পাশ্চাত্য দেশগুলির মতো ভারতবর্ষে কখনো কোনো সুসংগঠিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছিল না; রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের যে ধ্রুপদী সংগ্রাম বহু শতাব্দী ধরে ইয়োরোপকে আলোড়িত করেছিল, এটা যেন তার সর্বাধিক নিকটবর্তী রূপ। ভারতবর্ষে আমরা দেখি সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য অর্জনের সংগ্ৰাম ব্ৰাহ্মণ ও রাজন্যের মধ্যে।
বৈদিক যুগের অন্তিম পর্যায়ে বহুবিধ পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। অথর্ববেদ বিষয়ক আলোচনায় আমরা লক্ষ্য করেছি যে, একটি বিশেষ সময় পরিধিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সার্বভৌম রাজ্যের উত্থান হচ্ছিল–এটা প্রকৃতপক্ষে সেই যুগেরই বৈশিষ্ট্য যার সূচনায়। ঋগ্বেদের প্রথম ন’টি মণ্ডল সংকলিত এবং উপসংহারে উপনিষদগুলি রচিত হয়েছিল। সার্বভৌম রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংগঠনগুলি বিস্তৃত্ব অঞ্চল জুড়ে উথিত হয়ে সংলগ্ন রাজ্যসমূহ অধিকার করে নিচ্ছিল। বৈদিক যুগের অন্তিম পর্যায়ের বিশিষ্ট লক্ষণরূপে সার্বভৌম রাজ্যসমূহের উত্থান অথর্ববেদ এবং ব্রাহ্মণ সাহিত্যে সুচিত হয়েছে; সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে এসব রাজ্যই ক্ৰমে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক চিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করছিল।
যদিও খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে লোহার ব্যবহার প্রবর্তিত হয়েছিল, তবু খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম (মতান্তরে সপ্তম) শতাব্দীর অন্তভাগের পূর্বে সম্ভবত লাঙলে লোহার ব্যবহার হয়ে ওঠে নি। কিন্তু যখন সে-ধরনের প্রয়োগ শুরু হ’ল, অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক মানুষের সাহায্যে ও স্বল্পতর প্রচেষ্টায় অনেক বেশি জমি চাষ করা সম্ভব হয়ে উঠল। আবার, জমি যদি সমগ্ৰ কৌমের পরিবর্তে একক পরিবারগুলির স্বত্বাধীন হয়, কেবল তখনই এই অবস্থা লাভজনক হতে পারে, কারণ, তখন ন্যূনতম চাহিদা অপেক্ষা অধিক মাত্রায় উৎপাদনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। কৌম গোষ্ঠীর মধ্যে উৎপাদিত বস্তু সমানভাবে বণ্টন করার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তিলাভের পরে অর্থাৎ ব্যক্তি বা পরিবারের এককভাবে বাণিজ্য-প্ৰচেষ্টার সম্ভাবনায়। বস্তুত প্রকৃত লোহার লাঙল প্রবর্তনের প্রভাব সত্যই সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। খাদ্য-উৎপাদনের পরিমাণ বহুলাংশে বধিত করা ছাড়াও অনেক প্রতিক্রিয়া-পরম্পরার জন্ম দিয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে দেশের সাংস্কৃতিক চিত্ৰকে আমূল পরিবর্তিত করে দিয়েছিল।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে উত্তর-কৌশল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তী শতাব্দীতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন আরও লক্ষ্যগোচর হয়ে উঠল। বিম্বিসারের সময় থেকে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫২০) মগধ ক্রমশ রাষ্ট্রক্ষমতা ও রাজ্যসীমা বিস্তার করতে শুরু করেছিল, ফলে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০-এর মধ্যে অঙ্গ, বিদেহ, কাশী ও কৌশল মগধের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল। আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণের সময়ে সম্পূর্ণ গাঙ্গেয় উপত্যকা অর্থাৎ আধুনিক উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও বঙ্গ নন্দ সাম্রাজ্যের অধিকারভুক্ত হয়েছিল।
কৌম জীবন ভেঙে যাওয়ার পরেই এধরনের পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে, কেননা তখন কৌম বা গোত্রের পরিবর্তে পরিবার-ভিত্তিক ভূমির সত্ত্বাধিকার দেখা দিয়েছিল। পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে বাণিজ্যপথের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে; অন্যদিকে দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে বিশেষভাবে তােমা ও লোহার খনি আবিষ্কৃত হওয়ার ফলেই সেদিকে জনসাধারণের বসতি বিস্তার করার প্রেরণা এসেছিল। পথিমধ্যে গভীর অরণ্যকে অগ্নিদগ্ধ করে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্ৰদেশ, রাজস্থান ও বিহার অঞ্চলের বিস্তুত ভূমিকে কৃষিকার্যের উপযুক্ত করে তোলা হয়েছিল। লোহার লাঙল ব্যবহারের ফলে উদ্ধৃত্তি খাদ্য দ্বারা সেইসব অনুৎপাদক নগর ও তাদের দুর্গসমূহের জন্য আহার সংস্থান করা সম্ভব হল, যেগুলি দ্রুত বর্ধমান সার্বভৌম রাজ্যসমূহের কেন্দ্র। সেসব স্থানে বণিকরা বাস করত যাদের বহুদূর অবধি ভ্ৰমমাণ বাণিজ্য শকট ক্ষত্রিয়দের দ্বারা রক্ষিত হত। রাজারা এধরনের বণিকদের আশ্রয় দিয়ে ও মিত্ৰতার সম্পর্ক স্থাপন করে লাভবান হতেন। কারুশিল্পীদের বিভিন্ন সঙেঘর কথা আমরা শুনি; প্রতিটি শিল্পের একজন ‘জেট্ঠক’ বা নেতা থাকতেন। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের তখন নতুনভাবে প্রসার হচ্ছিল। এই যুগেই শেষ-পর্বের উপনিষদগুলি রচিত হয়েছিল।
