১৯৫*
19 W. 38th St., নিউ ইয়র্ক
২২ জুন, ১৮৯৫
প্রিয় কিডি,
তোমাকে এক লাইন না লিখে একখানা গোটা চিঠি লিখছি।
তুমি দিন দিন উন্নতি করছ জেনে খুব সুখী হলাম। তুমি যে ভাবছ, আমি আর ভারতে ফিরব না, এটা তোমার ভুল ধারণা। আমি শীঘ্রই ভারতে ফিরব, তবে কোন বিষয়ে ব্যর্থ হয়ে ছেড়ে দেওয়া আমার স্বভাব নয়। এখানে আমি একটি বীজ পুঁতেছি, শীঘ্রই সেটি বৃক্ষে পরিণত হবে—হবেই হবে। তবে আমার আশঙ্কা, যদি আমি তাড়াহুড়ো করে যত্ন নেওয়া বন্ধ করি, গাছটির বাড়ের ক্ষতি হবে। তোমাদের কাগজটা বার করে ফেল। তোমাদের সঙ্গে আমার এখানকার লোকদের যোগাযোগ করে দিয়ে আমি ভারতে যাচ্ছি আর কি।
বৎস, কাজ করে যাও, রোম একদিনে নির্মিত হয়নি। আমি প্রভুর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি। সুতরাং শেষে সব ভালই দাঁড়াবে। চিরদিনের জন্য আমার ভালবাসা জানবে।
তোমার
বিবেকানন্দ
১৯৬*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.
২৬ জুন, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
ভারতীয় পত্রগুলির (mail) জন্য ধন্যবাদ। এবার অনেক সু-খবর এল। অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের ‘আত্মার অমরত্ব’ শীর্ষক প্রবন্ধগুলি মাদার চার্চকে পাঠিয়েছি। আশা করি, এখন সেগুলি পড়ে তুমি আনন্দ পাচ্ছ। বেদান্তের কোন অংশই বৃদ্ধ উপেক্ষা করেননি। সাবাস তাঁর নির্ভীক কৃতিত্ব! ঔষধগুলি এসে পৌঁছেছে শুনে সমধিক সুখী হলাম। শুল্ক কিছু লাগল নাকি? যদি লেগে থাকে, আমি দিয়ে দেব; আপত্তি করো না। খেতড়িরাজের প্রেরিত শাল, কিংখাব আর ছোটখাট কয়েক রকম সুন্দর জিনিসের একটা বড় প্যাকেট আসছে। এগুলি বন্ধুদের উপহার দিতে চাই। তবে এসে পৌঁছতে এখনও অন্ততঃ মাস-কয়েক লাগবে
ভারতের চিঠিগুলোতে দেখবে, আমাকে দেশে ফিরে যাবার জন্য বারংবার অনুরোধ করছে। ওরা অস্থির হয়ে পড়েছে। ইওরোপে যদি যাই তো নিউ ইয়র্ক অঞ্চলের মিঃ ফ্রান্সিস লেগেটের অতিথি হয়ে যাব। তিনি ছয় সপ্তাহ ধরে জার্মানী, ফ্রান্স, ইংলণ্ড ও সুইজরলণ্ডের সর্বত্র ঘুরবেন। ওখান থেকে ভারতে ফিরব। চাই কি এখানেও ফিরতে পারি। এদেশে যে বীজ বপন করলাম, তার পরিণতি কামনা করি। এইবারের শীতে চমৎকার কাজ হয়েছে নিউ ইয়র্কে। সহসা ভারতে চলে গেলে সব পণ্ড হয়ে যেতে পারে। তাই যাওয়া সম্বন্ধে এখনও মন করিনি।
সহস্রদ্বীপোদ্যানে লক্ষ্য করার মত তেমন কিছু ঘটেনি। দৃশ্য রমণীয় বটে। কয়েকজন বন্ধু রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে ঈশ্বর ও আত্মা সম্বন্ধে ইচ্ছামত প্রসঙ্গ হয়। ফল দুধ প্রভৃতি আহার করি, আর বেদান্তবিষয়ক প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সংস্কৃত গ্রন্থ পড়ি, এগুলি ওরা ভারত থেকে অনুগ্রহ করে পাঠিয়েছে।
