০৯. বারলোর বাড়ি থেকে বেরিয়ে

০৯.

আরো দেড় ঘণ্টা পর বারলোর বাড়ি থেকে বেরিয়ে হারমাস এবং অ্যানসন ফেরার পথ ধরলেন।

অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কাটলো। অবশেষে প্রথম কথা বললেন হারমাস, দেখুন মিঃ অ্যানসন ম্যাডক্সকে আপনি বুড়ো হাবড়াই বলুন আর যাই বলুন লোকটার মাথা আছে। একবার ভেবে দেখুন, সাধারণ একটা কেরাণী, ফুলের দোকানের সামান্য মাইনের চাকরী সেই লোকটাই যখন হঠাৎ করে পঞ্চাশ হাজার ডলারের এক জীবনবীমা করিয়ে বসে তখন তো স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে। ম্যাডক্স তো আগেই সন্দেহ করেছিলেন। আজ ওদের বাড়ী দেখে সন্দেহটা আমার মনেও বদ্ধ মূল হল।

অ্যানসন গিয়ার পাল্টে গাড়ির গতিবেগ একটু বাড়ালো, একটা জিনিস আপনি ভুলে যাচ্ছেন মিঃ হারমাস, ওর ইনসিওর করার কারণটা একবার দেখুন। স্বাধীন ব্যবসা করবেন, পলিসি জমা রেখে ব্যাঙ্কের কাছ থেকে টাকা ধার নেবেন, তাই এই বীমা, এসব কথা আমি আগেই মিঃ ম্যাডক্সকে বলেছি। তাছাড়া, আমারই বা কী করার থাকতে পারে বলুন, আমি তো আর যেচে যাইনি ওদের বীমা করতে।

সে ত ঠিকই। একশোবার ঠিক। তবে, হারমাস আড় চোখে অ্যানসনের দিকে তাকিয়ে বললেন এত সাধারণ রোজগারের একটা লোক এত টাকার বীমা করালেন। সইসাবুদ করার আগে একটু ভাল করে ভেবে দেখলে পারনে।

কি আর ভাববো বলুন তো, যাওয়া মাত্রই বাগান দেখিয়ে বলল বীমা করানোর উদ্দেশ্যটা কি। প্রথম প্রিমিয়ামের টাকাটা পর্যন্ত নগদ দিতে রাজী হলো, আমার আর আপত্তি করার কারণ রইল না।

পুরো টাকাটাই নগদে দিল?

হ্যাঁ?

বাড়ী দেখে তো মনে হয় না, অত টাকা নগদ বের করার ক্ষমতা ওর ছিল।

অত জানিনা মশায়, যা ভালো বোঝেন করুন। এই নিয়ে জলঘোলা করুন, ঘোট পাকান, যাঃ খুশি তাই করুন গিয়ে। আমার অষ্টরম্ভা। আমি সাতে পাচে নেই।

না না সে তো ঠিকই থাকতে যাবেনই বা কেন? সে যাকগে এবার মিসেস বারলো সম্বন্ধে আমাকে কিছু বলুন। মহিলাটি কেমন?

আমি তার কি জানি? অ্যানসন ঠোঁট উল্টে বললো, দেখতে ভালো, বয়েস অল্প, এছাড়া আর কিছুই আপনাকে বলতে পারবো না।

স্বামী স্ত্রীর বেশ মিল ছিলো, কি বলেন?

হ্যাঁ তা ছিল বৈকি, বেশ মিল ছিল।

তাই নাকি? তা কি দেখে বুঝলেন সদ্ভাব ছিল?

অ্যানসন প্রমাদ গুনলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই প্রশ্ন। ইহঁ বাবা, হতে পারো তুমি ম্যাডক্স এর পেয়ারের লোক, আমিও কমতি যাই না। আমাকে তুমি শত চেষ্টা করেও টুপি পরাতে পারবে না, তুমি যদি থাকো ডালে ডালে, আমি থাকবো পাতায় পাতায়।

অ্যানসন স্থির দৃষ্টিতে সামনের রাস্তা দেখলো। বললো, ঠিক কি দেখে বুঝলাম জানিনা। তবে দেখে মনে হল তাই বললাম। এছাড়া একদিন মিঃ বারলোও কথায় কথায় ওর স্ত্রীর খুব সুখ্যাতি করছিলেন।

মিঃ অ্যানসন আপনি ঠকেছেন। বারলোর কথায় বিশ্বাস করে আপনি আসল রহস্য ধরতে পারেন নি। দোতলায় কোনো দিন গেছেন কি?