ব্যাপক বাণিজ্যের পক্ষে বিনিময়ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেহেতু খুব একটা সহায়ক ছিল না, তাই ধীরে ধীরে মুদ্রাব প্রবর্তন হ’ল। বিভিন্ন ধাতুর খনি আবিষ্কৃত হওয়ার পরে ধাতুশিল্প যখন সুসংবদ্ধ রূপে নিল, সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর শেষদিকে বাণিজ্যিক ও রাজকীয় মুদ্রার প্রচলন শুরু হ’ল। বাণিজ্য-ভিত্তিক অর্থনীতি ও রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মুদ্রা ব্যবস্থা সমৃদ্ধির ফলে উদ্ধৃত্তি উৎপাদন মুষ্টিমেয় লোকের লাভের পথ প্রশস্ত করল; শ্রেষ্ঠী এবং সার্থবাহদের প্রাধান্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বলে বৌদ্ধ সাহিত্যে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা গেল। বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতি যখন সমুন্নত হয়, তা শুধু সম্পদের উৎসই হয় না, ভাবাদর্শ ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও স্বীকৃত শক্তি হয়ে উঠে। তাই, তৎকালীন বণিকশ্রেণী যেহেতু প্ৰচলিত যজ্ঞধর্মের পরিবর্তে উদীয়মান নব্য ধর্মীয় ও দার্শনিক মতগুলিকে সমর্থন জানিয়েছিল এবং বিভিন্ন শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল, তাই সমসাময়িক সমাজের উপসংগঠনে এর প্রবল প্রভাব দেখা গেল।
সমাজের কৌম-চরিত্র ভেঙে পড়ার পরে মগধের উত্থান অত্যন্ত তাৎপৰ্যপূৰ্ণ। নূতন উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন-সম্পর্ক সূচনার সঙ্গে তা অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পূক্ত। নব্যচিন্তাধারার প্রতিষ্ঠাতাদের অধিকাংশ যে মগধ এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন তা মোটেই আকস্মিক ঘটনা নয়। কৌম-অন্তর্বতী পুরাতন সামাজিক সম্পর্কগুলি শৃঙ্খলে পরিণত হয়েছিল বলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রগতির স্বার্থে সেগুলি চুৰ্ণ করতে হ’ল। প্রাথমিকভাবে মগধে খ্রিস্টপূর্ব ৫২০ থেকে ৩৬০ অব্দের মধ্যে সমাজ-সংস্থায় নতুন বৈশিষ্ট্যের সূত্রপাত হয়েছিল।
বৰ্ণভেদ তখনো পৰ্যন্ত কতটা শিথিল ও সঞ্চরণশীল থাকায় রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক বাণিজ্য থেকে লব্ধ অর্থ তিনটি উচ্চতর বর্ণের যে কোনো একটির হাতে সঞ্চিত হতে পারত। পূৰ্ণবিকশিত মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতি অবশ্য আরো পরবর্তীকালে আবির্ভূত হয়েছিল : মুদ্রার পরিবর্তে তখনো ছণ্ডির প্রচলন ছিল। কিন্তু তাতেও উদ্ধৃত্তি উৎপাদনের প্রমাণ পাওয়া যায়, যার সঙ্গে শোষণের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য; কারণ, কেবলমাত্র মুষ্টিমেয় উদ্যমী ব্যক্তি বাণিজ্য করত এবং ধনাঢ্য হয়ে উঠে তারা দরিদ্রদের বাণিজ্য ও উৎপাদন উভয় কর্মেই নিযুক্ত করত। লোভ হয়ে উঠল প্ৰধান মানসিক বৃত্তি; ফলে কৌম অর্থনীতি ভেঙে যাওয়ার পরে সম্পদের অসম বণ্টন বিপুল জনতার মধ্যে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের সূচনা করল। এই ভাগ্যহীন শোষিত জনতার মধ্যে এক ধরনের নৈরাশ্যবাদ ও হতাশা পুঞ্জীভূত হয়ে উঠল; জীবনে শেষ পর্যন্ত কোথাও ন্যায়বিচার নেই বলেই তাদের কাছে প্ৰতিভাত হ’ল; অস্পষ্টভাবে জনসাধারণের মধ্যে এই উপলব্ধির সূচনা হ’ল যে, মুষ্টিমেয় ব্যক্তির লোভ সর্বনাশের কারণ হয়ে উঠছে। মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতির প্রাথমিক স্তরের উন্মেষ হয়েছিল এই পর্বে।
এটা মোটেই আকস্মিক নয় যে, তৈত্তিরীয় উপনিষদের পুনরাবৃত্ত ধ্রুবপদগুলির অন্যতম হ’ল ‘নির্লোেভ শ্রোত্ৰিয়’ কিংবা ঈশোপনিষদের প্রারম্ভে রয়েছে ধনলিন্সার প্রতি নিষেধবাণী; তেমনি প্ৰজাপতি অলৌকিক অভিব্যক্তির মাধ্যমে মানুষকে দানশীল হতে আহ্বান জানিয়েছেন। শূদ্রেরা এই পর্যায়ে নিতান্ত ভরণপোষণের বিনিময়ে যথাসাধ্য শ্রমশক্তির জোগান দিয়েছে; ফলে মুষ্টিমেয় ভূম্যধিকারী ধনী ব্যক্তির হাতে পুঞ্জীভূত সম্পদ প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেল। উৎপাদন যখন এমন স্তরে উপনীত হ’ল যে তা অনুৎপাদক নগরগুলির ভরণপোষণ করতে পারে এবং অন্তর্দেশীয় ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের পক্ষে প্রয়োজনীয় উদ্ধৃত্তি খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্ৰী জোগান দিতে পারে, তখনই জনসাধারণের বিপুল অংশের পক্ষে জীবন এই প্ৰথম অনিবাৰ্য অমঙ্গলেব প্ৰতিমূর্তি হয়ে উঠল, যার থেকেই পলায়ন-ই কাম্য বলে মনে হল।
কৃষিব্যবস্থার উন্নতি ও বিপুলভাবে কৃষিব্যবসায়ের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারবাহী পশু নুতন গুরুত্ব লাভ করল; ফলে, ক্রমবর্ধমান যজ্ঞগুলিতে তাদের অনিয়ন্ত্রিত হত্যা এই পর্যায়ে অযৌক্তিক অপচয়রূপে প্ৰতিভাত হ’ল। বিপুল কৃষিব্যবসায়ের প্রমাণ বৌদ্ধ জাতকে পাওয়া যায়–জাতকের সমাজ মোটামুটিভাবে উপনিষদের সমসাময়িক। জাতকের কাহিনীতে (৩ : ২৯৩; ৪ : ২৭৬) আমরা ৮,০০০ একর ব্যাপ্ত কৃষিখামারের কথা শুনি, যাতে ৫০০টি লাঙল ব্যবহৃত হত। সুত্রনিপাতে (১ : ৪) বলা হয়েছে যে, এই জমি সাধারণত ব্ৰাহ্মণদের অধিকারে ছিল। জরথুস্ত্ৰ যে ধর্মীয় আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন, তাও এই বিপুল কৃষিখামারের সহগামী; অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পশুর