০৯. পরের দিন খুব উত্তেজনার মাঝে গেল

পরের দিন খুব উত্তেজনার মাঝে গেল। আমি যখন ঝুম্পা ফারা আর বগাকে ফ্লাইং মেশিনের কথা বললাম, তারা প্রথমে আমার কথা বিশ্বাসই করতে চাইল না। তাদের ল্যাবরেটরি ঘরে ফ্লাইং মেশিনটা দেখানো হল তারপরও তারা বিশ্বাস করতে চাইল না। অনেক রকম কীরা কসম কাটার পর শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করল, তখন সবাই এক সাথে ফ্লাইং মেশিনে উঠতে চাইল।

মিঠুন, বলল “একসাথে তো সবাই উঠতে পারবে না। একজন একজন করে উঠতে হবে।”

ঝুম্পা বলল, “ঠিক আছে, একজন একজন করেই উঠি। আগে আমাকে ওঠা।”

মিঠুন মাথা চুলকে বলল, “দিনের বেলা ওঠা তো ঠিক হবে না। সবাই দেখে ফেলবে।”

ঝুম্পা বলল, “দেখে ফেললে সমস্যা কী?”

মিঠুন বলল, “এখনই জানাজানি হলে সমস্যা আছে। প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে মারা যাব।”

ঝুম্পা বলল, “ঠিক আছে তাহলে রাত্রি বেলাই চলে আসব।”

মিঠুন বলল, “তুই আসবি ঠিক আছে কিন্তু আমাকে বাসা থেকে রাত্রি বেলা বের হতে দিচ্ছে না।”

“কেন?”

“সেদিন যে ইবুর সাথে রাতে গেলাম তখন আম্মু সন্দেহ করেছে। এখন কয়দিন বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছে না।”

আমি বললাম, “রাত্রি বেলা চোরের মত ফ্লাইং মেশিনে উড়ে কোনো মজা নাই। দিনের বেলা উড়তে হবে।”

মিঠুন খানিকক্ষণ চিন্তা করল তারপর মাথা নেড়ে বলল, “ঠিকই বলেছিস। আমারা কী চুরি করেছি নাকি যে চোরের মত থাকতে হবে?”

ঝুম্পা হাতে কিল দিয়ে বলল, “চল তাহলে এখনই উড়ি।”

বগা বলল, “আমিও উড়ব।” ফারাহ বলল, “আমি কী দোষ করলাম?”

“একসাথে তো সবাইকে নেয়া যাবে না। এখন একসাথে মাত্র দুইজন উঠতে পারবে।”

আমি বললাম, “এটাকে আরো একটু বড় করে ফেল, সবাই যেন একসাথে উঠতে পারে।”

ঝুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, সবাই একসাথে উঠতে পারলে বেশি মজা হবে।”

মিঠুন বলল, “আমি একটু সময় পেলে আরেকটু বড় করতে পারি। সবার বসার জন্যে চেয়ার লাগিয়ে দিলেই হয়। ইঞ্জিনটা আরেকটু পাওয়ার ফুল করতে হবে, ভোল্টেজ কন্ট্রোলটার সার্কিটটা একটু বদলে দিতে হবে। আর ওয়েট ব্যালেন্সটা দেখতে হবে। স্ট্যাবিলিটির জন্যে একটা ফিন দেয়া যেতে পারে—” মিঠুন বিড় বিড় করে অনেকটা নিজের সাথে কথা বলতে থাকে— তার কিছুই আমরা বুঝতে পারলাম না।

যাই হোক মিঠুন তখন তখনই তার ফ্লাইং মেশিনে আরো তিন চারজন বসার মতো জায়গা করার কাজে লেগে গেল।

আমাদের মহাব্বতজান স্কুলে কে ক্লাশে আছে কে নেই সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ক্লাশে এলেও আমরা কিছু শিখি না, না এলেও আমাদের কোনো ক্ষতি হয় না। তাই যখন ক্লাশ হচ্ছে তখন মিঠুন ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে লাগল, তার সাথে আমরা দুই একজন থাকতে লাগলাম তাকে সাহায্য করার জন্য।

 

বিকেল বেলা স্কুল ছুটির পর আমরা বাসায় যাচ্ছি তখন হঠাৎ একটা গাড়ী আমাদের পাশে থেমে গেল, গাড়ীর জানালা দিয়ে মাথা বের করে একজন মানুষ একটা দামী ক্যামেরা দিয়ে ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে আবার গাড়ী চালিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি অবাক হয়ে মিঠুনের দিতে তাকিয়ে বললাম, “কী হল? আমাদের ছবি তুলল কেন?”