চিকাগোয় যদি ফিরি তো ছয় সপ্তাহের পূর্বে নয়, চাই কি আরও দেরী হতে পারে। বেবী যেন আমার জন্য তার ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন না করে। ফিরে যাবার আগে যে-কোন উপায়ে তোমাদের সকলের সঙ্গে দেখা করব—নিশ্চয় জেনো।
মান্দ্রাজ-অভিনন্দনের উত্তর পড়ে তুমি খুবই বিচলিত হয়েছিলে; সেখানে কিন্তু তার খুব ফল হয়েছে। সেদিন মান্দ্রাজ ‘খ্রীষ্টান কলেজে’র অধ্যক্ষ (President) মিঃ মিলার তাঁর এক ভাষণে আমার চিন্তাগুলি অনেকাংশে সন্নিবিষ্ট করে বলেছেন যে, ঈশ্বর ও মানুষ সম্বন্ধে ভারতের তত্ত্বগুলি প্রতীচ্যের খুব উপযোগী, আর যুবকদের সেখানে (পাশ্চাত্যে) গিয়ে প্রচারকার্যে ব্রতী হতে আহ্বান করেছেন। এতে ধর্মযাজক মহলে বেশ ক্রোধের সঞ্চার হয়েছে। ‘এরেনা’ পত্রে প্রকাশিত যে প্রবন্ধের কথা তুমি লিখেছ, আমি তার কিছুই দেখিনি। নিউ ইয়র্কের মহিলারা আমার সম্পর্কে কোনরূপ হইচই করেননি। তোমার বন্ধুটির বিবরণ কল্পনাপ্রসূত। প্রভুত্ব করা তাদের স্বভাব নয়। আশা করি, ফাদার পোপ ও মাদার চার্চ ইওরোপে যাচ্ছেন। দেশভ্রমণ জীবনে খুবই আনন্দদায়ক। আমাকে এক জায়গায় বেশী দিন আটকে রাখলে সম্ভবতঃ মারা পড়ব। পরিব্রাজক-জীবনের তুলনা হয় না।
চতুর্দিকে অন্ধকার যতই ঘনিয়ে আসে, উদ্দেশ্য ততই নিকটবর্তী হয়, ততই জীবনের প্রকৃত অর্থ—জীবন যে স্বপ্ন, তা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে; কেন যে মানুষ এটা বুঝতে পারে না তাও বোঝা যায়। সে যে একান্ত অর্থহীনের মধ্যে অর্থসঙ্গতি খুঁজতে চেষ্টা করেছিল! স্বপ্নের মধ্যে বাস্তবের সন্ধান শিশুসুলভ উদ্যম বৈ আর কি! ‘সবই ক্ষণিক, সবই পরিবর্তনশীল’—এইটুকু নিশ্চয় জেনে জ্ঞানী ব্যক্তি সুখদুঃখ ত্যাগ করে জগদ্বৈচিত্র্যের সাক্ষিমাত্ররূপে অবস্থান করেন, কোন কিছুতে আসক্ত হন না।
‘যাঁদের চিত্ত সাম্যে প্রতিষ্ঠিত, তাঁরা ইহজীবনেই জন্মমৃত্যুর বন্ধন অতিক্রম করেছেন। ভগবান্ নির্দোষ ও সমদর্শী এবং সকলের প্রতি সমবুদ্ধি; সুতরাং তাঁরা ভগবানেই অবস্থিত।’৭৪ বাসনা, অজ্ঞান ও ভেদদৃষ্টি—এই তিনটিই বন্ধন। জীবনে অনাসক্তি, জ্ঞান ও সমদর্শিতা—এই তিনটি মুক্তি। মুক্তিই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের লক্ষ্য।
না আসক্তি, না বিদ্বেষ; না সুখ, না দুঃখ; না মৃত্যু, না জীবন; না ধর্ম, না অধর্ম; নেতি, নেতি নেতি।
চিরতরে তোমার
বিবেকানন্দ
১৯৭*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.
