বাংলোর সব আলো জ্বলে উঠল। বীতশোক জল খেয়ে সিগারেট ধরাল। তারপর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “ইভনিং ভিলা থেকে বোসসায়েবকে নিয়ে যখন বেরোলুম, তখন প্রায় সওয়া একটা। হ্যাঁ, টাইমফ্যাক্টরটা ইমপটান্ট। আমরা গেলুম নিউ টাউনশিপের নর্থে লেক এরিয়ায়। ওখানে ভি আই পি-দের কয়েকটা কটেজ আছে। ইন্ডাস্ট্রি মিনিস্টারেরও একটা কটেজ আছে। পাটনা থেকে তার পৌঁছুনোর কথা দেড়টা নাগাদ। আমরা প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর স্টিল অথরিটির লোকাল ডিরেক্টরের অফিসে গেলুম। সেখান থেকে আবার মিনিস্টারের কটেজে যাওয়ার কথা। কিন্তু বোসসায়েব কেন যেন হঠাৎ ইভনিং ভিলায় ফোন করলেন। লাইন পেলেন না। আমাকে চেষ্টা করতে বললেন। এবার এক্সচেঞ্জ অপারেটর বলল, ‘সামথিং রং। দা লাইন ইজ ডেড। কথাটা শুনেই বোসোহেব বললেন, বাড়ি ফিরতে চান। বাকি কাজগুলো যেন আমি সেরে নিই। তো ওঁকে ইভনিং ভিলার গেটে পৌঁছে দিলুম। তখন প্রায় পৌনে তিনটে। হর্ন শুনে যথারীতি গণেশ এসে গেটের তালা খুলে দিল। আমি ফিরে গেলুম নিউ টাউনশিপে। কেটারিং কোম্পানিকে তাগিদ দিয়ে মিনিস্টারের খোঁজে গেলুম। তিনি এসে পৌঁছাননি। বুঝলুম, আর ওঁর আসার চান্স নেই। যাই হোক, ইভনিং ভিলার কাছে গিয়ে দেখি, পুলিশের কয়েকটা গাড়ি। আমি তো ধরেই নিয়েছিলুম, প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোক সেই ভ্যাগাবন্ডটাকে খুনের দায়ে বোসোহেবকেই ফাঁসিয়েছেন, অ্যান্ড হি ইজ অ্যারেস্টেড। মাই গড! ব্যাপারটা তা নয়। বোসসায়েবকেই কেউ খুন করেছে। দোতলায় ওঁর ড্রয়িং রুমের মেঝেয় বডি পড়ে আছে। মাথার পেছনে আঘাত করেছে খুনি। খুলি ফেটে-ওঃ! হরি!”
বীতশোক চোখ বুজে দুই কাঁধ নাড়া দিল।
ঈশিতা শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “দোতলায় কেউ ছিল না তখন?”
বীতশোক বলল, “নাহ্। সেটাই তো অদ্ভুত!”
“মিসেস বোস কোথায় ছিলেন?”
“এগেন দা টাইম-ফ্যাক্টর ইজ ইমপর্টান্ট।” বীতশোক সিগারেটের ধোঁয়ার রিং বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, “মিসেস বোস দুটো নাগাদ আরিফের সঙ্গে এই বাংলোয় এসেছিলেন। ডিটেকটিভদ্রলোকের সঙ্গে কী সব কথাবার্তা বলতে এসেছিলেন। কী ব্যাপার জানি না। আরিফ ওঁকে ইভনিং ভিলার গেটে পৌঁছে দেয় সওয়া তিনটে নাগাদ। তারপর আরিফ চলে যায়। নাও সি দা ফান! বোসসায়েব যে খুন হয়ে পড়ে আছেন, সেটা আর কেউ টের পেল না। গণেশ দেখল না। তার বউ মালতী দেখল না। ওপরে গিয়ে দেখতে পেলেন মিসেস রত্না বোস!”
“পুলিশ ওঁকে অ্যারেস্ট করেনি?”
“নাহ্। আরিফ খান ইজ হার স্ট্রং অ্যালিবাই।” বীতশোক চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “মার্ডার উইপনটা এবার পাওয়া গেছে। ওই ঘরের কার্পেটেই পড়ে ছিল। রক্তমাখা ফুট আড়াই তিন লম্বা হেভি লোহার রড। এদিকে টেলিফোনের তার কাটা। পুলিশের ধারণা, খুনি পর্দার আড়ালে ওত পেতে দাঁড়িয়ে ছিল। অ্যান্ড নাও ইমাজিন হু হি ইজ? সোমনাথ!”
নীপা চেঁচিয়ে উঠল, “মিথ্যা! আমি বিশ্বাস করি না। ওকে ট্র্যাপ করা হয়েছে!”
তাকে থামিয়ে বীতশোক বলল, “ঘটনাটা শোনো আগে। উত্তেজিত হয়ে কোনও লাভ নেই। পাশের একটা ঘরের দরজা বন্ধ ছিল এবং দরজার পর্দা একেবারে ফর্দাফাই। বুলডগ কুকুরটা নখের আঁচড় কাটছিল। ভেতরে চুপচাপ বসে সিগারেট টানছিল সোমনাথ। হাতে আর জামাপ্যান্টে রক্ত। তো হাজবন্ডকে ওই অবস্থায় দেখে মিসেস বোস নাকি চিৎকার করেই ফিট হয়ে পড়ে যান। মালতী চিৎকারটা শুনেছিল। যাই হোক, টেলিফোন ডেড দেখে গণেশ থানায় খবর দিতে ছোটে। পুলিশ আসার পর বুলডগের দিকে চোখ পড়ে। গণেশ কুকুরটা সরিয়ে নিয়ে যায়। তারপর পুলিশের হুমকি শুনে সোমনাথ দরজা খোলে।”
নীপা কী বলতে যাচ্ছিল। বাধা দিয়ে ঈশিতা বলল, “সোমনাথ কী বলছে?”
বীতশোক বিরক্তমুখে বলল, “সোমনাথ একটা ইডিয়ট। শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ কোট করছে।”
নায়ার বলে উঠল, “বুদ্ধিজীবীর অসম্বদ্ধ প্রলাপ। কিন্তু তার বক্তব্য কী?”