মিঠুন মাথা চুলকে বলল, “বুঝতে পারছি না। মনে হয় ব্ল্যাকহোলের বাচ্চার কথা জানাজানি হয়ে গেছে।”

আমি বললাম, “জানাজানি হলে ক্ষতি কী? এখন সবাইকে বলে দিলেই হয়।”

মিঠুন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “বলে দিব?”

“দিবি না কেন?”

“কিন্তু কী বলব? নিজেই তো জানি না জিনিষটা কী। এটাকে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা বলছি কিন্তু এটা কী বৈজ্ঞানিক নাম হতে পারে? বৈজ্ঞানিক নাম হতে হলে এটাকে বলা দরকার ব্ল্যাকিওন না হলে সুপার মাসিভ বোজন না হলে এনার্জী রিলিজিং পার্টিকেল–সংক্ষেপে ইআরপি—”

প্রত্যেকটা নামই আমার পছন্দ হল। আমি বললাম, “তুই ইচ্ছা করলে এর যে কোনো একটা নাম দিতে পারিস কিংবা তিনটা মিলিয়েই একটা নাম তৈরী করে ফেল।”

“তিনটা মিলিয়ে? ই আরপি সুপার মাসিভ বোজনিক ব্ল্যাকিওন?”

“হ্যাঁ, ফাটাফাটি শোনাচ্ছে নামটা।”

মিঠুনকে কেমন যেন চিন্তিত মনে হল। দুইজনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছি হঠাৎ করে বড় বড় সাইজের দুজন মানুষ আমাদের থামাল। সুন্দর চেহারা কিন্তু চুলগুলো ছোট করে ছাটা সে জন্যে কেমন জানি হাবা হাবা দেখতে। হা হাবা চেহারার একজন বলল, “এই ছেলে দাঁড়াও।”

আমাকে বলেছে না মিঠুনকে বলেছে বুঝতে পারলাম না তাই দুজনেই দাঁড়ালাম। হাবা চেহারার একজন মিঠুনকে ধরে ফেলে তার সার্ট প্যান্টে হাত বুলাতে লাগল। মিঠুন অবাক হয়ে বলল, “কী করছেন?”

“সার্চ করছি।”

“কেন সার্চ করছেন?”

“দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য আমরা যে কোনো মানুষকে সার্চ করতে পারি।”

“আমি কী আইন শৃঙ্খলা নষ্ট করেছি?”

“করতেও তো পার।” মিঠুন বলল, “আপনি এটা করতে পারেন না। আমাকে যেতে দিন।”

“বেশী কথা বলবে না। তাহলে এক কিল দিয়ে তোমার মাথাটা শরীরের ভিতর ঢুকিয়ে দিব।”

মানুষটার যা সাইজ আসলেই এক কিল দিয়ে মাথাটা শরীরের ভিতর ঢুকিয়ে দিতে পারে। তাই মিঠুন আর কথা বলল না। মানুষটা মিঠুনের জামা কাপড় পরীক্ষা করল, তার ব্যাগ খুলে ভিতরে দেখল, হাত ঢুকিয়ে নাড়া চাড়া করল। মিঠুনের ব্যাগে অনেক রকম ছোট বড় শিশি বোতল কৌটা থাকে সেগুলি খুলে খুলে দেখতে লাগল।

মিঠুন বলল, “এগুলি খুলবেন না।”

“কেন খুলব না?”

“ভিতরে আমার দরকারী জিনিষ আছে।”

“কী তোমার দরকারী জিনিষ?” বলে হাবা চেহারার মানুষটা ছোট একটা কৌটা খুলতেই ভেতর থেকে ক্রুদ্ধ শব্দ করে কিছু বোলতা বের হয়ে মানুষটাকে আক্রমণ করল। মানুষটা চিৎকার করে ঝাড়া দিয়ে হাতে এবং ঘাড়ের দুইটা বোলতা সরাতে পারলেও নাকেরটা ঝাড়তে পারল না, সেটা একটা কামড় দিয়ে দিল। হাবা চেহারার মানুষটা গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে লাফাতে থাকে এবং দেখতে দেখতে তার নাকটা টমেটোর মতো ফুলে উঠে। একটু আগে তাকে হাবার মত লাগছিল এখন কেমন জানি কাটুনের মত দেখাতে থাকে।

মানুষটা নাক চেপে ধরে চিৎকার করে বলল, “কীঁ রেঁখেছ ব্যাঁগের ভিঁতর? মাঁথা খাঁরাপ নাঁকী?”