অর্থহীন অপচয় পরোক্ষভাবে বন্ধ করার তাগিদ থেকে ঐ আন্দোলনের সূত্রপাত। সম্রাট অশোকের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পিছনেও উৎপাদনব্যবস্থায় অপচয় রোধ করার জন্য তৎকালীন সমাজের পরোক্ষ প্ৰতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছে। সেইসঙ্গে সমস্ত ধরনের সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের উত্থানের মধ্যে তৎকালীন অনুষ্ঠানসর্বস্ব সমাজে বিপুল আড়ম্বর ও ঐশ্বর্যের সঙ্গে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিদারুণ দারিদ্র্যের সহাবস্থানের বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদী প্রতিক্রিয়া প্ৰকাশিত হয়েছে। যজ্ঞধর্ম যদিও তখনো পর্যন্ত অবশ্য পালনীয়রূপে জনসাধারণের মধ্যে বিদ্যমান ছিল, সেসময়ে আজীবিক, বৌদ্ধ ও জৈন” মর্মর মতো প্ৰতিবাদী ধর্মমতগুলি যজ্ঞের অপ্রয়োজনীয়তা ও নৈতিকভাবে অহিংসার একান্ত আবশ্যকতা প্রচার করেছিল। লক্ষণীয় যে, উপনিষদ পর্যায়ের ব্রাহ্মণ্যধৰ্মও যজ্ঞকে ‘অদৃঢ় তরণী’ ব’লে বর্ণনা করেছে (মুণ্ডক ১ : ২ : ৭)।
জনসাধারণের এক বৃহৎ অংশ ব্যয়বহুল যজ্ঞের কেবল নিষ্ক্রিয় দর্শকরূপেই বিদ্যমান ছিল, কেননা যজ্ঞ মূলত রাজাদের এবং নব্য ধনিক সম্প্রদায় অর্থাৎ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের পৃষ্ঠপোষকতার অনুষ্ঠিত হত। পুরোহিত সম্প্রদায় ও তাদের সহকারীরা জনসাধারণের সংখ্যালঘু অংশ মাত্র ছিলেন; কেবল তারাই যজ্ঞ থেকে লাভবান হতেন। কিন্তু প্ৰতিশ্রুতি ফলদানে যজ্ঞগুলির বারংবার ব্যর্থতাও নিশ্চিতভাবে তাদের উপযোগিতা সম্পর্কে কতকটা সংশয়ের জন্ম দিচ্ছিল। তবে যজ্ঞ পার্থিব জীবনে সমৃদ্ধি এবং পরলোকে পার্থিব আনন্দের নিরবিচ্ছিন্ন অনুব্যাপ্তির আশ্বাস দিত। কিন্তু এই পর্যায়ে জীবন যেহেতু মুখ্যত দুঃখময় ও অবাঞ্ছনীয় বলে প্রতিভাত হচ্ছিল এবং ইহলোকের যজ্ঞাদি ফলপ্ৰসূ কর্ম পরলোকে শুধুমাত্র পুনর্জন্মেরই হেতু, তাই এই পুনরাবৃত্ত অমঙ্গল থেকে আত্যন্তিক মুক্তি পুনর্জন্মের শৃঙ্খল-মোচনই প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অথচ এক্ষেত্রে যজ্ঞ সামান্য মাত্রায়ও সহায়ক হতে পারত না। ভারতীয জীবনে এই যে আঁধির প্রকাশ ঘটেছিল, বস্তুত তা পৃথিবীর প্রত্যেকটি মহাদেশে ব্যাপ্ত ছিল। কেননা গ্রিস, ইরান, চীন ও মিশর, মেসোপোটামিয়ায় প্ৰায় এই সময়ে অনুরূপ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আধ্যাত্মিক অস্থিরতা ও বহু দার্শনিকের আবির্ভাব হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে চীনে লাওৎসে এবং ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে কনফুসিয়াস আর গ্রিসে হেরাক্লিটাস, এ্যানাক্সাগোরাস, এম্পিডোক্লিস ও জেনোফানেস-এর জন্ম হয়েছিল। অধিকাংশ গবেষকদের মতে জরথুস্ত্ৰ আবির্ভূত হয়েছিলেন খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম ও ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে। ভারতবর্ষে জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীর ও বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বুদ্ধদেব খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ইহুদীদের তোরাহ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে সংকলিত হয়েছিল; বিদেশী প্রভাব পারস্য থেকে ভারতে এসে পৌঁছেছিল, দারিয়ুস খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর শেষদিকে সিন্ধু জয় করেছিলেন। গ্রিস, চীন ও মিশর বাণিজ্যসূত্রে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। উপনিষদ যুগের শেষ পর্বে, বিশেষত আলেকজাণ্ডারের ভারত-আক্রমণের ফলশ্রুতি হিসাবে, গ্রিসের সঙ্গে ভারতবর্ষের চিন্তা ও ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে বিনিময় শুরু হয়। পূরণ কশ্যপ, অজিত কেশকম্বল, কুকুন্দ কাত্যায়ন, নিগ্ৰন্থ জ্ঞাতপুত্র, মস্করী গোশাল, রুদ্র রামপুত্র, সঞ্চয় বৈরাটিপুত্র প্রভৃতি নাম তৎকালীন ভারতবর্ষে বহুব্যাপ্ত আধ্যাত্মিক আলোড়নের ইঙ্গিত বহন করে, এদের মধ্যে বৈরাটিপুত্র সঞ্জয় ও মস্করী গোশাল ছিলেন বুদ্ধদেবের সমকালীন। নানাভাবে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল ব’লে নতুন চিন্তাধারা ও জীবনের মূল্যবোধগুলির নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নূতন প্রবণতার সূত্রপাত হল। এ-সমস্ত প্রতিবাদী ধারার বিশিষ্ট চরিত্রলক্ষণ হ’ল যজ্ঞের চূড়ান্ত মূল্যের ও তাৎপর্যের প্রত্যাখ্যান; জ্ঞানকাণ্ডের ভিত্তিমূলে নিহিত রয়েছে চিরাগত ধর্মীয় ঐতিহ্য প্রত্যাখ্যানের মনোভাব। একটি নতুন প্রতীকী ও নিগূঢ় রহস্যমূলক বিশ্লেষণ দিয়ে শুরু করে তা শ্ৰীঘ্রই সম্পূর্ণভাবে যজ্ঞের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ভিন্ন দিকে মুখ ফিরিয়েছিল।