বীতশোক বলল, “পেছনদিকের ভাঙা বাউন্ডারিওয়াল ডিঙিয়ে ঢুকেছিল। তারপর অ্যালসেশিয়ানের তাড়া খেয়ে ড্রেনপাইপ বেয়ে দোতলায় ওঠে। তোমরা লক্ষ্য করে থাকবে, ও-বাড়ির দোতলায় প্রায় সব ঘরেই ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। গরাদ বা গ্রিল নেই। নিচের তলায় অবশ্য আছে। তো সোমনাথ মরিয়া হয়ে ফ্রেঞ্চ উইন্ডো দিয়ে যে ঘরটাতে ঢোকে, সেটাই মিঃ বোসের ড্রয়িং রুম। তখনও নাকি মিঃ বোস নড়াচড়া করছিলেন। সে তাকে নাকি তুলে বসানোর চেষ্টা করে। সেইসময় বুলডগটা দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকে। অমনি সে ভয় পেয়ে পাশের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। সে ড্রেনপাইপ বেয়েই পালাতে পারত। কুকুরের ভয়ে নাকি পালায়নি। ওপরে কুকুর, নীচেও কুকুর।”
সুমিত বলল, “ব্যাটা আঁতেল কেন অমন করে ইভনিং ভিলায় ঢুকতে গেল, বলেনি?”
বীতশোক সিগারেটটা জুতোর তলায় ঘসে ডলে দিয়ে বলল, “অদ্ভুত ওর কথাবার্তা! মিসেস বোসের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল। পুলিশ ওই অ্যালিবাই মেনে নেবে কোন যুক্তিতে? মিসেস বোসের সঙ্গে কথা বলতে হলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে গেল না কেন? পাঁচিল ডিঙিয়ে গেল কেন?”
নীপা আস্তে বলল, “আরিফদা যায়নি ওখানে?”
“হ্যাঁ। হি ইজ দেয়ার।” বীতশোক বাঁকা হাসল। “প্রাইভেট ডিটেকটিভও খুব দাড়ি নাড়ছে দেখলুম। বুড়ো যেন তক্কেতক্কে ছিল। তবে একটা ব্যাপারে খটকা লেগেছে আমার। সোমনাথ আজ দুপুরে আমাকে বলছিল, একটা বডি পড়েছে। আরেকটা বডি পড়বে। এটা কি নেহাত অ্যাসিডেন্টাল, নাকি সত্যি সে কোনও আভাস পেয়েছিল?”
নায়ার দু’হাত নেড়ে বলল, “অ্যাকসিডেন্টাল। সোমনাথ চোখ দিয়ে কিছু দেখে না, মন দিয়ে দেখে।”
বীতশোক উঠে দাঁড়াল। “আমাকে বাফুন দেখাচ্ছে সম্ভবত। জেন্টলম্যান সেজে আসি চাবি দাও!”
ঈশিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো।”
বীতশোক তার গাড়ি থেকে ব্রিফকেস আর বান্ডিলবাঁধা একতাড়া ফাইল বের করল। ঈশিতা বান্ডিলটা নিল।
দুজনে লবিতে ঢুকে গেলে সুমিত চাপা স্বরে বলল, “সব স্টোরির ফ্রন্টসাইড ব্যাকসাইড থাকে। আমরা ফ্রন্টসাইডটা শুনলুম। ঈশিতা এবার ব্যাকসাইডটা শুনবে।”
নায়ার চটে গিয়ে বলল, “ব্যাকসাইড আবার কী?”
“আছে রে বাবা, আছে?” সুমিত চোখে ঝিলিক তুলল। তারপর হাততালি দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে-থাকা ক্যান্টিনবয়কে ডাকল। “এই যে ভাই! তোমার নামটা যেন কী? ঔর এক পট চায় হোগা?”
উর্দিপরা কিশোরটি এসে এঁটো কাপপ্লেট আর পটগুলো ট্রেতে সাজিয়ে দিয়ে গেল। নায়ার নীপার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। সোমনাথ হঠকারী নয়। তা ছাড়া আরিফ থাকায় সে নিরাপদ। আমরা চা খেয়ে আরিফের কাছে যাব। এটা আমাদের কর্তব্য। বিশেষ করে এই রত্নটা। শীঘ্র পুলিশকে হস্তান্তর করা উচিত।”
সুমিত সায় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। এটা একটা রিস্ক। নীপু! তুমি গিয়ে দেখ না, ফোনে আরিফকে পাও নাকি? ম্যাথু আমাদের ওপর চটে আছে। ফোন করতে দেবে না হয়তো। মহিলাদের কথা আলাদা। নীপু! দেরি কোরো না।”
নীপা অনিচ্ছা-অনিচ্ছা করে উঠে গেল।
একটু পরে বীতশোক ও ঈশিতা ফিরে এল। দুজনেই পোশাক বদলেছে। বীতশোক বলল, “নীপা কোথায়?”
নায়ার বলল, “আরিফকে ফোন করতে গেছে।”
ঈশিতাকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। আস্তে বলল, “কার মুখ দেখে যে বেরিয়েছিলুম! পালাতে পারলে বেঁচে যাই। আমার আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।”
সুমিত বলল, “মাইরি! শুধু সোমনাথটাকে কোনওরকমে ছাড়িয়ে আনতে পারলে ব্যস! আমরা কাট করব।”
ক্যান্টিনবয় চায়ের ট্রে রেখে গেল। ঈশিতা বলল, “আবার চা? আমি খাব না।”
বীতশোক বলল, “খাওয়া যাক। আমি এবার র’টি খাব।”
ঈশিতা চা করতে থাকল। সেই সময় নীপা ফিরে এল। সুমিত বলল, “পেলে ওকে?”
নীপা বসে বলল, “হ্যাঁ। থানায় কনফারেন্স বসেছে। আধঘণ্টা পরে আসবে।”
নায়ার বলল, “সোমনাথ সম্পর্কে ওর কী বক্তব্য?”
“জিজ্ঞেস করিনি। আরিফদা বলল, কনফারেন্স চলছে। বড় ব্যস্ত। তবে সে। আসবে।”
সুমিত বলল, “সোমনাথ সম্পর্কে কিছু বলল না? আশ্চর্য তো!” বলে সে চায়ের কাপ-প্লেট নিল। চায়ে চুমুক দিয়ে ফের বলল, “হু! ও যতই বন্ধুতা থাক বাবা, পুলিশ ইজ পুলিশ।”
নীপা চা খেল না। বলল, “আচ্ছা অশোকদা, ক্রিস্নান কিছু স্বীকার করেছে।, জানো?”