প্রিয় ভগিনী,
ভারতীয় পত্রাদির জন্য বহু ধন্যবাদ। ভাষার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে অক্ষম। মাদার চার্চকে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার-লিখিত ‘অমরত্ব’ নামক যে প্রবন্ধটি পাঠাই, সেটি পড়ে দেখে থাকবে—তাঁর মতে, ইহজীবনে যারা আমাদের প্রীতিভাজন, অতীত জন্মেও তারা নিশ্চয় তেমনি ছিল। তাই মনে হয়, কোন পূর্বজন্মে আমি এই ভক্ত পরিবারেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। ভারত থেকে কয়েকখানি বই আসবার কথা, হয়তো এসে গেছে। যদি এসে থাকে, তবে অনুগ্রহ করে এখানে পাঠিয়ে দিও। ডাকমাশুল বাবদ যদি কিছু দেয় থাকে, সংবাদ পাবামাত্র পাঠাব, জানবে। কম্বলগুলির জন্য শুল্কের কথা তুমি তো কিছু লেখনি। খেতড়ি থেকে আর একটি বড় প্যাকেট আসবে—কার্পেট, শাল, কিংখাব ও অন্যান্য ছোট ছোট জিনিষের। বোম্বাইয়ে আমেরিকান কনসালের মারফৎ শুল্ক ওখানেই দিয়ে দেওয়া সম্ভব হলে ওখানেই দিয়ে দিতে লিখেছি। নয়তো আমাকেই এখানে দিতে হবে। মনে হয় মাসকয়েকের পূর্বে আসছে না। বইগুলির জন্য উদ্গ্রীব রইলাম। এলেই অনুগ্রহ করে পাঠিয়ে দিও।
মাকে, ফাদার পোপ ও ভগিনীদের সকলকে আমার ভালবাসা। এ স্থানটি বড় ভাল লাগছে। আহার যৎসামান্য, অধ্যয়ন আলোচনা ধ্যানাদি কিন্তু খুব চলছে। অপূর্ব এক শান্তির আবেগে প্রাণ ভরে উঠছে। প্রতিদিনই মনে হচ্ছে—আমার করণীয় কিছু নেই। আমি সর্বদাই পরম শান্তিতে আছি। কাজ তিনিই করছেন। আমরা যন্ত্রমাত্র। তাঁর নাম ধন্য! কাম, কাঞ্চন ও প্রতিষ্ঠারূপ ত্রিবিধ বন্ধন যেন আমা থেকে সাময়িক ভাবে খসে পড়েছে। ভারতে মধ্যে মধ্যে আমার যেমন উপলব্ধি হত, এখানেও আবার তেমনি হচ্ছে—‘আমার ভেদবুদ্ধি, ভালমন্দ বোধ, ভ্রম ও অজ্ঞান বিলুপ্ত হয়েছে, আমি গুণাতীত রাজ্যে বিচরণ করছি। কোন্ বিধিবিশেষ মানব? কোন্টাই বা লঙ্ঘন করব?’ সে উচ্চ ভাবভূমি থেকে মনে হয়, সারা বিশ্ব যেন একটা ডোবা। হরিঃ ওঁ তৎ সৎ; একমাত্র তিনিই আছেন আর কিছু নাই। আমি তোমাতে, তুমি আমাতে। হে প্রভো! তুমি আমার চির আশ্রয় হও। শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। সতত প্রীতিশুভেচ্ছাযুক্ত—
তোমাদের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
১৯৮*
আমেরিকা
