[১৮৯৫ খ্রীঃ ১৬ নভেন্বর লণ্ডনে প্রদত্ত ভাষণের অনুলিপি]
অনুভূতির গভীরে উপনীত হতে প্রতীক-উপাসনা এবং অনুষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে যাবার প্রয়োজন মানুষের আছে বলেই ভারতবর্যে আমরা বলে থাকি, ‘কোন ধর্মমতের গণ্ডীর মধ্যে জন্মান ভাল, কিন্তু সেই মত নিয়েই মরা ভাল নয়।’ চারাগাছকে রক্ষা করার জন্য বেড়ার আবশ্যকতা আছে, কিন্তু চারা যখন বৃক্ষে পরিণত হয়, তখন বেড়াই আবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং প্রাচীন পদ্ধতিগুলি সমালোচনা ও নিন্দা করার কোন প্রয়োজন নেই। আমরা ভুলে যাই যে, ধর্মের ক্রমবিকাশ অবশ্যই থাকবে।
আমরা প্রথমে সগুণ ঈশ্বরের চিন্তা করি, এবং তাঁকে স্রষ্টা, সর্বশক্তিমান্, সর্বজ্ঞ ইত্যাদি বলে বিশেষিত করে থাকি। কিন্তু প্রেমের সঞ্চার হলে ঈশ্বর শুধু প্রেমস্বরূপ হয়ে যান। ঈশ্বর কী—তা নিয়ে প্রেমিক ভক্ত মাথা ঘামায় না, কারণ সে তাঁর কাছে কিছুই চায় না। জনৈক ভারতীয় সাধক বলেছেন, ‘আমি তো আর ভিক্ষুক নই।’ আর সে ভয়ও করে না। ভগবানকে মানুষেরই মত ভালবাস।
ভক্তিভাবাশ্রিত কয়েকটি সাধনপ্রণালীর উল্লেখ এখানে করা যাচ্ছে। (১) শান্তঃ সহজ শান্তিপূর্ণ অনুরাগ—পিতৃত্ব ও সাহায্যের একটা ভাব মিশ্রিত; (২) দাস্যঃ সেবাভাবের আদর্শ; ঈশ্বর প্রভু বা অধ্যক্ষ বা সম্রাট্রূপে দণ্ড ও পুরস্কারদানে রত; (৩) বাৎসল্যঃ ঈশ্বরে সন্তানভাব। ভারতবর্ষে মা কখনই শাস্তি দেন না। এ-সব অবস্থার প্রত্যেকটিতে উপাসক ঈশ্বরের এক-একটি আদর্শ গ্রহণ করে তদনুযায়ী সাধন করে। তারপর (৪) ভগবান্ হন সখা; সখ্যভাবে কোন ভয় নেই। এতে সমতা ও অন্তরঙ্গতার ভাবও আছে। অনেক হিন্দুসাধক ঈশ্বরকে সখা ও খেলার সাথী জ্ঞানে উপাসনা করে। তারপর (৫) মধুর-ভাবঃ মধুরতম প্রেম, পতি-পত্নীর প্রেম। সেণ্ট টেরেসা এবং ভাবাবিষ্ট সাধকগণ—এর দৃষ্টান্ত। পারসীকদের মধ্যে কান্তাভাবে এবং হিন্দুদের মধ্যে পতিরূপে ঈশ্বরকে ভজনা করার রীতি আছে। মহীয়সী রানী মীরাবাঈ-এর কথা আমাদের মনে পড়ে; তিনি ভগবানকে পতি বলে প্রচার করতেন। অনেকের মত এত চরমে পৌঁছেছে যে, তাদের কাছে ঈশ্বরকে ‘সর্বশক্তিমান্’ বা ‘পিতা’ বলা যেন অধর্ম। এ-ভাবের উপাসনার ভাষা প্রণয়মূলক। এমন কি কেউ কেউ অবৈধ প্রণয়ের ভাষাও ব্যবহার করে থাকেন। কৃষ্ণ ও ব্রজগোপিকাদের কাহিনী এই পর্যায়ভুক্ত। তোমাদের হয়তো ধারণা যে, এই ভাবের উপাসনায় সাধকের অত্যন্ত অধোগতি হয়। তা হয়ও বটে। তথাপি অনেক বড় বড় সাধকের জীবনে উন্নতিও হয়েছে এই ভাবের মধ্য দিয়ে। এমন কোন মানবীয় বিধান নেই, যার অপব্যবহার হয়নি। ভিখারী আছে বলে কি তুমি রান্না বন্ধ রাখবে? চোরের ভয়ে তুমি কি নিঃস্ব হয়েই কাটাবে? ‘হে প্রিয়তম, তোমার অধরের একটি চুম্বনের একবার মাত্র আস্বাদন আমাকে পাগল করে তুলেছে!’১১
এই ভাবে আরাধনার ফলে কেউ বেশীদিন কোন সম্প্রদায়ভুক্ত থাকতে বা আচার-অনুষ্ঠানাদি মেনে চলতে পারে না। ভারতে ধর্ম মুক্তিতে পর্যবসিত হয়। কিন্তু এ মুক্তিও ত্যাগ করতে হয়, তখন শুধু প্রেমের জন্যই প্রেম।