মিঠুন বলল, “আমি আগেই না করেছি। আমার কথা শুনেন নাই।”

অন্য মানুষটা তখন মিঠুনের ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে আমার ব্যাগটা সার্চ করতে থাকে। ব্যাগে কী খুঁজল কে বলতে পারে–এর ভিতরে কী আছে কে জানে, আমি নিজেও জানি না! ব্যাগ দেখা শেষ করে আমার জামা কাপড় দেখতে থাকে। শহরের রাস্তায় প্রকাশ্য দিনের বেলায় পাহাড়ের মতন দুইজন মানুষ আমাদের মত দুইটি বাচ্চাকে এভাবে সার্চ করছে দেখে এতোক্ষণে আশেপাশে ভীড় জমে গেছে। কলেজ ইউনির্ভার্সিটি ছাত্রের মত দেখতে একজন আমাদের জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

আমি বললাম, “বুঝতে পারছি না। মনে হয় ছেলে ধরা।”

আর যায় কোথায়। সাথে সাথে আমাদের ঘিরে থাকা মানুষগুলো হই হই করে উঠল, শুনতে পেলাম, কয়েকজন চিৎকার করে বলল, “ধর শালাদের।”

বিশাল একটা হুটোপুটি লেগে যায়। মানুষগুলো চিৎকার করে বলল, “আমরা ছেলেধরা না–আমরা ইন্টেলিজেন্স এর লোক।”

কিন্তু কে শোনে কার কথা আমরা হুটোপুটির মাঝে বের হয়ে দে দৌড়।

 

এর পরের কয়েকদিন আমরা টের পেলাম আমাদের নিয়ে বিশেষ করে মিঠুনকে নিয়ে কিছু একটা ঘটছে। যখনই আমরা বের হই তখনই মনে হয় আমাদের পিছু পিছু কেউ হাঁটছে। হঠাৎ করে গাড়ি পাশে দাঁড়িয়ে যায়আমরা তখন ছুটে পালাই, গাড়ীর ভেতর থেকে ঘঁাচ ঘঁাচ করে ছবি তুলে নেয়। ব্ল্যাকহোলের বাচ্চার জন্যেই এসব ঘটছে, কাজেই আমাদের প্রথম কাজ হল সেটাকে ভালো করে লুকিয়ে রাখা। ফ্লাইং মেশিনের ভেতর থেকে আসল ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাটা সরিয়ে আমরা সেখানে ফাঁকা একটা শিশি রেখে দিলাম। আসলটা লুকিয়ে রাখলাম ল্যাবরেটরির কংকালটার খুলির ভিতরে।

মিঠুন খুব খাটাখাটুনি করে শেষ পর্যন্ত ফ্লাইং মেশিনটাকে দাড়া করাল। দুজনের জায়গায় এখন ছয়জন যেতে পারবে। সেজন্যে ইঞ্জিনটার পরিবর্তন করল, পাখাগুলো পরিবর্তন করল, পিছনে প্লেনের লেজের মত একটা লেজ লাগালো। তারপর একদিন আমাদের বলল, “আমি রেডি। আমরা এখন ছয়জন যেতে পারব।”

স্কুল ছুটির পর আমরা রয়ে গেলাম। স্কুলের স্যার, ম্যাডামরা ছুটির আগেই চলে যায়, ছাত্র-ছাত্রীরা যায় একটু পরে। তারা চলে যাবার পর পুরো স্কুল ফাঁকা হয়ে গেল। তখন আমি, মিঠুন, ঝুম্পা বগা আর যারা দোতালায় উঠে গেলাম। মিঠুনের ফ্লাইং মেশিনটা ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে এলাম, মিঠুন পুরোটা ভাল করে দেখল, এখানে সেখানে ধাক্কা দিল, টানাটানি করল, আঁকুনি দিল, টেপাটেপি করল। তারপর কংকালের করোটির ভেতর থেকে ব্লাকহোলের বাচ্চা ভরা শিশিটা নিয়ে ফ্লাইং মেশিনে লাগিয়ে দিল।