১ জুলাই, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তোমাদের প্রেরিত মিশনরীদের বইখানা ও রামনাদের রাজার ফটো পেলাম। রাজা ও মহীশূরের দেওয়ান—দুজনকেই পত্র লিখেছি। রমাবাঈয়ের দলের লোকদের সঙ্গে ডাঃ জেনসের বাদ-প্রতিবাদ থেকে বেশ বোধ হয়, মিশনরীদের পুস্তিকাখানা এখানে বহুদিন পূর্বে পৌঁছেছে। ঐ পুস্তিকাতে একটা অসত্য কথা আছে। আমি এদেশে খুব বড় হোটেলে কখনও খাইনি, আর কোনরূপ হোটেলেও খুব কমই গেছি। বাল্টিমোরে ছোট হোটেলওয়ালারা অজ্ঞ—তারা নিগ্রো ভেবে কোন কালা আদমিকে স্থান দেয় না। সেইজন্য ডাঃ ভ্রূম্যান্কে—আমি যাঁর অতিথি ছিলাম—ঐখানে একটা বড় হোটেলে নিয়ে যেতে হয়েছিল; কারণ তারা নিগ্রো ও বিদেশীদের মধ্যে প্রভেদ জানে।
আলাসিঙ্গা, তোমায় বলছি শোন, তোমাদের নিজেদেরই আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে। তোমরা কচি খোকার মত ব্যবহার করছ কেন? যদি কেউ তোমাদের ধর্মকে আক্রমণ করে, তোমরা নিজেরাই তার সমর্থন করতে এবং আক্রমণকারীকে মুখের উপর জবাব দিতে পার না কেন? আমার সম্বন্ধে বলছি, তোমাদের ভয় পাবার দরকার নেই। এখানে আমার শত্রুর চেয়ে মিত্রের সংখ্যা বেশী। আর এদেশের অধিবাসীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মাত্র খ্রীষ্টান; আর শিক্ষিতদের ভেতর খুব অল্পসংখ্যক লোকই মিশনরীদের গ্রাহ্যের মধ্যে আনে। মিশনরীরা কোন কিছুর বিরুদ্ধে লাগলে শিক্ষিতেরা আবার সে বিষয়টি পছন্দ করে। এখন মিশনরীদের শক্তি এখানে অনেক কমে গেছে এবং দিন দিন আরও কমে যাচ্ছে। তারা হিন্দুধর্মকে আক্রমণ করলে যদি তোমাদের কষ্ট হয়, তবে তোমরা অভিমানী ছেলের মত ঠোঁট ফুলিয়ে আমার কাছে কাঁদুনি গাইতে কেন আস? তোমরা কি লিখতে পার না এবং তাদের ধর্মের দোষ দেখিয়ে দিতে পার না? কাপুরুষতা তো আর ধর্ম নয়!
এখানে ইতোমধ্যেই ভদ্রসমাজের ভেতর একদল লোক আমার ভাব নিয়েছে। আগামী বৎসর তাদের এমনভাবে সঙ্ঘবদ্ধ করব, যাতে তারা কার্যক্ষম হতে পারে; তখন কাজটা চলতে থাকবে। তারপর আমি ভারতে চলে গেলেও এখানে এমন অনেক বন্ধু আছে, যারা এখানকার কাজের পৃষ্ঠপোষক হবে এবং ভারতেও আমায় সাহায্য করবে। সুতরাং তোমাদের ভয় পাবার দরকার নেই। তবে তোমরা যতদিন মিশনরীদের আক্রমণে কেবল চীৎকার করবে এবং কিছু করতে না পেরে লাফিয়ে বেড়াবে, ততদিন আমি তোমাদের দিকে চেয়ে হাসব। তোমরা ছেলেদের হাতের ছোট ছোট পুতুলের মত, তা ছাড়া আর কি? ‘স্বামীজী, মিশনরীরা আমাদের কামড়াচ্ছে—উঃ জলে মলুম! উঃ-উঃ।’ স্বামীজী আর বুড়ো খোকাদের জন্য কি করতে পারে?