না, কেন?

 গেলে বুঝতেন বারলো আপনাকে কি ধোঁকাই না দিয়েছে। ওরা দুজন আলাদা ঘরে শুতে।

বারলোর বিছানার চাদরটা বোধহয় বছর খানেক হলো কাঁচা হয়নি। তাছাড়া একটু দোনামনা করে হারমাস বললো, লোকটা ছিল এক নম্বরের বিকৃতকামী। ওর ঘরে আমি কখানা বাজে ধরনের বই পেয়েছি।

কি জানি হতে পারে। আমার তো ধারণা ছিলো, দুজনেই বেশ সুখী।

আপনার ধারণা ভুল মিঃ অ্যানসন। বিয়ে তো এখনও করেননি, করলে বুঝতেন। যে স্ত্রী স্বামীকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, সহস্র কাজের ফাঁকেও সে ঘর-দোর নিখুঁতভাবে গুছিয়ে রাখে। অমন শুয়োরের খোঁয়াড় করে রাখে না।

হতে পারে, আবার এও হতে পারে যে মিসেস বারলো ঘরদোরের কাজ তেমন জানেন না। সব মেয়েই তো আর একরকম হয় না।

এখনই এত যুক্তিতর্কের অবতারনা আমি করতে চাই না মিঃ অ্যানসন। আগে ডিটেকটিভ এজেন্সির সেই রিপোর্টটা পড়ি, তারপর এ সম্বন্ধে আপনার সঙ্গে তর্ক করবো।

তখন থেকে খালি রিপোর্ট রিপোর্ট করছেন, কি আছে রিপোর্টে?

এখনও দেখিনি। ম্যাডক্স দেখেছেন, উনি সব জানেন।

 গাড়ি এসে মার্লবোরো হোটেলের সামনে থামলো। হারমাস গাড়ি থেকে নামলো।

অ্যানসন হাসলো, আমার তো আর থাকার উপায় নেই, আধ ঘণ্টা বলে বেরিয়ে কত দেরী হয়ে গেল বলুন। আমি যাই, কাজকর্ম অনেক বাকী পড়ে আছে।

হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই, আমার জন্য ভাববেন না। খানিকটা বিশ্রাম করে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ যাবো জেনস-এর অফিসে। ওখান থেকে ওর সঙ্গে হাসপাতালে যাব। মিসেস বারলোকে একটু বাজিয়ে দেখতে হবে, ঠিক আছে আপনি তাহলে আসুন। দুজন করমর্দন করলেন, আচ্ছা আবার দেখা হবে, কতদূর কি এগোল, সময় মতো আপনাকে সব জানাবোখন।

মৃদু হেসে হাত নেড়ে অ্যানসন গাড়ি ছাড়লো। হারমাস একদৃষ্টে তার গমনপথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হোটেলের রিসেপশনিষ্ট-এর দিকে এগোলেন।

হোটেলের বিপরীত দিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ফেললি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

অ্যানসন গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলো। সঙ্গের লোকটা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল তার গমন পথের দিকে, তারপর ধীর পায়ে এগোল। রিসেপশনিষ্ট টম নর্ডলির ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো, এই যে টম ব্যস্ত নাকি?

টম ঘাড় তুলে একবার ললিকে দেখলো তারপর বলল হ্যাঁ তা একটু ব্যস্ত বইকি, কেন দরকার কি?

দরকার মানে, ব্যাগ খুলে এক ডলারের একখানা নোট বের করে ললি তার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ঐ রোমিওটি কে, সেটা বলতে পারবে?

