নবম পরিচ্ছেদ – বনপর্ব
পার্বত্য নদী যেমন সিধা একদিকে চলিতে চলিতে হঠাৎ এক সময় মোড় ঘুরিয়া সম্পূর্ণ নূতন দিকে চলিতে আরম্ভ করে, তেমনি বজ্রের জীবনও এতদিন বৈচিত্র্যহীন ঋজু পথে প্রবাহিত হইবার পর অকস্মাৎ নূতন পথ ধরিল। এই অভাবনীয় পরিবর্তনের জন্য বজ্র নিজেও প্রস্তুত ছিল না। সে জানিত সে রাজার ছেলে। সাত বছর ধরিয়া সে পিতার পূর্ণ পরিচয় জানিবার জন্য প্রতীক্ষা করিয়াছে, কিন্তু পিতৃ-পরিচয় পাইবার পর কী করিবে এ প্রশ্ন তাহার মনে আসে নাই। কাল বর্ষণমথিত সন্ধ্যায় যখন সে মায়ের মুখে তাহার পিতার কাহিনী শুনিল, তখন নিমেষমধ্যে তাহার মনে দৃঢ় সঙ্কল্প জাগিয়া উঠিল— সে পিতার সন্ধানে যাইবে, পিতাকে খুঁজিয়া বাহির করিবে, মাতার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান করিবে। হয়তো তাহার অন্তরের অন্তস্তলে এই সঙ্কল্পের বীজ লুক্কায়িত ছিল, হয়তো চাতক ঠাকুর অনুভবে তাহা বুঝিয়াছিলেন বলিয়াই তাহার পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্তির পূর্বে পিতৃ-পরিচয় জানিতে দেন নাই। এক মুহূর্তে সব লণ্ডভণ্ড হইয়া গেল, বজ্র নিঃসঙ্গভাবে অজানিত নূতন পথে যাত্রা করিল।
পায়ে হাঁটার পক্ষে পথ অল্প নয়। গ্রামের সীমান্ত হইতে বিস্তৃত প্রান্তর আরম্ভ হইয়াছে। তরুপাদপহীন মাঠ, তাহার দক্ষিণে বহু দূরে শ্যামায়মান অরণ্য দিক্চক্রকে যেন স্থূল রেখার দ্বারা চিহ্নিত করিয়া দিয়াছে। মৌরী নদীর ধারা কুটিল খাতে আঁকিয়া বাঁকিয়া ঐ বনরেখায় মিলাইয়াছে।
বজ্র যখন বনের প্রান্তে গিয়া পৌঁছিল তখন দ্বিপ্রহর অতীতপ্রায়। এই বন অনুমান দশ ক্রোশ গভীর, বিশাল তরুশ্রেণীর সমাবেশে অন্ধকার এবং দুর্গম। পূর্বকালে নাকি এই বনে হাতি বাস করিত; এখন হিংস্র জন্তুর মধ্যে ভালুক ও সাপের বাস। অন্যান্য ক্ষুদ্র জীবজন্তুও আছে। এই বন পার হইয়া আরও একদিনের পথ হাঁটিলে কর্ণসুবর্ণে পৌঁছানো যায়। মৌরীর তীর ধরিয়া চলিলে বনের সঙ্কট এড়াইতে পারা যায়; কিন্তু এই স্থান হইতে মৌরীর স্রোত ধনুকের মত পশ্চিম দিকে বাঁকিয়া গিয়াছে, কূল ধরিয়া চলিলে একটু ঘুর পড়ে। যাহারা শীঘ্র রাজধানীতে পৌঁছিতে চায়, তাহাদের পক্ষে বন ভেদ করিয়া যাওয়াই সুবিধা।
বজ্র এক তরুচ্ছায়ায় বসিয়া আতপতপ্ত দেহের উষ্ণা দূর করিল। কিন্তু অধিক বিলম্ব করা চলে না, দিনের আলো থাকিতে থাকিতে জঙ্গল পার হইতে পারিলেই ভাল। সে উঠিয়া নদীতে অবতরণ করিল। হাত মুখ ধুইয়া কিছু আহার করিতে হইবে, তারপর আবার যাত্রা।
