০৯. পত্রাবলী ৪৫৫-৪৬৪

৪৫৫

[ভগিনী নিবেদিতাকে লিখিত]

লস্ এঞ্জেলেস্, ক্যালিফোর্নিয়া
২৪ জানুআরী, ১৯০০

প্রিয়—,
যে শান্তি ও বিশ্রাম আমি খুঁজছি, তা আসবে বলে তো মনে হচ্ছে না। তবে মহামায়া আমাকে দিয়ে অপরের—অন্ততঃ আমার স্বদেশের—কথঞ্ছিৎ কল্যাণ করাচ্ছেন; আর এই উৎসর্গের ভাব-অবলম্বনে নিজ অদৃষ্টের সঙ্গে একটা আপস করাও অপেক্ষাকৃত সহজ। আমরা সকলেই নিজের নিজের ভাবে উৎসর্গীকৃত। মহাপূজা চলছে; একটা বিরাট বলি ভিন্ন অন্য কোন প্রকারে এর অর্থ পাওয়া যায় না। যারা স্বেচ্ছায় মাথা পেতে দেয়, তারা অনেক যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি পায়। আর যারা বাধা দেয়, তাদের জোর করে দাবানো হয়, এবং তাদের দুর্ভোগ হয় বেশী। আমি এখন স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করতে বদ্ধপরিকর। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৪৫৬*

[মিসেস লেগেটকে লিখিত]

C/o Miss Meade
477 Douglas Building
লস্ এঞ্জেলেস্, ক্যালিফোর্নিয়া
১৫ ফেব্রুআরী ১৯০০

প্রিয় নিবেদিতা,
তোমার—তারিখের পত্র আজ প্যাসাডেনায় আমার নিকট পৌঁছিল। দেখছি, জো তোমায় চিকাগোতে ধরতে পারেনি; তবে নিউ ইয়র্ক থেকে তাদের এ-পর্যন্ত কোন খবর পাইনি। ইংলণ্ড থেকে একরাশ ইংরেজী খবরের কাগজ পেলাম—খামের উপর লেখা এক লাইনে আমার প্রতি শুভেচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে ও সই রয়েছে ‘F. H. M’। অবশ্য সেগুলির মধ্যে দরকারী বিশেষ কিছু ছিল না। আমি মিস মূলারকে একখানা চিঠি লিখতাম; কিন্তু আমি তো ঠিকানা জানি না। আবার ভয় হল, চিঠি লিখলে তিনি পাছে ভয় পান!

আমি মিসেস সেভিয়ারের কাছে খবর পেলাম যে, নিরঞ্জন কলিকাতায় সাঙ্ঘাতিক রকমের পীড়িত হয়ে পড়েছে—জানি না, তার দেহত্যাগ হয়েছে কিনা। যাই হোক নিবেদিতা, আমি এখন খুব শক্ত হয়েছি—আগের চেয়ে আমার দৃঢ়তা খুব বেড়েছে—আমার হৃদয়টা যেন লোহার পাত দিয়ে বাঁধান হয়ে গেছে। আমি এখন সন্ন্যাস-জীবনের অনেকটা কাছাকাছি যাচ্ছি।

আমি দু-সপ্তাহ যাবৎ সারদানন্দের কাছ থেকে কোন খবর পাইনি। তুমি গল্পগুলি পেয়েছ জেনে খুশী হলাম। ভাল বিবেচনা কর তো তুমি নিজে ওগুলি আবার নতুন করে লেখ। কোন প্রকাশককে যদি পাও, তাকে দিয়ে ওগুলি ছাপিয়ে প্রকাশ করে দাও; আর যদি বিক্রী করে কিছু লাভ হয়, তোমার কাজের জন্য নাও। আমার নিজের দরকার নেই। আমি এখানে কিছু অর্থ পেয়েছি। আসছে সপ্তাহে সান ফ্রান্সিস্কোয় যাচ্ছি; সেখানে সুবিধা করতে পারব—আশা করি।

ভয় কর না—তোমার বিদ্যালয়ের জন্য টাকা আসবে, আসতেই হবে। আর যদি না আসে, তাতেই বা কি আসে যায়? মা জানেন, কোন্ রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবেন। তিনি যে-দিক্‌ দিযে নিয়ে যান, সব রাস্তাই সমান। জানি না, আমি শীঘ্র পূর্ব অঞ্চলে১৬ যাচ্ছি কিনা। যদি যাবার সুযোগ হয়, তবে ইণ্ডিয়ানায় নিশ্চিত যাব।