বীতশোক মাথা দোলাল। “জানি না। আরিফই বলল যে, ওকে স্টেশনে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। প্রাইভেট ডিটেকটিভ কর্নেল সরকারই নাকি ওকে হিন্ট দিয়েছিলেন, ক্রিস্নান পালিয়ে যেতে পারে।”
ঈশিতা বলল, “একটা ব্যাপার আমার আশ্চর্য লাগছে। সোমনাথ যখন অ্যালসেশিয়ানের তাড়া খেয়ে ড্রেনপাইপ বেয়ে দোতলায় উঠল, তখন তো অ্যালসেশিয়ানটা বোবা হয়ে যায়নি! আমার অ্যালসেশিয়ান আছে। একটুতেই চেঁচামেচি করে অস্থির করে।”
বীতশোক বলল, “ঠিক। কিন্তু ইভনিং ভিলা একটা বিশাল বাড়ি। আজই পুরোটা প্রথম ভাল করে দেখলুম। গণেশ আর মালতী থাকে নীচের তলায় সাউথ-ইস্টে। সোমনাথ কুকুরের তাড়া খেয়ে উঠেছে বাড়ির নর্থ-ওয়েস্ট উল্টোদিকে। কাজেই কুকুরের ডাক ওরা নাও শুনতে পারে। এখন, বোসসায়েব খুন হয়েছেন পৌনে তিনটে থেকে সওয়া তিনটের মধ্যে। মালতী তখন নাকি তার ঘরে বাচ্চাদুটোকে ঘুম পাড়াচ্ছিল। গণেশ বোসসায়েবকে গেট খুলে দিয়ে তালা এঁটে সোজা নিজের ঘরে যায়। কিছুক্ষণ পরে রায়সায়েব ঘণ্টা বাজিয়ে তাকে ডাকেন। গণেশের ঘরে ইলেকট্রিক বেল আছে। দরকার হলে রায়সায়েব তাকে এ ভাবেই ডাকেন। হ্যাঁ, উনি থাকেন নীচের তলায় হলঘরের কাছাকাছি একটা ঘরে। প্রতিদিন তিনবেলা ওর একটা হাতে কবরেজি তেল মালিশ করে দেয় গণেশ। হাতটা অবশ। এ দিন তেল মালিশ করতে একটু দেরি হয়েছিল। তো গণেশ তেল মালিশ করছিল। কিছুক্ষণ পরে গেটের দিকে গাড়ির হর্ন। গণেশ গেট খুলতে যায়। মিসেস বোস ফিরে এসেছেন। সো হিজ অ্যালিবাই ইজ অলসো স্ট্রং।”
ঈশিতা বলল, “টেলিফোন কোন ঘরে থাকে?”
“একটাই লাইন। কিন্তু বেডরুমে একটা টেলিফোন, ড্রইং রুমে আরেকটা। দুটোতেই একসঙ্গে রিং হয়। অদ্ভুত ব্যাপার, তার কাটা হয়েছে দুটো লাইনের জয়েন্টের নীচে। কাটা বলা ঠিক হবে না, টেনে ছেঁড়া। গায়ে যথেষ্ট শক্তি না থাকলে এটা সম্ভব নয়। আবার, ও-ভাবে লোহার রড মেরে খুলি ক্র্যাক করাও সম্ভব নয়। দা মার্ডারার ওয়জ আ ভেরি স্ট্রং ম্যান।”
ঈশিতা শ্বাস ছেড়ে বলল, “তাহলে গণেশ! পুলিশ ভুল করছে।”
নায়ার বলল, “গণেশের প্রভুহত্যার উদ্দেশ্য কী থাকতে পারে?”
ঈশিতা জোর দিয়ে বলল, “মিসেস বোস গণেশকে দিয়ে মার্ডার করিয়েছে। আরিফকে ফোন করে ডেকে এই বাংলোয় আসা ওঁর নিছক অ্যালিবাই। আমি ভদ্রমহিলাকে দেখেই বুঝেছিলুম। সামথিং রং ইন হার ইমেজ। স্বামী-স্ত্রীর বয়েস পার্থক্যও চোখে পড়ার মতো। তাই না সুমিত?”
সুমিত সায় দিল। “মাইরি! আমার মনে পড়ছে কাল রাত্তিরে গাড়িতে আসার সময় সোমনাথ বলছিল ‘আ স্ট্রেঞ্জ কাল। সোমনাথকে আমরা যতই আঁতেল-ফঁতেল বলে ঠাট্টা করি, হি ইজ ভেরি ইনটেলিজেন্ট, এটা কিন্তু স্বীকার করতেই হবে।”
বীতশোক চা শেষ করে সিগারেট ধরিয়ে বলল, “তো যাক গে। আমার কোম্পানির একটা সেটব্যাক হয়ে গেল। বোসসায়েব কেতন সিংকে ম্যানেজ করেছিলেন। এবার কেতন সিং হারামজাদা কাকে ব্যাক করবে কে জানে! মিসেস বোস আলটিমেটলি কোম্পানিতে হাজবান্ডের শূন্যস্থান পূর্ণ করবেন। কিন্তু প্রব্লেম হল, কেতন সিংকে তিনি একেবারে নাকি সহ্য করতে পারেন না। কী একটা স্ক্যান্ডালাস এপিসোড আছে শুনেছি। এদিকে কেতন সিং যাকে ব্যাক করবে, সে-ই এক্সটেনশন প্রজেক্টের কনট্রাক্টটা পাবে।
ঈশিতা চাপা স্বরে বলে উঠল, “ও অশোক! তা হলে কেতন সিংয়ের সঙ্গে মিসেস বোসের কোনও গোপন আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়নি তো? তাকে দিয়েই মার্ডার করাননি তো?”
বীতশোক একটু হাসল। “তোমার ধারণা সত্য হলে আমার কোম্পানি খুশি হবে।”
বীতশোক মাফিয়ালিডারের রোমাঞ্চকর কিছু গল্প বলতে থাকল। কিছুক্ষণ পরে গেটের বাইরে হেডলাইটের ঝলক দেখা দেল। চৌকিদার আগের মতো দৌড়ে গিয়ে গেট খুলে দিল। আরিফের জিপ এসে ঢুকল।
জিপ থেকে আরিফ এবং কর্নেল নামলেন।
নায়ার গম্ভীর মুখে বলল, “আরিফ! সোমনাথ কোথায়?”
আরিফ খান হাসল। “শ্বশুরালয়ে আছে। সোমনাথের কাছে এটা নতুন কিছু নয়। সে একজন প্রাক্তন বিপ্লবী, তা তো ভালই জানো।”
চৌকিদার দুটো চেয়ার এনে দিল। আরিফ ও কর্নেল বসলেন। কর্নেল চৌকিদারকে বললেন, “ম্যাথু সাবকো বোলো, দো কাপ কফি।”।
নীপা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আরিফদা! সোমনাথ কি সত্যিই খুন করেছে?” নায়ার ফুঁসে উঠল। “অসঙ্গত প্রশ্ন! কিন্তু আমার প্রশ্ন সম্পূর্ণ ভিন্ন। বীতশোকের বর্ণনা অনুসারে সোমনাথ হত্যাকারী হতে পারে না। সোমনাথ ক্ষীণকায়। বুদ্ধিজীবী। আরিফের উচিত ছিল তার অবিলম্বে জামিনের ব্যবস্থা করা।”
আরিফ বলল, “একটু টেকনিকাল প্রব্লেম আছে। তবে আশা করি, আগামীকালই ওর জামিন হয়ে যাবে নীপা! তোমার চিন্তার কারণ নেই। সোমনাথ জামাই আদরেই থাকবে। রাতের ডিনার আমার বাড়ি থেকে যাবে। বিরিয়ানি!”
