ফিরতে ফিরতে বেশ বেলা হল টুপুরদের। ঢুকেই দেখে পার্থ হাঁড়িমুখ করে সোফায় বসে, বাড়িময় ছড়িয়ে আছে ইলিশমাছ। ভাজার অপরূপ সুঘ্ৰাণ।
মিতিন হালকা ভাবে জিজ্ঞেস করল, সাহেবের এখনও খাওয়া হয়নি মনে হচ্ছে?
পার্থ গুমগুমে গলায় বলল, আমি তোমাদের মতো বেআক্কেলে নই। সবাই একসঙ্গে জমিয়ে খাব বলে বাজার করলাম, আর তোমরা আসি বলে কাশী!
টুপুর কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, কী করব, অনেকগুলো জায়গায় যেতে হল যে। প্রথমে মিস্টার মাইকেলের বাড়ি, সেখান থেকে উৎপলবাবুদের বাড়ি, সেখান থেকে রিপন লেনে মিসেস জোনসের ডেরা…। মিস্টার জোনসের কী হাল গো, বেচারা হুইল চেয়ার ছাড়া মুভই করতে পারেন না।
গপ্পো পরে ফাঁদবে। ইলিশমাছ কিন্তু বরফ হয়ে যাচ্ছে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, চলো আগে বসে যাই। মিতিন বলল, বুমবুমের খাওয়া হয়েছে তো?
তার বোধ হয় এতক্ষণে হজম হয়ে গেল। আমি আর ভারতী পেটে কিল মেরে বসে আছি।
এক থালা খিচুড়ি আর গোটাচারেক ইলিশভাজা পাকস্থলীতে যাওয়ার পর চিত্ত প্ৰফুল্ল হয়েছে পার্থর। হাত চাটতে চাটতে বলল, তা তোমাদের কেস কত দূর এগোল?
নৌকো প্ৰায় পাড়ে এসে গেছে। এখন নোঙর ফেললেই হয়।
কীরকম? পবিত্র আত্মাকে ঘায়েল করার প্যাঁচ পেয়ে গেছ বুঝি?
হচ্ছে ব্যবস্থা। সময় হলেই জানতে পারবে।
পার্থ অবশ্য জানার তেমন কৌতূহলও দেখাল না। আহার শেষ হতেই হাই তুলছে বড় বড়। বৃষ্টি একদমই থেমে গেছে, আকাশ এখন প্রায় নির্মেঘ, রোদ্দুরে ঝলমল করছে বাইরেটা। পাৰ্থর তবু বেরোনোর কণামাত্র বাসনা নেই, সটান গিয়ে শুয়ে পড়েছে ঘুমন্ত বুমবুমের পাশে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নাক ডাকা শুরু হয়ে গেল। ফরর ফর, ফরর ফর।
রান্নাঘরে বসে খাচ্ছে ভারতী। টুপুরকে নিয়ে নিজের গলতায় চলে এল মিতিন। দু-কামরার ভাড়াবাড়ির পিছনের চওড়া বারান্দাটায়। নিজেই বারান্দাটা ঘিরে নিয়েছে মিতিন। অফিস কাম ডিটেকশান চেম্বার। খুপরি জায়গাটুকুতে আছে চেয়ারটেবিল, খুদে সোফা, একখানা ফাইল ক্যাবিনেট, বেঁটে একটা স্টিল আলমারি, আর বইটই। গোপন নথিপত্র থাকে আলমারিতে। নিজের পেশার প্রয়োজনীয় জিনিসও।
টুপুরকে চেয়ারে বসিয়ে টেবিলফ্যান চালিয়ে দিল মিতিন। বলল, এবার তোর আসল কাজ স্টার্ট।
টুপুর টান টান, কী করতে হবে?
রাইটিং প্যাডটা নে। সেই প্রথম দিন থেকে শুরু করে যাকে যাকে দেখেছিস তাদের সম্পর্কে ডিটেলে লিখে ফ্যাল। যেখানে যেখানে গেছিস, যা যা শুনেছিস তাও নোট করবি। তারপর রিমার্কস কলামে লিখবি কার কার কোন কোন ব্যাপারটা তোর সন্দেহজনক লেগেছে। দুঘণ্টা টাইম দিলাম। ও কে?