নদী হইতে তীরে ফিরিয়া বজ্র লক্ষ্য করিল, অদূরে এক বৃহৎ পাষাণখণ্ডের পাশে একজন মানুষ বসিয়া আছে। স্থির হইয়া বসিয়া আছে, একটু নড়িতেছে না, কিন্তু তাহার সমস্ত দেহ সতর্কতার চেষ্টায় ব্যগ্র হইয়া আছে।
বজ্র বিস্মিত হইল। এই নির্জন বনপ্রান্তে মানুষ কোথা হইতে আসিল, কী করিতেছে, কোথায় যাইবে? কৌতূহলবশে বজ্র তাহার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। দেখিল মানুষটি অন্ধ। কঙ্কালসার দীর্ঘ দেহ, দেহের চর্ম রৌদ্রে পুড়িয়া খদির-বর্ণ ধারণ করিয়াছে, মাথায় মুখে জটা-গ্রন্থিযুক্ত রুক্ষ কেশ, কটিতে জীর্ণ কৌপীন। হাতের নড়ি পাশে রাখা রহিয়াছে। অন্ধ বজ্রের পদশব্দ শুনিতে পাইয়াছিল, সে নড়ি শক্ত করিয়া ধরিয়া আরও সতর্ক হইয়া বসিল; একবার অধরোষ্ঠ খুলিয়া যেন কিছু বলিবার উদ্যোগ করিল, তারপর কিছু না বলিয়াই মুখ বন্ধ করিল।
বজ্র তাহাকে ভাল করিয়া দেখিয়া বলিল— ‘তুমি অন্ধ, এখানে কি করে এলে?’
অন্ধ কিছুক্ষণ উত্তর দিল না, তারপর ক্ষীণ অনিশ্চিত স্বরে বলিল— ‘আমার দৃষ্টি নেই, কখন কোথায় যাই বুঝতে পারি না। তোমার পায়ের শব্দ শুনে ভেবেছিলাম বনের শ্বাপদ—’
বজ্র প্রশ্ন করিল— ‘তুমি কোথায় যাবে? কোনও গন্তব্য স্থান আছে কি?’
অন্ধ দ্বিধাভরে ক্ষণেক নীরব রহিল, শেষে নড়ি নাড়িয়া বলিল— ‘না।’
অসহায় অন্ধের ভগ্ন-জীর্ণ অবস্থা দেখিয়া বজ্রের দয়া হইল। সে বলিল— ‘তুমি ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে। আমার কাছে খাদ্য আছে। খাবে?’
অন্ধ উত্তর দিল না, বুকে চিবুক গুঁজিয়া বসিয়া রহিল। বজ্র তখন তাহার হাত ধরিয়া তুলিল, হাত ধরিয়া বৃক্ষতলে লইয়া গেল। পুঁটুলিতে যে খাদ্য ছিল তাহা ভাগ করিয়া অর্ধেক অন্ধকে দিল অর্ধেক নিজে লইল। অন্ধ আর সঙ্কোচ করিল না।
আহার করিতে করিতে বজ্র বলিল— ‘আমি কর্ণসুবর্ণ যাচ্ছি, তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’
অন্ধ কিছুক্ষণ স্থির থাকিয়া বলিল— ‘না।’
‘তবে কোথায় যাবে?’
অন্ধ আবার স্থির সতর্কতার সহিত চিন্তা করিল।
‘জানি না। কাছে কি লোকালয় নেই?’
‘দক্ষিণের কথা জানি না। উত্তরে চার-পাঁচ ক্রোশ দূরে গ্রাম আছে।’
‘কোন্ গ্রাম?’
‘বেতসগ্রাম।’
অন্ধের চর্বণক্রিয়া বন্ধ হইল, তাহার অস্থিসার দেহ সহসা কঠিন হইয়া স্থির হইয়া গেল। সে তৎক্ষণাৎ কথা কহিল না, যখন কহিল তখন তাহার কণ্ঠস্বর চাপা উত্তেজনায় অসংলগ্ন শুনাইল— ‘কি গ্রাম বললে?’