সে হাসতে লাগল। ঈশিতা বলল, “ক্রিস্নান কনফেস করেছে কিছু?”
আরিফ কর্নেলের দিকে তাকাল। কর্নেল বললেন, “হ্যাঁ। করেছে।”
নায়ার হাতের মুঠো খুলে বলল, “রত্নপাচারকারিণীর হস্তচ্যুত রত্ন। নীপার বাথরুমে উদ্ধার করেছি। আর এই দেখুন, রঙিন মার্বেল পেপারের অংশ।”
সুমিত বলল, “তার আগে বলা দরকার, কীভাবে আমাদের সঙ্গে হাথিয়া ফসল থেকে সে পালিয়ে এসেছিল। তারপর–
কর্নেল হাত তুলে তাকে থামিয়ে বললেন, “আমি সন্দেহ করেছিলুম, ক্রিস্নান পালিয়ে যেতে পারে। ফিল্মরোলটা সে ইচ্ছে করেই নষ্ট করেছিল। কারণ ওতে চিতাবাঘের পায়ের তলায় রাখা হ্যাভারস্যাকের ছবিটা ছিল। নাহ্। আমি অন্তর্যামী নই। কিন্তু আজ সকালে হ্যাভারস্যাকটা দেখার পর ক্রিস্নানের প্রচণ্ড উত্তেজনা আমার চোখ এড়ায়নি। আমাদের মনে পড়তে পারে, সে তার ব্যাগ এনে দেখাতে চাইছিল। এটা যাকে বলে ‘ঠাকুরঘরে কে রে? আমি তো কলা খাইনি!’ যাই হোক, বার্ড ওয়াচিংয়ের মতো ম্যানওয়াচিংও আমার হবি। ক্রিস্নানের মুখের রেখায় লেখা ছিল, এটা সে শুধু দেখেছে তা-ই নয়, এর সঙ্গে সে যেন জড়িত। তাই বিপন্ন বোধ করছে। স্মরণ করুন তার কথা : ‘আমি বিদেশি। আমার প্রতি সন্দেহ হতে পারে।‘ যাকে বলে ‘বিটুইন দা লাইনস’, সেইরকম একটা প্রচ্ছন্ন মানে তার কথার মধ্যে ছিল।”
ঈশিতা বলল, “কৃষ্ণা কী কনফেস করেছে, বলুন?”
“মিসেস ব্যানার্জি!” কর্নেল একটু হাসলেন। “আপনার হাজব্যান্ডকে জিজ্ঞেস করুন। তিনি সো-কল্ড স্মাগলিং এপিসোডের গোড়ার অংশটা জানেন।”
সবাই তাকাল বীতশোকের দিকে। ঈশিতা চমকে উঠেছিল। আস্তে বলল, “আই সি!”
বীতশোক সিগারেট ধরিয়ে কর্নেলের দিকে তাকাল। “ক্যান য়ু প্ৰভ দ্যাট?”
“হ্যাঁ।” কর্নেল একটু হাসলেন। “সোমনাথবাবু একটা চমৎকার কথা বলেছেন, ‘আমরা অনেক সময় জানি না যে, আমরা কী জানি। কাজেই এই বাংলোর চৌকিদার কিষেনলালও জানত না যে, সে কী জানে। দুপুর রাতে ওই গ্যারেজে আপনার গাড়ি থেকে কোনও জিনিস নিয়ে আসা, কিংবা ওই গেটের সামনে আপনার ঝুঁকে পড়ে কিছু করা তার কাছে সন্দেহজনক মনে হওয়ার কোনও কারণই ছিল না। সে ভেবেছিল আপনার পকেট থেকে কিছু পড়ে গেছে। আপনি তা খুঁজছেন। সে গতরাতের মতো আপনাকে সাহায্য করতে ছুটে এসেছিল। তাই প্রথমেই চোখে পড়ার মতো জায়গায় ‘ডেঞ্জার সিগনাল’ পুরোটা আঁকতে বাধা পান আপনি। অর্থাৎ আড়াআড়ি দুটো হাড়ের ওপর খুলিটা আঁকা হয়নি। আজ দুপুরে ওই অসমাপ্ত সাইনটা নিয়ে আপনার স্ত্রী এবং বন্ধুরা হইচই বাধান। কিষেনলাল ক্ষুব্ধ হলেও কিছু সন্দেহ করেনি। আজ বিকেলে তার সঙ্গে কথা বলার সময় প্রথমে সে দ্বিতীয় ঘটনাটাই উল্লেখ করল আমার কাছে। তার সেন্টিমেন্টে লেগেছিল। তবে সে আপনার খুব প্রশংসা করল। আপনিই এঁদের হুমকি থেকে তাকে বাঁচিয়েছিলেন, তা-ও বলল। হ্যাঁ, এবার বাকিটা আপনিই বলুন।”
বীতশোক চুপ করে আছে দেখে আরিফ বলল, “তোমার নিজের স্বার্থেই ব্যাপারটা বলা উচিত, অশোক!”
বীতশোক আস্তে বলল, “ইউ নো মিঃ বোস ওয়াজ মাই লোকাল কোম্পানি চিফ। তার কোনও অনুরোধ যত অদ্ভুত হোক, আমার পক্ষে না মেনে উপায় ছিল না।”
নীপা বলে উঠল, “তা হলে তুমিই হ্যাভারস্যাকটা আমাদের বাথরুমে পাচার করেছিলে?”
ঈশিতা শক্তমুখে বলল, “অশোক আমার সাহায্য চেয়েছিল। আমিই ওকে বললুম, ইট ইজ সো ইজি। বাইরে থেকেই ক্রিমানদের বাথরুমে ঢোকানো যায়।”
বীতশোক বলল, “অনেস্টলি বলছি। তখনও আমি জানতুম না ওটার মধ্যে কী আছে।”
সুমিত বলল, “কিন্তু তারপর ওটা আমাদের বাথরুমে গেল কী করে? সোমনাথ দেখেছিল বলেছে।”
এতক্ষণে কফি এল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, “এগেন সোমনাথবাবুর থিওরি এসে যাচ্ছে। আমরা অনেকসময় জানি না যে, আমরা কী জানি। সকালে ব্রেকফাস্টের সময় ক্রিস্নানকে হঠাৎ কি কেউ উঠে যেতে দেখেননি?”