তুমি কী করবে এতক্ষণ?
আমিও যাই একটু গড়িয়ে নিই। খিচুড়ি খেয়ে চোখটা বড় টানছে।
ঘন্টাদেড়েকের মধ্যে টুপুরের কাজ শেষ। উঠে মিতিনমাসিকে ডাকতে গিয়ে টুপুর বেজায় অবাক। ওমা, ঘুমোচ্ছে কোথায়, মিতিনমাসি তো দিব্যি জাগ্রত। পায়চারি করছে ড্ৰয়িংরুমে। হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ছে হঠাৎ, বিড় বিড় করে কী যেন বলছে, কুঁচকোচ্ছে কপাল। চিন্তা করার সময়ে মিতিনমাসি কেমন খ্যাপাটে হয়ে যায়, সারান্ডাতেও দেখেছে টুপুর। এই সময়ে ডাকাডাকি করলে মিতিনমাসির চিন্তার সুতো নাকি ছিঁড়ে যায়।
টুপুর চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। মিতিনেরই হঠাৎ চোখ পড়েছে টুপুরের দিকে।
ভুরু জড়ো করে বলল, হয়ে গেছে?
টুপুর ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।
এখানেই বোস। পড়ে শোনা। থেমে থেমে পড়বি। হড়বড় করবি না।
টুপুর গলা ঝেড়ে নিয়ে শুরু করল:
জোনাথন মাইকেল
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। বয়স একাত্তর। হাইট জোর পাঁচ পাঁচ। গায়ের রং ফরসা নয়। বাবা বাঙালি হিন্দু, মা আইরিশ। গত জানুয়ারি মাসে ভাগলপুরের, দুখানা বাড়ি বেচে চোদ্দো লক্ষ টাকা পেয়েছেন। তার মধ্যে পঞ্চাশ হাজার পেয়েছে ডিক, পঞ্চাশ হাজার মির্না। কথাবার্তা ভাল। ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করেন। ইলিয়ট রোডের বাড়ির ওপর বড় মায়া, কিন্তু বাড়িটাকে তেমন যত্ন করেন না। ছেলের ওপর দুর্বলতা নেই যে তা নয়, তবে মেয়ের ওপর টান বেশি। জামাইয়ের ওপর অনেকটাই নির্ভর করেন। অজ উৎপলের মুখ থেকে জানা গেল, ভাগলপুরের বেকারি বেচে এসে জোনাথনের মা কলকাতায় একটা বেকারি খুলেছিলেন। পরে জোনাথনই দেখতেন ব্যবসাটা। তবে জোনাথন কোনওকালেই তেমন উদ্যোগী মানুষ নন, বেকারি চলত টিকিয়ে টিকিয়ে। বেকারিটা ছিল তালতলায়। ভাগলপুরের বেকারির নামেই নাম ছিল মাইকেল্স বেকারি। বছর কুড়ি আগে আগুন লেগে বেকারিটি পুরো পুড়ে যায়। তারপর আর ব্যবসায়। নামেননি জোনাথন। বেকারি পুড়ে যাওয়ায় ইনসিওরেন্স থেকে কিছু টাকা পেয়েছিলেন। ভাগলপুরের বাড়ির ভাড়া, আর ইনসিওরেন্সের টাকার সুদেই সংসার চলত। জোনাথনের স্ত্রী মারা গেছেন আট বছর। আগে। ক্যানসারে। সম্ভবত ওই সময়ে স্ত্রীর চিকিৎসা করতে গিয়ে বেশ কিছু জমানো টাকা খরচ হয়ে যায়।
মাতৃসূত্রে পাওয়া পুরনো বাড়িটার পূর্ব ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান আছে জোনাথনের। গুপ্তধনের আশায় বিচিত্র একটা নোট যত্ন করে পুষে রেখেছেন। বাড়িতে ভূতুড়ে উপদ্রব শুরু হওয়ার পর প্রথমে তেমন একটা নাভাস হননি। তবে কাচ ভাঙার ঘটনাগুলোর পর এখন প্রায় বিধ্বস্ত দশা। বাড়ি বেচার ব্যাপারে মন থেকে এতটুকু সায় নেই, সুরজমলকে বার বার ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এখন এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে বাড়ি বেচতে রাজি হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
