ঐদিনই সন্ধ্যার দিকে পাটনা থেকে ফিরে এল সাধন মিত্র। এবং বাড়িতে পৌঁছে ব্রজদুলালের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তো একেবারে স্তম্ভিত।
কিরীটী সুখময় মল্লিককে পূর্বেই বলে রেখেছিল সাধন মিত্র ফিরলেই যেন তাকে একটা সংবাদ দেওয়া হয়।
যে পুলিস অফিসারটিকে কিরীটীর নির্দেশেই সুখময় মল্লিক গচা লেনের বাড়িতে প্রহরায় রেখে গিয়েছিলেন তাঁর কাছ থেকে ফোনে সাধন মিত্রের পৌঁছানো সংবাদ পেয়েই সুখময় কিরীটীকে সংবাদটা দেন। এবং সাধন মিত্র গচা লেনের বাড়িতে এসে পৌঁছবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কিরীটী সুখময়কে সঙ্গে নিয়ে গচা লেনের বাড়িতে এসে হাজির হল।
.
সন্ধ্যার অন্ধকার তখন চারিদিকে ঘনিয়ে এসেছে।
বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতেই ভৃত্য জীবন এগিয়ে এল।
জীবন!
আজ্ঞে?
সাধনবাবু আছেন বাড়িতে? সুখময় মল্লিকই প্রশ্ন করেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ, উপরে আছেন তাঁর ঘরে।
তাঁকে একবার খবর দাও, বল আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
বসুন, আমি খবর দিচ্ছি।
জীবন ওঁদের পারলারে বসিয়ে খবর দিতে গেল।
বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাধন মিত্র এসে পারলারে প্রবেশ করল।
সাধন মিত্রের চেহারাটা সত্যিই দেখবার মত।
বেশ পরিষ্কার গায়ের রঙ। সুন্দরই বলা চলে। মুখে কয়েকটা বসন্তের ক্ষতচিহ্ন। চক্ষু দুটি বুদ্ধিদীপ্ত। ছুরির ফলার মত যেন ধারাল চোখের দৃষ্টি।
সাধন মিত্রের দিকে তাকিয়ে সুখময় মল্লিকই প্রশ্ন করেন, সাধন মিত্র আপনার নাম?
হ্যাঁ।
বসুন।
কিরীটী একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে দেখছিল সাধন মিত্রকে, মুখের মধ্যে কোথাও কোন সেরকম বেদনা বা দুশ্চিন্তার চিহ্ন নেই।
বেশভূষাও পরিপাটি। এবং পোশাক দেখে মনে হয় বোধ হয় কোথাও বেরুচ্ছিল। পরিধানে দামী লংস, ডবল কপের শার্ট, গলায় দামী একটি আমেরিকান টাই।
সুখময় মল্লিক বসবার জন্য অনুরোধ করা সত্ত্বেও সাধন মিত্র কিন্তু বসে না। যেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমনিই থাকে।
সুখময় মল্লিক আবার বলেন, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই আপনি শুনেছেন সাধনবাবু?
হ্যাঁ। মৃদু শান্তকণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয় সাধন মিত্র।
এখানে এসেই খবরটা পেলেন বোধ হয়? সুখময় আবার জিজ্ঞাসা করেন।
হ্যাঁ, terribly shocking! তাছাড়া রেবেকা বলছিল—
কি বলছিলেন মিস মণ্ডল? কিরীটীই এবার প্রশ্নটা করে।
বলছিল, আপনাদের ধারণা নাকি ব্যাপারটা হত্যা, homicide!
হ্যাঁ। জবাব দেন সুখময় মল্লিক।
কিন্তু–
হ্যাঁ, কারণ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যদিও এখনও আমরা পাইনি—সুখময়ই কথা বলেন, তবু ব্যাপারটা যে আত্মহত্যা নয়—হত্যা, সেটাই আমাদের ধারণা।
সাধন মিত্র চোখ তুলে তাকাল সুখময়ের দিকে, হত্যাই তাহলে আপনাদের স্থির ধারণা?
হ্যাঁ।
কিন্তু হঠাৎ কে তাঁকে হত্যা করতে যাবে আর কেনই বা করবে, এটা তো আমি বুঝতে পারছি না মিঃ মল্লিক! সাধন মিত্র বলে।
Why and why অর্থাৎ কে করতে পারে আর কেন করল সেটুকু জানতে পারলে তো আমাদের যাবতীয় মুশকিল আসানই হয়ে যেত সাধনবাবু। কিন্তু আপনার কি ধারণা, ব্যাপারটা তা নয়? সুখময় মল্লিক শুধান।
To tell you frankly, আমার অন্ততঃ তা মনে হয় না। কারণ আপনারা জানেন না, কিন্তু আমি তাঁকে অনেকদিন ধরে জানতাম। তাঁর কোন শত্রু থাকতে পারে আমি বিশ্বাসই করতে পারি না। তাছাড়া–
বলুন, থামলেন কেন?