নীপা নড়ে বসল। “মনে পড়েছে! সোমনাথকে ডেকে আসি বলে সে হঠাৎ উঠে গিয়েছিল।”
কর্নেল বললেন, “ক্রিস্নান সব কথা খুলে বলেছে। রাত্তিরে সে বাথরুমে সন্দেহজনক শব্দ শুনেছিল। সে সাহসী মেয়ে। বাথরুমে গিয়ে সে হ্যাভারস্যাকটা দেখে ভড়কে যায়। কারণ তখনই তার মনে পড়ে গিয়েছিল, ইভনিং ভিলায় ঠিক এই জিনিসটাই সে দেখেছে। ভেতরে কী আছে দেখার জন্য মুখটা টেনে খোলার চেষ্টা করে। কাত করে খুলতে গিয়েই কী একটা সবুজ রঙের ছোট্ট জিনিস নীচে পড়ে যায়। সেটা খুঁজে পায়নি।”
নায়ার বলল, “আমি খুঁজে পেয়েছি।” সে আবার মুঠো খুলে সবুজ পান্না দেখাল।
কর্নেল বললেন, “থ্যাংস্। তো ক্রিস্নান এবং তার বয়ফ্রেন্ডের ভিসায় একটা টেকনিকাল এরর আছে। তার ওপর রহস্যময় একটা জিনিসের আবির্ভাব তার বাথরুমে। এবং তার ভেতর সম্ভবত ‘জুয়েল’ রয়েছে! চিন্তা করুন তার মনের অবস্থা। ভয় পেয়ে সে ওটা বাইরে ফেলতে গিয়েছিল। কিন্তু চৌকিদারের কাসির শব্দ শুনে ফিরে আসে। নিজের বেডরুমের খাটের তলায় লুকিয়ে রাখে। সকালে ব্রেকফাস্টের সময় সে মরিয়া হয়ে ওঠে। জিনিসটা সে সবার চোখের বাইরে দূরে কোথাও ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু করিডরের শেষে ব্যাকডোর খুলে বেরিয়ে সে দ্বিধায় পড়ে। বাউন্ডারিওয়াল অব্দি অন্তত তিরিশমিটার খোলা জায়গা পেরুতে হবে। কিন্তু সেখানে মাত্র তিন পা দূরত্বে সোমনাথবাবুদের বাথরুম। সোমনাথবাবু ঘুমুচ্ছিলেন তখনও। ক্রিস্নান লম্বা মেয়ে। উঁকি মেরে কেউ নেই দেখে সে ওটা ওখানেই ঢুকিয়ে দেয়।”
নায়ার ফিক করে হেসে বলল, “আমার তত্ত্ব! সুমিত, স্মরণ কর!”
সুমিত বলল, “কিন্তু ওটা নদীতে ফেলল কে?”
কর্নেল তার বাইনোকুলারটি দেখিয়ে বললেন, “এই জিনিসটি দূরকে নিকটে আনে। মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে নদীর ওপারে টিলায় উঠেছিলুম। দেখতে পেলুম সুইপার হন্ডুরাম কী একটা জিনিস পাঁচিল পার করে নদীতে ছুঁড়ে ফেলল। পরে ওটা খুঁজে পেলুম, সে তো আপনারা জানেন। বিকেলে হচ্ছুরামকে একলা পেয়ে আলাপ জমিয়েছিলুম। ঘটনাটি খুব স্বাভাবিক। হন্ডুরাম বাথরুম ‘সাফা করতে গিয়ে জিনিসটা দেখতে পায়। কৌতূহল অনেকেরই মজ্জাগত। সে ওটার মুখ খুলেই বিকট দুর্গন্ধ পায়। সে ধরেই নিয়েছিল, সাবলোগ’ মাতাল অবস্থায় এর মধ্যে জৈবিক কুকর্ম করেছেন। অতএব স্বভাবত এটা ফেলার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।”
কর্নেল চুরুট ধরালেন। নায়ার বলল, “এই রত্নপাচারের উদ্দেশ্য কী হলে?”
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, “ওই সবুজ জিনিসটা রত্ন নয়। ইভনিং ভিলায় সেকেলে ঝাড়বাতি আছে। তার ঝালরের সবুজ ডিমালো কাঁচ।”
“অ্যাঁঃ!” নায়ার অবাক হয়ে গেল। “এন্তাপরেন্তু!”
কর্নেল প্রায় অট্টহাসি হাসলেন। “সো-কল্ড স্মাগলিং এপিসোড আসলে একটা রেড হেরিং। কথাটা জানেন, ‘চেজিং আফটার আ রেড হেরিং। যা নেই, তার পেছনে ছুটোছুটি! বসন্ত হাজরার হত্যারহস্য গোপন রাখার উদ্দেশ্যেই আমাকে এবং পুলিশকে বিভ্রান্ত করে ভুলপথে ছোটানোর চেষ্টা মাত্র। অ্যাজ ইফ বসন্ত হাজরার মৃত্যুর সঙ্গে একটা স্মাগলিং র্যাকেটেরই সম্পর্ক আছে। দৈবাৎ একজন বিদেশি মেয়ে আপনাদের দলে থাকার জন্যই এই উপায়টা বেছে নেওয়া হয়েছিল। যাই হোক, জুয়েলারির দোকানে ওটা পরীক্ষা করিয়েই আমি আরিফকে বলেছিলুম, ক্রিস্নান বস্তুত আমাদের ভাইটাল এভিডেন্স হয়ে উঠবে। কিন্তু ভয় পেয়ে তার পালানোরও চান্স আছে। কাজেই বাস এবং রেলস্টেশনের দিকে পুলিশ যেন নজর রাখে।”
আরিফ গম্ভীর মুখে বলল, “আমরা সর্বত্র জাল পেতে রেখেছিলাম।”
ঈশিতা রুষ্ট ভঙ্গিতে বলল, “সেই জালে সম্ভবত আমার হাজব্যান্ডও পড়েছে?”
আরিফ হেসে ফেলল। “তা তো পড়েছেই।”
“তা হলে ওকে অ্যারেস্ট করছ না কেন?”
“দরকার হচ্ছে না। কারণ বীতশোক আমাদের প্রসিকিউশন-উইটনেস।”
সুমিত বলল, “তা হলে আসল খুনি ধরা পড়েছে? নাকি সোমনাথকে ফাসাচ্ছ তোমরা?”