টম হাত বাড়িয়ে খপ করে নোটটা চেপে ধরে বলল, উনি স্টিভ হারমাস, ন্যাশনাল ফাইডেলিটি ইনসুরেন্সের তদন্ত বিভাগের বড়কর্তা। ললি, ওদিকে তোমার বিশেষ সুবিধে হবে না বড় শক্ত চাঁই।

তদন্ত বিভাগ? ললি নাচিয়ে বলল, পুলিস-টুলিস নাকি?

না, পুলিস না, তবে পুলিস বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। বারলো হত্যা রহস্যের কিনারা করতে এখানে এসেছেন।

হু, হত্যা রহস্যের তদন্তে যখন এসেছেন তখন তো পুলিসই।

 ঐ হলো আর কি যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন।

ঠিক আছে, চলি। পরে আবার দেখা হবে। দরজার দিকে এগোল ললি। টম হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

প্রু টাউন হাসপাতালের ডাক্তার হেনরী প্রবীন এবং বিচক্ষণ চিকিৎসক। মাথার চুল তার ধবধবে সাদা, মুখে বয়েসের রেখা সুস্পষ্ট। জেনস এবং হারমাসকে দেখে তিনি সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বসতে বললেন।

ইনি মিঃ হারমাস, ন্যাশনাল ফাইডেলিটি ইনসুরেন্সের তদন্ত বিভাগের প্রধান। চেয়ারে বসতে বসতে জেনস বললো, বারলো এদের কাছে কোম্পানীর বীমা করিয়েছিলেন। তাই..

হারমাস হাত তুলে বললেন, এক মিনিট, পাছে হেনরী ভুল করে তাকে আবার অন্য কিছু ভেবে বসেন তাই আগেই তিনি সাবধান হলেন বললেন যে, আমি তদন্ত করতে এসেছি ঠিকই তবে একা একা কিছু করবো না যা করার জেনসন্-এর সঙ্গে মিলে মিশেই করবো। কোম্পানীর যাবতীয় দাবী সম্পর্কিত পলিসির তদন্ত করাই আমার কাজ। বারলোর পলিসি সম্পর্কে এখনও কোন দাবী আমাদের দপ্তরে পৌঁছয় নি। তবু আগে থেকে যতটা সম্ভব সতর্ক হওয়া দরকার। তাছাড়া পলিসির অঙ্কটাও নেহাত কম নয়। পঞ্চাশ হাজার ডলার। মাত্র দশদিন আগে তিনি বীমা করিয়েছিলেন। দশদিন পরেই এই দুর্ঘটনা। তা দুর্ঘটনা হোক আর যাইহোক, টাকা তো আমাদের দিতে হবে। সুতরাং দাবীর যথার্থতা সম্বন্ধে আগে ভাগেই চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করে রাখা ভালো। কি বলেন ঠিক কিনা।

হ্যাঁ ঠিকই কিন্তু মুশকিল হল, হেনরী দু-হাত তুলে এক অসহায় ভঙ্গী করলো, আমিতো এর মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে.এত সব বলার কারণই বা কি?

হারমাস বললেন কারণ এই মিঃ হেনরী, দাবী পূরণের আগে আমাদের স্থির নিশ্চিত হতে হবে যে মিসেস বারলো সত্যি সত্যিই ধর্ষিত হয়েছিল কি না এ সম্পর্কে আপনার রিপোর্ট আমাদের কাছে যথেষ্ট মূল্যবান।

হেনরী ব্যস্ত হলেন। ও এই কথা। তা বেশতো রিপোর্ট দেবোখন। মিসেস বারলো যথার্থই আক্রান্ত হয়েছিলেন। চোয়ালের হাড় তার সরে গেছে। তাছাড়া তাকে খুব বাজেভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে, বরং আপনারা যদি বলেন তাহলে ওর কাছ থেকে জেনে ঘটনার যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার বিবরণ আমার রিপোর্টে ঢুকিয়ে দেবো।

না, না, অতো খুঁটিনাটির দরকার নেই। আপনার রিপোর্টটুকুই যথেষ্ট। তা এখন কি আমরা ওর সঙ্গে কথা বলতে পারি?