না। কিছু না। আই সিমপ্লি ডোন্ট বিলিভ ইট, রাদার আই কান্ট বিলিভ ইট, আমি বিশ্বাস করতে পারি না।
সহসা ঐ সময় কিরীটী শান্তকণ্ঠে সাধন মিত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, তাহলে কি আপনার ধারণা মিঃ মিত্র, উনি আত্মহত্যাই করেছেন?
সত্যি কথা বলতে কি, সেরকম কিছুও আমি ভাবতে পারছি না। কেনই বা আত্মহত্যা তিনি করতে যাবেন? সাধন মিত্র বলে।
কেন?
মিঃ সাহা সত্যিকারের বুদ্ধিমান, বিবেচক ও স্থিতধী লোক ছিলেন। আত্মহত্যা করবার মত টেম্পারামেন্ট কোনদিনই তাঁর ছিল না। তাছাড়া–
তাছাড়া?
তাছাড়া মান যশ অর্থ প্রতিপত্তি সবই তো বেশি পেয়েছিলেন এবং যতদূর জানি খুশিই ছিলেন। সেক্ষেত্রে হঠাৎ কেন আত্মহত্যা করতে যাবেন?
আচ্ছা মিঃ মিত্র—কিরীটীই আবার কথা বলে।
বলুন?
অফিস-সংক্রান্ত কাজেই শুনলাম আপনি মিঃ সাহাকে নাকি মাদ্রাজ থেকে আকস্মিক ভাবে ট্রাঙ্ক কল করে ডেকে এনেছিলেন?
হ্যাঁ, এনেছিলাম। পাটনার ব্রাঞ্চ অফিস সংক্রান্ত একটা জরুরী ব্যাপারে তাঁর উপস্থিতির প্রয়োজন হয়েছিল বলে তাঁকে ডেকে আনতে বাধ্য হয়েছিলাম।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো তিনি পাটনা যাননি?
না। আমাকেই পাঠিয়েছিলেন।
আচ্ছা মিঃ মিত্র, আপনি তাঁর পাসোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন এবং আপনাকে তিনি যেমন স্নেহ করতেন তেমনি বিশ্বাসও করতেন শুনেছি।
ঠিক শুনেছেন।
তাঁর জীবনের অনেক কথাই আশা করতে পারি আপনি জানেন?
কি জানতে চান বলুন স্পষ্ট করে, জানা থাকলে নিশ্চয়ই বলব।
মিঃ মিত্র?
বলুন।
তাঁর সম্পর্কে অনেক কথাই বললেন কিন্তু একটা কথা বলেননি।
কি বলিনি?
বলছিলাম তাঁর চরিত্র কেমন ছিল? বহুদিন ধরে তিনি বিপত্নীক ছিলেন শুনেছি—
সেরকম একটু-আধটু দুর্বলতা মানুষ মাত্রেরই থাকে, বিশেষ করে ঐরকম বয়েসে উইডোয়ার হলে।
তাহলে খুলেই বলি মিঃ মিত্র—কিরীটী বলে, আমি জানতে চাইছিলাম তাঁর সঙ্গে রেবেকা মণ্ডলের সম্পর্কের কথাটা।
মুহূর্তকাল সাধন মিত্র চুপ করে থাকে, তারপর মৃদু একটা হাসি তার ওষ্ঠপ্রান্তে দেখা দেয়।
কই, জবাব দিলেন না তো আমার প্রশ্নের? কিরীটী আবার বলে।
বোধ হয় একটু দুর্বলতা ছিল ঐ দিকে তাঁর।
শুধু দুর্বলতাই।
হ্যাঁ। আর কি বলব বলুন!
আর কিছু জানেন না আপনি?
দেখুন, তাঁকে আমি অত্যন্ত ভক্তি করতাম, শ্রদ্ধা করতাম। এবং আপনারা শুনেছেন কিনা জানি না, তাঁর স্নেহ ও সাহায্য না পেলে আজ আমি যা হয়েছি তা হতে পারতাম না। আর বেশী কিছু তাঁর সম্পর্কে আমার পক্ষে বলা সম্ভবপর নয়। আমাকে ক্ষমা করবেন।