এই আন্তর্জাতিক মেলামেশার মতলবটা খুব ভাল—যে রকমে পার, ওতে যোগ দাও; আর যদি তুমি মাঝ থেকে কতকগুলি ভারতীয় নারী-সমিতিকে এতে যোগ দেওয়াতে পার, তবে আরও ভাল হয়।

কুছ পরোয়া নেই, আমাদের সব সুবিধা হয়ে যাবে। এই লড়াইটা যেমন শেষ হবে, অমনি আমরা ইংলণ্ডে যাব ও সেখানে খুব চুটিয়ে কাজ করবার চেষ্টা করব—কি বল? ধীরামাতাকে লিখব কি? যদি তাঁকে লেখা ভাল মনে কর, তাঁর ঠিকানা আমায় পাঠাবে। তিনি কি তারপর তোমায় পত্রাদি লিখেছেন?

ধৈর্য্য ধরে থাক, শক্ত ও নরম—সবই ঠিক ঘুরে আসবে। এই যে তোমার নানা রকম অভিজ্ঞতা লাভ হচ্ছে, এইটুকুই আমি চাই। আমারও শিক্ষা হচ্ছে। যে মুহূর্তে আমরা উপযুক্ত হব, তখনই আমাদের কাছে টাকা উড়ে আসবে। এখন আমার স্নায়ুপ্রধান ধাত ও তোমার ভাবুকতা মিলে সব গোল হয়ে যেতে পারে। সেই কারণে ‘মা’ আমার স্নায়ুগুলিকে একটু একটু করে নীরোগ করে দিচ্ছেন, আর তোমারও ভাবুকতা শান্ত করে আনছেন। তারপর আমরা—যাচ্ছি আর কি। এইবার রাশি রাশি ভাল কাজ হবে, নিশ্চিত জেনো। এইবার আমরা প্রাচীন দেশ—ইওরোপের মূল ভিত্তি পর্যন্ত তোলপাড় করে ফেলব।

আমি ক্রমশঃ ধীর স্থির, শান্তপ্রকৃতি হয়ে আসছি—যাই ঘটুক না কেন, আমি প্রস্তুত।এইবার যে কাজে লাগা যাবে, প্রত্যেক আঘাতে বেশ কাজ হবে—একটিও বৃথা যাবে না— এই হচ্ছে আমার জীবনের আগামী অধ্যায়। আমার ভালবাসাদি জানবে। ইতি

বিবেকানন্দ

পুনঃ—তোমার বর্তমান ঠিকানা লিখবে। ইতি

বি—

৪৫৭*

[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]

লস্ এঞ্জেলেস্
১৫ ফেব্রুআরী, ১৯০০

প্রিয় ধীরামাতা,
এই চিঠি আপনার হাতে পৌঁছবার আগেই আমি সান ফ্রান্সিস্কো যাত্রা করব। কাজটার সম্বন্ধে আপনার সবই জানা আছে। বেশী কাজ করিনি, কিন্তু দিন-দিনই আমার হৃদয়—(দেহ ও মন দু-দিক্‌ দিয়ে) আরও বেশী সবল হচ্ছে। কোন কোন দিন আমার বোধ হয় যে, আমি সবই সহ্য করতে পারি এবং সব দুঃখই বরণ করতে পারি। মিস মূলার যে কাগজের তাড়া পাঠিয়েছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। তাঁর ঠিকানা না জানায় আমি তাঁকে কিছুই লিখিনি। তাছাড়া ভয়ও ছিল।

আমি একা থাকলেই অধিকতর ভাল কাজ করতে পারি; এবং যখন সম্পূর্ণ নিঃসহায় থাকি, তখনই আমার দেহ মন সবচেয়ে ভাল থাকে। আমি যখন আমার গুরুভাইদের ছেড়ে আট বৎসর একাকী ছিলাম, তখন প্রায় এক দিনের জন্যও অসুস্থ হইনি। এখন আবার একা থাকার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি! অবাক কাণ্ড! কিন্তু মা যেন আমায় ঐভাবে রাখতে চান—জো যেমন চায় ‘নিঃসঙ্গ গণ্ডারে’র মত একাকী বেড়াতে। … বেচারা তুরীয়ানন্দ কতই না ভুগেছে, অথচ আমায় কিছুই জানায়নি—সে বড় সরলচিত্ত ও ভালমানুষ! মিসেস সেভিয়ারের পত্রে জানলাম, বেচারা নিরঞ্জনানন্দ কলিকাতায় এতই সাঙ্ঘাতিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে যে, সে এখনও বেঁচে আছে কিনা জানি না। ভাল কথা! সুখ-দুঃখ হাত ধরাধরি করে চলতেই ভালবাসে। এ বড় অদ্ভুত ব্যাপার! তারা যেন চক্রাকারে চলে! আমার বোনের একখানি পত্রে জানলাম যে, তার পালিত কন্যাটি মারা গেছে। ভারতের ভাগ্যে যেন একমাত্র দুঃখই আছে। তাই হোক! সুখ-দুঃখে আমি যেন বোধশূন্য হয়ে গেছি! হালে আমি যেন লোহার মত হয়ে গেছি! তাই হোক—মায়ের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক!