দুটো কাচ ভাঙার ঘটনার সঙ্গে জোনাথন সরাসরি যুক্ত। প্রথমে নিজের ঘরের দেওয়াল-আলমারি, দ্বিতীয় বার ডাইনিং প্লেসের বড় ক্ৰকারিকেস। প্রথমটি ভাঙে সন্ধেবেলা, ওষুধ বার করতে গিয়ে। দ্বিতীয়টি গভীর রাত্রে, হাতের চাপ লাগার পর। কোনও ঘটনারই কোনও প্রত্যক্ষ সাক্ষী নেই।
গোলাপবাগানের শখ আছে, কিন্তু গোলাপগাছের অবস্থা দেখে করুণা হয়। মানুষটিকে দেখেও। বিকেলে নিয়মিত হাঁটার অভ্যেস আছে ভদ্রলোকের। ফেরেন সন্ধে নাগাদ। খানিকটা একাকিত্বে ভোগেন বলে মনে হয়।
মিসেস মারিয়া জোনস
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। বয়স বছর পঞ্চাশ। কালো মোটাসোটা চেহারা। গোলগাল মুখে একটা মা মা ভাব আছে। অত্যন্ত ধর্মপ্রাণা। হোলি স্পিরিটে শুধু বিশ্বাসই নেই, আত্মাকে অনুভবও করেছেন। জোনাথন মাইকেলের বাড়ি কাজ করছেন জোনাথনের স্ত্রীর অসুখের সময় থেকে। প্রায় বাড়ির লোকের মতো হয়ে গেছেন। স্বামী অসুস্থ বলে রাতে জোনাথনের বাড়িতে থাকা সম্ভব হয় না। ফার্নিচার রুমে রাতের উৎপাত দেখেননি একদিনও, তবে গল্প শুনেই ভয়ে জবুথবু। দুটো-চারটে বাম্ব, টিউব ভাঙার সময়ে উপস্থিত থাকলেও একটিও কাচের আসবাব ভাঙার সাক্ষী নন। উৎপল-মির্নার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল। ডিকের ওপর কিঞ্চিৎ বিরাগ আছে। শনিবার সকালে সুরজমল যখন জোনাথনের কাছে এসেছিল, তখনও উপস্থিত ছিলেন না। বাড়ি বেচা, না বেচার ব্যাপারে তাঁর কোনও মন্তব্যই নেই। ভূতের উপদ্রব চলতে থাকলে হয়তো চাকরি ছেড়ে দিতে পারেন। যথাসম্ভব দেখভাল করেন অসুস্থ স্বামীর। সম্প্রতি কালোসাদা টিভি বেচে একটি রঙিন টেলিভিশন কিনে দিয়েছেন স্বামীকে। ইনস্টলমেন্টে দাম দেন। মাসে তিনশো নিরানব্বই। দু বছরে টাকা শোধ হবে। মাত্র সতেরোশো টাকা মাইনে পান, খুব কষ্ট করে চালান সংসার।
উৎপল ক্রিস্টোফার বিশ্বাস
বাঙালি ক্রিস্টান। বয়স বছর বত্ৰিশ তেত্রিশ। স্বাস্থ্যটি দেখার মতো। কলেজের পরীক্ষা না দিয়েই সার্কাসে চাকরি নেন। তিনটে সার্কাস কোম্পানি মিলিয়ে চাকরি করেছেন এগারো বছর। শেষ ছিলেন। জুপিটার সার্কাসে। বলছেন সার্কাসের অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, তবে যুক্তিটা খুব জোরালো নয়। বিয়ে করেছেন জোনাথনকন্যা মির্নাকে। বছর ছয়েক আগে। সার্কাসেই মির্নার সঙ্গে পরিচয়। বাচ্চাকাঙ্ক্ষা এখনও হয়নি। কুকুর পোষেন।