এই নতুন আধ্যাত্মিক প্রবণতার উদ্ভূত হওয়ার পিছনে অন্যতম সহায়ক উপাদান ছিল প্ৰাগাৰ্য বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংঘাত ও চূড়ান্ত সংশ্লেষণ। আর্যরা যখন প্রথম এসে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল ও পাঞ্জাবে বসতি স্থাপন করেছিল, সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীদের মধ্যে যারা দাস বা শূদ্ররূপে অধিকৃত হয় নি–তারা সম্ভবত দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পলায়ন করেছিল। বৈদিক যুগের অন্তিম পর্বের সূচনায় অধিকতর ভূমির প্রয়োজনে এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বহুধাতুসমৃদ্ধ জমিতে প্রবেশাধিকার লাভের তাগিদে অরণ্য অঞ্চল অগ্নিদগ্ধ করার নূতন প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হল। শতপথ ব্রাহ্মণের বিদেঘ মাধবের কাহিনীতে এবং মহাভারতের খাণ্ডব দহনের উপাখ্যানে আমরা তার প্রমাণ পাই। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ গবেষকদের অভিমত এই যে খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে মহাভারতের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সুতরাং বৈদিক জনসাধারণের পূর্বমুখী সম্প্রসারণের সময়ে অর্থাৎ খুব প্রাচীন কালপর্যায়ে মহাভারত রচনার শুরু এবং খাণ্ডব উপাখ্যানও মূলত ঐতিহাসিক। পরবর্তী কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের যুগে ধাতু ও ধাতুশিল্পীরা ছিলেন প্রধান ভূমিকায়। তাৎপৰ্যপূর্ণভাবে মহাভারতের খাণ্ডব-উপাখ্যানে প্ৰদৰ্শিত হয়েছে যে, ধাতু গলানোয় বিশেষজ্ঞ ও নির্মাণবিদ্যায় দক্ষ অসুরবংশীয় স্থপতি ময়কে অন্বেষণ করার জন্য অরণ্যদহন অনিবাৰ্য হয়ে পড়েছিল।
উত্তর ভারতের অধিকাংশ স্থানে কৌম সমাজের চূড়ান্ত অবক্ষয় ঘটেছিল উপনিষদের যুগে। পিতৃ-উপাসনার ঐন্দ্রজালিক বন্ধন ভেঙে যাওয়ার মধ্যে তা প্রতিফলিত হয়েছে। নূতন বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতির জন্য এমন গতিশীল জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন ছিল, যারা পারিবারিক ও স্থানগত বন্ধনে আবদ্ধ নয়; আর, এইজন্য কৌম জীবনের রক্তসম্পর্কের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্ৰাচীন ধরনের সামাজিক বন্ধন ভেঙে মিশ্র-জনগোষ্ঠী দ্বারা গঠিত অধিকতর স্বাধীন প্রশাসনিক সংগঠন প্রবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। পিতৃ-উপাসনা ছিল সম্পূর্ণত কৌম জীবনের বৈশিষ্ট্য; অন্যদিকে উপনিষদে এমন সমাজের চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে যেখানে জনসাধারণ কৌম-গোষ্ঠীর তুলনায় অনেক বেশি গতিশীল।
আর্যরা বিভিন্ন ধাতুর খনিতে সমৃদ্ধ পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ মগধ, অঙ্গ ও বঙ্গের দিকে এগোলেন, সম্ভবত পথিমধ্যে গঙ্গা-যমুনা বিধৌত দোয়াব ও ধাতুসমৃদ্ধ অঞ্চলের অধিবাসীরা আর্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল, এবং শান্তিপূর্ণভাবে আর্যধারায় মিশে গিয়েছিল অথবা সেসব অঞ্চল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। আৰ্যদের যাত্রাপথের উভয়দিকে এবং বিশেষভাবে বিন্ধ্য অঞ্চলে ও আর্যায়ত্ত মধ্যদেশ অঞ্চলের সীমাস্তবতী অরণ্যভূমিতে প্ৰাগাৰ্যরা বসবাস করত। বিভিন্ন জাতির পারস্পরিক মিশ্রণ, কৌম সমাজের ক্ষয়, উৎপাদন-পদ্ধতি ও উৎপাদন-সম্পর্কের পরিবর্তন, ব্যবসা-বানিজ্যের প্রসারণ, মুদ্রাব্যবস্থার প্রবর্তন, ধাতুর ব্যবহার, বর্ষগণনাপঞ্জী ও লেখনপদ্ধতির প্রবর্তন ইত্যাদির ফলে সংস্কৃতিক্ষেত্রে যে সম্মিলন ও একীভবনের সূত্রপাত হয়েছিল—তার অনিবাৰ্য প্রভাবে যজ্ঞধর্মের প্রাচীন রূপটি অপ্রচলিত হয়ে গেল, অর্থাৎ যুগের প্রয়োজনের অনুবর্তী আর রইল না।
যখন যজ্ঞগুলি এত অসংখ্য, দীর্ঘায়িত, জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠল যে শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় ব্যক্তিই প্ৰত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারত, তখন প্রতিবাদী মনোভাব ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠল; জনসাধারণ যজ্ঞের যৌক্তিকতা ও ঈপ্সিত ফলদানে ব্যর্থতা দেখে সেগুলির প্রতিশ্রদ্রুত শক্তি সম্পর্কে সংশয় পোষণ করতে লাগল। অতীন্দ্ৰিয় আধ্যাত্মিক ও প্রতীকী ভাবে যজ্ঞানুষ্ঠানের পুনর্বিশ্লেষণ প্রকৃতপক্ষে দ্রুত ক্ষীয়মান ধর্মীয় বিশ্বাসের পুনরুদ্ধার করার শেষ মরিয়া প্রচেষ্টাকেই অভিব্যক্ত করছে। কিন্তু তখন ভিন্ন ধরনের ভাবাদর্শ উদ্ভূত হয়ে প্রচলিত চিন্তাধারাকে যে প্রত্যাহ্বান জানালো, যজ্ঞধর্ম যথাযথভাবে তার প্রত্যুত্তর দিতে অসমর্থ হ’ল; যেমন যজ্ঞের সাহায্যে কর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করা কঠিন। অবশ্য জন্মান্তরবাদ দুরূহতম সমস্যা সৃষ্টি করেছিল কারণ, পুনর্জন্ম অবিমিশ্র অমঙ্গল বলেই বিবেচিত হত এবং তাই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে উঠল পুনর্জন্ম-পরম্পরার সমাপ্তি ঘটানো। কিন্তু কোনও যজ্ঞে এই আশ্বাস পাওয়া যায় নি।
ফলে, এই নুতন সমস্যা সমাধানের আশায় জনসাধারণ স্বভাবতই ভিন্নপথগামী হতে বাধ্য হ’ল। আর্যবৃত্তের বহির্ভূত জনসাধারণের মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কয়েকটি সম্ভাব্য বিকল্প পাওয়া গেল। এমনকি বহুপূর্বে ঋগ্বেদের যুগেও আমরা
