দিন কয়েক ধরে পোয়ারোর অদ্ভুত অনুরোধের কথাটাই মাথায় ঘুরছিল। কিন্তু লরেন্সকে এখনও পর্যন্ত কথাটা বলা হয়ে ওঠেনি কারণ সুযোগই পাইনি।
সেদিন বাগানে ঘুরছিলাম, নানা কথা মনে আসছিল। হঠাৎ লরেন্সকে দেখতে পেলাম। বাগানের মধ্যে ছোট খেলার মাঠটাতে লরেন্স দুটো বল নিয়ে নিজের মনে নাড়াচাড়া করছিল। মনে হল এই সময়ই কথাটা বলার সুযোগ। না হলে পোয়ারো যা ব্যস্তবাগীশ নিজেই হয়ত কোনোদিন জিজ্ঞাসা করে বসবে, এটা হতে দিতে মন চাইল না। তাই সরাসরি লরেন্সের কাছে গিয়ে বললাম যে আমি তাকেই খুঁজছিলাম।
লরেন্স কি ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম পোয়ারো তাকে একটা কথা জানাতে বলেছিল। লরেন্স উদগ্রীব হয়ে উঠল। আমি আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম কথাটা হলবাড়তি কফির কাপটা খুঁজে বের করুন, তা হলে আর চিন্তার কারণ থাকবে না।
লরেন্স বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল পোয়ারো এই কথার দ্বারা কি বলতে চাইছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম সে কি কিছুই বুঝতে পারছে না। লরেন্স মাথা নাড়ল।
আমি বললাম তাহলে পোয়ারোকে গিয়ে আমি কি কি জানাব। লরেন্স বলল আমি যাতে পোয়ারোকে বলি যে সে সত্যিই কথাটার অর্থ কিছুই বুঝতে পারছে না।
এই সময় বাড়ির পেটা ঘড়িটার শব্দ কানে এল। আমরা দুজনে একসঙ্গে বাড়িতে ঢুকলাম। পোয়ারোকে বসে থাকতে দেখলাম। জন ওকে দুপুরের খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমরা স্থির করলাম যে দুর্ঘটনার বিষয়ে কোনো আলোচনা করব না। সকলে মিলে যুদ্ধের বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলাম।
ডরকাস আমাদের বিস্কুট আর পানীয় পরিবেশন করল। এই সময় পোয়ারো হঠাই মেরী ক্যাভেণ্ডিসের দিকে ঘুরে বসে বলল। সে আবার পুরোনো স্মৃতিটাকেই জাগিয়ে তুলতে বাধ্য হচ্ছে কারণ তার দুএকটা জিজ্ঞাসা আছে। মেরী ক্যাভেণ্ডিসের কোনো আপত্তি আছে কিনা সে জানতে চাইল। মেরী বললেন পোয়ারো যা জানতে চান স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল সিনথিয়ার ঘর থেকে মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ ছিল কিনা। মেরী প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে বলল দরজাটা যে বন্ধ ছিল একথা তো তিনি তদন্তের সময়ও বলেছিলেন।
পোয়ারো বলল মিসেস ক্যাভেণ্ডিস তার প্রশ্নের উদ্দেশ্যটা ঠিক বুঝতে পারেননি। তার প্রশ্ন হল দরজাটা এমনি ভেজানো ছিল না খিল বন্ধ ছিল। মেরী এবার বুঝতে পেরে বললেন তিনি ঠিক মনে করতে পারছেন না। সম্ভবতঃ দরজাটা খিল এঁটে বন্ধ ছিল। কারণ দরজাটা খোলা যাচ্ছিল না।
পোয়ারো বলল শুধুমাত্র সম্ভাবনা দিয়ে কাজ চলবে না, ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে হবে।
কথার মাঝখানে হঠাৎ লরেন্স বাধা দিয়ে বলল সে দেখেছিল দরজায় খিল আঁটা ছিল।
পোয়ারো বলল তাহলে তো আর কিছু বলার নেই ওকে যেন একটু হতাশ দেখাল।
খাওয়া-দাওয়ার পর পোয়ারো আমাকে ওর সঙ্গে যেতে অনুরোধ করল। আমি সম্মত হলাম। বাগানের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে পোয়ারো আমাকে জিজ্ঞাসা করল আমি কি ভাবছি। আমি শান্ত স্বরেই বললাম যে কিছু ভাবছি না। পোয়ারো চুপ করে রইল।