উৎপল যথেষ্ট করিৎকর্মা। জোগাড়যন্ত্র করে দিব্যি বড়সড় একটা জিমনাসিয়াম বানিয়ে ফেলেছেন। শ্বশুরকে জপিয়ে জাপিয়ে ভাগলপুরের বাড়ি বেচিয়েও পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে শ্বশুরের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি আছে, শ্বশুরের নিয়মিত দেখাশুনো করেন। শ্বশুরের কাছাকাছি থাকার জন্যেই ঠাকুরপুকুরের বাড়ি ছেড়ে মুজফফর আহমেদ স্ট্রিটে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন। ফ্ল্যাট ছোট হলেও সুসজ্জিত। শ্বশুরবাড়িতে প্রচুর অ্যান্টিক ফার্নিচার থাকলেও উৎপলের ফ্ল্যাটে সব আধুনিক আসবাব। খাট আলমারি ড্রেসিংটেবিল সোফা ক্যাবিনেট শোকে সবই প্রায় নতুন। টিভি ফ্রিজও। ওয়াশিংমেশিনটাও নতুন। সেমি অটোমেটিক। বাড়ির রাতদিনের কাজের মেয়ে সেলিমার বয়স বছর কুড়ি। মেয়েটি বদ্ধ কালা। চারবার চেঁচিয়ে বললে তবে শুনতে পায়। টিপসিটা খুব কিউট। লাফিয়ে কোলে উঠে পড়ে। আগের দিন ফিনাইল গিলে ফেললেও আজ যথেষ্ট নাচানাচি করছিল। ব্যাগে একটা চকোলেট ছিল, দেওয়া মাত্র কচর কচর খেয়ে নিল। উৎপল একাধিক দিন ভূতের উৎপাতের সময়ে জোনাথনের বাড়িতে ছিলেন। ভূত বা আত্মা সম্পর্কে তাঁর তেমন বিশ্বাস নেই, কিন্তু এখন যেন একটু একটু দুর্বল হয়ে পড়েছেন। যদিও এখনও উৎপলের আঙুল সুরজমলের দিকেই। বাম্ব-টিউব বা কাচের আসবাব ভাঙার সময়ে অনেকবারই উৎপলা জোনাথনের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। অবশ্য তিনি কোনও আসবাবে হাত দেওয়ার সময়ে কাচ ভাঙেনি।
ফার্নিচাররুমের ফাঁক দিয়ে বাচ্চা গলার আইডিয়াটা উৎপলের মাথায় কেন এসেছিল বলা দায়। বেড়াল ঢোকার থিয়েরিটাও সত্যিই বিশ্বাস করেছিলেন কিনা সন্দেহ আছে। তবে উৎপল গোড়া থেকেই বাড়ি বেচার বিরোধী। শ্বশুরবাড়ির অতীত ইতিহাস সম্পর্কে অবশ্য বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। বাড়ির কোথাও মহামূল্য জিনিস লুকোনো আছে এমন ধারণাকে গুলগল্প বলে উড়িয়ে দিলেও সেই অজানা জিনিসটির প্রতি চোরা লোভ আছে বলে মনে হয়।
শখশৌখিনতা নেই। কেজো লোক। ডিকের সঙ্গে সম্পর্কটা এখন ভাল নয়।
মির্না বিশ্বাস
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। বয়স বছর তিরিশ। হাইট পাঁচ সাত তো হবেই। হুবহু মেমদের মতো দেখতে, মাথার চুলটি যদিও কুচকুচে কালো। সার্কাসে প্রথম দিকে জিমনাসটিক্সের খেলা দেখাতেন, বিয়ের পর থেকে ট্রাপিজে। ফ্ল্যাটের দেওয়ালে মির্নার জিমনাসটিক্স করার ছবি আছে।
মির্না বেশ নার্ভাস টাইপ। জোনাথনের ক্ষতি হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় সর্বদা কাঁটা হয়ে থাকেন। ভূতপ্রেতে অবিশ্বাসী নন। উৎপলের ওপর কন্ট্রোল আছে। মির্না চান না বলেই উৎপলও সম্ভবত বাড়ি বেচার ব্যাপারে তাঁর মতেই মত দিয়ে যান। মির্নার উপস্থিতিতে অনেকগুলো কাচের জিনিস ভেঙেছে। প্রথমে মোমবাতি বার করতে গিয়ে ভাঙে ওয়ালক্যাবিনেটের কাচের ড্রয়ার। তারপর মোমবাতি রাখতে গিয়ে সেন্টারটেবিলের কাচ। মির্নার নিজের ঘরের দেওয়াল-আলমারির কাচও মির্নার হাত লেগেই ভাঙে! বেশ কয়েকটি বান্ধ-টিউব ভাঙারও সাক্ষী মির্না।