হ্যাঁ, পারেন। চলুন আমিই নিয়ে যাই আপনাদের। তবে একটা অনুরোধ, কথা যতদূর সম্ভব সংক্ষেপে সারতে পারেন ততই ভালো। কারণ অবস্থার এখনও তেমন কিছু পরিবর্তন হয়নি। এছাড়া মানসিক আঘাতওঁ কম নয়।

বুঝেছি, আমাদের অতটা অবিবেচক ভাববেন না মিঃ হেনরী। জেনস উঠে দাঁড়ালো, শুধু কিভাবে কি ঘটেছে, আততায়ীর চেহারার বর্ণনাটুকু জেনেই আমরা চলে যাবো। বেশী প্রশ্ন করে ওকে বিরক্ত করবো না।

ডাক্তারের পেছন পেছন দুজন এসে এক কেবিনে ঢুকলেন। ঘরের এক কোনের টেবিলে ওষুধপত্র এটা সেটা। মাঝখানে একটা দুধ-সাদা শয্যায় শুয়ে আছেন এক মহিলা। তার চোখ দুটো বোজা, বালিশের সাদা ঢাকনা ছাপিয়ে একমাথা পিঙ্গল চুলের রাশ রয়েছে এলিয়ে, সাদা চাদর বুক অবধি ঢাকা।

দরজার কাছে জেনস এবং হারমাসকে দাঁড় করিয়ে রেখে হেনরী বিছানার কাছে এগিয়ে গেলেন। মাথানীচু করে মৃদু স্বরে বললেন, মিসেস বারলো, পুলিস দপ্তরের মিঃ জেনস এসেছেন আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করতে। আমি ওকে বলেছি, আপনাকে ওরা বেশি বিরক্ত করবেন না। আপনি কি এখন কথা বলতে পারবেন?

মেগ ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। বললো পারবো। এখন একটু সুস্থ বোধ করছি।

জেনসন এক পা এগিয়ে এসে বললো আপনাকে এ সময় বিরক্ত করতে আসার জন্য দুঃখিত মিসেস বারলো, কিন্তু কি করি উপায় নেই। পুলিস হিসাবে যেটুকু করার তা তো আমাকে করতেই হবে। অবশ্য আপনাকে বেশি বিরক্ত করব না। দু-একটা প্রশ্ন করে চলে যাবো। আমাদের এখন বলুন, যে লোকটা আপনাকে আক্রমণ করেছিল তাকে কেমন দেখতে।

মেগ চোখ বুজলো। তারপর চোখ খুলে সে পাশের টেবিলটার দিকে তাকাল। টেবিলের উপর একগুচ্ছ তাজা গোলাপ।

গোলাপ দেখেই অ্যানসনের কথাগুলো তার মনে পড়ে গেল। যদি গোলাপ পাঠাই, তাহলে বুঝবে উন্মাদটা এখনো ধরা পড়েনি। অতএব মেগ বলল লোকটা বেঁটে, মোটা। মাথায় মস্ত টাক।

হু সবই মিলে যাচ্ছে। এ নির্ঘাত সেই হতভাগাটা। জেনস বললেন, আচ্ছা মিসেস বারলো, কিভাবে আপনি বুঝলেন যে লোকটার মাথায় টাক?

একটু বিরতি। মেগ আবার চোখ বুজল। তারপর যেন স্বপ্নের মধ্যে কথা বলছে সে এমনভাবে বললো, ধস্তাধস্তির সময় ওর মাথার টুপিটা খুলে গিয়েছিল, তখনই দেখলাম, একেবারে তেল চুকচুকে টাক।

আচ্ছা পরনে কি ছিল?

কালো কোট আর কপাল ঢাকা কালো টুপি। জেনসন্ ঘাড় নাড়লো, আপাততঃ এটুকুই যথেষ্ট মিসেস বারলো। আপনি বিশ্রাম করুন।

হারমাস এতোক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেগকে দেখছিলেন। বাঁ দিকের গালে চোয়ালের কাছে রক্ত জমে আছে। বাঁ চোখটা জখম হয়েছে, ফুলে আছে। নীচের ঠোঁটটা একটু কাটা। দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ভদ্রমহিলাকে বেশ শক্ত হাতেই আঘাত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কোন ভানভনিতা নেই। তবে হ্যাঁ এসব ত্রুটি সত্ত্বেও ওর সৌন্দর্য কিন্তু এতটুকু নষ্ট হয়নি। মিসেস বারলো অবশ্যই বেশ সুন্দরীর পর্যায়ে পড়েন।

জেনস প্রশ্ন শেষ করতেই হারমাস এগিয়ে গেলেন। মিসেস বারলো আমার একটা প্রশ্ন, আপনি ও আপনার স্বামী সেদিন জেনসন প্লেনে গেলেন কেন?