“নাহ্। সোমনাথও প্রসিকিউশন-উইটনেস। তবে প্রব্লেম হল, এখনও খুনি ধরা পড়েনি।”
নায়ার বিরক্ত হয়ে বলল, “বাংলায় কী যেন বলে? গাছে কাঁটাল গোঁফে তেল! হত্যাকারী ধরা পড়ল না, উইটনেস প্রস্তুত! তা ছাড়া দুটি হত্যাকাণ্ড। প্রথমটি বাইরে, দ্বিতীয়টি ঘরে।”।
কর্নেল বললেন, “না মিঃ নায়ার! বসন্ত হাজরাকে ইভনিং ভিলার হলঘরেই মারা হয়েছিল। তার বডি দেখতে পাওয়ার পর গেটের বাইরে থেকে হলঘর অব্দি রক্ত ছড়ানো হয়। এর একটাই কারণ। মিঃ বোস খুনিকে বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে এই খুনের দায় থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, সেই খুনির হাতেই তাকে মরতে হল।”
বীতশোক চমকে উঠে বলল, “কে সে?”
এই সময় ম্যাথু এসে সেলাম ঠুকে আরিফের উদ্দেশে বলল, “স্যার! ইওর টেলিফোন।”…
আরিফ বাংলোর কেয়ারটেকার ম্যাথুর অফিসে টেলিফোন ধরতে গেল।
বীতশোক কর্নেলকে আবার প্রশ্ন করল, “কে সে?”
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, “আপনাদের বন্ধু আরিফ খানকে তো বলতে শুনলেন, খুনি এখনও ধরা পড়েনি।”
“তার মানে সে গা-ঢাকা দিয়েছে?”
“তা-ও জানি না। শুধু এটুকু জানতে পেরেছি, বসন্ত হাজরা এবং মিঃ জে এন বোসের খুনি একই লোক।”
সুমিত একটু নার্ভাস হেসে বলল, “লাইফে স্যার আমি এই প্রথম একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ দেখতে পেলুম। তাই আমার জানতে আগ্রহ হচ্ছে, খুনি যে একই লোক, তা আপনি স্যার কী মেথডে জানলেন?”
কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন, “আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নই মিঃ চৌধুরি। কেউ আমাকে ডিটেকটিভ বললে অপমানিত বোধ করি। কাল রাত্তিরে আপনাদের সঙ্গে আলাপের সময়ই কথাটা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলুম–মিঃ ব্যানার্জির এটা মনে পড়া উচিত।”
বীতশোক বলল, “ওয়েল! কিন্তু আপনি এখানে আসার পর যে কাজগুলো করছেন, তা প্রাইভেট ডিটেকটিভরাই করে থাকে। তাছাড়া গতকাল মিঃ বোস। আমাকে কথায় কথায় বলছিলেন, তার পেছনে নাকি প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগিয়েছে কেউ।”
কর্নেল দ্রুত তার দিকে ঘুরলেন। “মিঃ বোস বলছিলেন?”
“হ্যাঁ। তবে আমি ভেবেছিলুম, আমাদের কোম্পানির এই বিগ ডিলটা কেউ বানচাল করার জন্য এনিওয়ে, ইউ নো, বহু কোম্পানি নানা ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সাহায্য নিয়ে থাকেন।”
কর্নেল আবার বললেন, “মিঃ বোস আপনাকে বলেছিলেন কেউ তার পেছনে প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগিয়েছে?”
“ঠিক তা-ই করব। একটু প্রেম-প্রেম ফ্লার্টিং, একটুখানি ঈশিতা চোখে ঝিলিক তুলল। “তোমরা কিন্তু লক্ষ রাখবে। ওই চান্স তোমরা ছাড়বে না। কেমন তো?”
নায়ার বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু একটা ব্যাপার তোমরা লক্ষ করোনি। বীতশোক লোকটাকে চেনে। কাল রাত্তিরে বীতশোকই বলল, আপনি সেই বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ! আরিফ কিন্তু ওর পরিচয় দেয়নি। আরিফ আমাদের বন্ধু হলেও একজন পুলিশ অফিসার। বীতশোক না বললে আমরা তো জানতেম না লোকটা কে। এটাই অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। কৃষ্ণার গতিবিধির ওপর দৃষ্টি রাখতে গভর্মেন্ট ওকে পাঠিয়েছে।”
ঈশিতা নায়ারের পেছনের চুল খামচে ধরে বলল, “খালি কৃষ্ণা বেচারাকে ভয় দেখাচ্ছে! আর একটা কথা নয়।”
রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো। জঙ্গল পেরিয়ে বিশাল খোলামেলা মাঠ। রুক্ষ পাথুরে মাটি। এখানে-ওখানে কিছু ঝোঁপঝাড় এবং গাছের জটলা। মাঝখান দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে, সেটা এবার মোটামুটি মসৃণ। গাড়ির গতি বাড়ল। .
ড্রাইভার গাইডের ভঙ্গিতে ঘোষণা করল, “উও দেখিয়ে। হাওয়াই আড্ডিকি জঙ্গল।”
দূরে টুকরো-টুকরো ধংসস্তূপ। কোথাও ভাঙাচোরা টাওয়ার বা পাঁচিলের খানিকটা অংশ মাথা তুলে আছে জঙ্গলের ভেতর। সুমিত বলল, “সোমনাথের থিওরি, ওখানে নাকি গুপ্তধন খুঁজতে রীতিমতো একটা এক্সপিডিশনে নামব। নাহ্। সঙ্গে মহিলা থাকবে না। কারণ শাস্ত্রে বলেছে ‘পথি নারী বিবর্জিতা’!”
ঈশিতা বলল, “তোমাদের এক্সপিডিশনের আগেই অশোকদের কোম্পানি হাওয়াই আড্ডির জিওগ্রাফি বদলে দেবে। স্টিল ফ্যাক্টরির এক্সটেনশন প্রজেক্ট এরিয়া ওটা।”
গাড়ি আবার ডাইনে মোড় নিয়ে চড়াইয়ে উঠল। একটু পরে মোটামুটি সমতল একটা জায়গায় গিয়ে থামল। ঘন গাছপালায় ঢাকা মাটি। বড়-বড় পাথর। পড়ে আছে। গাড়ি থেকে সবাই নামল। কয়েকপা এগিয়ে যেতেই জলপ্রপাতের গর্জন শোনা গেল। আরও কয়েকটা পাথরের ফাঁক দিয়ে হেঁটে গিয়ে চোখে পড়ল হাথিয়া ফলস। ছোট্ট প্রপাত। ধাপবন্দি পাথর বেয়ে জল আছড়ে পড়ার। দরুন জলের গর্জনটা বেশি। কিন্তু আসলে এটা কয়েকটা টুকরো-টুকরো প্রপাতের সমন্বয়। নীচের জলটা গভীর এবং দেখতে একটা ছোটখাটো দের মতো।
সুমিত বলল, “ছ্যা ছ্যা! এটা কি একটা ফসল নাকি? লোক নেই, জন নেই।”
নায়ার বলল, “পর্যটক বর্জিত স্থান।”
ঈশিতা হাসল। “এটা নাকি ভুতুড়ে ফলস। ভূতের ভয়ে কেউ আসে না।”
সুমিত ও নায়ার পাথরের ধাপ বেয়ে নেমে একটা চাতালে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর সুমিত ঈশিতাকে হাত নেড়ে ডাকল। ঈশিতা বুড়ো আঙুল দেখাল। ক্রিস্নান জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল। একটু পরে তাকে প্রপাতের মাথায় কাছে দেখা গেল। সে ক্যামেরা বের করে ছবি তুলছিল।
ঈশিতা বলল, “আমি বাবা নামছি না এই ধুমসি শরীর নিয়ে। নীপু, নামবে নাকি?”