একটু পরে আমি পোয়ারোকে বললাম তার কথাটা আমি লরেন্সকে জানিয়েছি। পোয়ারো জানতে চাইল কথাটা শুনে লরেন্সের প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল। আমি বললাম যে লরেন্স কথাটার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি। ভাবলাম কথাটা শুনে পোয়ারো হয়ত হতাশ হয়ে পড়বে, কিন্তু ঠিক উল্টোটা ঘটল। পোয়ারো বলল সে জানত যে এরকমই হবে। পোয়ারোকে আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করতে একটুও ইচ্ছে হল না।
পোয়ারো কথা প্রসঙ্গে বলল সিনথিয়াকে তো খাওয়ার আসরে দেখা গেল না। আমি বললাম সিনথিয়া হাসপাতালে গেছে, সে আজ থেকে আবার কাজে যোগ দিয়েছে।
পোয়ারো বলতে লাগল সিনথিয়া বেশ পরিশ্রমী, এবং দেখতে বেশ সুন্দরীও। সে জিজ্ঞাসা করল সিনথিয়া কি তার ডাক্তারখানাটা দেখতে চাইলে দেখাবে। আমি বললাম না দেখানোর কোনো কারণ নেই বরং খুশীই হবে সে কারণ ওটা দেখাবার মতই।
পোয়ারো প্রশ্ন করল সিনথিয়াকে রোজ যেতে হয় কিনা। আমি বললাম ওর শুধু বুধবার পুরোদিন আর শনিবার আধবেলা ছুটি। পোয়ারো বলল সময়টা মনে রাখতে হবে।
এবার পোয়ারো জানতে চাইল সিনথিয়ার ওখানে মারাত্মক বিষ আছে কিনা। আমি বললাম নিশ্চয়ই আছে, সেগুলো একটা আলাদা আলমারীতে রাখা থাকে, ঘরের বাইরে গেলেই চাবিটা সবসময় নিজের কাছে রাখে।
আলমারীটা কোথায় রাখা থাকে, জানলার ধারে কিনা পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল। ওর প্রশ্নগুলো শুনে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। আমি জানতে চাইলাম কেন সে এই প্রশ্ন করছে। পোয়ারো বলল তার একটু আশ্চর্য মনে হচ্ছিল, তাই।
আমরা কথা বলতে বলতে পোয়ারোর বাড়ির কাছে এসে পড়েছিলাম। পোয়ারো তার বাড়িতে খেতে বলল আমাকে। আমি বললাম যে এখন আর যাব না, একটু বড় রাস্তা দিয়ে ঘুরে বাড়ি যাব।
স্টাইলসের চারদিকের দৃশ্য বড়ই মনোহর। গাছপালার মধ্য দিয়ে হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিল, চারদিক শান্ত, নিস্তব্ধ। হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছের নিচে এসে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। মনে হল সব কথা ভুলে যাই, এমনকি পোয়ারোর কথাও। কিন্তু মনের গতি বড়ই বিচিত্র। ঘুরে ফিরে সেই হত্যাকাণ্ডের কথাটাই আবার মনে হতে লাগল। ভাবতে ভাবতে বোধহয় একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। মনে হল লরেন্স অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পপকে খুন করে বসেছে–আধো ঘুম আধো জাগরণে এটাই বুঝি দেখতে পেলাম। মনে হল জন যেন চিৎকার করছে। চমকে উঠতেই তন্দ্রা ছুটে গেল আমার।
চারদিকে তাকালাম, এরকম জায়গায় ঘুমিয়ে পড়াটা একটুও ঠিক হয়নি বুঝতে পারলাম। হঠাৎ সামনের দিকে নজর পড়তেই দেখতে পেলাম জন ও মেরী ক্যাভেণ্ডিস আমার কিছু দূরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ভাগ্যিস আমাকে দেখতে পায়নি ওরা। ওদের ভাবভঙ্গী দেখে সহজেই বোঝা যায় যে ওরা ঝগড়া করছে।