নীল চাখ দুটো তুলে মেগ হারমাস-এর দিকে তাকালো বললো ফিল ছাড়লোনা, যেতে চাইল, আমাদের বিবাহ বার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখতে চাইলো। প্রথমে নিয়ে গেল কোর্ট রোডহাউস রেস্তোরাঁয়, সেখান থেকে জেসনস্ প্লেন-এ, তার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। সে চোখ ঢাকল।

হেনরী ব্যস্ত হয়ে বললেন, ব্যস্ ব্যস্ এই অবধি, দয়া করে আর ওকে বিরক্ত করবেন না। ওকে একা থাকতে দিন।

হাত ধরে জেনসন এবং হারমাসকে একরকম জোর করেই তিনি নিয়ে এলেন বাইরে। দরজার এপাশে এসে হারমাস একবার ঘাড় ফেরালেন। মেগ একই ভাবে চোখ ঢেকে শুয়ে আছে।

লম্বা টানা বারান্দা দিয়ে এগোতে এগোতে জেনস বললেন আততায়ী নিঃসন্দেহে সেই লোক। শুয়োরটাকে এখনও ধরা গেলো না। কে জানে, আবার কবে কি করে বসে, চলো বারলোকে গিয়ে একবার দেখে আসি।

কিন্তু বারলোকে দেখে কি হবে হারমাস?

লাভ বইকি, অমন একখানা জিনিসকে পঞ্চশরে গাথলেন যিনি, তাকে তো চোখে দেখাও ভাগ্যের কথা হে জেনসন। চলল চলো দেখেই আসি একঝলক।

মর্গের নিগ্রো ভৃত্যটি সাদা চাদর সরিয়ে তাদের ডাকলো, আসুন দেখে যান, অবশ্য দেখার কিই বা আর আছে?

জেনসন আগেই দেহটি দেখেছিলেন। তিনি আর এগোলেন না। সিগারেটে ঘন ঘন টান দিয়ে তিনি মনের বিরক্তি চাপা দিলেন।

হারমাস পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইলেন মৃতদেহটির দিকে। তারপর ভৃত্যটিকে মৃতদেহ ঢাকতে বলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারপর তাকালেন জেনস-এর দিকে, বললেন আচ্ছা যে গুলি খেয়ে উনি মরেছেন সেই গুলিটা সম্বন্ধে কোন রিপোর্ট পেয়েছ?

না, এখনও পাইনি?

 পেতে কত দেরী হবে?

ফিরে গিয়েই পেতে পারি।

 তাহলে চল, আর দেরী করে লাভ নেই। রিপোর্টটা আমার দরকার।

কারনারের অফিসে ঢুকে ব্যালিস্টিক দপ্তরে ফোন করলেন জেনস। হারমাস চিন্তান্বিত স্বরে বললেন, একটা হিসেব কিছুতেই মেলাতে পারছি না। অমন রূপসী বউ, বারলোর কি দেখে সে মজলো?

এতে আর অবাক হবার কি আছে। কথায় আছে যার যেখানে মজে মন। হা হা, বলছি ঠিক আছে টেড ধন্যবাদ, আমি যাচ্ছি হ্যাঁ এখুনি যাচ্ছি। ফোন নামিয়ে রেখে অবাক চোখে হারমাসের দিকে তাকাল জেনসন। জানো কি বললো? বললো বারলো এবং সেই আগের লোকটি দুজনেই নাকি মরেছে ৩৮ বোরের পিস্তলের গুলিতে। তবে হ্যাঁ দুটো পিস্তল দুরকমের। তাছাড়া গুলি দুটোও আলাদা। তা তুমি এসব আন্দাজ করলে কিভাবে।

কি জানি কেমন যেন মনে হল। ব্যাপার গুরুতর জেনস, ভারী গুরুতর। অবশ্য এটুকু সূত্রই আমাদের রহস্য সমাধানের পক্ষে যথেষ্ট সহায়। এমনও হতে পারে আমাদের এই টাকমাথা বন্ধুটার দুটো ৩৮ বারের বন্দুক আছে। দুটোই হয়তো সে দুবারে ব্যবহার করেছে, কিন্তু যতদূর মনে হয়…

.