ব্রাত্যদের উল্লেখ পেয়েছি, যাদের জীবনযাত্রা ও বিশ্বাস পরস্পর-ভিন্ন হলেও অন্তত একটি ক্ষেত্রে তাদের সমধর্মিতা ছিল : বৈদিক যজ্ঞ-ধর্মের প্রত্যাখ্যান ও বিকল্প মূল্যবোধ গ্ৰহণ। এসব জনগোষ্ঠীর বিচিত্ৰ ভাবাদর্শের মধ্যে যে নতুন জীবনদর্শনের সম্ভাবনা ছিল, উপনিষদ যুগের শেষ পর্যায়ের পূর্বে তার প্রতি মানুষেবা দৃষ্টি বিশেষ পড়েনি, অথচ এসব পরস্পর-ভিন্ন পরিব্রাজক তপস্বীগোষ্ঠীর দীর্ঘকাল-ব্যাপী নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তার ঐতিহ্য বৈদিক জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বিদ্যমান ছিল। এদের মোটামুটিভাবে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়,–আদিম জনগোষ্ঠী, যারা আর্য আক্রমণের ফলে উদ্বাস্তু হয়েছিল এবং যারা সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতার গভীর বহির্ভূত ছিল। এদের মধ্যে উত্তর ও মধ্য অঞ্চল এবং অঙ্গ ও মগধের মতো পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীরা ব্রাত্য নামে পরিচিত ছিল। মূলত, এরা ছিল কৃষিজীবী ও পশুপালক জনগোষ্ঠী; তবে এদের মধ্যে বহুসংখ্যক লোক ধাতুশিল্প, কারুশিল্প ও বাণিজ্য নিরত ছিল। বৌদ্ধ বিবরণগুলিতে এরা সমৃদ্ধিশালী গোষ্ঠীরূপে চিত্রিত হয়েছে। সম্ভবত, ব্রাত্যক্টোম ছিল এমন একটি অনুষ্ঠান যার মাধ্যমে এরা আর্যসমাজে প্রবিষ্ট হতে পারত, কেননা সমৃদ্ধিশালী গোষ্ঠীর আত্মীকরণ আর্যদের পক্ষে সুবিধাজনক ও আকৰ্ষণীয় ছিল। অন্যদিকে এরাও যেসব উদীয়মান রাজ্যে বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনা আছে, এমন সব রাজ্যে জনসাধারণের সঙ্গে একাত্মীভূত হওয়ার প্রত্যাশায় প্ৰলুব্ধ বোধ করেছিল–যেহেতু তাদের খনিজ দ্রব্য, কৃষিজাত উদ্ধৃত্তি ও শিল্পজাত পণ্যগুলিকে লাভজনকভাবে হস্তাস্তরের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
দ্বিতীয়, একটি গোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন সন্ন্যাসী, যোগী, মুনি ও বৈখানসদের বিভিন্ন সম্প্রদায় যাঁরা নৈতিক জীবন যাপন করতেন এবং বিবিধ প্রকারের সাধন-পদ্ধতি ও সাধনার জন্য কৃচ্ছ-প্রক্রিয়া অবলম্বন করতেন। রক্ষণশীল বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নানারূপেই অভিব্যক্ত হয়েছিল। এদের অধিকাংশই অরণ্যে বাস করতেন এবং সেই সূত্রে যজ্ঞধর্ম সম্পর্কে বিতৃষ্ণ আর্য জিজ্ঞাসুদের সঙ্গেও এদের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এধরনের তাপস-গোষ্ঠীর প্রাথমিক উল্লেখ ব্ৰাহ্মণ এবং আরণ্যকে পাওয়া গেছে। মানসিক আরাধনার যে পদ্ধতি মূলত ব্ৰাহ্মণ্য-ধর্মের বৃত্ত-বহির্ভূত ছিল, উপনিষদের যুগে ক্রমশ তা আর্যদের ধর্মীয় ভাবনায় অনুপ্রবিষ্ট হ’ল।
তৃতীয়ত, ভ্ৰমমান দার্শনিকদের কিছু কিছু গোষ্ঠী গ্রিস দেশের ‘সোফিস্ট’দের মতো ইতস্তত বিচরণ করতেন, কখনো একাকী কখনো বা শিষ্যবৰ্গকে নিয়ে এরা চলতেন। এদের প্রত্যেকেই নীতিশাস্ত্র, ধর্ম বা অধ্যাত্মবিদ্যা, কর্মবাদ, পুনর্জন্মবাদ, প্রেততত্ত্ব ও মুক্তি সম্পর্কে কোনো না কোনো নতুন মতবাদ প্রচার করতেন। এ সমস্ত গোষ্ঠী প্ৰচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ছিলেন প্ৰতিবাদী, কারণ এদের কেউই যজ্ঞধর্ম অনুসরণ করতেন না। এরা একত্রে ব্রাহ্মাণ্য-ধর্মের প্রাসঙ্গিকতার বিরুদ্ধে প্ৰত্যাহ্বান জানাতে সফল হয়েছিলেন। এই সমস্ত ব্যাপারটি ছিল গৌণ ও সমাজব্যবস্থাপকদের অগোচর ঘটনা, কেউ পূর্বনির্দিষ্ট সূত্র ধরে এটি ঘটায়নি।
এই নতুন সমস্যার বাতাবরণে তৎকালীন চিস্তাবিদ ও দার্শনিকরা বিভিন্নভাবে প্রত্যাহ্বানের সম্মুখীন হতে চেয়েছিলেন; কিন্তু, তাদের মধ্যে মাত্র তিনটি গোষ্ঠী সাফল্য অর্জন করেছিলেন। প্রথমত, জৈনধর্ম; কয়েক শতাব্দী ধরে মোটামুটিভাবে ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল এটি সীমাবদ্ধ ছিল। জৈনদের অধ্যাত্মবাদী চিন্তার সঙ্গে বৌদ্ধ ভাবনার কতকদূর পর্যন্ত সাদৃশ্য ছিল; তবে শেষোক্তের তুলনায় ভারতবর্ষে তারা যে দীর্ঘতর জীবন পেয়েছিল, তার কারণ সাধারণ মঠ-বহির্ভূত ভক্তদের পক্ষে জৈনধর্ম একটি ব্যাপক আচরণবিধি নির্মাণ করতে পেরেছিল, কিন্তু বৌদ্ধধর্ম সন্ন্যাস-জীবনের উপরই প্ৰধান গুরুত্ব আরোপ করেছিল। স্পষ্টত গণধর্মান্তরের ফলে জৈনদের মতবাদ আরো ব্যাপক ও কতকটা সারগ্রাহী হ’ল, সাধারণ গৃহী ভক্তদের জন্য এখানে যথার্থ স্থান নির্দেশিত হ’ল। একই যুক্তি দিয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের দীর্ঘ জীবন লাভ ও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে; তৃতীয় ও চতুর্থ আশ্রমে ভিন্নমতাবলম্বী ও প্রতিবাদী তপস্বী গোষ্ঠীদের ঐকামীভূত করার বিচক্ষণতা দেখিয়ে ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ‘আপিন প্রভাবের পরিধি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই সঙ্গে যে-গৃহস্থরা জনসাধারণের বিপুল অংশ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের শক্তির মূল স্তম্ভরূপে পরিগণিত হয়েছিল, তাদের জন্যও সর্বতোভাবে গ্ৰহণযোগ্য একটি সামাজিক বিন্যাস পাওয়া গেলো।