জন বলে উঠল সে একথা বিশ্বাস করে না। মেরী শান্ত গলায় বলল তার কাজকর্মে বাধা দেবার অধিকার জনের নেই। জন বলল মাত্র গত শনিবার তার মাকে কবর দেওয়া হয়েছে। আর মেরী ঐ লোকটার সঙ্গে ঢলাঢলি করছে এত সারা গ্রামে টিঢ়ি পড়ে যাবে।
মেরী জিজ্ঞাসা করল জন কি শুধু গ্রামে টিটি পড়ার ভয়েই কাহিল হয়ে পড়ছে। জন বলল শুধু তা নয়, ঐ লোকটাকে সে আর সহ্য করতে পারছে না, লোকটা একটা পোলিশ ইহুদী। মেরী উত্তরে বলল শরীরে একটু ইহুদী রক্ত থাকা ভালো, তাতে যত আকাট ইংরেজ আছে তাদের বুদ্ধি খুলতে পারে।
মেরী ক্যাভেণ্ডিসের আগুন ঝরা কথায় জনের মুখ লাল হয়ে উঠল। সে তীব্র কণ্ঠে মেরী বলে চিৎকার করে উঠল; জানতে চাইল এটাই মেরীর শেষ কথা কিনা। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেরী ডাঃ বরস্টিনের সঙ্গে মেলামেশা করবে কিনা।
মেরী বলল তার ইচ্ছা হলেই সে মিশবে। জন জিজ্ঞাসা করল তার অপছন্দ জেনেও মেরী এই কাজ করবে। মেরী উত্তরে বলল তার ইচ্ছাতে বাধা দেবার কোনো অধিকার জনের নেই। সে জানতে চাইল জনের কি এমন কোনো বন্ধু নেই যাকে মেরী অপছন্দ করে।
এই কথাটা শুনে জন বোধ হয় একটু ধাক্কা খেল। একটা দুশ্চিন্তার ছায়া খেলে গেল ওর মুখে। ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলত মেরী কি বলতে চাইছো। শান্ত কণ্ঠে মেরী বলল সে শুধু বলতে চাইছে তার বন্ধুদের নিয়ে যাতে জন আর মাথা না ঘামায়।
জনের চোখেমুখে মিনতি ঝরে পড়ল এবার। সে জানতে চাইল সত্যি কি মেরীর ওপর তার আর কোনো অধিকার নেই। হাত বাড়িয়ে জন মেরীর হাত ধরে ফেলল।
আমার মনে হল মেরী হয়ত একটু নরম হয়ে পড়লেন। কিন্তু মুহূর্তেই সেই ভুলটা ভেঙে গেল যখন মেরী নিজের হাত ছিনিয়ে নিয়ে বলে উঠলেন, সত্যি তার ওপর জনের কোনো অধিকার নেই।
মেরী হনহন করে এগিয়ে যেতেই জন আবার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল যাওয়ার আগে মেরী যেন সত্যি কথাটা বলে যায় যে সে সত্যি বরস্টিনকে ভালোবাসে কিনা।
ঘুরে দাঁড়িয়ে ঋজু ভঙ্গীতে মেরী উত্তরে বললেন হয়ত তাই। তারপর দৃঢ় পায়ে একটা গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
জনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একদম পাথর হয়ে গেছে সে। আমি খুব অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। স্বামী স্ত্রীর গোপন কথোপকথন আমাকে শুনতে হল অনিচ্ছাসত্ত্বেও। কি করি ভাবতে ভাবতে শুকনো পাতাগুলোর ওপর দিয়ে জনের দিকে এগোতে লাগলাম। আমার পায়ের শব্দে ঘুরে দাঁড়াল জন। আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল আমি পোয়ারোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছি কিনা। জন জানতে চাইল পোয়ারো কি সত্যি কিছু করতে পারবেন।
মনে মনে খুশী হলাম। জন ভেবেছে আমি এইমাত্র এসেছি। যাই হোক আমি তার প্রশ্নের উত্তরে বললাম একসময় পোয়ারোর চেয়ে বড় গোয়েন্দা আর কেউ ছিল না। বয়স হলেও ওর প্রতি শ্রদ্ধা আমার এতটুকু কমেনি।
জন বলল তাহলে তো ভালোই। কিন্তু তার একদম ভালো লাগছে না, মনে হচ্ছে পৃথিবীটাই একদম বিশ্রী। কিছু না জানার ভান করে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে?
