মুনি বলে অবধান গুনহ রাজন।
মুনিস্থানে স্বর্গ হতে এল সর্ব্বজন।।
অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী একত্র মিলিয়া।
ব্যাসের সদনে সবে মিলিল আসিয়া।।
দেখিয়া সন্তুষ্টচিত্ত হৈয়া মুনিবর।
কহিলেন সকলেরে ডাকিয়া সত্বর।।
মনের বাসনা পূর্ণ হইল সবাকার।
ইষ্ট মিত্র বন্ধু সবে দেখ আপনার।।
দিব্যরথে আসিল যে সারথি সহিত।
গঙ্গার নন্দন ভীষ্ম সংগ্রামে পন্ডিত।।
দিব্য শরাসন হাতে দিব্য শর তূণ।
মালতীর মালা গলে শোভে চতুগুন।।
দিব্য শঙ্খ বাদ্য পূরি গগণমন্ডলী।
এইরূপে দেখা দেন ভীষ্ম মহাবলী।।
দিব্য ধনুর্ব্বাণ করে দ্রোণ মহাশয়।
দিব্য রথসজ্জা রক্তবর্ণ চারি হয়।।
সপ্ত কুম্ভ কমন্ডলু ধ্বজ মনোহর।
দিব্য শঙ্খ শব্দেতে পূরিত চরাচর।।
শুক্ল বস্ত্র পরিধান ভূষণ মলয়জ।
স্কন্ধেতে উত্তরী অঙ্গে ভূষিত মলয়জ।।
স্কন্ধেতে উত্তরী অঙ্গে ভূষিত কবচ।
দিব্যরথে আরোহিয়া কর্ণ মহাবল।।
অক্ষয় কবচ অঙ্গে মকর কুন্ডল।
অগুরু চন্দন শোভে পদ্ম পুষ্পমাল।।
আজানুলন্বিত ভূজ বিক্রমে বিশাল।
দিব্যরথে সারথি বিজয়ী ধনুর্ব্বাণ।।
অখন্ডমন্ডল বিধু জিনিয়া বয়ান।
সিংহনাদ শঙ্খনাদে পূবে বনস্থলী।।
প্রফুল্লবদনে সবে আশ্বাসয়ে বলি।
ভগদত্ত জয়সেন জয়দ্রথ রাজা।।
দুঃশাসন দুম্মুখ বিকর্ণ মহাতেজা।
শত ভাই সহিত নৃপতি দুর্য্যোধন।।
শকুনি মাতুল সঙ্গে তনয় লক্ষণ।
নারায়নী সেনাগণ সুশর্ম্মা সংহতি।।
সোমদত্ত ভুরি শ্রবা শল্য মহারথী।
প্রতিবিন্দ অনুবিন্দ আর জরাসন্ধ।।
কাশীরাজ কান্বোজ সহিত নৃপবৃন্ধ।
দন্ড ধনুর্ব্বাণ করে সুষেণ নৃপতি।।
কলিঙ্গ ঈশ্বর শত অনুজ সংহতি।
অলম্বুষ অলায়ূধ রাক্ষস সকল।।
বিপরীত গর্জ্জনে পূরিছে বনস্থল।
দিব্যরথে আরোহিয়া ঘটোৎকচ বীর।।
কনক কুন্ডল কর্ণে প্রকান্ড শরীর।
মহাবীর অভিমন্যু শুভদ্রানন্দন।।
দিব্যরথে আরোহিয়া হাতে শরাসন।
দ্রুপদ নৃপতি পুত্রগণ সমুদিত।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন শিখন্ডী সহিত সত্রাজিত।
সপুত্র বিরাট রাজা সহ দুই ভাই।।
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র দেখ এক ঠাঁই।
জরাসন্ধসুত সহদেব ধনুর্দ্বর।।
শিশুপাল তনয় চেদীর নৃপবর।
পূর্বেব কুরুক্ষেত্রে সবে ভারত সমরে।।
সমর করিল তাঁরা যেমন প্রকারে।
সেই ধনুর্ব্বাণ সেই রথ আরোহণ।।
সেই অশ্ব সারথি মাতঙ্গ অশ্বগণ।
রথ রথী অশ্বের উপরে আসোয়ার।।
গজেতে মাহুতগণ পর্ব্বত আকার।
ধানুকী ধনুক হাতে চর্ম্ম অসি ঢালী।।
অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী এক ঠাঁই মেলি।
নিজ নিজ বান্ধব পাইয়া দরশন।।
আনন্দ সাগরে ভাসিলেন সর্ব্বজন।
ধৃতরাষ্ট্রে দিব্যচক্ষু দিলা মুনিবর।।
আত্মীয় সকলে দেখে অন্ধ নৃপবর।
আনন্দ সাগরে ভাসে কুরু নরপতি।।
হরিষে চক্ষুর জলে তিতে বসুমতী।
দুর্য্যোধন আদি এক শত সহোদর।।
প্রণমিয়া দান্ডাইল অন্ধের গোচর।
পুত্রগণ কোলে করি অন্বিকানন্দন।।
অনিমিষ নয়নে করয়ে নিরীক্ষণ।
আলিঙ্গন শিরোঘ্রাণ বদনে চুম্বন।।
মনের মানসে করে কথোপকথন।
ভীষ্ম দ্রোণ ভগদত্ত শল্য নরপতি।।
কর্ণ ভূরিশ্রবা জয়দ্রথ মহামতি।
ধৃতরাষ্ট্র নিকটে বসিল সর্ব্বজন।।
কানন ভিতরে হৈল হস্তিনাভুবন।
পূর্ব্বমত সভা করি বৈসে অন্ধরাজ।।
পাত্রমিত্র ইষ্ট বন্ধু সকল সমাজ।
ব্যস্ত হয়ে গান্ধারী ধরিল পুত্রগণে।।
প্রণমিল শত পুত্র মায়ের চরণে।
শত পুত্র কোলে করি সুবল নন্দিনী।।
হরিষে চক্ষুর জলে তিতিল মেদিনী।
ঘন ঘন চক্ষুর জলে তিতিল মেদিনী।।
অনিমিষ নয়নে পুত্রের মুখ দেখে।
আনন্দ সাগরে সবে হইল পূর্ণিত।।
অন্য অন্য কহে কথা মনের পীরিত।
পূলকে পূর্ণিত পঞ্চ পান্ডুর নন্দন।।
খন্ডিল সকল তাপ আনন্দিত মন।
ভীষ্ম দ্রোণ চরণে করিল নমষ্কার।।
মদ্ররাজে সম্ভাষে মাতুল আপনার।
কর্ণেরে প্রণাম করে পঞ্চ সহোদর।।
আনন্দে চক্ষুর জল বহে খরতর।
ভ্রাতৃগণ সঙ্গে কর্ণ করি আলিঙ্গণ।।
কুন্তীর নিকটে গেল ভাই ছয় জন।
প্রণাম করিল কর্ণ কুন্তী পদতলে।।
আনন্দে ভাসিল কুন্তী পুত্র নিল কোলে।
ঘন ঘন চুম্ব দেন বদনকমলে।
বার বার অনিমিষ নয়নে নেহালে।।
খন্ডিল সকল পাপ আনন্তি মনে।
কোলে করি বৈসে কুন্তী পুত্র ছয় জনে।।
কথোপকথন করে মনের হরিষে।
সব পাসরিল যত দুঃখ শোক ক্লেশে।।
বৃষসেন আদি যত কর্ণের কুমার।
ঘটোৎকচ অভিমন্যু পঞ্চপুত্র আর।।
নিকটে আসিয়া সবে হৈল উপনীত।
পাঞ্চাল বিরাট বন্ধুগণের সহিত।।
পুত্রগণ পেয়ে কুন্তী হৃদয়ে লইল।
হরিষে নয়নজলে স্মান করাইল।।
ঘটোৎকচ পেয়ে তবে ভীমসেন বীর।
আলিঙ্গন করি ভীম পুলক শরীর।।
অভিমন্যু করি কোলে বীর ধনঞ্জয়।
আসিয়া সুভদ্রা দেবী পুত্র কোলে লয়।।
মাতা পিতা সন্বোধিয়া অভিমন্যু রথী।
পরীক্ষিত পুত্র কোলে নিল শীগ্রগতি।।
বসিল উত্তরাদেবী অভিমন্যুপাশে।
নানা কথা আলাপন করে পরিতোষে।।
দুর্য্যোধন আদি করি ভাই শত জন।
পঞ্চ ভাই পান্ডব করিল সম্ভাষণ।।
পূর্ব্বমত শত্রুভাব নাহিক এখন।
অন্য অন্য সম্ভাষা করয়ে হৃষ্টমন।।
পঞ্চ পুত্র পেয়ে তবে দ্রুপদ-কুমারী।