ডিকের সঙ্গে মির্নার সম্পর্ক খুবই তিক্ত। ভায়ের সম্পর্কে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি। তাঁর মতে ডিক অত্যন্ত স্বার্থপর, নিজেরটুকু ছাড়া কিছু বোঝেনা, সংসারে একটা পয়সা ঠেকায় না, দিদিকে হিংসে করে, বাবার খেয়াল তো রাখেই না। তবে ডিক যে অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার প্ল্যান ভাঁজছে সেটা মির্না জানেন না বলেই মনে হল।
রিচার্ড মাইকেল (ডিক)
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। বয়স সাতাশ-আটাশ। গায়ের রং পোড় পোড়া, মুখের আদলে মির্নার সঙ্গে সামান্য মিল আছে। ভীষণ হড়বড় করে
ইংরিজি বলে, বাংলা জানেই না প্রায়। স্বভাবটা ভারী রুক্ষ, বাড়ির কারও সঙ্গেই বনে না। অবিরাম নাইট ডিউটি করে, আর সকালে এসে পড়ে পড়ে ঘুমোয়। প্রয়োজনীয় টাকা হাতে এলে দেশ ছাড়ার মতলবে আছে। রাতে থাকে না বলে ফার্নিচার রুমের ভূতুড়ে আওয়াজ কোনওদিন শোনেনি। তবে একদিন স্বচক্ষে হেলি। স্পিরিটকে দেখেছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, উৎপল কিছু চেয়ার-টেবিল ফার্নিচার রুমে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যই হোলি স্পিরিট কুপিত হয়েছেন। এবং তিনি আর কখনওই ঠাণ্ডা হবেন না, বাড়ি এখনই বেচে ফেলাই শ্রেয়।
অবশ্য ডিক গোড়া থেকেই বাড়ি বেচায় আগ্রহী। সুরজমলের সঙ্গে সেই গোপনে যোগাযোগ করেছিল। এখনও সুরজমলের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। ভূতুড়ে আওয়াজ না শুনলেও বা ফাটা, কাচ ভাঙার সেও অন্যতম সাক্ষী। তার ঘরেই প্রথম কাচ ভাঙার ঘটনা ঘটে। কোনও কিছুতে না থাকতে চাইলেও বাড়ির ইলেকট্রিক লাইন ডিকই চেক করিয়েছিল।
ডিকের ঘর দেখে বোঝা যোয় সে খুব শৌখিন। গোছানো স্বভাবের। মোটেই উড়নচণ্ডী নয়। গান শোনার নেশা আছে, ক্যাসেটের কালেকশান ভালই। সিলিন ডিয়নের ভক্ত। ঘরে সিলিনের পোস্টার আছে।
সুরজমল অগ্নিদেব
অবাঙালি। হয় উত্তর প্রদেশের, নয় রাজস্থানের। বয়স বছর চল্লিশ। সুদৰ্শন। কেতাদুরস্ত। মুখে দামি পাইপ ঝোলে। ধনী এবং ধুরন্ধর ব্যবসায়ী। নিজেকে অতি ধর্মভীরু বলে প্রতিপন্ন করতে চায়। মা কালীর ভক্ত। মুক্তকেশানন্দ নামের এক গুরুদেবের ছত্রছায়ায় থাকে। এদিকে আবার গুণ্ডাও পোষে। জ্যোতিষেও প্রবল বিশ্বাস। হিরে ছাড়াও তিন আঙুলে তিনটে পাথর বসানো আংটি। একটি সম্ভবত নীলকান্তমণি।
সুরজমল কথাবার্তাতেও অতি দড়। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও ছুড়তে জানে। বলছে বটে জোনাথনের জমি বাড়ি নিয়ে তত আগ্রহ নেই, কিন্তু কেনার ধান্দায় ডিডের কাগজপত্রসহ অ্যাডভান্স নিয়ে চলেও এসেছিল। জোনাথনের ধ্যাতানি খেয়ে এখন অপমানে গরগর করছে।