জন বলতে লাগল প্রথমেই তো এরকম একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটল, স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের লোকেরা জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে, তার ওপর খবরের কাগজগুলোর অত্যাচার তো আছেই। সবচেয়ে মারাত্মক কাণ্ড ঘটেছে সকালবেলা, দরজার সামনে এক দঙ্গল লোক জমা হয়েছিল, হয়ত তারা বিনা পয়সায় মজা দেখার জন্য এসেছিল।
আমি জনকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম যেন সে মুষড়ে না পড়ে, সব ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।
জন বলল, কিছুই ঠিক হবার নয়। এবার তো ঘটনা আরও মারাত্মক দিকে মোড় ঘুরল। সে বলতে লাগল ইঙ্গলথর্প ছাড়া পেয়ে গেছে যখন তখন অপরাধী নিশ্চয় আমাদের মধ্যে কেউ।
জনের কথাটা শুনে সত্যিই চমকে উঠলাম। আমাদের মধ্যে হত্যাকারী লুকিয়ে আছে কথাটা ভাবতেই কেমন লাগল। হঠাৎ একটা কথা মাথার মধ্যে চকিতে জেগে উঠল; এই সম্ভাবনাটার কথা তো আমার একেবারেই মনে হয়নি। নিজেকে মূক বলে মনে হল। এবার মনটা অনেকটা হাল্কা হয়ে গেল।
জনকে বললাম আমাদের মধ্যে কেউ এই কাজ করতে পারে না। জন বলল তাহলে আর কে করবে? আমি বললাম সে কি সত্যিই বুঝতে পারছে না। জন মাথা নাড়ল। আমি চারদিক দেখে নিয়ে ফিসফিস করে জনকে ডাঃ বরস্টিনের নাম বললাম।
জন বলে উঠল অসম্ভব। আমি অসম্ভব কেন জিজ্ঞাসা করলাম। জন উল্টে প্রশ্ন করল তার মার মৃত্যুতে ডাঃ বরস্টিনের কি লাভ হবে?
আমি বললাম সেটা বলা কঠিন। তবে পোয়ারোও যে এই সন্দেহটাই করছে সেটা জনকে জানালাম।
জন জিজ্ঞাসা করল পোয়ারো আমাকে একথা বলেছে কিনা। আমি জনকে সেদিনের কথা বললাম–ডাঃ বরস্টিন সেই রাতে স্টাইলসে ছিলেন শুনে পোয়ারো কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি পোয়ারো বেশ কয়েকবার বলেছিল সব কিছু বদলে গেল।
আমি জনকে মনে করাতে লাগলাম যে ইঙ্গলথর্প বলেছিলেন কফির কাপটা উনি হলঘরে রেখেছিলেন আর ঠিক সেই সময়েই ডাঃ বরস্টিন এসেছিলেন। আমি প্রশ্ন করলাম হলঘরের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় কাপে কিছু মিশিয়ে দেওয়া কি ওর পক্ষে অসম্ভব।
জন বলল ব্যাপারটা দারুণ ঝুঁকির ছিল। আমি বললাম অসম্ভব তো ছিল না।
জন জিজ্ঞাসা করল ওটা যে তার মার কফির কাপ ছিল সেটা ডাঃ বরস্টিন জানবেন কি করে? এই যুক্তিটা সে মানতে চাইল না।
আমি বললাম কথাটা ঠিক। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় বললাম ওভাবে ঘটনাটা ঘটেনি। জনকে এবার বললাম পোয়ারো আবার কোকোর কিছু অংশ রাসায়নিক বিশ্লেষণের জন্য দিয়ে এসেছে।
জন অবাক হয়ে বলল সেটা তো ডাঃ বরস্টিন পরীক্ষা করেছেন। আমি বললাম যদি বরস্টিনই হত্যা করে থাকে তাহলে আসল কোকোর পরিবর্তে অন্য কোকোর কিছু অংশ পরীক্ষা করা ওর পক্ষে কত সহজ। ওতে তাহলে আর স্ট্রিকনিন পাওয়া যাবে না। কেউ বরস্টিনকে সন্দেহ করতে পারবে না বা আবার কোকোটা পরীক্ষা করার কথাও ভাববে না। একমাত্র পোয়ারো ছাড়া।
জন বলল আরেকটা ব্যাপার ভাবার আছে, কোকো তো স্ত্রিকনিনের ঐ তেতো স্বাদটা ঢাকতে পারবে না।
আমি বললাম এই কথাটা তো আমরা ডাঃ বরস্টিনের মুখেই শুনেছি। বরস্টিন হলেন পৃথিবীর সবচেয়ে নামী বিষ বিশেষজ্ঞ। আমার ধারণা কোনো উপায়ে তিনি স্ট্রিকনিনের তেতো স্বাদটা চাপা দিয়েছেন, এমনও হতে পারে বিষটা হয়ত স্ট্রিকনিন নয়, অন্য কোনো বিষ। বিষটার নাম হয়ত কেউ শোনেনি এর উপসর্গগুলো স্ট্রিকনিনেরই মত।