গত দু-বৎসর যাবৎ যে দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে আসছি, তাতে আমি বড়ই লজ্জিত। এর সমাপ্তিতে আমি খুশী। ইতি

আপনার চিরস্নেহবদ্ধ সন্তান
বিবেকানন্দ

৪৫৮*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

প্যাসাডেনা
২০ ফেব্রুআরী, ১৯০০

প্রিয় মেরী,
মিঃ হেলের দেহত্যাগের বেদনাদায়ক সংবাদ বহন করে তোমার চিঠিখানা গতকাল পৌঁছেছে। আমি মর্মাহত হয়েছি, সন্ন্যাসের শিক্ষা সত্ত্বেও আমার হৃদয়বৃদ্ধি এখনও বেঁচে আছে। তারপর যে-সব মহাপ্রাণ মানুষ আমি দেখেছি, মিঃ হেল তাঁদের একজন।

অবশ্যই তুমি দুঃখিত ও নিতান্ত ব্যথিত; মাদার চার্চ, হ্যারিয়েট—সবারই সেই এক অবস্থা, বিশেষতঃ এই ধরনের শোক তোমাদের কাছে যখন এই প্রথম। জীবনে আমি অনেক সয়েছি, অনেককে হারিয়েছি, আর সেই বিয়োগের সবচেয়ে বিচিত্র যন্ত্রণা হল—আমার মনে হয়েছে, যে চলে গেল আমি তার যোগ্য ছিলাম না। পিতার মৃত্যুর পর মাসের পর মাস এই যাতনায় কেটেছে—আমি তাঁর কতই না অবাধ্য ছিলাম!

তুমি খুবই কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলে; যদি তোমার ঐ ধরনের কিছু মনে হয়, তাহলে জেনো সেটা শোকেরই একটি রূপ।

মেরী, মনে হয়, ঠিক এখন থেকেই তোমার যথার্থ জীবন শুরু। যতই আমরা বই পড়ি বা বক্তৃতা শুনি, বা লম্বা লম্বা কথা বলি, শেষ পর্যন্ত অভিজ্ঞতাই একমাত্র শিক্ষক, সেই শুধু চোখ ফোটায়। অভিজ্ঞতা যে ভাবে হয়, সেই ভাবেই তা সবচেয়ে ভাল। আমরা শিখি হাসির আলোয়, শিখি চোখের জলে। জানি না কেন এমন হয়, কিন্তু তা যে হয়, তা দেখতেই পাই। সেটাই যথেষ্ট। মাদার চার্চের জন্য অবশ্য ধর্মের সান্ত্বনা আছে। আমরা সকলে যদি স্বপ্নে ডুবে থাকতে পারতাম!

জীবনে এতদিন পর্যন্ত তুমি নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছ, আর আমাকে জ্বলতে কাঁদতে হয়েছে সারাক্ষণ। এখন ক্ষণকালের জন্য তুমি জীবনের অপর দিকটা দেখতে পেলে। এ ধরনের অবিরাম আঘাতে আঘাতে আমার জীবন তৈরী হয়েছে, এর চেয়েও শতগুণ ভয়ঙ্কর আঘাত—দারিদ্র্যের বিশ্বাসঘাতকতার আর আমার নিজের নির্বুদ্ধিতার যন্ত্রণা। এটা নৈরাশ্যবাদ? এখন তুমি বুঝবে, কেমন করে তা আসে। ঠিক, ঠিক, তোমাকে আর কি বলব মেরী, কথা তো সবই তোমার জানা। শুধু একটি কথা বলি এবং তার মধ্যে এতটুকু ভেজাল নেই, যদি আমাদের দুঃখ বিনিময় করা সম্ভব হত, এবং তোমাকে দেবার মত আনন্দ-ভরা মন যদি আমার থাকত, তাহলে নিশ্চয় বলছি, চিরদিনের জন্য তোমার সঙ্গে তা বিনিময় করে নিতাম। সে-কথা মা-ই জানেন।