তারপর আমরা ফ্লাইং মেশিনে উঠলাম, দুইটি করে সিট, প্রথমে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে মিঠুনের পাশে আমি বসতে চেয়েছিলাম কিন্তু ঝুম্পা জোর করে আমার জায়গায় বসে গেল। মাঝখানে বসল বগা আর ফারা। পিছনে আমি একা।

মিঠুন বলল, “সবাই সিট বেল্ট বেঁধে নে।”

আমার সিট বেল্ট বেঁধে নিলাম।

“তোরা কেউ ভয় পাবি না–এটা কাপতে পারে, দুলতে পারে উপর নিচ করতে পারে কিন্তু কখনোই নিচে পড়ে যাবে না।”

আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম “ঠিক আছে।”

“সিট থেকে বেশি নাড়াচাড়া করবি না–সেন্টার অফ গ্রাভিটি অনেক গবেষণা করে ঠিক জায়গায় রাখা হয়েছে–নাড়াচাড়া করলে সেটার উনিশ বিশ হতে পারে–তখন ফ্লাইটেরও উনিশ বিশ হতে পারে।”

মিঠুনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বুঝতে পারলাম না–সিটে বেশি নাড়াচাড়া করার বিষয়টা খালি বুঝতে পারলাম। সেটার জন্যই জোরে জোরে মাথা নাড়লাম।

“তাহলে শুরু করছি” বলে মিঠুন কন্ট্রোল প্যানেলের একটা সুইচ টিপে ধরল, সাথে সাথে ফ্লাইং মেশিন থরথর করে কাঁপতে থাকে। ফারা ভয় পেয়ে বলল, “কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?”

মিঠুন বলল, “ভয়ের কিছু নাই। চুপ করে বসে থাক।”

“ভেঙ্গে পড়ে যাবে না তো?”

“না ভাঙবে না। সবাই শক্ত হয়ে বসে থাক আমরা টেক অফ করছি।”

মিঠুন একটা হ্যান্ডেল নিজের দিকে টেলে নিল। সাথে সাথে ফ্লাইং মেশিনের নিচ দিয়ে আগুনের একটা হালকা বের হতে থাকে আর ফ্লাইং মেশিনটা পিছনের দিকে কাত হয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। আমরা সবাই একই সাথে ভয় আর আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। দেখতে দেখতে ফ্লাইং মেশিনটা স্কুলের ছাদ পার হয়ে গাছগুলো পার হয়ে উপরে উঠে যায়।

আমরা সবাই আবার ভয় আর আনন্দের শব্দ করে উঠলাম। মিঠুন আরেকটা হ্যান্ডেল টেনে ধরতেই ফ্লাইং মেশিনটা কাত হয়ে ঘুরে যেতে শুরু করে, আমাদের মুখে বাতাসের ঝাপটা লাগতে থাকে আর ফ্লাইং মেশিনটা ঘুরে যেতে শুরু করে। আমরা নিচের দিকে তাকালাম, স্কুলটাকে ঠিক চেনা যায় না দোকান পাট, রাস্তা, রাস্তায় গাড়ী ট্রাক টেম্পাে সবকিছুকে কেমন যেন খেলনার মত মনে হতে থাকে।

মিঠুন চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগছে?”

ঝুম্পা বলল, “ফাটাফাটি।”

ফারা জিজ্ঞেস করল, “পড়ে যাব না তো?”

“না, পড়বি না।”

ঝুম্পা বলল, “আরো উপরে নিয়ে যা–অনেক উপরে।”

বগা ভয়ে ভয়ে বলল, “কোনো সমস্যা হবে না তো?”

ঝুম্পা বলল, “হলে হবে। নিয়ে যা উপরে।”

মিঠুন তখন ফ্লাইং মেশিনটাকে আরো উপরে নিয়ে যায় সেখান থেকে নিচের পৃথিবীটাকে কেমন যেন অবাস্তব মনে হতে থাকে।

মিঠুন ফ্লাইং মেশিনটাকে ওপরে এক জায়গায় থামিয়ে দিয়ে বলল, “এখানে পার্ক করলাম।”

বগা বলল, “পার্ক করলি?”