‘বেতসগ্রাম।’
অন্ধ আর কোনও কথা বলিল না, প্রশ্ন করিল না। কিন্তু তাহার সমস্ত সত্তা অত্যন্ত তীক্ষ্ণভাবে সজাগ হইয়া রহিল।
আহার সমাধা হইলে বজ্র বলিল— ‘আমি এবার যাব। তুমি কোথায় যেতে চাও তা তো বললে না।’
অন্ধ কণ্ঠস্বরে ঔদাস্য ভরিয়া বলিল— ‘আমার কাছে সব সমান। বেতসগ্রামেই যাই।’
‘ভাল।’
বজ্র তখন অন্ধকে উত্তরমুখ করিয়া দাঁড় করাইয়া হাতে নড়ি ধরাইয়া দিল। বলিল— ‘এইবার সিধা চলে যাও। বাঁ দিকে বেশি যেও না, নদীতে পড়ে যাবে। এখনও অনেক বেলা আছে, চাকা ডোববার আগে গ্রামে পৌঁছতে পারবে।’
অন্ধ বলিল— ‘তুমি বড় সৎ, বড় দয়ালু। তোমার নাম কি?’
বজ্রের একবার ইচ্ছা হইল নিজের নামের সঙ্গে নবলব্ধ পিতৃ-পরিচয়ও অন্ধকে জানাইয়া দেয়। কিন্তু সে প্রলোভন সম্বরণ করিয়া কেবল বলিল— ‘আমার নাম বজ্র।’
তারপর দুইজনে ছাড়াছাড়ি হইল। কেহ কাহাকেও চিনিল না, অদৃষ্টপ্রেরিত হইয়া বিপরীত মুখে চলিল।
শীঘ্র গন্তব্য স্থানে পৌঁছিবার আগ্রহে বজ্র নদীর তীর ছাড়িয়া বনের অন্তর্দেশে প্রবেশ করিয়াছিল। মনস্থ করিয়াছিল, যদি দিন থাকিতে বন পার হইতে না পারি গাছে উঠিয়া রাত্রি কাটাইয়া দিব। কিন্তু দুই ঘটিকা চলিবার পর তাহার দিগ্ভ্রম হইল। জঙ্গলের অভ্যন্তরে মাঝে মাঝে মুক্ত স্থান আছে বটে, কিন্তু অধিকাংশই তরুচ্ছায়াচ্ছন্ন মন্দালোকিত; স্তম্ভের ন্যায় বৃক্ষকাণ্ডের সারি অন্তহীনভাবে চারিদিকে চলিয়া গিয়াছে, নিবিড় পত্রাবচ্ছেদে সূর্য দেখা যায় না। বজ্র দিক্ হারাইয়া ফেলিল, দক্ষিণে যাইতেছে কি পশ্চিমে যাইতেছে কিম্বা যেদিক হইতে আসিয়াছিল সেইদিকে ফিরিয়া যাইতেছে তাহা নির্ণয় করিতে পারিল না।
উপরন্তু বনে যে জীবজন্তু আছে তাহাও সে অনুভব করিয়াছে। উহারা যেন তাহার উপর লক্ষ্য রাখিয়াছে, নিজেরা অদৃশ্য থাকিয়া তাহার আশেপাশে ঘুরিতেছে। ক্বচিৎ অদূরস্থ গুল্মের মধ্যে সর্ সর্ শব্দ করিয়া কোনও প্রাণী অলক্ষিতে অন্তর্হিত হইতেছে। একবার একটা কৃষ্ণকায় রোমশ জন্তু দূরে একটা গাছের আড়াল হইতে বাহির হইয়া অন্য গাছের আড়ালে চলিয়া গেল, আবছায়া অন্ধকারে সেটা কী জন্তু ধরা গেল না।
উহারা সকলে হিংস্র শ্বাপদ না হইতে পারে, কিন্তু কিছুই বলা যায় না। বজ্র তীরধনুক আনে নাই; শবরের ন্যায় ধনুষ্পাণি বেশে কর্ণসুবর্ণে অবতীর্ণ হইবার বাসনা তাহার ছিল না, কিন্তু এখন মনে হইল— আনিলেই ভাল হইত। অন্তত বনের মধ্যে অনেকটা নির্ভয় বোধ করিতে পারিত। যেটুকু স্বল্পালোক ছিল তাহাও ধীরে ধীরে কমিয়া আসিতেছে, সূর্যাস্তের বোধহয় আর বিলম্ব নাই। বজ্র ভাবিল এই বেলা গাছে উঠিয়া বসি, কাল প্রাতে দিঙ্নির্ণয় করিয়া আবার চলিব।