তোমার চিরবিশ্বস্ত ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

৪৫৯*

[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]

ওঁ তৎ সৎ

ক্যালিফোর্নিয়া
২১ ফেব্রুআরী, ১৯০০

কল্যাণবরেষু,
তোমাদর পত্রে সমস্ত সমাচার অবগত হয়ে বিশেষ আনন্দ লাভ করলুম। বিদ্যাবুদ্ধি বাড়ার ভাগ—উপরের চাকচিক্য মাত্র; সমস্ত শক্তির ভিত্তি হচ্ছে হৃদয়। ‘জ্ঞানবলক্রিয়া’শালী আত্মার অধিবাস হৃদয়ে, মস্তিষ্কে নয়। ‘শতঞ্চৈকা চ হৃদয়স্য নাড্যঃ’ (হৃদয়ে একশত এবং একটি নাড়ী আছে) ইত্যাদি। হৃদয়ের নিকট ‘সিম্প্যাথেটিক্ গ্যাংলিয়ন’ নামক যে প্রধান কেন্দ্র, সেথায় আত্মার কেল্লা। হৃদয় যতই দেখাতে পারবে, ততই জয়। মস্তিষ্কের ভাষা কেউ কেউ বোঝে, হৃদয়ের ভাষা আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত সকলে বোঝে। তবে আমাদের দেশে, মড়াকে চেতানো—দেরী হবে; কিন্তু অপার অধ্যবসায় ও ধৈর্যবল যদি থাকে তো নিশ্চিত সিদ্ধি, তার আর কি?

ইংরেজ রাজপুরুষদের দোষ কি? যে পরিবারটির অস্বাভাবিক নির্দয়তার কথা লিখেছ, ওটা কি ভারতবর্ষের অসাধারণ, না সাধারণ? দেশসুদ্ধই ঐ রকম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আমাদের দেশী স্বার্থপরতা, নেহাত দুষ্টামি করে হয়নি, বহু শতাব্দী যাবৎ বিফলতা আর নির্যাতনের ফলস্বরূপ এই পশুবৎ স্বার্থপরতা; ও আসল স্বার্থপরতা নয়—ও হচ্ছে গভীর নৈরাশ্য। একটু সিদ্ধি দেখলেই ওটা সেরে যাবে। ইংরেজ রাজপুরুষেরা ঐটিই দেখছে চারিদিকে, কাজেই প্রথমে বিশ্বাস করতে পারবে কেন? তবে যথার্থ কাজ দেখতে পেলে কেমন ওরা সহানুভূতি করে বল! দেশী রাজপুরুষেরা অমন করে কি?

এই ঘোর দুর্ভিক্ষ, বন্যা, রোগ-মহামারীর দিনে কংগ্রেসওয়ালারা কে কোথায় বল? খালি ‘আমাদের হাতে রাজ্যশাসনের ভার দাও’ বললে কি চলে? কে বা শুনছে ওদের কথা? মানুষ কাজ যদি করে—তাকে কি আর মুখ ফুটে বলতে হয়? তোমাদের মত যদি ২০০০ লোক জেলায় জেলায় কাজ করে—ইংরেজরা ডেকে রাজকার্যে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করবে যে!! ‘স্বকার্যমুদ্ধরেৎ প্রাজ্ঞঃ’ (প্রাজ্ঞ ব্যক্তি নিজের কার্য উদ্ধার করিবেন)। … অ-কে Centre (কেন্দ্র) খুলতে দেননি, তার বা কি? কিষণগড় দিয়েছে তো? মুখটি বুজিয়ে সে কাজ দেখিয়ে যাক—কিছু বলা-কওয়া, ঝগড়া-ঝাঁটির দরকার নাই। মহামায়ার এ কাজে যে সহায়তা করবে, সে তাঁর দয়া পাবে, যে বাধা দেবে ‘অকারণাবিষ্কৃতবৈরদারুণঃ’ (বিনা হেতুতে দারুণ শত্রুতাবদ্ধ) নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবে।