জোনাথনের বাড়ির গুপ্তধনটির খবর সুরজমল সম্ভবত জানে না।
মিস্টার জোনস
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। পুরো নাম জানা হয়নি। ষাটের মতন বয়স। দড়িপাকানো চেহারা। গায়ের রং তামাটে। মাথার কোঁকড়া চুল বেশির ভাগই পাকা। অপরিচ্ছন্ন রিপন লেনের পলেস্তরাখসা মান্ধাতা আমলের এক বাড়ির দমচাপা অন্ধকার অন্ধকার একতলার একটা ঘরে বাস। সারাদিন একলাই কাটান। টিভি দেখে। একসময়ে। ধর্মতলার নামী ছবি বাঁধাইয়ের দোকান রয়্যাল বাইন্ডার্সে চাকরি করতেন। সাড়ে চার বছর আগে বাস থেকে পড়ে গিয়ে কোমরে চোট পেয়েছিলেন। পোরাসিক ভাটিায়। প্যারাপ্লেজিয়া মতন হয়ে গেছে। হাঁটতে-চলতে পারেন না, ঘরে রাখা হুইলচেয়ারটাই এখন ভরসা। হুইলচেয়ার করে মাঝে মাঝে বেরোন কাছে পিঠে। মিসেস জোনস হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে গেলে চার্চেও যান। খুপরি ঘরটার দেওয়াল যিশু আর মা মেরির ছবিতে ছয়লাপ। ধূমপানের নেশা আছে, হাতে পাকানো সিগারেট খান।
ব্যবহারটি মধুর। উৎপলের সঙ্গে ভালই পরিচয়। জোনাথনের বাড়ির ভূতুড়ে কাণ্ডর খবরাখবর রাখেন। তবে মিসেস জোনসের মতো হহলি স্পিরিটের ব্যাপারে সিরিয়াস নন, বরং মিসেস জোনসের আতঙ্ক দেখে মজাই পান।
মন্তব্য
এক– ডিকের ভূত দেখার কাহিনীটা কি আষাঢ়ে নয়?
দুই— উৎপল সব সত্যি বলছে বলে মনে হয় না কেন?
তিন— সুরজমলের সত্যি মিথ্যে কি পৃথক করা সম্ভব?
চার– ডিককে সন্দেহের তালিকার বাইরে কোনওভাবেই রাখা যায় না।
পাঁচ– কাচ ভাঙছে বাড়িরই কেউ। কিন্তু কীভাবে? বালবটিউবই বা ওভাবে ফাটে কী করে?
ছয়– ফার্নিচারঘরের শব্দটা কি কোনও টেপের আওয়াজ? কোথায় লুকোনো থাকতে পারে টেপটা? কেই বা তাকে চালু করে? কীভাবে করে?
টুপুরের পাঠ শেষ। মিতিন চোখ বুজে শুনছিল। বলল, কীরে, আর কিছু নেই?
আর কী থাকবে?
প্রত্যেকের বাড়ির ডেক্রিপশান? কাচ ভাঙাভাঙির ডিটেল? ফার্নিচাররুমের বর্ণনা?
ওগুলোও লিখতে হবে? লিখব?
থাক। মিতিন ঝুঁকে টুপুরের চুল ঘেঁটে দিল, নোটটা ভালই বানিয়েছিস। ভাষাও বেশ ঝরঝরে হয়েছে। তবে অবজারভেশান আরও তীক্ষ্ম করতে হবে। দু-চারটে ইম্পর্ট্যান্ট পয়েন্ট মিস করে গেছিস।
যেমন?
ভাগলপুরের বাড়ি বিক্রি করতে গিয়ে কী একটা ঝামেলা হয়েছিল।
হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো। মিস্টার মাইকেল নাকি নিজেদের বাড়ি পর্যন্ত যেতেই পারেননি। হোটলে বসেই তাঁকে নাকি সইসাবুদ করে দিতে হয়েছিল। ন্যায্য দামও পাননি, জলের দরে বেচতে হয়েছে। যে। কিনেছে সে নাকি উৎপলবাবুকেও খুব ভয় দেখিয়েছিল। টুপুর বলতে বলতে থমকাল, কিন্তু মিতিনমিসি, ওসবের সঙ্গে ইলিয়ট রোডের বাড়ির ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানার কী সম্পর্ক?