রাত্রিবাসের উপযোগী একটি গাছের সন্ধানে এদিক-ওদিক চাহিতে চাহিতে বজ্র চলিল। কিছুদূর যাইবার পর সহসা এক করুণ কাকুতি শুনিয়া সে দাঁড়াইয়া পড়িল। কাকুতি মনুষ্যকণ্ঠের নয়, কোনও জন্তুর। কিন্তু কোন্ জন্তুর? কিছুক্ষণ উৎকর্ণ হইয়া থাকিবার পর বজ্র আবার সেই আর্তস্বর শুনিতে পাইল। তাহার মুখে বিস্ময়-চকিত হাসি দেখা দিল। কুকুরের ডাক! কুকুর থাকিয়া থাকিয়া ভীতস্বরে রোদন করিয়া উঠিয়াছে।
এই অরণ্যে কুকুর কোথা হইতে আসিল? কুকুর তো গ্রামে থাকে; বেতসগ্রামেও দুই চারিটা আছে। তবে, যখন কুকুরের ডাক শুনা গিয়াছে তখন মানুষও আছে। বজ্র জানিত শবরেরা কুকুর লইয়া শিকার করিয়া বেড়ায়, কুকুর তাহাদের নিত্য সঙ্গী। নিশ্চয় শবর আছে।
বজ্র কুকুরের কাতরোক্তি লক্ষ্য করিয়া চলিল। দুই তিন রজ্জু যাইবার পর একটি বৃক্ষতলে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখিয়া তাহার গতিরোধ হইল। এস্থানে ছায়া তেমন ঘন নয়; বজ্র দেখিল এক কৃশকায় ক্ষুদ্রাকৃতি শবর মাটিতে চিৎ হইয়া পড়িয়া হাঁ করিয়া আছে এবং একটি কুকুর পাশে বসিয়া তাহার মুখমণ্ডল চাটিতেছে।
কুকুর বজ্রকে দেখিয়া সহর্ষে উঠিয়া লেজ নাড়িতে লাগিল। শবরের কিন্তু কোনও দিকে লক্ষ্য নাই, সে হাঁ করিয়া শুইয়া রহিল।
আরও নিকটবর্তী হইয়া বজ্র ব্যাপার বুঝিতে পারিল। গাছের ডালে কুলার মত একটা মৌচাক ঝুলিতেছে, ঠিক তাহারই নীচে শবর হাঁ করিয়া আছে আর চক্রনির্গলিত মধু তাহার মুখে টোপাইয়া পড়িতেছে। তীরধনুক পাশেই রহিয়াছে, সুতরাং অনুমান করা কঠিন নয় যে তীরের খোঁচা দিয়া সে মৌচাকে ছিদ্র করিয়াছে। শবরের চক্ষু মুদিত, মুখে মদির হাস্য।
কুকুরটির কিন্তু চিত্তে সুখ নাই। সে থাকিয়া থাকিয়া প্রভুর বদনসুধা লেহন করিতেছে বটে কিন্তু বনের মধ্যে রাত্রিযাপন করিবার ইচ্ছা তাহার আদৌ নাই। তাই সে প্রভুর কানের কাছে ডাকিয়া ডাকিয়া গৃহে ফিরিবার ব্যগ্রতা জানাইতেছে। মধুমত্ত প্রভুর কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নাই।
বজ্র উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল।
নূতন ধরনের শব্দ শুনিয়া শবর আরক্ত চক্ষু মেলিল, তারপর উঠিয়া বসিল। বজ্রকে পরম গাম্ভির্যের সহিত নিরীক্ষণ করিয়া ঈষৎ গর্বভরে বলিল— ‘আমার নাম কচ্ছু। এ আমার চুচু।’* বলিয়া কুকুরের গলা জড়াইয়া ধরিল।
বজ্র বলিল— ‘আমার নাম বজ্র। তোমার ঘর কোথায়?’