সর্বশেষে আসে নির্বিশেষ প্রেম—আত্মা। একটি পারসী কবিতায় বর্ণিত আছে, জনৈক প্রণয়ী তার প্রণয়িনীর ঘরের দরজায় ঘা দিল। প্রেমিকা জিজ্ঞাসা করল ‘কে তুমি?’ প্রেমিক উত্তর দিল, ‘তোমারই প্রিয়তম অমুক।’ প্রেমিক শুধু বলল, ‘আমি তো এমন কাউকে চিনি না! তুমি চলে যাও!’ … এভাবে চতুর্থবারও যখন প্রশ্ন করল, তখন প্রেমিক বলে উঠল, ‘প্রিয়তম, আমি তো তুমিই, অতএব দরজা খোল।’ অবশেষে দরজা খুলে গেল।
প্রেমিকার ভাষায় অনুরাগ বর্ণনা করে জনৈক মহান্ সাধক বলেছেনঃ ‘চার চোখের মিলন হল। দুটি আত্মায় যেন কি পরিবর্তন হয়ে গেল! এখন আর আমি বলতে পারি না—তিনি পুরুষ এবং আমি নারী, অথবা তিনি নারী এবং আমি পুরুষ। শুধু এটুকুই স্মৃতিতে আছে যে, আমরা দু-টি আত্মা ছিলাম। অনুরাগের আবির্ভাবে এক হয়ে গেছি।’১২
সর্বোচ্চ প্রেমে শুধু আত্মারই মিলন। অন্য যত রকম ভালবাসা, সবই দ্রুত বিলীয়মান। শুধু আত্মিক প্রেমই স্থায়ী হয়, এবং ক্রমশঃ বেড়ে যায়।
প্রেম দেখে আদর্শটি। এটি ত্রিভুজের তৃতীয় কোণ। ঈশ্বর কারণ, স্রষ্টা ও পিতা। প্রেম হচ্ছে চরম পরিণতি। কুঁজো সন্তানের জন্য মা অপেক্ষা করেন, কিন্তু দিন কয়েক লালন-পালনের পরই তাকে স্নেহ করেন এবং সব চেয়ে সুন্দর মনে করেন। কৃষ্ণাঙ্গ ইথিওপের ললাটে প্রেমিক সুন্দরী হেলেনেরই রূপ দেখে। এ-সব ব্যাপার আমরা সাধারণতঃ উপলব্ধি করতে পারি না। ইথিওপের ললাট উপলক্ষ মাত্র; প্রেমিক তো দেখে হেলেনকেই। উপলক্ষের উপর তার আদর্শটি প্রক্ষেপ করা হয়, এবং আদর্শ তাকে আবৃত করে—শুক্তি যেমন বালুকণাকে মুক্তায় রূপান্তরিত করে। ঈশ্বর হচ্ছেন আদর্শ, যাঁর ভিতর দিয়ে মানুষ সব কিছু দেখতে পারে।
সুতরাং আমরা প্রেমকেই ভালবাসছি। এই প্রেম মুখে প্রকাশ করা যায় না। কোন বাক্যই তা উচ্চারণ করতে পারে না। এ বিষয়ে আমরা মৌন।
ইন্দ্রিয়গুলি প্রেমে অতিশয় উন্নত হয়। আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, মানবীয় ভালবাসা গুণ-মিশ্রিত। অন্যের মনোভাবের উপর তা নির্ভরশীলও বটে। প্রেমের এই পারস্পরিক নির্ভরতাকে ব্যক্ত করার শব্দ ভারতীয় ভাষাগুলিতে আছে। সর্বাপেক্ষা নিম্নস্তরের ভালবাসা হচ্ছে স্বার্থযুক্ত; তাতে শুধু ভালবাসা পাবার সুখই আছে। আমরা ভারতবর্ষে বলি, ‘একজন গাল পেতে দিচ্ছে, আর একজন চুম্বন করছে।’ পারস্পরিক প্রেম এর ঊর্ধ্বে। কিন্তু এও থাকে না। যথার্থ প্রেম সর্বস্ব-ত্যাগে। এ-অবস্থায় আমরা অন্যকে দেখতে অথবা আমাদের আবেগকে প্রকাশ করবার মত কিছু করতেও চাই না। দেওয়াটাই যথেষ্ট। এভাবে মানুষকে ভালবাসা প্রায় অসম্ভব, কিন্তু ঈশ্বরকে ভালবাসা সম্ভব।
বালকেরা রাস্তায় ঝগড়া করতে করতে যদি ভগবানের নামে শপথ করে, ভারতবর্ষে তাতে কোন ঈশ্বরনিন্দা হয় না। আমরা বলি, আগুনে হাত দাও—তুমি অনুভব কর আর নাই কর, তোমার হাত পুড়বেই। তেমনি ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করলে কল্যাণ ছাড়া আর কিছু হবে না।
ঈশ্বরনিন্দার ভাবটি এসেছে য়াহুদীদের কাছ থেকে; য়াহুদীরা পারসীকদের আনুগত্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। ঈশ্বর বিচারকর্তা ও শাস্তা—এ-ভাবটি মন্দ না হলেও নিম্নস্তরের ও স্থূল। ত্রিভুজের তিনটি কোণঃ প্রেম কিছু চায় না; প্রেমে কোন ভয় নাই; প্রেম সর্বদাই উচ্চতম আদর্শের জন্য।
‘সেই প্রেমময় ভগবান্ যদি বিশ্বভুবন জুড়ে না থাকতেন, তবে কে-ই বা এক মুহূর্ত বাঁচতে পারত, কে-ই বা এক মুহূর্ত ভালবাসতে পারত?’