“হ্যাঁ। এখানে চুপচাপ ভেসে থাকব।”

আমি বললাম, “মোটেও চুপচাপ ভেসে নাই। তোর ইঞ্জিনটা শো শো করে শব্দ করছে।”

মিঠুন বলল, “আমি ইচ্ছে করলে ইঞ্জিনটা বন্ধ করে শব্দও বন্ধ করে দিতে পারি। তবে”।

“তবে কী?

“তাহলে এই ফ্লাইং মেশিন মারবেলের মতন টুপ করে নিচে পড়ে যাবে।”

ঝুম্পা হি হি করে হাসল বলল, “থাক বাবা তোর ইঞ্জিন বন্ধ করার কোনো দরকার নাই। আমি এর মাঝে বসে বসেই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পারব।”

আমরা সবাই তখন চারিদিকে তাকালাম, বাতাসে ভাসতে ভাসতে আমরা অনেকদূর সরে এসেছি। নিচে একটা সরু নদী দেখা যাচ্ছে, রোদ পড়ে সেটা চিক চিক করছে। নদীটার ওপার একটা নৌকা— কী আশ্চর্য সেই দৃশ্য। নদীর দুই তীরে সবুজ ধানক্ষেত, ধানক্ষেত যে এতো সবুজ হতে পারে আমি আগে কখনো দেখিনি।

মিঠুন বলল, “আমার মনে হয় এখন আমরা ব্ল্যাকহোলের বাচ্চার কথা সবাইকে বলে দিই।”

ঝুম্পা থাবা দিয়ে বলল, “অবশ্যই বলে দিব।”

বগা বলল, “একটা সাংবাদিক সম্মেলন করতে হবে। সেখানে মিঠুন একটা লিখিত বক্তব্য দেবে। তারপর প্রশ্ন এবং উত্তর।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সাংবাদিকেরা যদি না আসে?”

ঝুম্পা আরেকবার ফ্লাইং মেশিনের গায়ে থাবা দিয়ে বলল, “আসবে না মানে? একশবার আসবে। সাংবাদিকদের বাবারা আসবে। এই রকম ফ্লাইং মেশিন তারা বাপের জন্মে দেখেছে?”

আমি বললাম, “ইন্টেলিজেন্সের লোকজন আমাদের পিছনে লেগে গেছে, সাংবাদিকদের বলে সবাইকে জানিয়ে দিলে ওরা আর কিছু করতে পারবে না।”

মিঠুন মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু সাংবাদিকদের কী বলব?”

বগা বলল, “কিছু বলতে হবে না, ফ্লাইং মেশিনটা চালিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে আসবি। সব সাংবাদিকেরা অধৈর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আমরা আকাশ থেকে নেমে আসলাম। চিন্তা করতে পারিস কী মজা হবে?”

ফারা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমরা? আমরা সবাই?”

মিঠুন বলল, “হ্যাঁ। আমি একা একা যাব নাকি? আমার কী মাথা খারাপ হয়েছে?”

ফারা জিজ্ঞেস করল, “আমরা গেলে আমাদেরকেও কী প্রশ্ন করবে?”

আমি বললাম, “করতেও পারে।”

ফারা বলল, “সর্বনাশ! আমি যে কিছুই জানি না।”

“না জানার কী আছে?” আমি বললাম, “বলবি পৃথিবীর মানুষ মাত্র শতকরা চার ভাগ পদার্থের কথা জানে। যে ছিয়ানব্বই ভাগের কথা জানে না–এটা হচ্ছে সেই ছিয়ানব্বই ভাগের ব্ল্যাকহোল।” আমি মিঠুনের দিকে তাকিয়ে বললাম, “ঠিক বলেছি না রে মিঠুন?”

মিঠুন বলল, “ঠিক বলেছিস।” ফারা বলল, “এইটুকু বললেই হবে?”

মিঠুন বলল, “আরেকটু বলতে পারিস। বলবি এই ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাকে ইলেকট্রিক ফিল্ডের মাঝে রাখলে তার ভরটা শক্তিতে পাল্টে যায়।”

আমি বললাম, “আইনস্টাইনের ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়ার হিসাবে, তাই না মিঠুন?”