বৎস! আমি বুঝছি, আমাকে গিয়ে তোমাদের মানুষ তৈরী করতে হবে। আমি জানি, ভারতে কেবল নারী ও ক্লীবের বাস। সুতরাং বিরক্ত হয়ো না। ভারতে কাজ করার জন্য উপায় উদ্ভাবন আমাকেই করতে হবে। কতকগুলো মস্তিষ্কহীন ক্লীবের হাতে গিয়ে আমি পড়ছি না।
তোমাদের উদ্বিগ্ন হবার দরকার নেই, তোমরা যতটুকু পার করে যাও, তা যত অল্পই হোক না কেন, একলাই আগাগোড়া সব করে যেতে হবে। কলিকাতার লোকদের এত সঙ্কীর্ণভাব! আর তোমরা মান্দ্রাজীরা কুকুরের ডাকে মূর্ছা যাও! ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ।’—দুর্বল কখনও এই আত্মাকে লাভ করতে পারে না। আমার জন্য তোমাদের ভয় পাবার দরকার নেই, প্রভু আমার সঙ্গে রয়েছেন। তোমরা কেবল আত্মরক্ষা করে যাও; আমাকে দেখাও যে, তোমরা ঐটুকু করতে পার, তা হলেই আমি সন্তুষ্ট। কে আমার সম্বন্ধে কি বলছে, তাই নিয়ে আর আমাকে বিরক্ত করো না। আমার সম্বন্ধে কোন আহাম্মকের সমালোচনা শোনবার জন্য আমি বসে নেই। তোমরা শিশু, [জেনে রাখ] কেবল প্রভূত ধৈর্য, অসীম সাহস ও মহতী চেষ্টা দ্বারাই শ্রেষ্ঠ ফল লাভ হয়ে থাকে। আমার ভয় হচ্ছে, কিডির মন মাঝে মাঝে যেমন ডিগবাজি খায়, সেইরকম ডিগবাজি খাচ্ছে। কোণ থেকে বেরিয়ে এসে কলম ধরুক না। ‘স্বামী, স্বামী’ বলে না চেঁচিয়ে ঐ দুষ্টুদের বিরুদ্ধে কি মান্দ্রাজীরা এখন যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে না, যাতে তারা ‘ত্রাহি ত্রাহি’ চীৎকার করতে থাকে?
তোমরা ভয় পাচ্ছ কিসে? সাহসী লোকেরাই কেবল বড় বড় কাজ করতে পারে—কাপুরুষেরা পারে না। হে অবিশ্বাসিগণ, চিরকালের জন্য জেনে রাখ যে, প্রভু আমায় হাত ধরে নিয়ে চলেছেন। যতদিন আমি পবিত্র থাকব, তাঁর দাস হয়ে থাকব, ততদিন কেউ আমার একটি কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না।
তোমাদের কাগজখানা বার করে ফেল। যে-কোন রকমে হোক, আমি খুব শীঘ্র তোমাদের আরও টাকা পাঠাচ্ছি এবং মাঝে মাঝে টাকা পাঠাতে থাকব। তোমরা কাজ করে চল। দেশবাসীর জন্য কিছু কর—তাহলে তারাও তোমাদের সাহায্য করবে, সমগ্র জাতি তোমার পিছনে থাকবে। সাহসী হও, সাহসী হও! মানুষ একবারই মরে। আমার শিষ্যেরা যেন কখনও কোনমতে কাপুরুষ না হয়।
সদা প্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
১৯৯*
[মিঃ লেগেটকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.