হয়তো নেই। আবার হয়তো বা আছেও। একটা কথা মাথায় রাখিস, ভাগলপুরের বাড়ি বিক্রি করে আসার আগে পর্যন্ত ইলিয়ট রোডের বাড়িতে কিন্তু কোনও সমস্যা ছিল না।
তা বটে। টুপুরের চোখ সরু হল, তুমি কি উৎপলবাবুকে সন্দেহ করছ? কিন্তু তিনি কেন তা হলে যেচে তোমার কাছে….?
সেই মোটিভটাই তো খুঁজে বার করতে হবে। অবশ্য আমি উৎপলবাবুকেই দোষী বলে দিচ্ছি তা কিন্তু নয়। তবে হ্যাঁ, সেও সন্দেহের তালিকার বাইরে নেই। মুখে সে যাই বলুক, শ্বশুর যদি ভয় পেয়ে বাড়ি বিক্রি করেন, তারও কিন্তু মোটা লাভের সম্ভাবনা।
হুম, এটাও একটা ভাবার বিষয় বটে।
তারপর ধর, কাচ ভাঙার ব্যাপারটা। লক্ষ করেছিস কি কাচ ভাঙার নেচারটা দুরকমের? লাস্ট কাচটা ভেঙেছে টুকরো টুকরো হয়ে। নট ইন রেগুলার জিওমেট্রিকাল প্যাটার্ন। অন্য দিনের মতো হাত লেগে খসেও পড়েনি, কোন কিছুর আঘাতে ভেঙেছে। প্লাস পুতুল গুড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়াটাও একেবারেই নতুন ধরনের ইন্সিডেন্ট। তারপর ধর, আমরা প্রথমবার ও-বাড়ি ভিজিট করার পর ফার্নিচার রুমে আওয়াজ হওয়া ঝপ করে কমে গেল। কিন্তু সুরজমল ফের ঘুরে যাওয়ার পর থেকেই শুরু হল বালব-টিউব আর কাচ ভাঙার উপদ্রব। এই পিরিয়ডে ফার্নিচাররুমে মাত্র এক দিনই আওয়াজ হয়েছে। এখন বালব-টিউবও আর রোজ ফাটছে না। এবং চেয়ার-টেবিল বার করে দেওয়ার একদিন পরই লাস্ট ইন্সিডেন্টটা ঘটল।… এগুলো তো তুই লিখিসনি! এইসব ঘটনাই তো সুতায় গাঁথতে হবে। নয় কি?
টুপুর মাথা চুলকোল, ভুল হয়ে গেছে। দেব নোট করে?
আর লাগবে না। তবে তোর আর একটা ব্যাপারও আমায় একটু হতাশ করেছে রে।
কী?
তোর নাকটা এখনও পাকেনি।
মানে?
পরে শুনিস। এখন আয়, সব ইনফরমেশানগুলোকে ছেঁকেছুঁকে তাদের একটা যুক্তির শিকড়ে গেঁথে ফেলি। তারপর মেথড অফ এলিমিনেশান দিয়ে ধাপে ধাপে বুল্স আইতে পৌঁছই। মিতিন ঝপ করে থেমে গিয়ে মুচকি হাসল, তবে তারও আগে আর একটা কাজ যে আছে মিস ওয়াটসন।
কী?
জিভটা যে বড় চা চা করছে।
দৌড়ে ভারতীকে চা করতে বলে ফিরেছে টুপুর, আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে পাৰ্থর আবির্ভাব। মুখব্যাদান করে প্রকাণ্ড এক জৃম্ভণ সারল। ঢুলুঢুলু চোখে বলল, মাসি-বোনঝিতে জোর গুলতানি চলছে দেখি!
তাতে কি মহাশয়ের এক ডজন দিবাস্বপ্ন দেখার কোনও ব্যাঘাত ঘটল?