‘শনৈঃ পন্থাঃ’ ইত্যাদি, রাই কুড়িয়ে বেল।—যখন প্রধান কাজ হয়ে, ভিত্তি-স্থাপন হয়, রাস্তা তৈরী হয়, যখন অমানুষ বলের আবশ্যক হয়—তখন নিঃশব্দে দু-একজন অসাধারণ পুরুষ নানা বিঘ্ন-বিপত্তির মধ্যে নিঃসাড়ে কাজ করে। যখন হাজার হাজার লোকের উপকার হয়, ঢাক-ঢোল বেজে ওঠে, দেশসুদ্ধ বাহবা দেয়—তখন কল চলে গেছে, তখন বালকেও কাজ করতে পারে, আহাম্মকেও কলে একটু বেগ দিতে পারে। এইটি বোঝ—ঐ দু-একটি গাঁয়ের উপর ঐ ২০ টি অনাথ বালক সহিত অনাথাশ্রম, ঐ ১০ জন ২০ জন কার্যকরী—এই যথেষ্ট, এই বজ্রবীজ। ঐ থেকে কালে লক্ষ লক্ষ লোকের উপকার হবে; এখন ২/১০টা সিংহের প্রয়োজন—তখন শত শত শৃগালেরাও উত্তম কাজ করতে পারবে।

অনাথ মেয়ে হাতে পড়লে তাদের আগে নিতে হবে। নইলে ক্রিশ্চানরা সেগুলিকে নিয়ে যাবে। এখন বিশেষ বন্দোবস্ত নাই তার আর কি? মায়ের ইচ্ছায় বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। ঘোড়া হলেই চাবুক আপনি আসবে। এখন মেয়ে (ও) ছেলে একসঙ্গেই রাখ। একটা ঝি রেখে দাও মেয়েগুলিকে দেখবে, আলাদা কাছে নিয়ে শোবে; তারপর আপনিই বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। যা পাবে টেনে নেবে এখন বাছবিচার কর না—পরে আপনিই সিধে হয়ে যাবে। সকল কাজেই প্রথমে অনেক বাধা—পরে সোজা রাস্তা হয়ে যায়।

তোমার সাহেবকে আমার বহু ধন্যবাদ দিও। নির্ভয়ে কাজ করে যাও—ওয়াহ্ বাহাদুর!! সাবাস, সাবাস, সাবাস!!

ভাগলপুরে যে কেন্দ্র স্থাপনের কথা লিখেছ, সে কথা বেশ—স্কুলের ছেলেপুলেকে চেতানো ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের mission (কার্য) হচ্ছে অনাথ, দরিদ্র, মূর্খ, চাষাভূষোর জন্য; আগে তাদের জন্য করে যদি সময় থাকে তো ভদ্রলোকের জন্য। ঐ চাষাভূষোরা ভালবাসা দেখে ভিজবে; পরে তারই দু-এক পয়সা সংগ্রহ করে নিজেদের গ্রামে মিশন start (প্রতিষ্ঠা) করবে এবং ক্রমে ওদেরই মধ্য হতে শিক্ষক বেরুবে।

কতলগুলো চাষার ছেলেমেয়েকে একটু লিখতে-পড়তে শেখাও ও অনেকগুলো ভাব মাথায় ঢুকিয়ে দাও—তারপর গ্রামের চাষারা চাঁদা করে তাদের এক-একটাকে নিজেদের গ্রামে রাখবে। ‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং’ (নিজেই নিজেকে উদ্ধার করবে)—সকল বিষয়েই এই সত্য। We help them to help themselves (তারা যাতে নিজেই নিজেদের কাজ করতে পারে, এইজন্য আমরা তাদের সাহায্য করছি)। ঐ যে চাষারা গাল দিচ্ছে—ঐটুকু হচ্ছে আসল কাজ। ওরা যখন বুঝতে পারবে নিজেদের অবস্থা, উপকার এবং উন্নতির আবশ্যকতা, তখনই তোমার ঠিক কাজ হচ্ছে জানবে। তাছাড়া পয়সাওয়ালারা দয়া করে গরীবের কিছু উপকার করবে—তা চিরন্তন হয় না এবং তায় আখেরে উভয় পক্ষের অপকার মাত্র। চাষাভূষো মৃতপ্রায়; এজন্য পয়সাওয়ালারা সাহায্য করে তাদের চেতিয়ে দিক্‌—এই মাত্র! তারপর চাষারা আপনার কল্যাণ আপনারা বুঝুক, দেখুক এবং করুক। তবে ধনী-দরিদ্রের বিবাদ যেন বাধিয়ে বসো না। ধনীদের আদতে গাল-মন্দ দেবে না।—স্বকার্যমুদ্ধরেৎ প্রাজ্ঞঃ (প্রাজ্ঞ ব্যক্তি নিজের কার্য উদ্ধার করবে)। তাছাড়া ওরা তো মহামূর্খ, অজ্ঞ—ওরা কি করবে?