 অ্যানসন সন্ধ্যে ছটা অবধি একনাগাড়ে কাজ করল। ছটা বাজতে কাগজপত্র গুটিয়ে উঠে। পড়লো। গাড়ি নিয়ে সোজা গেল মার্লবোনরা হোটেলে। হোটেলের গ্যারেজে গাড়ি তুলে কাঁচ বন্ধ করতে করতে তার মনে হাজার চিন্তা এসে ভিড় করল।

জেনসন আর হারমাস হয়তো এতক্ষণে পৌঁছে গেছেন হাসপাতালে, মেগকে জেরায় জেরায় অস্থির করে তুলেছে। এ সময় হাসপাতালে থাকতে পারলে ভাল হত। মেগ পারবে তো সব গুছিয়ে বলতে। তবে যতদূর মনে হয় পারবে। কারণ মেগ পারে না পৃথিবীতে এমন কাজ নেই।

আর ঐ এক রিপোর্ট। রিপোর্ট রিপোর্ট করে হারমাস একেবারে কানের পোকা বের করে দিলো। কি এমন আছে ঐ রিপোর্টে! মেগ কি তাহলে আমার কাছে কিছু চেপে গেছে। ম্যাডক্স কি জেনে গেছে যে মেগ-এর পিরিতের লোকটা কে?

হু, হতেই হবে। বারলোর সঙ্গে যখন মেগ এক ঘরে থাকতো না তখন নিশ্চয়ই মেগ-এর একজন নাগর আছে, আলবাৎ আছে। মেগ তাকে বরাবর ধোঁকা দিয়েছে। তা বোকামো নিজেও তোকম করেনি, ওদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মিল আছে একথাটা বলে সে ঠিক করেনি। যখন দুজনের আলাদা ঘরে থাকার ব্যাপারটা মনেই ছিল না।

জন…

অ্যানসন চমকে ঘাড় ফেরালো। ললি এসে দাঁড়িয়েছে একেবারে তার পাশে, তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

অ্যানসন অন্য দিকে মুখ ফেরালো এই যে ললি, খবরটবর ভালো তো। আমাকে আবার এখুনি বেরোতে হবে। জরুরী কাজ আছে। এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে। ঠিক আছে পরে একদিন টেলিফোনে তোমার সঙ্গে কথা বলব। ললি এক পা এগিয়ে এসে খপ করে তার হাত চেপে ধরে বললো ওসব গল্প অনেক শুনিয়েছে অ্যানসন, একই গল্প শুনতে রোজ বিশ্রী লাগে। আজ আমি তোমার কোন আপত্তিই শুনবো না। আজ সারারাত তোমার সঙ্গে থাকবো, নেশা করবো, ফুর্তি করবো, তারপর তোমার ভর্তি মানিব্যাগ বেশ খানিকটা হালকা করে তবে বাড়ি যাবো।– যাও যাও। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল অ্যানসন, রাস্তার মেয়ে, রাস্তায় এসব ন্যাকামি মারাও গিয়ে। এটা তোমার বেশ্যাখানা নয়। বড় বড় পা ফেলে সে হোটেলে ঢুকল। চাবির বোর্ড থেকে চাবি নিয়ে লিফটে উঠলো।

নির্বাক ললি তাকিয়ে রইল একভাবে। চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়লে তার দু-ফোঁটা অশ্রু। ব্যাগ থেকে ছোট রুমালটা বের করে সে চোখের জল মুছলো, তাকালো আবার লিফটের দিকে। ঠোঁটের কোনে এবার তার ফুটে উঠল কুটিল হাসি। ধীর পদক্ষেপে হোটেলের চত্বর ছেড়ে সে বাইরে এল।

.