দ্বিতীয়ত, বৌদ্ধধর্ম সমগ্ৰ ভারতবর্ষে প্রভাব বিস্তার করলেও কয়েক শতাব্দী পরে উপমহাদেশ থেকে প্রকৃতপক্ষে বিদায় নিয়েছিল। তৃতীয় ধারা অর্থাৎ উপনিষদীয় বৈদিক ধর্ম ব্ৰাহ্মণ্যধর্মকে সমকালীন আধ্যাত্মিক প্রয়োজননির্বাহের উপযোগী করে তোলে এবং বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মৌল উপাদানগুলিকে নিজ মতবাদের মধ্যে ক্রমশ আত্মসাৎ করে নিয়ে নতুন আধ্যাত্মিক আলোড়নকে সবচেয়ে সার্থকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়েছিল। অর্থনৈতিক দিক থেকেও এই ধারা নিজের অবস্থানকে গ্ৰহণযোগ্য করতে পেরেছিল; এজন্য বহু দীর্ঘ ও জটিল যজ্ঞে গোসম্পদের অপ্রয়োজনীয় অপচয় সম্পর্কে জনসাধারণকে নিরুৎসাহ করার সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিলাভের উচ্চতর লক্ষ্যের প্রতিও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল। এই মুক্তি যজ্ঞানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়, আত্মার প্রকৃত স্বরূপ বিষয়ে জ্ঞানলাভের দ্বারাই সম্ভব–এই মত ধীরে-ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। অবশ্য, এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উপনিষদে অভিব্যক্ত আধ্যাত্মিক পরিশীলনের প্রবণতায় কোনভাবে বিপুল জনসাধারণের বিশ্বাস প্রতিফলিত হয় নি, তারা সম্ভবত তখনো পর্যন্ত একাগ্রভাবেই প্রাচীনতর বৈদিক ধর্ম অর্থাৎ যজ্ঞধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করত। এর অন্যতম কারণ হল, একমাত্র এধরনের ধর্মে ঐন্দ্ৰজালিক বিশ্বাসের যৌক্তিকতা সিদ্ধ হ’ত; এই বিশ্বাস ব্ৰাহ্মণ্য-চিন্তার একটি আবশ্যিক উপাদান। এই ঐন্দ্ৰজালিক শক্তি অর্থাৎ প্রাচীনতর ‘ব্ৰহ্ম’ (অর্থাৎ অলৌকিক শক্তিযুক্ত বচন) এর প্রতি প্ৰশ্নসংকুল প্রত্যাহ্বান উত্থাপিত হওয়ার ফলে শেষ পর্যন্ত বস্তুবাদের সঙ্গে সামান্যতম সম্পর্কযুক্ত সমস্ত কিছুই নিন্দিত ও প্রত্যাখ্যাত হল। ইন্দ্ৰজাল যেহেতু যজ্ঞানুষ্ঠানের মৌল ভিত্তি তাই পুরোহিত শ্রেণীর নিকট তা অপরিহার্য; ফলে, তাদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার প্রতি ন্যূনতম প্রশ্নের আশঙ্কাও সহ্য করা হয় নি। সুতরাং বিদ্বৎসমাজের মধ্যে নতুন অধ্যাত্মবাদী সাহিত্যের রচনা ও প্রচারের দিনগুলিতেও বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠান ও প্রাগ্বৈদিক স্থানীয় উপাসনা-পদ্ধতি জনসাধারণের ধর্মীরূপে প্ৰচলিত ছিল। কারণ, অন্তত আরো কয়েকটি শতাব্দী ধরে তা স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে সহায়ক হয়েছিল; বিশেষত যে-জনসাধারণ ধর্মের নিকট আশ্রয় ও নিরাপত্তার আশ্বাস পেতে চায় তাদের জন্য এই স্থিতাবস্থা কার্যকরী হয়েছিল।
এই পরিস্থিতি একদিকে স্পষ্টত জনসাধারণের সংখ্যাগুরু অংশকে তুষ্ট করেছিল, অন্যদিকে অগ্ৰগামী চিন্তাবিদরা এই প্রশ্নের দ্বারা তাড়িত হচ্ছিলেন : কোথায় এবং কিভাবে মুক্তিপ্ৰদ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভবপর। আর, ঠিক এখানেই ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসী আচার্য ও তপস্বীরা সমাধানের একটি পথ দেখালেন। যেহেতু তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল অরণ্যবাসী, তাই শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে অরণ্যে গমন ও বসবাস আবশ্যিক বলে বিবেচিত হল; অথচ ব্রাহ্মণ্যজীবনের শৃঙ্খলাবোধ অনুযায়ী বেদাধ্যয়নের পরে তরুণ যুবকের পক্ষে গাৰ্হস্থ্য আশ্রমে প্রত্যাবর্তনই ছিল বাধ্যতামূলক। অন্যদিকে, এই যুগের বিশিষ্ট চরিত্রলক্ষণযুক্ত আধ্যাত্মিক আন্দোলনে নতুন আধ্যাত্মিক সমস্যাবলীর সমাধানকল্পে অরণ্যে দীর্ঘকালব্যাপী অবস্থান ছিল আবশ্যিক। সুতরাং ব্রাহ্মাণ্য ধর্ম পারস্পরিক বোঝাপড়ায় মধ্যপন্থা গ্ৰহণ করতে বাধ্য হল : পঞ্চাশ বছর বয়সের পর বেদাধ্যয়নে ব্ৰহ্মাষণ, বহু যজ্ঞানুষ্ঠানের দ্বারা দেবষণ শোধ করে, নিজ পরিবার গঠনের দ্বারা পিতৃঋণ এবং অতিথিসেবা ও অন্যান্য প্রাণীদের জন্যে অন্নদানে প্ৰাণিমাত্রেয় ঋণ পরিশোধ করার পরেই শুধু অরণ্যে গমন করে বনবাসী জীবনযাপনের অনুমতি পাওয়া গেল। অরণ্যে ন্যূনতম যজ্ঞের আয়োজনই ছিল যথেষ্ট। একে বলা হল বানপ্ৰস্থ।
কিন্তু ভ্ৰমমাণ দার্শনিক শিক্ষকরা বহু জ্ঞানভাণ্ডারের একমাত্র অধিকারী ছিলেন এবং একটি নির্দিষ্ট স্থানে তারা দীর্ঘকাল অবস্থানও করতেন না। ফলে, আরো আপোষের ব্যবস্থা আবিষ্কার করতে হ’ল—তখন জীবনের শেষ পর্যায়টি একাকী ভ্ৰমমাণ অবস্থায় অতিবাহিত করার নিয়ম নির্দেশিত হল। তপস্যা ও সন্ন্যাস-জীবনকে বিশেষ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মানে সমুন্নীত করার ফলে চতুর্থ আশ্রম ব্যতি বা “সন্ন্যাস’ নামে চিহ্নিত হয়েছিল। যতিদের জীবনযাপন যজ্ঞকেন্দ্ৰিক বৈদিক সমাজের একটি সম্ভাব্য বিকল্পরূপে ঋগ্বেদের সময় থেকেই বর্তমান ছিল—উপনিষদের যুগে রক্ষণশীল বৈদিক সংস্কৃতি তাকে যথাযথ স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হল।
সুসংগঠিত ধর্মপ্রতিষ্ঠানের অভাবে আশ্রম’-এর ভাবাদর্শ বহুলপ্রচলিত হয়ে একটি প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র অর্জন করে নেয়; চার বা পাঁচ শাল তাব্দী ধরে ব্ৰহ্মচারী, গৃহী ও বানপ্ৰহী—এই তিনটি স্তর সামাজিক অনুমোদন পেয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব শেষ দুটি শতাব্দীতে সন্ন্যাসী বা যতির বগীকরণ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতিলাভ করে।