জয় গুরু জয় জগদম্বে, ভয় কি? ক্ষেত্রকর্মবিধান আপনা হতেই আসবে! ফলাফল আমার গ্রাহ্য নাই, তোমরা যদি এতটুকু কাজ কর, তা হইলেই আমি সুখী। বাক্যি-যাতনা, শাস্ত্র-ফাস্ত্র, মতামত—আমার এ বুড়ো বয়সে বিষবৎ হয়ে যাচ্ছে। যে কাজ করবে, সে আমার মাথার মণি—ইতি নিশ্চতম্। মিছে বকাবকি চেঁচামেচিতে সময় যাচ্ছে—আয়ুক্ষয় হচ্ছে, লোকহিত একপা-ও এগোচ্ছে না। মাভৈঃ, সাবাস বাহাদুর—গুরুদেব তোমার হৃদয়ে বসুন, জগদম্বা হাতে বসুন। ইতি

বিবেকানন্দ

৪৬০*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

১২৫১ পাইন ষ্ট্রীট, সান ফ্রান্সিস্কো
২ মার্চ, ১৯০০

প্রিয় মেরী,
আমাকে চিকাগোয় যাবার নিমন্ত্রণ জানিয়ে লিখেছ, সেটা তোমার একান্ত সহৃদয়তা। এই মুহূর্তেই যদি আমি সেখানে চলে যেতে পারতাম! কিন্তু আমি এখন টাকা যোগাড় করতে ব্যস্ত; তবে বেশী কিছু করে উঠতে পারছি না। হ্যাঁ, যে কোন উপায়েই হোক; দেশে যাওয়ার খরচটা তোলার মত টাকা আমায় করতেই হবে। এখানে একটা নূতন ক্ষেত্র পেয়েছি—শত শত উৎসুক শ্রোতা আসছে, আমার বই পড়ে এরা আগে থেকেই প্রস্তুত ও উদ‍্গ্রীব ছিল।

অবশ্য টাকা যোগাড় করার ব্যাপারটা যেমন মন্থর, তেমনই বিরক্তিকর। কয়েক-শো যোগাড় করতে পারলেই আমি খুশী হব। এর মধ্যে নিশ্চই আমার আগের চিঠিখানা পেয়ে গিয়েছ। মাসখানেক কি মাস-দেড়েকর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে যাব, আশা করছি।

তোমরা সকলে কেমন আছ? মাকে আমার আন্তরিক ভালবাসা দিও। তাঁর মত মনোবল যদি আমার থাকত! খাঁটি খ্রীষ্টান তিনি। আমার স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু পূর্বের বল এখনও ফিরে পাইনি। কিন্তু এতটুকু শক্তির জন্য অনেকখানি পরিশ্রম করতে হবে। অনন্ত কয়েকটা দিনের জন্যও যদি বিশ্রাম ও শান্তি পেতাম! নিশ্চয় চিকাগোয় ভগিনীদের কাছে তা পাব। তবে মা-ই সব জানেন, আমার সেই পুরানো কথা—তিনি ভাল জানেন। গত দু-বছর বিশেষ খারাপ গেছে। মনের দুঃখে বাস করেছি। এখন কিছুটা আবরণ সরে গেছে, এখন আমি সুদিনের—আর ভাল অবস্থার আশায় আছি। তুমি, অন্য ভগিনীরা এবং মা—সকলের উপর সর্ববিধ আশীর্বাদ। আমার ঘাত-প্রতিঘাতময় বেসুরো জীবনে মেরী, তুমি সব সময় মধুরতম সুরের মত বেজেছ। তোমার বিশেষ সুকৃতি, তুমি অনুকূল পরিবেশের মধ্যে জীবন শুরু করতে পেরেছ। আর আমি মুহূর্তের জন্যও শান্তিময় জীবন পাইনি। সব সময়ে দুর্বহ ভার মনের মধ্যে। প্রভু তোমাকে আশীর্বাদ করুন।

সতত তোমার স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

৪৬১*

সান ফ্রান্সিস্কো
১৫০২ জোন‍্স্ ষ্ট্রীট
৪ মার্চ, ১৯০০

প্রিয় ধীরামাতা,
এক মাস যাবৎ আপনার কাছ থেকে কোনই খবর পাইনি। আমি সান ফ্রান্সিস্কোতে আছি। আমার লেখার ভেতর দিয়ে লোকের মন আগে থেকেই তৈরী হয়েছিল, আর তারা দলে দলে আসছে; কিন্তু টাকা খসাবার কথা যখন উঠবে, তখন এই উৎসাহের কতটা থাকে, সেইটুকু দ্রষ্টব্য!