‘আমার ঘর—’ কচ্ছু অনিশ্চিতভাবে একদিকে হাত নাড়িল— ‘আমার ঘর ঐদিকে। সেখানে রত্তি আর মিত্তি আছে। আমি ঘরে যাব না, মধু খাব।’ বলিয়া শয়নের উপক্রম করিল।
বজ্র একটু উদ্বিগ্ন হইয়া বলিল— ‘রাত্রির কিন্তু আর দেরি নেই। আমি বনের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছি, কোথাও আশ্রয় পাচ্ছি না। তুমি আজ রাত্রির জন্যে তোমার ঘরে আমাকে আশ্রয় দেবে?’
বনের মধ্যে অতিথি! শবর তৎক্ষণাৎ মাদকের মোহ ত্যাগ করিয়া ধনুক হাতে উঠিয়া দাঁড়াইল। সে গিরিগুহাবাসী বনচর মানুষ, কিন্তু আতিথেয়তা তাহার সহজাত ধর্ম। তাহার লঘু খর্ব দেহটি যেমন পরিপূর্ণ যৌবন-স্বাস্থ্যের প্রলেপে সুচিক্কণ, মনের অকুন্ঠিত সরলতাও তেমনি মধুর অনুপানে স্নিগ্ধ। পা একটু টলিতেছে বটে কিন্তু মুখে সহৃদয় আতিথ্যের হাসি। সে আসিয়া বজ্রের হাত ধরিল, গদ্গদ স্বরে বলিল— ‘তুমি আমার ঘরে যাবে? আমার ঘরে রত্তি আর মিত্তি আছে, তারা তোমাকে হরিণের মাংস খাওয়াবে। এস এস।’
সে বজ্রের হাত ধরিয়া চলিল। কুকুরটি প্রভুর অভিপ্রায় বুঝিয়া সানন্দে লাফাইতে লাফাইতে পথ দেখাইয়া চলিল। বজ্র ভাবিল, গাছের ডালে রাত্রিবাসের চেয়ে এ ভাল; প্রাতে শবর কর্ণসুবর্ণের পথ বলিয়া দিতে পারিবে।
অর্ধদণ্ড কাল চলিবার পর তাহারা একটি মুক্ত স্থানে পৌঁছিল। ভূমি কঙ্করময়, তাই গাছ গজায় নাই; কেবল ছোট ছোট গুল্ম। উন্মুক্ত আকাশের তলে আসিয়া বজ্র দেখিল রাত্রি হইতে এখনও বিলম্ব আছে। পশ্চিমের বিশাল তরুশ্রেণীর আড়ালে সূর্য দেখা যাইতেছে না, কিন্তু এখনও সূর্যাস্ত হয় নাই। প্রতিফলিত আলোকে মুক্ত স্থান সমুজ্জ্বল।
‘চুচু— চুপ। দাঁড়া।’
মুক্ত স্থানের কিনারায় আসিয়া শবরের অভ্যস্ত চক্ষু শিকার দেখিতে পাইয়াছিল; তাহার চাপা গলার আওয়াজে কুকুরও স্থাণুবৎ দাঁড়াইয়া পড়িল। বজ্র দেখিল, প্রায় এক রজ্জু দূরে একটা কাঁটাসার গুল্মের পাশে একটি ময়ূর খেলা করিতেছে। মাত্র একটি ময়ূর; পেখম মেলিয়া নাচিতেছে।
গাছের পিছনে থাকিয়া শবর একবার বজ্রের পানে ঘোলা চোখ তুলিয়া হাসিল, তারপর ধনুকে শরসন্ধান করিল।
কিন্তু মাদকের প্রভাবে তাহার হস্ত স্থির নয়, চক্ষুও তীক্ষ্ণতা হারাইয়াছে। কিছুক্ষণ চেষ্টা করিয়া সে ধনুক নামাইল, বজ্রের পানে করুণ চক্ষু তুলিয়া মাথা নাড়িল।
বজ্র নিঃশব্দে শবরের হাত হইতে ধনুঃশর লইল, নৃত্যপর ময়ূরের উপর সাবধানে লক্ষ্য স্থির করিল। তারপর টঙ্কার শব্দে ধনু হইতে তীর বাহির হইয়া গেল। বাণবিদ্ধ ময়ূর একবার ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হইয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িল।