৭ জুলাই, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
দেখতে পাচ্ছি—আপনি নিউ ইয়র্ক খুব উপভোগ করছেন, সুতরাং একটি চিঠির দ্বারা আপনার মধুর স্বপ্ন ভাঙবার জন্য ক্ষমা করবেন।
মিস ম্যাকলাউড এবং মিসেস স্টার্জিস-এর কাছ থেকে আমি দুটি সুন্দর চিঠি পেয়েছি। তাঁরা বার্চগাছের ছালের দুটি সুন্দর খাতা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি সংস্কৃত মূল শ্লোক এবং অনুবাদে সে দুটি ভরিয়ে ফেলে আজকের ডাকে পাঠিয়ে দিলাম।
শুনছি, মিসেস ডোরা৭৫ গূঢ় রহস্যাদিতে বিশ্বাসী ‘মহাত্মা’-পদ্ধতিতে চমকপ্রদ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন।
পার্সি৭৬ ছাড়ার পর থেকে আমি লণ্ডনে যাবার জন্য অপ্রত্যাশিত অনেক জায়গা থেকে আমন্ত্রণ পাচ্ছি এবং আমি বহু আশা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি। লণ্ডনে কাজ করার এই সুযোগ হারাতে চাই না। তাই লণ্ডনের আমন্ত্রণের সঙ্গে আপনার আমন্ত্রণকে আরও কাজ করার দৈব আহ্বান বলেই মনে করি।
আমি পুরো এ মাসটা এখানেই থাকব এবং অগষ্ট মাসের কোন সময়ে কয়েকদিনের জন্য মাত্র চিকাগোয় যেতে হবে।
উদ্বিগ্ন হবেন না, ফাদার লেগেট, এই হল আশান্বিত হবার সর্বোৎকৃষ্ট সময়—যখন ভালবাসায় এত নিশ্চয়তা।
প্রভু আপনাকে চিরকাল আশীর্বাদ করুন, চিরদিনের জন্য সকল শান্তি লাভ করুন, কারণ আপনি তা লাভ করার খুবই উপযুক্ত।
ভালবাসা এবং স্নেহে চিরদিন আপনার
বিবেকানন্দ
১৯০*
19W, 38th St., নিউ ইয়র্ক
৮ জুলাই, ১৮৯৫
স্নেহের অ্যালবার্টা,৭৭
আমি নিশ্চিত যে, তুমি এখন সম্পূর্ণভাবে তোমার সঙ্গীতশিক্ষায় নিমগ্ন। আশা করি ইতোমধ্যে তুমি স্বরগ্রামের সব কিছুই শিখে নিয়েছ। পরের বারে দেখা হলে তোমার কাছ থেকে স্বরগ্রাম সম্বন্ধে পাঠ গ্রহণ করা আমার খুব আনন্দের বিষয় হবে।
পার্সিতে মিঃ লেগেটের সঙ্গে আমাদের দিনগুলি বেশ আনন্দে কেটেছে—তিনি ঋষিকল্প নন কি?
আমি নিশ্চিত যে, হলিস্টারও (Hollister) জার্মান দেশটা খুব উপভোগ করছে এবং আশা করি তোমরা কেউই জার্মান শব্দ উচ্চারণ করার চেষ্টা করতে গিয়ে জিভ জখম করনি—বিশেষ করে সেই সকল শব্দ, যেগুলির আরম্ভ sch, tz, tsz, এবং অন্য সব মধুর জিনিষ দিয়ে।
জাহাজ থেকে লেখা তোমার চিঠিখানি তোমার মায়ের কাছে পড়েছি। আগামী সেপ্টেম্বরে আমি খুব সম্ভবতঃ ইওরোপ যাচ্ছি। আজ পর্যন্ত ইওরোপে যাইনি। মোটের উপর, সেটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুব বেশী ভিন্নরকম হবে না, ইতোমধ্যেই আমি এদেশের আচার-ব্যবহার বেশ রপ্ত করে ফেলেছি।
পার্সিতে নৌকায় বেড়াবার সময় আমি দাঁড় চালানর দু-একটি বিষয় শিখে নিয়েছি। মাসীমা ‘জো জো’-কে তাঁর ‘মধুরতা’র জন্য খেসারত দিতে হয়েছে, কারণ মাছি এবং মশাগুলি মুহূর্তের জন্যও তাঁকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না। পরন্তু আমাকে তারা অনেকখানি জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল; আমার মনে হয় এর কারণ মাছিগুলি ছিল গোঁড়া; তাই একজন পৌত্তলিককে তারা স্পর্শ করেনি। আবার আমার মনে হয়, পার্সিতে আমি খুব গান গাইতাম, সেই ভয়েই তারা পালিয়ে গিয়েছে। আমাদের ভারি সুন্দর সুন্দর বার্চ (birch) বৃক্ষ ছিল। তার ছাল থেকে বই তৈরী করার চিন্তা আমার মনে উদিত হল—যেমন প্রাচীনকালে আমাদের দেশে করা হত; তোমার মা ও মাসীমার জন্য আমি কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক লিখেছি।
অ্যালবার্টা, আমি নিশ্চয়ই জানি—তুমি অচিরেই একজন বিস্ময়কর বিদুষী হতে চলেছ। তোমাদের দুজনের জন্য ভালবাসা এবং আশীর্বাদ।
সতত স্নেহবদ্ধ তোমাদের
বিবেকানন্দ
২০১*
[মিসেস স্টার্জিসকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.