আমরা অনেকেই দেখতে পাব যে, শুধু কর্ম করতেই আমরা জন্মেছি। ফলাফল ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করব। ভগবানের প্রীতির জন্যই কাজ করা হয়েছে। বিফল হলেও দুঃখ করবার কিছু নাই। ভগবানের প্রীতির জন্যই তো যত কিছু কর্ম।
নারীর মধ্যে মাতৃ-ভাবটি খুব পরিস্ফুট। ঈশ্বরকে তাঁরা সন্তানভাবে উপাসনা করেন; যা কিছু করেন তার জন্য, কিছুই চান না।
ক্যাথলিক এই-সব গভীর তত্ত্বের অনেক কিছুই শেখায়, এবং একটু সংকীর্ণ হলেও অতিশয় ধর্মনিষ্ঠ। আধুনিক সমাজে প্রোটেষ্টাণ্ট মত উদার হলেও অগভীর। সত্য কতখানি মঙ্গল করেছে, তা দ্বারা সত্যের বিচার করা—একটি শিশুকে কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূল্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার মতই অসঙ্গত।
সমাজ হবে প্রগতিশীল। নিয়মকে অতিক্রম করে নিয়মের ঊর্ধ্বে যেতে হবে। প্রকৃতিকে জয় করার প্রয়োজনেই আমরা তাকে স্বীকার করি। ত্যাগের অর্থই হচ্ছে—কেউই ঈশ্বর ও ধন-দেবতার উপাসনা একসঙ্গে করতে পারে না।
তোমাদের বিচার-বুদ্ধি ও প্রেম গভীর কর। তোমাদের হৃদয়-পদ্ম ফুটিয়ে তোল—মৌমাছি আপনিই এসে জুটবে। প্রথমে নিজের উপর বিশ্বাস রাখ,—তারপর ঈশ্বরে বিশ্বাস আসবে। মুষ্টিমেয় শক্তিধর মানুষই পৃথিবী তোলপাড় করে দিতে পারে। চাই পরের জন্য অনুভব করার সহানুভূতিশীল হৃদয়, উদ্ভাবনকারী মস্তিষ্ক, এবং কর্ম করার উপযোগী দৈহিক শক্তি। বুদ্ধ (মনুষ্যেতর) প্রাণিবর্গের জন্যও আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। নিজেকে কর্ম করার যোগ্য যন্ত্র করে তোল। কিন্তু ঈশ্বরই কর্ম করেন, তুমি কর না। একজনের মধ্যেই সমগ্র বিশ্ব রয়েছে। জড়বস্তুর একটি কণার মধ্যেই জগতের সমস্ত শক্তি নিহিত আছে। হৃদয় মস্তিষ্কের যদি বিরোধ দেখ, তবে হৃদয়কেই অনুসরণ কর।
পূর্বে বিধান ছিল প্রতিযোগিতা, আজকের বিধান হচ্ছে সহযোগিতা। আগামীকাল কোন বিধি-বিধানই থাকবে না। ঋষিরা তোমায় সাধুবাদ করুন, অথবা জগৎ তোমায় ধিক্কার দিক্, ভাগ্য-লক্ষ্মী তোমার প্রতি প্রসন্না হোন অথবা দারিদ্র্য ও বস্ত্রহীনতা তোমায় ভ্রুকুটি করুক, একদিন হয়তো বনের লতাপাতা আহার করবে, আবার পরদিনই পঞ্চাশ উপকরণের বিরাট ভোজে অংশ গ্রহণ করবে, ডাইনে বাঁয়ে লক্ষ্য না করে এগিয়ে যাও!১৩
[স্বামীজী তারপর প্রশ্নোত্তরে পওহারী বাবার কথা উল্লেখ করেন—কিভাবে সেই যোগী নিজের বাসনপত্রগুলি নিয়ে চোরের পিছনে ছুটেছিলেন এবং তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলেছিলেন, ‘প্রভু, আমি জানতুম না যে, তুমি এসেছিলে! দয়া করে বাসনগুলি গ্রহণ কর। এগুলি তোমার! আমি তোমার সন্তান, আমাকে ক্ষমা কর।’ স্বামীজী আরও বলেন, কিভাবে এক বিষধর সাপ সেই যোগীকে দংশন করে এবং সন্ধ্যার দিকে সুস্থ বোধ করে তিনি বলতে থাকেন, ‘আমার প্রিয়তমের কাছ থেকে দূত এসেছিল!’]