শবর কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া রহিল। তারপর লম্ফ দিয়া বজ্রের গলা জড়াইয়া ধরিয়া মদোৎফুল্লকণ্ঠে বলিল— ‘তুমি তীর ছুঁড়তে জানো? এত ভাল তীর ছুঁড়তে পারো? তুমি আমার বন্ধু। আজ আমরা ময়ূরের মাংস খাব, ময়ূরের পাখা দিয়ে রক্তি-মিত্তি কোমরের গয়না তৈরি করে পরবে।’
বজ্রকে ছাড়িয়া কচ্ছু টলিতে টলিতে মৃত ময়ূরটার দিকে চলিল। ময়ূর শিকার তাহার জীবনে প্রথম নয়। কিন্তু আজ মধুপানে তাহার হৃদয় আনন্দ-বিহ্বল, তার উপর সে মনের মত বন্ধু পাইয়াছে। বজ্রও তাহার উল্লাসে উল্লসিত; সে স্মিতমুখে কচ্ছুর পিছে পিছে গেল। কুকুরটা হর্ষধ্বনি করিতে করিতে সঙ্গে চলিল।
তারপর মুহূর্তমধ্যে তাহাদের সমস্ত আনন্দ আতঙ্কে পরিণত হইল। আনন্দ ও শঙ্কার মুহুর্মুহুঃ পরিবর্তন, ইহাই বোধহয় বনের আদিম রীতি।
শবর আগে গিয়া মৃত ময়ূরটাকে হাতে তুলিয়া নৃত্য শুরু করিয়াছিল, হঠাৎ ‘উঃ’ বলিয়া কয়েক পা পিছাইয়া মাটিতে বসিয়া পড়িল। বজ্র ছুটিয়া কাছে গিয়া দেখিল— শবরের পায়ের অঙ্গুষ্ঠ রক্তাক্ত, অদূরে একটা মুমূর্ষু সাপ পড়িয়া আছে। সাপের সর্বাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত, কিন্তু মরে নাই। বজ্রের বুঝিতে বিলম্ব হইল না, এই সাপটাকে লইয়া ময়ূর খেলা করিতেছিল কিন্তু সাপ মারিবার পূর্বেই ময়ূর শরাহত হইয়া মরিয়াছে। তারপর কচ্ছু হয়তো না দেখিয়া সাপের ঘাড়ে পা দিয়াছে। মুমূর্ষু সাপ কচ্ছুর পায়ে তাহার অন্তিম জিঘাংসা ঢালিয়া দিয়াছে।
বজ্র লাঠি দিয়া সাপ মারিল, কচ্ছুকে জিজ্ঞাসা করিল— ‘কামড়েছে?’
কচ্ছুর আর মাদকের মত্ততা নাই, মৃত্যুর সম্মুখীন হইয়া সে শান্ত আত্মস্থ। সহজ স্বরে বলিল— ‘জাত সাপে খেয়েছে, আর বাঁচব না।’
বজ্র ধনুকের ছিলা ছিঁড়িয়া কচ্ছুর পায়ে দৃঢ় বন্ধন দিল। বলিল— ‘এখান থেকে তোমার ঘর কতদূর?’
কচ্ছু বলিল— ‘বেশি দূর নয়, কিন্তু যেতে পারব না। রত্তি-মিত্তি সাপের ওষুধ জানে, ঘরে পৌঁছুতে পারলে তারা বাঁচাতে পারত। বন্ধু, তোমাকে নিয়ে আনন্দ করতে পেলাম না। যদি পারো, রত্তি-মিত্তিকে খবর দিও। চুচু তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।’
বজ্র জিজ্ঞাসা করিল— ‘রত্তি আর মিত্তি কে?’
‘ওরা আমার বৌ।’ বলিয়া কচ্ছু ধীরে ধীরে শুইয়া পড়িল।
‘না, তোমাকে আমি ঘরে নিয়ে যাব।’ বলিয়া বজ্র কচ্ছুর অবসন্ন দেহ দুই হাতে তুলিয়া লইল। চুচু এতক্ষণ প্রভুর পাশে নিশ্চলভাবে বসিয়া ছিল, এখন লাফাইয়া উঠিয়া চিৎকার করিতে করিতে একদিকে দৌড়িতে আরম্ভ করিল। বজ্র কচ্ছুকে কাঁধে ফেলিয়া তাহার পশ্চাতে ছুটিয়া চলিল।