মিঠুন বলল, “ঠিক বলেছিস। এটাই হচ্ছে ব্ল্যাকহোলের বাচ্চার আসল গুরুত্ব। পৃথিবীর এনার্জি ক্রাইসিস মিটিয়ে দিতে পারবে।”

আমি বললাম, “এই তো হয়ে গেল। সাংবাদিক সম্মেলনে আর কিছু বলার দরকার নাই। তখন তাদেরকে খালি ফ্লাইং মেশিনটা দেখাতে হবেদেখলেই সবাই ট্যারা হয়ে যাবে।”

ঝুম্পা বলল, “ইবুর কথা ঠিক। সবাই ট্যারা হয়ে যাবে। ভুবন ট্যারা।”

মিঠুন বলল, “খালি একটা সমস্যা।”

বগা জিজ্ঞেস করল, “কী সমস্যা?”

“আমরা তো এইটাকে বলছি ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা। সেইটাতো বৈজ্ঞানিক নাম হল না। একটা বৈজ্ঞানিক নাম দিতে হবে। সেইটা কী হতে পারে?”.

আমি নামটা বলার চেষ্টা করার আগেই ঝুম্পা বলল, “কেন? এইটার নাম হবে মিঠুনিয়াম।”

মিঠুন চমকে উঠে বলল, “মিঠুনিয়াম?”

“হ্যাঁ। এটা তুই আবিষ্কার করেছিস তাই এটা হতে হবে তোর নামে মিনিয়াম।”

আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ ঠিকই বলেছে। এটার নাম হবে মিনিয়াম।”

মিঠুন দুলে দুলে হাসল, বলল, “তোদের কারো মাথার ঠিক নাই।”

“কেন?”

“নিজের নাম ব্যবহার করে আবার নাম দেয়া যায় নাকী?”

বগা হাতে কিল দিয়ে বলল, “একশবার দেয়া যায়। আমাদের স্কুলের নাম কী মহব্বত জানের নামে হয় নাই?”

আমরা বললাম, “হয়েছে হয়েছে।“

মিঠুন শুনতেই রাজী হল না, বলল, “হলে হয়েছে, আমার বেলা হবে না। আমি কিছুতেই এটার নাম মিঠুনিয়াম দিব না।”

ফারা বলল, “তোরা শুধু শুধু তর্ক করছিস। আমার কী মনে হয় জানিস?”

“কী?”

“ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা খুব সুন্দর একটা নাম। এটার নাম থাকুক ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা।”

মিঠুন প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল হঠাৎ করে সে থেমে গিয়ে বলল, “সর্বনাশ!

“কী হয়েছে?”

“ঐ দেখ।”

মিঠুন হাত দিয়ে দূরে দেখাল, আমরা সবাই দেখলাম, অনেক দূরে একটা হেলিকপ্টার, সেটা আমাদের দিকে আসছে।

বগা বলল, “আমাদের ধরতে আসছে।”

ফারা জিজ্ঞেস করল, “আমাদেরকে কেন ধরতে আসবে? আমরা কী করেছি?”

আমি বললাম, “আমাদেরকে ধরতে আসছে না, এটা আসছে আমদের ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা কেড়ে নিতে।”

ফারা বলল, “সর্বনাশ!”

বগা বলল, “এখন কী করব?”

আমি বললাম, “পালা।” মিঠুন জিজ্ঞেস করল, “কোথায় পালাব?”

ঝুম্পা এদিক সেদিক তাকাল তারপর দূরে সাদা মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল, “চল ঐ মেঘের ভিতরে লুকিয়ে যাই।”

“মেঘের ভিতরে?”