রেভারেণ্ড বেঞ্জামিন ফে মি‍ল‍্স্ আমায় ওকল্যাণ্ডে আহ্বান করেছিলেন এবং আমার বক্তব্য প্রচারের জন্য একটি শ্রোতৃমণ্ডলীর আয়োজন করেছিলেন। তিনি সস্ত্রীক আমার গ্রন্থাদি পাঠ করে থাকেন এবং বরাবরই আমার খবরাখবর রেখে আসছেন।

মিস থার্সবির দেওয়া পরিচয়পত্রখানি আমি মিসেস হার্স্টকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি তাঁর এক সঙ্গীতবাসরে আমাকে আগামী রবিবারে নিমন্ত্রণ করেছেন।

মিস থার্সবির দেওয়া পরিচয়পত্রখানি আমি মিসেস হার্স্টকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি তাঁর এক সঙ্গীতবাসরে আমাকে আগামী রবিবারে নিমন্ত্রণ করেছেন।

আমার স্বাস্থ্য প্রায় একরূপই আছে—আমি তো কোন ইতরবিশেষ দেখছি না। সম্ভবতঃ স্বাস্থ্যের উন্নতিই হচ্ছে—যদিও অজ্ঞাতসারে। আমি ৩০০০ শ্রোতাকে শোনাবার মত উঁচু গলায় বক্তৃতা দিতে পারি; ওকল্যাণ্ডে আমায় দুবার তাই করতে হয়েছিল। আর দু-ঘণ্টা বক্তৃতার পরেও আমার সুনিদ্রা হয়।

খবর পেলাম, নিবেদিতা আপনার সঙ্গে আছে। আপনি ফ্রান্সে যাচ্ছেন কবে? আমি এপ্রিলে এ জায়গা ছেড়ে পূর্বাঞ্চলে যাচ্ছি। সম্ভব হলে মে মাসে ইংলণ্ডে যাবার বিশেষ ইচ্ছা আছে। আর একবার ইংলণ্ডে চেষ্টা না করে দেশে ফেরা চলবে না কিছুতেই।

ব্রহ্মানন্দ ও সারদানন্দের কাছ থেকে সুন্দর একখানি চিঠি এসেছে। তারা সবাই ভাল আছে। তারা মিউনিসিপ্যালিটিকে বোঝাবার চেষ্টা করছে। এতে আমি খুব খুশী। এ মায়ার সংসারে হিংসা করা ঠিক নয়; কিন্তু ‘না কামড়ালেও ফোঁস করতে দোষ নেই’—এই যথেষ্ট।

সব ঠিক হয়ে আসবে নিশ্চয়—আর যদিই বা না হয়, তাও ভাল। মিসেস সুটারের কাছ থেকেও সুন্দর একখানি চিঠি পেয়েছি। তাঁরা পাহাড়ে বেশ আছেন। মিসেস—কেমন আছেন? … তুরীয়ানন্দ কেমন আছে?

আমার অসীম ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানবেন। ইতি

সতত আপনার
বিবেকানন্দ

৪৬২*

সান ফ্রান্সিস্কো
৪ মার্চ, ১৯০০

কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
আমি আর কাজ করতে চাই না—এখন বিশ্রাম ও শান্তি চাই। স্থান ও কালের তত্ত্ব আমার জানা আছে, কিন্তু আমার বিধিলিপি বা কর্মফল আমায় নিয়ে চলেছে—শুধু কাজ, কাজ! আমরা যেন গরুর পালের মত কসাইখানার দিকে চালিত হচ্ছে; কসাইখানা অভিমুখে তাড়িত গরু যেমন পথের ধারের ঘাস এক এক খাবলা খেয়ে নেয়, আমাদের অবস্থাও ঠিক সেই রকম। আর এই হচ্ছে আমাদের কর্ম বা আমাদের ভয়—ভয়ই হচ্ছে দুঃখ ব্যাধি প্রভৃতির আকর। বিভ্রান্ত ও ভয়চকিত হয়ে আমরা অপরের ক্ষতি করি। আঘাত করতে ভয় পেয়ে আমরা আরও বেশী আঘাত করি। পাপকে এড়িয়ে চলতে একান্ত আগ্রহান্বিত হয়ে আমরা পাপেরই মুখে পড়ি।

আমাদের চারপাশে কত অকেজো আবর্জনা-স্তূপই না আমরা সৃষ্টি করি! এতে আমাদের কোন উপকারই হয় না; পরন্তু যাকে আমরা পরিহার করতে চাই তারই দিকে—সেই দুঃখেরই দিকে আমরা পরিচালিত হই।

আহা! যদি একেবারে নির্ভীক সাহসী ও বেপরোয়া হতে পারা যেত!