হাতের ফাইলটা বন্ধ করে ডেস্কের এপ্রান্তে ছুঁড়ে দিলেন ম্যাডক্স। সেটা গিয়ে পড়লো মেঝেয়। সেদিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক মুখভঙ্গি করে তিনি একটা সিগারেট ধরালেন। গলগল করে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন, তারপর টেনে নিলেন আর একটা ফাইল।

ডেস্কের স্বয়ংক্রিয় টেলিফোনের সবুজ বাতিটা জ্বলে উঠলো। বোতাম চেপে ম্যাডক্স বললেন কে?

আমি প্যাটি, স্যার। মিঃ হারমাস এসেছেন।

আচ্ছা ঠিক আছে। অভ্যন্ত ভঙ্গিতে কথা কটা বলেই তিনি বাস্তবে ফিরে এলেন, আঁ কে এসেছে বললে, হারমাস? এখুনি পাঠিয়ে দাও তাকে…এই মুহূর্তে।

হারমাস দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন। সকাল সোয়া নটা। সারা রাত সমানে গাড়ি ছুটিয়ে সবে ভোর রাত নাগাদ এসে পৌঁছেছেন তিনি সানফ্রানসিসকোয়। ঘুম হয়েছে মোটে পাঁচ ঘণ্টা। শরীরটা তাই ম্যাজম্যাজ করছে।

ম্যাডক্স মুখ তুলে বললেন কি চলে এলে যে?

আসতে বাধ্য হলাম। হারমাস বিপরীত দিকের একটা চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। তারপর বললেন ওদিকের গতিক সুবিধের নয়। অনেক চমকপ্রদ খবর আছে। আপনার সঙ্গে একটু আলোচনা করতে এলাম। এক এক করে বলে যাই আপনি শুনুন। বারলো এবং তার স্ত্রী দুজনে আলাদা ঘরে শুতে।বারলো লোকটা খুবঅদ্ভুত প্রকৃতির। ওর ঘরে নানারকম বাজে বই পেয়েছি। মিসেস বারলো সত্যি সত্যিই ধর্ষিত হয়েছে। এই নিন ডাক্তারের রিপোর্ট। পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে হারমাস ম্যাডক্স-এর দিকে এগিয়ে দিলেন। হাসপাতালে যাবার আগে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। গিয়ে একেবারে গা ঘিনঘিন করে উঠলো। অমন নোংরা পরিবেশে কোন মানুষ থাকতে পারে। মর্গে গিয়ে বারলোকে দেখে এলাম। অতি কুৎসিত একজন পুরুষ। তাকে কেন যে মিসেস বারলোর মতো সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করতে গেল সেটা একটা রহস্য।

চেয়ারে পিঠ এলিয়ে মৃদু হেসে ম্যাডক্স বললেন থেমো না তারপর…

তারপর মিসেস বারলোর আবার ছোট গল্প লেখার সখ। তার লেখা গল্পের একটা খসড়া আমার হাতে এসেছে। গল্পটা এক ইনসুরেন্স কোম্পানিকে ধোকা দিয়ে বেশ কিছু টাকা হাতাবার কাহিনী। পকেট থেকে একতাড়া কাগজ বের করে তিনি ম্যাডক্স-এর দিকে এগিয়ে দিলেন। সময় পেলে একবার পড়ে দেখবেন। বেশ মাথা খাটিয়ে বের করেছে একখানা।

ম্যাডক্স কোটের পকেটে কাগজগুলো চালান করে দিয়ে হারমাস-এর দিকে তাকিয়ে বললো তারপর।

বারলো পিস্তল চালনায় ওস্তাদ ছিল। ৩৮ বোরের একটা পিস্তলও ছিলো। কিন্তু সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেটার হদিশ আমি পাইনি। বারলো এবং গ্রিন হিল-এর সেই লোকটা দুজনেই খুন হয়েছে ৩৮ বোরের পিস্তলের গুলিতে। তবে দুটো গুলি আলাদা। মিসেস বারলো আততায়ীর চেহারার এক বর্ণনা দিয়েছেন। সেই আগের খুনের পর খবরের কাগজের বর্ণনার সঙ্গে তার বর্ণনা একদম বহু মিলে গেছে।