ডাঁহা ভুল বললেন প্রজ্ঞাপারমিতা দেবী। পাৰ্থ সোফায় বাবু হয়ে বসল, শোনো, মানুষ প্রথম স্বপ্ন দেখে ঘুমানোর সাতষট্টি মিনিট পর। তারপর প্রতিটি স্বপ্ন দেখার মাঝে ব্যবধান থাকে সিক্সটিওয়ান টু সিক্সটিসেভেন মিনিটস। সুতরাং পৌনে তিন ঘণ্টার ঘুমে আমার পক্ষে একজোড়ার বেশি স্বপ্ন দেখা সম্ভব নয়।
ও তো গড় হিসেব। তুমি তো ব্যতিক্রম।
পার্থর ঘাড়ের রোঁয়া যেন ফুলে উঠল, তা হলে স্বীকার করছ আমি একটু ডিফারেন্ট?
অবশ্যই। মিতিন মিটিমটি হাসছে, তা ব্যতিক্রমী মানুষ, তোমাকে যে তিনটে কাজের ভার নিতে হবে।
আমি প্রস্তুত। কাজকে এ শর্মা ডরায় না।
বটেই তো। তুমি তো কাজপাগল। নইলে কি নিজেই নিজেকে ছুটি দিয়ে আজ ভোঁস ভোঁস ঘুমোতে! কুটুস করে একটা হূল ফুটিয়ে নিয়ে মিতিন সিরিয়াস হল, মন দিয়ে শোনো। প্রথম কাজ, যে কবরখানায় মাইকেল মধুসূদনের সমাধি আছে, সেখানে গিয়ে রবার্ট ম্যাকগ্রেগরের সমাধি খুঁজে বের করা। মৃত্যু-সাল আঠেরোশো চৌষট্টি।
কেন?
প্রশ্ন নয়, যা বলছি তাই করবে।
কিন্তু পাব কী করে? অত বড় একটা কবরখানায়…?
খুঁজবে সারাদিন। সঙ্গে সঙ্গে পুরনো কলকাতার ইতিহাস আরও ঝালাই হয়ে যাবে।
পার্থ বেজার মুখে প্রশ্ন করল, দুনম্বর কাজটা কী?
পরশু এখান থেকে একজন ইলেকট্রিশিয়ান ধরে নিয়ে গিয়ে মিস্টার জোনাথন মাইকেলের ফার্নিচার রুমে একটা টিউবলাইট ফিট করে দিয়ে আসতে হবে। কাল সকালে আমি টিউবটা তোমায় এনে দেব। মিস্টার মাইকেলকে ফোন করে বলে দেব টিউবটা মন্ত্ৰঃপূত, হোলি স্পিরিটও ওই টিউব ভাঙতে পারবে না। উলটে ওই টিউবের কল্যাণেই ও বাড়ির সমস্ত উপদ্রব বন্ধ হয়ে যাবে। টিউবলাইটটি জ্বালিয়ে দরজায় তালা দেবেন মিস্টার মাইকেল, তুমি বলে আসবে আমি না যাওয়া পর্যন্ত কোনওভাবেই ওই ঘরের দরজা যেন না খোলা হয়। ভেতরে তুলকালাম হয়ে গেলেও না।
এটা কোনও কাজই নয়। হয়ে যাবে।
অত সোজা ভেবো না। টিউবলাইট লাগানোর সময়ে লাইকোপোডিয়াম পাউডার ছড়িয়ে দিতে হবে ফার্নিচার রুমের কার্পেটে। খুব সাবধান, কেউ যেন পাউডার ছড়ানো দেখতে না পায়। মিস্টার মাইকেল, উৎপল, মিসেস জোনস, মির্না, ডিক কেউ না।
মন্ত্ৰঃপূত টিউবলাইট, পাউডার…. ব্যাপারটা কী বলল তো?
উহুঁ, প্রশ্ন নয়।
ও কে। ও কে। কী বিটকেল বিটকেল কাজ যে চাপাচ্ছ! তিন নম্বরটা কী?
ওটাই সিম্পল। কাল জামালপুর এক্সপ্রেসের দুটো টিকিট চাই। আমার আর টুপুরের। আপটু ভাগলপুর।