জন মাথা নেড়ে বলল তা হতে পারে কিন্তু উনি কোকোটা কেমন করে পেলেন, কাপটা তো নিচে ছিল না।
আমি বললাম তা ছিল না বটে–কথাটা বলার পরেই একটা সাংঘাতিক সম্ভাবনার কথা মাথায় খেলে গেল। সেটা হল ডাঃ বরস্টিনের কোনো সহকারী নিশ্চয়ই এ বাড়িতে রয়েছে। আর সেই সহকারী যে কে হতে পারেন বিদ্যুৎ চমকের মতোই তো খেলে গেল–তিনি মেরী ক্যাভেণ্ডিস ছাড়া আর কে? কিন্তু ভেবে কূল পেলাম না অমন সুন্দরী এক মহিলা কেমন করে খুনী হতে পারেন। মনটা বড় চঞ্চল হয়ে পড়ল। মেরী ক্যাভেণ্ডিসের উজ্জ্বল মুখচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। সব কথাগুলোও একেক করে মনে পড়তে লাগল।
হঠাৎ জনের কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙলো। সে বলল আরো একটা কথা ভাবার আছে। আমি জানতে চাইলাম, জন বলল ডাঃ বরস্টিন ময়না তদন্তের কথা বলেছিলেন। উনি ওটা না করলে ডাঃ উইলকিন্স অনায়াসেই ওটাই স্বাভাবিক মৃত্যু বলে ধরে নিতেন।
আমি বললাম কথাটা সত্যি। তবে বলা যায় না, উনি হয়ত এটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে ভেবেছিলেন ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। এমনও তো হতে পারে স্বরাষ্ট্র দপ্তর শেষ পর্যন্ত যদি মৃতদেহ খুঁড়ে বের করতে চায়। তখন আর কিছুই গোেপন থাকত না। ডাঃ বরস্টিনও নিতান্তই বেকায়দায় পড়ে যেতেন। ওর মত লোক যে ভুল করে থাকতে পারে কেউই তা বিশ্বাস করতো না।
জন বলল যুক্তিটা খারাপ নয়, তবে ডাঃ বরস্টিনের উদ্দেশ্যটা কি হতে পারে তা তার বোধগম্য হচ্ছে না।
কথা বলতে বলতে জনের সঙ্গে পথ চলছিলাম। বাগানের দরজাটা পার হয়ে ঢুকতেই ডুমুর গাছটার দিকে নজর পড়ল। ওখানে চায়ের আসর বসেছে। অনেকেই সেখানে আছে।
সিনথিয়াও হাসপাতাল থেকে এসে গেছে। একটা চেয়ার টেনে ওর পাশে বসে বললাম পোয়ারো তার ডাক্তারখানাটা দেখতে চেয়েছে।
সিনথিয়া কথাটা শুনেই উচ্ছল হল, বলল নিশ্চয়ই সে পোয়ারোকে দেখাবে।
দুএক মুহূর্ত এবার চুপচাপ কাটালাম। সিনথিয়া হঠাৎ মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে লক্ষ্য করে ফিসফিস করে বলল চা খাওয়ার পর সে কয়টা কথা আমাকে বলতে চায়।
হঠাৎ জন বেশ রেগেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল। চিৎকার করে বলতে লাগল গোয়েন্দারা ঘরে ঢুকে সব জিনিষপত্র ওলটপালট করে বিশ্রী কাণ্ড করে রেখেছে। একবার জ্যাপের সঙ্গে দেখা হলে সে তার মজা দেখাবে।
মিস হাওয়ার্ডও তাকে সায় দিলেন। লরেন্সও চুপ করে রইল না। শুধু মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে দেখে মনে হলো তার এসব ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। তিনি ভাবলেশহীনভাবে চুপচাপ বসে রইলেন।
চা খাওয়ার পর সিনথিয়াকে একটু বেরিয়ে আসার জন্য ডাকলাম। দুজনে সকলের চোখের আড়ালে চলে আসতেই সিনথিয়া টুপিটা খুলে একটা গাছের তলায় বসে পড়ল। পড়ন্ত সূর্যের আলো সিনথিয়ার মুখে ছড়িয়ে পড়ল। দারুণ সুন্দর লাগল সিনথিয়াকে, আমার মনটা হঠাৎ স্বপ্নিল হয়ে পড়ল।
সিনথিয়ার কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙলো। সে বলল আমাকে নাকি তার খুব ভালো লাগে। সিনথিয়ার কথা শুনে মৃদু হাসলাম। সে আবার কথা বলল, বলল একটা ব্যাপার সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, তাই আমার পরামর্শ তার প্রয়োজন।