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৪৬৩*

১৫০২ জোন্স্ ষ্ট্রীট
সান ফ্রান্সিস্কো
৭ মার্চ, ১৯০০

প্রিয় জো,
মিসেস বুলের পত্রে জানলাম যে, তুমি কেম্ব্রিজে আছ। হেলেনের পত্রে আরও খবর পেলাম যে, তোমায় যে গল্পগুলি পাঠানো হয়েছিল, তা তুমি পাওনি। বড়ই আপসোসের কথা। মার্গর কাছে এর নকল আছে, সে তোমায় দিতে পারে। আমার শরীর একরকম চলে যাচ্ছে। টাকা নেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম অথচ ফল শূন্য! লস্ এঞ্জেলেসের চেয়েও খারাপ! কিছু না দিতে হলে তারা দল বেঁধে বক্তৃতা শুনতে আসে—আর কিছু খরচ করতে হলে আসে না; এই তো ব্যাপার!

দিন কয়েক যাবৎ আমার শরীর খারাপ হয়েছে এবং বড় বিশ্রী বোধ হচ্ছে। আমার বোধ হয়, রোজ রাত্রে বক্তৃতা দেবার ফলেই এ-রকম হয়েছে। আমার আশা আছে যে, ওকল্যাণ্ডের কাজের ফলে অন্ততঃ নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত ফিরে যাবার টাকা সংগ্রহ করতে পারব; আর নিউ ইয়র্কে গিয়ে ভারতে ফেরবার টাকার যোগাড় দেখব। লণ্ডনে মাস কয়েক থাকবার মত টাকা এখানে সংগ্রহ করতে পারলে লণ্ডনেও যেতে পারি। তুমি আমায় আমাদের জেনারেল-এর ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিও তো। নামও দেখছি আজকাল মনে থাকে না।

তবে আসি। প্যারিসে তোমার সঙ্গে দেখা হতেও পারে, নাও পারে। ভগবান্‌ তোমায় আশীর্বাদ করুন। আমি যতটা সাহায্যের যোগ্য, তুমি তার চেয়েও বেশী সাহায্য আমায় করেছ। আমার অসীম ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানবে। ইতি

বিবেকানন্দ

৪৬৪*

১৫০২ জোন্স ষ্ট্রীট
সান ফ্রান্সিস্কো
৭ মার্চ, ১৯০০

প্রিয় ধীরামাতা,
… আপনাকে আমি আমার জন্য আর কিছু করতে বলছি না—আমার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি যা করেছেন, তাই যথেষ্ট—আমি যতটার উপযুক্ত, তার চেয়েও ঢের বেশী করেছেন। আপনিই আমার একমাত্র বন্ধু, যিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে জীবনের ধ্রুবতারারূপে গ্রহণ করেছেন; আপনাকে আমি যে এত বিশ্বাস করি, তার রহস্য ওইখানেই। অন্যেরা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ভালবাসে। কিন্তু তাদের ধারণাও নেই যে, তারা আমাকে শ্রীরামকৃষ্ণেরই জন্য ভালবাসে। তাঁকে বাদ দিলে আমি শুধু কতকগুলি অর্থহীন ও স্বার্থপূর্ণ ভাবুকতার বোঝা মাত্র। যাই হোক, ভবিষ্যতে কি হবে, এই দুশ্চিন্তা এবং ভবিষ্যতে কি হওয়া উচিত, এই আকাঙ্ক্ষার পীড়া বড়ই ভয়ানক। আমি সে দায়িত্বের অনুপযুক্ত—আমার অযোগ্যতা আজ ধরা পরে গেছে। আমাকে একাজ ছেড়ে দিতে হবে। এ কাজে যদি কোন নিজস্ব জীবনী শক্তি না থাকে তো মরে যাক; আর যদি থাকে, তবে আমার মত অযোগ্য কর্মীর জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হবে না। … আমি সারা জীবন মায়ের কাজ করেছি। এখন তা হয়ে গেছে—আমি এখন তাঁর চরকায় তেল দিতে নারাজ। তিনি অন্য কর্মী বেছে নিন—আমি ইস্তফা দিলাম!

আপনার চিরসন্তান
বিবেকানন্দ