নীপা বলল, “নাহ্।”
“তা হলে এখানেই বসি এসো।” ঈশিতা একটা পাথরে বসল।
নীপা তার পাশে গিয়ে বসে আস্তে বলল, “একটা কথা ঈশিতাদি!”
ঈশিতা ভুরু কুঁচকে তাকাল।
নীপা শ্বাসপ্রশ্বাসে মিশিয়ে বলল, “ক্রিস্নানকে আমার বিশ্বাস করা হয়তো। ভুল হয়েছে।”
“সে কী! কেন এ কথা বলছ?”
“কাল রাত্তিরে আমার ভাল ঘুম হয়নি। চোখ বুজে পড়ে ছিলুম।” নীপা চাপা স্বরে বলল। “একটা শব্দ শুনে চোখ খুলে দেখলুম ক্রিস্নান বাথরুমে ঢুকছে। আবার চোখ বুজে পড়ে রইলুম। ক্রিস্নান বাথরুমে ঢুকেছে তো ঢুকেছে। বেরুচ্ছে না। তারপর হয়তো ঠিক ঘুম নয়, একটু তন্দ্ৰামতো এসেছিল। আবার একটা শব্দ হল। তন্দ্রাটা কেটে গেল। চোখ খুলে দেখি, ক্রিস্নান এসে ওর। বেডে শুল। তখন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু সকালে হঠাৎ মনে হল–ঈশিতাদি! তুমি নিশ্চয় লক্ষ করেছ, বাথরুমের কাছে আমার বেড। ক্রিস্নানের বেড রুমের দরজার সামনাসামনি। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সে নিজের বেড়ে গেলে তার একটা পাশ আমি দেখতে পাব। কিন্তু ক্রিস্নান তার বেড়ে যখন যাচ্ছিল, তার বডির ফ্রন্টটা আমার চোখে পড়ল। তার মানে, সে বাইরে থেকে ঢুকছিল। নিশ্চয় সে বাইরে গিয়েছিল।”
ঈশিতা আস্তে বলল, “তুমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলে?”
“নাহ্।” নীপা বিব্রত মুখে বলল। “অমন একটা সিচুয়েশনে ও কথা জিজ্ঞেস করলে কী ভাবতে বলো? তা ছাড়া বাথরুমের দরজা বন্ধ করার শব্দ অন্যরকম। দ্বিতীয়বার শব্দটা শুনেছিলুম ইন্টারলকিং সিস্টেমের দরজায় যেমন শব্দ হয় ঠিক সেইরকম। তা না হলে ঘুমটা ছিঁড়ে যেত না। বাংলোর সব রুমের দরজায় ইন্টারলকিং সিস্টেম আছে।”
“হু। কিন্তু কৃষ্ণা বাইরে কোথায় গিয়েছিল বলে তোমার ধারণা?”
“ওই জুয়েলের ব্যাপারটা–” বলে নীপা থেমে গেল।
ঈশিতা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ। কৃষ্ণা ফিল্মরোলটা হয়তো ইচ্ছে করেই নষ্ট করেছে। বুঝলে নীপু? অশোকের কাছে শুনেছি ইভনিং ভিলায় একসময় প্রচুর জুয়েলস ছিল। রাজা-রাজড়ার ফ্যামিলি। কাজেই তা থাকতেই পারে। কিন্তু অনেক দামি জুয়েলস নাকি আউট অফ ট্রেস। অশোকের মতে, মিঃ বোসও লুকিয়ে বেচতে পারেন। কারণ ওসব প্রপার্টি নাকি মিসেস বোসের পৈতৃক। এনিওয়ে, কৃষ্ণার দিকে তুমি লক্ষ রেখো। ওর জন্য আমরা কিন্তু ফেঁসে যাব।” বলে ঈশিতা জোরে শ্বাস ছাড়ল। “যেতুম–যদি ভাগ্যিস আরিফ এখানে না থাকত। একে তো একটা মার্ডারকেস। তার ওপর ওই জুয়েলভর্তি হ্যাভারস্যাক। নায়ার ইজ ড্যাম রাইট। গভর্মেন্ট সি বি আই থেকেই ওই বুড়োকে এখানে পাঠিয়েছেন। গভর্মেন্টের সোর্সে নিশ্চয় তেমন কোনও ইনফরমেশন আছে যে, কৃষ্ণা আর তার বয়ফ্রেন্ড, আসলে স্মাগলার। মিঃ বোস সম্পর্কে তো অশোক কথায় কথায় বাস্টার্ড বলে। ওর কোম্পানির ইন্সট্রাকশন, বি ভেরি কেয়ারফুল অ্যাবাউট দ্যাট ম্যান। শুনলে না এরিয়ার মাফিয়া লিডার কেতন সিং ওর বন্ধু! নাও থিং নীপু!”
ঈশিতা ঘড়ি দেখল। নীপা বলল, “সোমনাথের জন্য সত্যি আমার ভাবনা হচ্ছে। ইভনিং ভিলায় কুকুর আছে না নেই, তা নিয়ে ওর মাথাব্যথা কেন? আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না ঈশিতাদি!”
ঈশিতা হাসল। “ওটা ওর চালাকি। আসলে মিসেস বোসের সঙ্গে প্রেম করতে গেছে।”
নীপা আড়ষ্টভাবে হাসল। পাত্তা পাবে না। ওসব ব্যারনেসটাইপ মহিলারা। বড় ডাল। তবে সোমনাথ ইজ আ গুড টেবল্টকার।”
“মিসেস বোস কনভেন্টে পড়া মহিলা কিন্তু।”
“হুঁউ। তা তো ইংরিজি বলার স্টাইল দেখেই বুঝতে পারছিলুম। স্যুডো আঁতেল টাইপ।”
ঈশিতা চোখ বড় করে বলল, “ওমা! তুমি এত্তো সব লক্ষ করেছ?”