“হ্যাঁ।”

মিঠুনের মনে হল আইডিয়াটা পছন্দ হল। সে একটা হ্যান্ডেল টেনে ধরতেই ফ্লাইং মেশিন থরথর করে কেঁপে উঠে তারপর কাত হয়ে ঘুরে সেটা মেঘের দিকে ছুটে যেতে থাকে। আমরা পিছন ফিরে দেখলাম হেলিকপ্টারটা খুব জোরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে আমরা এখন হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেতে শুরু করেছি। মনে হচ্ছে এটা সোজাসুজি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

মিঠুন ফ্লাইং মেশিনটার বেগ বাড়াতে থাকে, আমাদের মুখে বাতাসের তীব্র ঝাপটা এসে লাগল, আমরা প্রচণ্ড বেগে মেঘের দিকে ছুটে যেতে লাগলাম। কিন্তু হেলিকপ্টারটা আমাদেরকে প্রায় ধরে ফেলছে। আমরা হেলিকপ্টারের পাইলট, তার পাশে বসে থাকা একজন মিলিটারী ধরণের মানুষকে দেখতে পেলাম। পেছনে আরো কিছু মানুষ আছে, সবাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

মিঠুন হ্যান্ডেলটা টেনে রাখল আর হেলিকপ্টারটা যখন আমাদের খুব কাছে চলে এল তখন আমরা মেঘের ভেতর ঢুকে গেলাম। মেঘটা কী রকম হয় সেটা নিয়ে সব সময় আমার একটা কৌতূহল ছিল, মেঘের ভিতর ঢুকে পড়ার পর বুঝতে পারলাম এটা আসলে খুব ঘন কুয়াশার মত। আমরা ঘন কুয়াশার মত মেঘের ভিতরে সত্যি সত্যি লুকিয়ে যেতে পারলাম আর হেলিকপ্টারটা তখন থেমে গেল। এটা মেঘের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল উপরে উঠল নিচে নামল আমাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করল কিন্তু আমাদের খুঁজে পেল না, আমরা ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রইলাম।

বেশ কিছুক্ষণ পর হেলিকপ্টারটা চলে গেল তখন আমরা খুব সাবধানে মেঘ থেকে বের হয়ে এলাম। এদিক সেদিক তাকিয়ে আমরা তখন আমাদের স্কুলে ফিরে যেতে থাকি।

প্রথম দিন আমি আর মিঠুন যেভাবে হারিয়ে গিয়েছিলাম আজকেও আমাদের সেই একই অবস্থা হল, আমরা আবার হারিয়ে গেলাম। তবে আজকে আমাদের অবস্থা প্রথম দিনের মত তত খারাপ হল না। প্রথমত আজকে এখনো দিনের আলো আছে, নিচে দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত আজকে ছয়জন মানুষ থাকায় কোনদিকে যেতে হবে সেটা সবাই মিলে বের করে ফেলা যাচ্ছিল।

শেষ পর্যন্ত যখন স্কুলটা পাওয়া গেল তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। পরের দিন সাংবাদিক সম্মেলন করে সাংবাদিকদের ফ্লাইং মেশিনটা দেখার ঠিক করে আমরা স্কুলের ছাদে নেমে এলাম।

ঠিক যখন ফ্লাইং মেশিনটা ছাদে নেমেছে, মিঠুন সুইচ অফ করে ইঞ্জিনটা বন্ধ করেছে তখন হঠাৎ চারপাশ থেকে কালো পোষাক পরা ডজন খানেক মানুষ হাতে ভয়ংকর ভয়ংকর অস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। তারা আমাদের মুখ চেপে ধরে রাখল যেন আমরা চিৎকার করতে না পারি। আমাদেরকে টেনে হেঁচড়ে তারা নিচে নিয়ে বড় একটা গাড়িতে ঢুকিয়ে দেয়। কিছু বোঝার আগে ভিতরের মানুষগুলো আমাদের হাত পা বেঁধে মুখে টেপ লাগিয়ে দেয়।।

আমরা হুটোপুটি করে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করলাম, খুব একটা লাভ হল না। অবাক হয়ে দেখলাম উজন খানেক মানুষ আমাদের ফ্লাইং মেশিনটা ধরাধরি করে নামাচ্ছে। আমাদের গাড়ির পিছনে আরেকটা মিলিটারী ট্রাক, ফ্লাইং মেশিনটাকে সেখানে তুলে ফেলা হল। তারপর আমাদের গাড়িটি আর পিছু পিছু ট্রাকটা চলতে শুরু করে, আমাদের কোথায় নিচ্ছে আমরা সেটা বোঝার চেষ্টা করলাম কিন্তু খুব একটা লাভ হল না কারণ গাড়ি চলতে শুরু করতেই তারা আমাদের চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দিল।

আমি বুঝতে পারলাম আমরা ভয়ংকর একটা বিপদের মাঝে পড়েছি।