আমি জানতে চাইলাম, কি ব্যাপার। সিনথিয়া বলতে লাগল এমিলি ঠাকুমা বলেছিলেন তার জন্য কিছু ব্যবস্থা করে যাবেন, কিন্তু তিনি হয়ত ভুলেই গেছেন, অথবা এভাবে মারা যাবেন একথা তো তিনি জানতেন না। তাই হয়ত কিছুই করে যাননি, এখন এখানে তার থাকা উচিৎ কিনা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। সে ভাবছে চলে যাবে।
আমি বললাম এই মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়, তাছাড়া ওরাও তো তাকে ছাড়তে চাইবে না।
এক মুহূর্ত চুপ করল সিনথিয়া। হাত দিয়ে খাম ছিঁড়তে ছিঁড়তে আপন মনে বলল মিসেস ক্যাভেণ্ডিস চান যে সে এখান থেকে চলে যাক। এছাড়া আরো একজন চায়।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম সে কি জনের কথা বলছে। জন যে তাকে ভালোবাসে একথা তাকে বললাম।
সিনথিয়া বলল সে জনের কথা বলছে না, লরেন্সের কথা বলছে। তবে লরেন্স কি করল না করল তা সে তোয়াক্কা করে না। কারণ কারও কৃপার পাত্রী হতে সে চায় না।
সিনথিয়ার কথাগুলো শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি সান্ত্বনা জানিয়ে বললাম জন আর ইভিলিন যে তাকে ভালোবাসে একথাও তো তার মনে রাখা উচিৎ।
সিনথিয়া বলল একথা সে জানে। তবু মেরী আর লরেন্সের ব্যবহার সে সহ্য করতে পারে না। কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।
আমার কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গেল সিনথিয়ার কান্না দেখে। বড়ো একা মনে হল তাকে। ঝুঁকে পড়ে একটা হাত তুলে নিয়ে সিনথিয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম সে আমার হবে কিনা।
আমার কথা শুনে সিনথিয়া ওর হাত সরিয়ে নিল, কান্না থেমে গেল ওর, বলল এসব ছেলেমানুষী এখন থাক।
খুব অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলাম। তবু বললাম ছেলেমানুষী নয়, আমি সত্যি তাকে আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাই।
সিনথিয়া খিলখিল করে হেসে উঠল, বলল আমি নাকি ভারী মিষ্টি কথা বলি, সত্যি তো আমি যা বলছি তা চাই না।
আমি সিনথিয়াকে কিভাবে বিশ্বাস করাবো বুঝতে পারলাম না, তাকে আবারও কথাটা বললাম।
সিনথিয়া মিষ্টি করে হেসে আমাকে চুপ করতে বলল। একথাও বলল যে আমি যে কথাটা বলেছি সেটা নাকি আমি চাই না এবং সেও তা চায় না।
একথা বলে সে তাড়াতাড়ি গাছের আড়ালে পালিয়ে গেল, আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম, তারপর গ্রামের দিকে হাঁটতে লাগলাম।
আমার ইচ্ছা হল ডাঃ বরস্টিনকে একটু লক্ষ্য করি। একটা ছোটো কুঠুরির কাছে পৌঁছে দরজায় টোকা দিলাম, এই বাড়িতেই ডাঃ বরস্টিনের আস্তানা।
এক বুড়ি দরজা খুলল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ডাঃ বরস্টিন বাড়িতে আছেন কিনা। বুড়ি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল আমি কি কিছু শুনিনি। আমি বললাম কি শুনব। বুড়ি জানাল পুলিশ ডঃ বরস্টিনকে ধরে নিয়ে গেছে।
আমি কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। বরস্টিনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে…।
বুড়ির কথা শোনার আর কোনো আগ্রহ আমার ছিল না। যা শুনেছি তাই যথেষ্ট। এখনই পোয়ারোকে তা জানানো দরকার। কোনোদিকে না তাকিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে ছুটলাম।