নীপা একটু ঝুঁকে পাথরের ফাঁকে গজিয়ে ওঠা একটা গুল্মের পাতা ছিঁড়ে নিল। কিছু বলল না।
“কিন্তু তুমি ব্ল্যাক প্যান্থারের পায়ের তলার হ্যাভারস্যাকটা লক্ষ করোনি?”
“তুমিও করোনি!”
ঈশিতা এলোমেলো চুল গোছাতে গোছাতে বলল, “একটা ব্যাপার কেউ লক্ষ করেনি আসলে। হল ঘরে যথেষ্ট আলো ছিল না। সেকেলে ঝাড়বাতিতে বাল্ব ফিটকরা। অবশ্য চোখের পক্ষে সুদিং।”
সুমিত ও নায়ার কখন আরও নীচে নেমে গিয়েছিল। সেখানে থেকে সুমিত মুখে হাত রেখে টার্জানের ডাক ছাড়ল। ঈশিতা উঠে দাঁড়িয়ে দু হাতের বুড়ো আঙুল দেখাল। নীপা বলল, “আমি ক্রিস্নানের কাছে যাই।”
ঈশিতা প্রপাতের মাথার দিকটা দেখে নিয়ে বলল, “কৈ সে? চলো তো দেখি।”
দুজনে জঙ্গলের ভেতর পায়েচলা পথ দিয়ে এগিয়ে প্রপাতের মাথার কাছে গেল। ঈশিতা ডাকল, “কৃষ্ণা!”
ক্রিস্নানের সাড়া পাওয়া গেল না। ঈশিতা ও নীপা এগিতে-ওদিকে তাকিয়ে তাকে খুঁজছিল। ঈশিতা আরও কয়েকবার ডেকে বিরক্ত হয়ে বলল, “অদ্ভুত মেয়ে তো!”
সুমিত নীচে থেকে পাথরের ধাপে পা রেখে ওপরে উঠছে দেখা গেল। তার পেছনে নায়ার। ঈশিতা হাসতে হাসতে ঝুঁকে পড়ল। “নীপু! মাউন্টেনিয়ারিং দেখ। সাধে কি সুমিতটাকে চতুষ্পদ প্রাণী বলি? দেখ, চার পায়ে হাঁটছে।”
প্রপাতের ডান কাঁধের ওপর ঘাস আর ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা একটা টিলা। টিলায় একজন আদিবাসী রাখাল দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকটা গরু চরছে। রাখাল বাবুবিবিদের রঙ্গ দৃশ্যটি উপভোগ করার ভঙ্গিতে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে। নীপা টিলায় ওঠার চেষ্টা করছিল। ঈশিতা দেখতে পেয়ে বলল, “তুমিও মাউন্টেনিয়ারিং করছ নাকি নীপু? হাড়গোড় ভেঙে যাবে। চলে এস।”
নীপা হাত নেড়ে রাখাল ছেলেটিকে ডাকল। সে আস্তেসুস্থে নেমে এল। নীপা বলল, “তুমি কোনও মেমসায়েবকে দেখেছ?”
ঈশিতা এগিয়ে গেল। হাসতে হাসতে বলল, “ও বাংলা নেহি বুঝতা নীপু! রাষ্ট্রভাষামে পুছো। অবশ্য রাষ্ট্রভাষাও ও বোঝে কি না আই ভেরি মাচ ডাউট। লুকস আ ট্রাইবাল বয়। তবু চেষ্টা করা যাক। তুম্ কৈ মেমসাব দেখা ইধার? মেমসাব! লাল চুল। সাদা ঔরত বুঝতে পারতা।”
রাখালটি টিলার ওদিকে হাতের লাঠিটা তুলে স্থাননির্দেশের পর অদ্ভুত ভঙ্গি করল। মুখে সরল হাসি। ভঙ্গিটা ক্যামেরায় ছবি তোলারই।
নীপা বলল, “কোনও মানে হয়?”
ঈশিতা বলল, “ছবি তুলতে গেছে। ওদিকে বোধ হয় এদের বটিস্তি আছে। চলে এস।”
সুমিত ও নায়ার প্রপাতের মাথায় পৌঁছে গেছে এবং হাঁপ সামলাচ্ছে। ঈশিতা তাদের কাছে গিয়ে বসে পড়ল। সুমিত বলল, “উই হ্যাভ ডান ইট! পুরস্কৃত করো ঈশু!”
“কী পুরস্কার চাও, বলো!”
সুমিত ডান হাত বাড়িয়ে বলল, “করচুম্বন!”
ঈশিতা তার হাতের আঙুল কামড়ে ছেড়ে দিল। সুমিত প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিল। নায়ার ফিক করে হেসে বলল, “তোর আঙুলে রক্ত পড়ছে সুমিত?”
সুমিত হাতটা বাড়িয়ে স্রোতের জলে চুবিয়ে বলল, “ছ্যাঃ! লিপস্টিকের রঙ! মাইরি! কেন এসব রঙটঙ মেখে মেয়েরা ঠোঁটের ন্যাচারাল টেস্ট অ্যান্ড বিউটি নষ্ট করে, বুঝি না।”
“আবার কামড়ে দেব। কৈ, একটা সিগারেট দাও। টানি।”
নায়ার বলল, “আরে! অধ্যাপিকা ওখানে দাঁড়িয়ে নৃতত্ত্বচর্চা করছে নাকি?”
“নাহ। কৃষ্ণাকে খুঁজছে।”
সুমিত রুমালে হাত মুছে সিগারেট দিল ঈশিতাকে, নিজেও একটা ধরাল। তারপর বলল “কৃষ্ণা কোথায়?”
“সম্ভবত ট্রাইবাল বস্তিতে ছবি তুলতে গেছে।” বলে ঈশিতা ঘুরে ডাকল, “নীপু! চলে এস। একটু ফুর্তি করা যাক।”
নীপা এসে একটু তফাতে বসল। নায়ার বলল, “পাতালেশ্বরীর মন্দির এখান থেকে কতদূর?”
ঈশিতা বলল, “আট-নয় কিলোমিটার হবে।”
“এখানে বৈচিত্র্যের অভাব।” নায়ার বলল। “কাজেই আমাদের এখনই স্থানত্যাগ করা উচিত।”
“কৃষ্ণাকে খুঁজে আনো তা হলে।”
“আমরা পর্বতারোহণে ক্লান্ত।”
“তা হলে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করো। চা-ফা খেয়ে সময় কাটাও।” বলে সে চায়ের ফ্লাক্স বের করল ব্যাগ থেকে।
কিন্তু বিরক্তিকর দু-দুটো ঘণ্টা কেটে গেল। তখনও ক্রিস্নান ফিরল না।…