জুলাই, ১৮৯৫
মা,
আপনি নিশ্চয় ইতোমধ্যে নিউ ইয়র্কে এসে গিয়েছেন এবং সেখানে এখন গরম মোটেই প্রচণ্ড নয়।
এখানে আমাদের বেশ কাটছে। মেরী লুই (Marie Louise) গতকাল এসে পৌঁছেছেন। সুতরাং এখন পর্যন্ত যাঁরা এসেছেন, সবাইকে মিলিয়ে আমরা ঠিক সাতজন।
পৃথিবীর সব ঘুম যেন আমাতে নেমে এসেছে। আমি দিনে অন্ততঃ দু-ঘণ্টা ঘুমাই এবং সমস্ত রাত্রি জড়পিণ্ডের মত অসাড়ে নিদ্রা যাই। মনে হয়, নিউ ইয়র্কের অনিদ্রার এটি একটি প্রতিক্রিয়া। আমি কিছু কিছু লিখছি ও পড়ছি এবং প্রতিদিন প্রাতঃরাশের পর একটি করে ক্লাস নিচ্ছি। কঠোর নিরামিষবিধিতে আহার প্রস্তুত হচ্ছে, এবং আমি খুব উপোস করছি।
এ স্থান ত্যাগ করবার পূর্বে আমার চর্বি থেকে বেশ কয়েক পাউণ্ড উবে যাবে, এ বিষয়ে আমি দৃঢ়নিশ্চয়। এটা মেথডিষ্টদের জায়গা এবং অগষ্ট মাসে তাদের শিবির-সভা হবে। এটা অত্যন্ত সুন্দর স্থান; শুধু ভয়, জায়গাটা এই ঋতুতে অত্যন্ত জনবহুল হয়ে পড়ে।
মিস ‘জো জো’র মাছির ক্ষত নিশ্চয়ই এতদিনে সম্পূর্ণ সেরে গিয়েছে।—মা কোথায়? পরের বারে আপনি যখন তাঁকে চিঠি লিখবেন, দয়া করে তাঁকে আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানাবেন।
পার্সিতে যে-আনন্দে দিনগুলি কেটেছে, তার দিকে আমি সর্বদাই ফিরে ফিরে তাকাব এবং এই ব্যবস্থার জন্য মিঃ লেগেটকে সর্বদাই ধন্যবাদ জানাব। আমি তাঁর সঙ্গে ইওরোপে যেতে পারব। যখন তাঁর সঙ্গে পরের বারে দেখা হবে, দয়া করে তাঁকে আমার চিরন্তন ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানাবেন। তাঁর মত মানুষদের ভালবাসা দ্বারাই জগৎ সর্বদা আরও ভাল হবার দিকে যাচ্ছে।
আপনি কি আপনার বন্ধু মিসেস ডোরার (লম্বা জার্মান নাম) সঙ্গে আছেন? তিনি একজন মহাপ্রাণ, খাঁটি ‘মহাত্মা’। দয়া করে তাঁকে আমার ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানাবেন।
আমি এখন একপ্রকার তন্দ্রাচ্ছন্ন—অলস, আনন্দের ভাব নিয়ে আছি, মন্দ লাগছে না।মেরী লুই নিউ ইয়র্ক থেকে তাঁর পোষা একটি কচ্ছপ নিয়ে এসেছেন। এখন এখানে এসে পোষা প্রাণীটি তার স্বাভাবিক পরিবেশ পেয়েছে। সুতরাং বিপুল অধ্যবসায়ে গড়াতে গড়াতে এবং হামাগুড়ি দিতে দিতে সে মেরী লুই-র ভালবাসা ও আদরকে পেছনে—অনেক পেছনে ফেলে চলে গিয়েছে। প্রথমটায় তিনি কিছুটা দুঃখিত হয়েছিলেন, কিন্তু আমরা এত জোরের সঙ্গে স্বাধীনতার জয়গান করতে লাগলাম যে, তাঁকে অবিলম্বে ফিরে আসতে হল।
ঈশ্বর আপনাকে এবং আপনাদের সকলকে চিরকাল আশীর্বাদ করুন, এই সতত প্রার্থনা।
বিবেকানন্দ
পুনঃ—‘জো জো’ বার্চগাছের ছালের তৈরী বইটি পাঠায়নি। মিসেস বুলকে আমি যেটি পাঠিয়েছি, সেটি পেয়ে তিনি ভারি আনন্দিত।
ভারত থেকে আমি অনেকগুলি সুন্দর চিঠি পেয়েছি। সেখানে সব ঠিক চলছে। সাগরপারে বিদেশে অবস্থিত শিশুদের আমাদের ভালবাসা পাঠিয়ে দেবেন।
—বি
২০২*
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]
আমেরিকা.