ক্ষত্ৰিয়গণ যে এই যুগের নব্যচিন্তাধারার বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা গ্ৰহণ করেছিলেন-ত বিস্ময়কর নয়। সমাজের যে অংশ যজ্ঞের উপযোগিতা সম্পর্কে সর্বপ্রথম মোহমুক্ত হয়েছিল, স্বাভাবিকভাবে তারা হ’ল ক্ষত্ৰিয় শ্রেণীর অভিজাত সম্প্রদায় অর্থাৎ রাজন্য, কেননা এরাই ক্রমবর্ধমান বহুব্যয়যুক্ত জটিল ও দীর্ঘায়িত যজ্ঞানুষ্ঠানের আর্থিক দায় বহন করতেন। যোদ্ধা হিসাবে একমাত্র তীরাই অকালমৃত্যুর সম্মুখীন হতেন বলে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন ও প্রেততত্ত্ব সম্পর্কে তাদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ খুব স্বাভাবিক।
কর্মবাদ ও দেহান্তর-গ্রহণের নবোদ্ভূত তত্ত্ব পুরাতন বা নতুন চিন্তাধারার সঙ্গে সম্পূর্ণ খাপ খায়নি, এধরনের গ্রস্থিল সমস্যা সমাজের অন্য বর্গের তুলনায় ক্ষত্ৰিয় শ্রেণীকেই অধিক বিড়ম্বিত করত। ইতোপূর্বে আমরা ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মধ্যে অবদমিত দ্বন্দ্বের আভাস লক্ষ্য করেছি; দুই শ্রেণীর মধ্যে আর্থনীতিক স্বাৰ্থজনিত সংঘাতও ছিল। পরগাছার মতো পুরোহিত সম্প্রদায় যজ্ঞানুষ্ঠানের পরিবর্ধন, ব্যাপ্তি ও নিরবচ্ছিন্নতা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে প্রবলভাবে উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু অন্যদিকে আর্থিক দায়িত্বের বিপুল বোঝা ও যজ্ঞের অনিশ্চিত ফল এবং নব্যচিন্তাধারাপ্রসূত প্ৰত্যাহ্বানের উপযুক্ত প্ৰত্যুত্তর দানে সমগ্ৰ যজ্ঞতত্ত্বের ব্যর্থতা পৃষ্ঠপোষক ক্ষত্রিয় প্ৰস্তুত হল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, এক অর্থে কর্মবাদ যজানুষ্ঠান-ব্যবস্থাপক পুবোহিতদের শ্রেণীঃস্বার্থের পরিপহী ছিল, কারণ তা যজ্ঞবহির্ভূত জ্ঞানলব্ধ পুণ্যের শ্ৰেষ্ঠত্ব প্ৰতিপাদন করেছে।
নৈতিক আদর্শ অনুযায়ী পরিচালিত জীবনও স্বৰ্গলাভে সমর্থ–এই মতবাদ সমাজের অন্যজ্ঞ পরায়ণ অংশের পক্ষে যথোপযুক্ত হলেও তা যাজক-শ্রেণীর মৌল অস্তিত্বকে বিপন্ন করেছিল। তাই, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ–এই উভয়বিধ গ্রন্থ বারেবারে দুটি বর্ণের পারস্পরিক নির্ভরতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।–তৎকালীন সমাজে যার প্রয়োজন ছিল সর্বাধিক, অথচ প্ৰচলিত ধর্মচর্য ও উপাসনাপদ্ধতি যার নিশ্চয়তা বিধান করতে পারেনি। ব্ৰাহ্মণদের স্বাৰ্থ বিঘ্নিত করার অপরাধে ক্ষত্রিয়দের ধবংস সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন সতকীকরণের মধ্যে আমরা আরো একটি প্রমাণ পাই যে, এধরনের ঘটনা তখন সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল না। শ্রেণী হিসাবে ব্রাহ্মাণ ক্ষত্রিয়দের মধ্যে কেউ যে পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র ছিল না এবং জীবন ও সমৃদ্ধির প্রয়োজনে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল ছিল–উপনিষদের বিবরণ থেকে এই তথ্য যেমন স্পষ্ট, তেমনি আমরা বুঝতে প্লারি যে, উভয়বর্ণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাতজনিত স্নায়বিক উদ্বেগ নিরসন করার পথ অন্বেষণ করারও প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজনের আত্যন্তিক তাড়নায় এ ধরনের বিশিষ্ট সমন্বয়ের ভিত্তিতে সমাধান আবিষ্কৃত হল, আশ্রমধর্মের প্রবর্তন তারই একটি উপায়।
ত্ৰিবিধ প্ৰধান যজ্ঞানুষ্ঠান, পশু, সোম ও ইষ্টির মধ্যে প্রথম দুটিতে পশুবলি প্রয়োজন। সমৃদ্ধির দিক দিয়ে পরস্পর-প্রতিদ্বন্দ্বী নগররাষ্ট্রগুলির উত্থান এবং ততদিনে সামাজিক সম্মানের প্রতীকে পরিণত আড়ম্বরপূর্ণ যজ্ঞানুষ্ঠানের ফলে গোধনের প্রবল অপচয় হচ্ছিল। সেসময় লোহার লাঙ্গলের সঙ্গে ভারবাহী পশু কৃষিকার্যের অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছিল বলে এই অপচয়ে বৈশ্য সম্প্রদায় বিশেষভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল। শুধু তাই নয়, বাণিজ্যমার্গে যাতায়াতকারী শকটগুলির জন্যও এসব পশু প্রয়োজনীয় ছিল। সুতরাং অতিপাল্পবিত জটিল যজ্ঞাগুলি বৈশ্য সম্প্রদায়ের স্বার্থকে কঠোরভাবে আঘাত করেছিল। তাই যজ্ঞবিরোধী বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম যে বণিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সুদৃঢ় ভিত্তি ও আশ্রয় পেয়েছিল, তা মোটেই আকস্মিক নয়, কারণ এই যুগেই সমাজে বৈশ্যদের সমুত্থান সূচিত হয়েছিল।
উপনিষদে ক্ষত্ৰিয়শ্রেণী যদিও প্রধান সামাজিক বর্ণরূপে চিত্রিত হয়েছে, তব এই যুগেই বাণিজ্যরত বৈশ্যশ্রেণী, প্রকৃতপক্ষে সমাজে তাদের অবস্থানকে মর্যাদাযুক্ত করে তুলেছিলেন। ভারতবর্ষে সীমা-বহির্ভূত দেশগুলির সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্য খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে পুনঃস্থাপিত হয়েছিল এবং ব্যবসায়ীরা ক্রমশ অধিক সমৃদ্ধিশালী ও সমাজের অন্য বর্গের উপর কম নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। তাই উপনিষদের যুগ শুরু হয়েছিল শক্তিশালী ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের পরস্পর-নির্ভরতা দিযে; ক্রমশ চিন্তাধারার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দানের ভার ক্ষত্রিয়বর্গের উপর বিন্যস্ত হল। এই যুগের শেষ পর্যায়ে আধ্যাত্মিক চিন্তার ক্ষেত্রে প্রাধান্য যদিও তখনো পর্যন্ত মূলত ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণদেরই ছিল, তবু বৈশ্যশ্রেণীও নব্য চিন্তাধারার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন,—এবং এদেরই হাতে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতি থেকে লব্ধ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল। এরা ক্রমশ যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রতি বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। স্থিতিশীল যজ্ঞীয় ধর্মচর্যার যেহেতু আর্থনীতিক দিক থেকে বহুমূল্য গোধন ও সম্পদের অপচয় ঘটে, তাই তার পরিবর্তে ব্যয়ভারহীন ও নীতিনিষ্ঠ মুক্তিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠাই ক্ৰমে জনসাধারণের কাম্য হয়ে উঠল।