উত্তেজনায় ম্যাডক্স-এর চোখ চকচক করে উঠল। নীচু হয়ে ড্রয়ার খুলে একখানা ফাইল বের করে তিনি এগিয়ে দিলেন হারমাস-এর দিকে, এটা নিয়ে যাও। আগাগোড়া পড়ে তারপর আবার এসো তখন আরো কথা হবে।

হারমাস ফাইলটা তুলে নিয়ে বললেন যে আর একটা কথা, ইতিমধ্যেই অ্যানসন খবরের কাগজওলাদের সব জানিয়ে টানিয়ে বসে আছে। এতে আমাদের তরফের অসুবিধে হল এই যে যখনই আমরা মিসেস বারলোর দাবী অস্বীকার করবো সঙ্গে সঙ্গে কাগজগুলো ফলাও করে তা ছেপে দেবে। আমাদের দুর্নাম দশ দিকে একেবারে মুখর হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই ওখানে মহিলাটির পক্ষে জনমত তৈরী হতে শুরু করেছে।

ম্যাডক্স হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন, ঘাবড়াও মৎ। যে সব মূল্যবান বিবরণ ফাইলটাতে আছে তার যে কোন একটা অংশ কাগজে ছেপে দিলে তোমার জনমত লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবে। আরে বাবা এ চোখ কখনও ভুল করে না। ভুয়ো ইনসিওরগুলো টেবিলে এলেই কেমন যেন একটা বাজে গন্ধ নাকে এসে লাগে। সুতরাং কোন চিন্তা নেই। আগে বাড়ো, ধীরে ধীরে এগিয়ে যাও। জয় আমাদের হবেই।

.

অতি কষ্টে বাঁদিকে একটু ঘুরে জো ডানকান রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো। ডান হাতের পেনসিলটা দিয়ে ভুড়ি চুলকোতে চুলকোতে সে ঘাড় তুলে তাকালো গেলার-এর চোখে, আজ কত তারিখ খেয়াল আছে তো?

গেলার দুহাতে আড়াল করে দেশলাই জ্বেলে একটা সিগারেট ধরালো, একমুখ ধোয়া ছাড়লো, তারপর তাকাল সিলিংয়ের দিকে খেয়াল রেখে আমার লাভ?

গেলার লাভ-লোকসানের হিসেব দিতে পারবো না, তবে এটুকু বলতে পারি, আগামী পাঁচদিনের মধ্যে পঁচিশ হাজার ডলার দিতে পারলে তোমারই মঙ্গল, নয়তো এই শেষ, তোমার সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না।

ও টাকা টাকা করে দেখছি একেবারে জ্বালিয়ে মারলে। বলছি তো দেবো, ধার করে দিতে হলেও দেবো।

ধার? অতো টাকা তোমাকে কে ধার দেবে?

হু হু বাবা, গেলারকে অতো কাঁচা ছেলে ভেবো না। আমার দিনকাল এখন বেশ ভালই যাচ্ছে। একেবারে তুঙ্গে বৃহস্পতি। হাতের কাছে রাখা প্রু টাউন গেজেটখানা তুলে নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠার খবরখানায় টোকা দিয়ে বলল, এই তো তোমার সেই রোজগেরে বউ, দেখছি একেবারে শেষ করে দিয়েছে। তা সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কিভাবে তোমাকে টাকা দেবে।

 দেবে দেবে। হাসপাতালেই থাকুক, কি চুলোর দোরেই থাকুক, টাকা ও আমাকে দেবেই। স্বামীর পঞ্চাশ হাজার কয়েক দিনের মধ্যেই ওর হাতে আসছে। সে উঠে দাঁড়াল, চলি। আরো দু-একটা ধান্দা আছে, দেরী করলে লোকসান হয়ে যাবে। গেলার বড় বড় পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

জো তার গমন পথের দিকে খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর টেলিফোন তুলে ডায়াল ঘোরাল ৯ ৮ ৬-৭…