আনন্দে পূর্নিতা হৈল পুত্র কোলে করি।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন শিখন্ডী দ্রুপদ নরপতি।
ভ্রাতৃ জ্ঞাতি দেখি কৃষ্ণা আনন্দিত মতি।।
করযোড়ে প্রণমিল পিতার চরণে।
যথাবিধি সম্ভাষা করিল ভ্রাতৃগণে।।
ধরিয়া পিতার হস্ত দ্রৌপদী সুন্দরী।
শোক দুঃখ সম্বরে বিলাপ বহু করি।।
আনন্দে পূর্ণিত মনস্তাপ গেল দূরে।
নানা কথা আলাপন হরিষ অন্তরে।।
দ্রুপদ বিরাট আদি যত বন্ধুগণ।
পঞ্চভাই পান্ডব করিল সম্ভাষণ।।
অতি হৃষ্টচিত্ত হৈয়া ভাই পঞ্চজন।
সম্ভাযিয়া তোষেণ যতেক বন্ধুগণ।।
নিজ নিজ পতি দেখি যত নারীগণ।
সম্ভমে পতির পাশে আইল তখন।।
হরষিত হয়ে স্বামী বসাইল পাশে।
ইষ্টকথা আলাপনে সবারে সম্ভাষে।।
দুর্য্যোধন পাশে বসি ভানুমতী নারী।
তনয় লক্ষণ কোলে করিল সুন্দরী।।
দুঃশাসন সহ ঊনশত ভাই আর।
নিজ নিজ পত্নী লৈয়া বসে যে যাহার।।
এমত প্রকারে সবে বঞ্চিল রজনী।
নহিল নহিবে হেন অপূর্ব্ব কাহিনী।।
এইরূপে হৈল সব তাপ বিমোচন।
সাধু সাধু মুনিবর কহে সর্ব্বজন।।
মনোগত নারীগণে ভাবয়ে হৃদয়।
এমত রজনী যেন প্রভাত না হয়।।
পাছে পুনঃ স্বামীসনে হয়ত বিচ্ছেদ।
এই হেতু সবার হৃদয়ে বাড়ে খেদ।।
চাপিয়া চরণে ধরে নিজ নিজ পতি।
দেখিয়া ব্যথিত হৈল যত মহামতি।।
মুনিবাক্য শুনি তব্ আনন্দ অপার।
দৃঢ় করি ধরে সব স্বামী আপনার।।
তবে ধৃতরাষ্ট্র স্থানে বসি পঞ্চজনে।
বিদায় মাগিল সবে অন্ধের চরনে।।
শোকেতে কান্দেন অন্ধ গান্ধারী সহিত।
বিচ্ছেদ করিতে আর না হয় উচিত।।
দেখিয়া সকলে তবে প্রবোধিয়া কয়।
অকারণে শোক কেন কর মহাশয়।।
কত দিন বনে যোগ কর আচরণ।
অচিরে পাইবে আমা সবার দর্শন।।
ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী সহিত ভোজসুতা।
পঞ্চ ভাই পান্ডুপুত্র দ্রুপদ দুহিতা।।
সবারে প্রবোধ করি মাগিল বিদায়।
নিজ নিজ পত্নীগণে লৈয়া সবে যায়।।
উত্তরা সুন্দরী যায় অভিমন্যু সাথে।
দেখি যুধিষ্ঠির রাজা লাগিল চিন্তিতে।।
কহিলেন ব্যাসপদে করিয়া প্রণতি।
উত্তরা চলিল অভিমন্যুর সংহতি।।
মাতৃহীন হইবেক রাজা পরীক্ষিত।
উত্তরারে যাইবারে না হয় উচিত।।
যুধিষ্ঠির বাক্য শুনি চিন্তিত হৃদয়।
উত্তরারে রাখিলেন মুনি মহাশয়।।
অপর সকল নারী স্বামীর সংহতি।
স্বর্গপুরে চলে সবে পতিব্রতা সতী।।
সংসারের মায়া কেহ না করিল আর।
মুনির প্রসাদে ভবসিন্ধু হৈল পার।।
হেনমতে অবশেষ হইল রজনী।
দশদিক প্রসন্ন প্রকাশে দিনমনি।।
দিব্যজ্ঞান জন্মে সব পাপের বিনাশ।
আশ্রমিক পর্ব্ব কথা কহে কাশীদাস।।