অন্যদিকে বর্ণভেদপ্ৰথা দ্রুত শিলীভূত ও বর্ণগত সঞ্চরণশীলতা নিরুদ্ধ হওয়ার ফলে শূদ্ৰশ্রেণী সমাজে নিজেদের অধিকারের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছিল। এই অধিকারগুলি সমাজের সুদিনেও তাদেব পক্ষে নিরতিশয় স্বল্প ছিল, কিন্তু এই যুগে তা আরো কমে গেল। তিনটি উচ্চতর বর্ণের প্রতি শূদ্ৰদের অধিকতর সেবাপরায়ণতা যে সমাজেব অধিকর্তাদের পক্ষে বেশি কাম্য হয়ে উঠেছে, তা সেসময়ে রচিত প্রাচীনতর ধর্মসূত্রগুলির সাক্ষ্য থেকে স্পষ্ট। শূদ্ররা যেহেতু সমাজের বিপুল অংশ, বর্ণনির্ভর সামাজিক অধিকার ও অনমনীয় বৰ্ণভেদপ্রথার উ*া বা প্রতিষ্ঠিত যজ্ঞধর্ম সম্পর্কে তাদের বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদ সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে বেড়েই গেল, কেননা বর্ণগত বিদ্বেষের ফলে তাদের সামাজিক অবস্থান প্ৰায় অমানবিক স্তরে নেমে গিয়েছিল। এই স্তরে বর্ণ এবং বর্ণগত অবস্থান, বর্ণগত মর্যাদাকে অল্প কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদের বিশেষভাবে প্ৰতিফলিত করেছে। বৈশ্যদের শ্রেণী-স্বার্থ যদিও অনেকাংশে বণিক ও কারুশিল্পীদের সঙ্ঘ দ্বারা রক্ষিত হয়েছিল, তবুও শূদ্ৰদের অবস্থান ছিল নিতান্ত হেয়, যেহেতু তারা সম্পূর্ণত প্ৰভুদের দয়ার উপর নির্ভরশীল ছিল। সুতরাং এটা একটুও বিস্ময়ের নয় যে বৈশ্যরা নূতন ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসী ধর্মপ্রচারকদের চতুস্পার্থে ধীরে ধীরে সমবেত হয়ে বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম ও অন্যান্য তপস্বী গোষ্ঠীর প্রতি ক্ৰমেই আকৃষ্ট হয়েছিল।
তাই এই বহুধাব্যাপ্ত অসন্তোষকে নিয়ন্ত্রণ করা যজ্ঞামূলক ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের পক্ষে ক্রমশ দুরূহতার হয়ে উঠল, তেমনি নব্য চিন্তাধারা দ্বারা উত্থাপিত প্রশ্নগুলির সমাধান এবং সমাজে অসন্তুষ্ট ও বিচ্ছিন্ন বিরাট অংশের সামঞ্জস্যবিধানও অসম্ভব বিবেচিত হল। ফলে, ধমীয় ভাবনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন অনিবাৰ্য হয়ে উঠল। যখন এই প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হ’ল, বৈদিক ধর্মের দ্বিতীয় প্রধান পর্যায় অর্থাৎ জ্ঞানকাণ্ড তখনই আরম্ভ হ’ল।
ব্রাত্যষ্টোমের দ্বারা প্ৰাগাৰ্য গৃহস্থদের বহু আর্যবৃত্তবহির্ভুত গোষ্ঠী আৰ্য সামাজিক সংগঠনে একাত্মীভূত হয়েছিল; তেমনি বানপ্ৰস্থ পর্যায়ের দ্বারা অরণ্যবাসী তপস্বীরা এবং যতি বা সন্ন্যাস আশ্রমের মধ্যে দিয়ে ভ্ৰমমাণ ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসী সম্প্রদায় আৰ্যসমাজভূক্ত হয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম যেখানে গৃহস্থদের এবং জৈনধর্ম সন্ন্যাসীদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেখানে ক্যাথলিক ধর্মের মতো প্ৰাচীনতর ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম কিন্তু তার অন্তহীন গতিশীল প্রক্রিয়ার দ্বারা আপন পরিধির পরিসর ক্রমান্বয়ে প্রসারিত করে সর্ববিধ প্ৰতিবাদী ধমীয় অভিজ্ঞতা ও আচরণবিধিকে আত্মসাৎ করে নিয়েছিল। ছান্দোগ্য উপনিষদের একটি অংশে (৮ : ১৫ : ১) প্ৰথম তিনটি আশ্রম অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; আবার ঐ উপনিষদেরই অন্য একটি অংশে (৫ : ১০ : ২, ৩) বিকল্প ধর্মচর্যারূপে অরণ্যে ‘শ্রদ্ধা’ ও ‘তপঃ’ নির্দেশিত হয়েছে, যার সাহায্যে যজ্ঞাপরায়ণ গৃহস্থ উন্নততর আধ্যাত্মিক অবস্থানে উপনীত হতে পারেন। এই যুগে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের ক্রমোন্নতি ও সামাজিক প্রাধান্য অর্জন এবং সাহিত্যে অর্থাৎ সমাজে তাদের আদর্শায়িত আত্ম-প্রতিকৃতির প্রতিফলন লক্ষণীয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাণিজ্য, ভূমির ব্যক্তিগত স্বত্বাধিকার ও রাজনৈতিক-আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বতন্ত্র্যবাদ মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় ক্ৰমাগত বর্ধিত হচ্ছিল। বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম–এই দুটি শ্রমণ ধর্ম, যে দুটি সর্বাধিক ব্যক্তিস্বতন্ত্র্যবাদী শ্রেণীর অর্থাৎ বণিক ও রাজন্যদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তার কারণ এদের আদর্শগত প্রয়োজনও ধর্মদুটি দ্বারা রক্ষিত হয়েছিল। এভাবে নৈতিক ব্যক্তিস্বতন্ত্র্যবাদকে সামাজিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রসারিত অভিব্যক্তি এবং জন্মান্তরপ্রাপ্ত সত্ত্বাকে নৈতিক প্রতিরূপ বলে মনে হয়।