৯ জুলাই, ১৮৯৫
… আমার ভারতে ফেরা সম্বন্ধে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এইঃ মহারাজ তো বেশ ভালই জানেন, আমি হচ্ছি দৃঢ় অধ্যবসায়ের মানুষ। আমি এ দেশে একটি বীজ পুঁতেছি, সেটি ইতোমধ্যেই চারা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশা করি খুব শীঘ্রই এটা বৃক্ষে পরিণত হবে। আমি কয়েকশত অনুগামী শিষ্য পেয়েছি; কতকগুলিকে সন্ন্যাসী করব, তারপর তাদের হাতে কাজের ভার দিয়ে ভারতে চলে যাব। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা আমার বিরুদ্ধে যতই লাগছে, ততই তাদের দেশে একটা স্থায়ী দাগ রেখে যাবার রোক আমার বেড়ে যাচ্ছে। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা … তাদের বিদ্যাবুদ্ধি, কলাকৌশল যতই খাটাক না কেন, প্রতিদিনই বুঝছে, আমাকে চেপে মেরে ফেলা তাদের পক্ষে একটু কঠিন কাজ। ইতোমধ্যে লণ্ডনে আমার কয়েকটি বন্ধু জুটেছে। আমি অগষ্টের শেষে সেখানে যাব মনে করেছি—দেখি, ওদিকে পাদ্রীদের কতটা ঘাঁটাতে পারা যায়। যাই হোক, আগামী শীতের কিছুটা লণ্ডনে ও কিছুটা নিউ ইয়র্কে কাটাতে হবে—তারপরই আমার ভারতে ফেরবার বাধা থাকবে না। যদি প্রভুর কৃপা হয়, তবে এই শীতের পর এখানকার কাজ চালাবার জন্য যথেষ্ট লোক পাওয়া যাবে। প্রত্যেক কাজকেই তিনটি অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়—উপহাস, বিরোধ ও পরিশেষে গ্রহণ। যে-কোন ব্যক্তি তার সময়ে প্রচলিত ভাবরাশি ছাড়িয়ে আরও উচ্চতর তত্ত্ব প্রকাশ করে, তাকে নিশ্চয়ই লোকে ভুল বুঝবে। সুতরাং বাধা ও অত্যাচার আসুক, স্বাগতম। কেবল আমাকে দৃঢ় ও পবিত্র হতে হবে এবং ভগবানে গভীর বিশ্বাস রাখতে হবে, তবেই এ-সব উড়ে যাবে। ইতি
বিবেকানন্দ
২০৩*
[মিসেস স্টার্জিসকে লিখিত]
Thousand Island Park
২৯ জুলাই, ১৮৯৫
মা,
আপনার গৌরবময় সময় এসেছে। আপনি নিশ্চয়ই সুস্থ আছেন।
এখানে বেশ ভালভাবে সময় কাটছে। দু-একজন মহিলা সরাসরি ডেট্রয়েট থেকে এখানে এসেছেন আমাদের সঙ্গে থাকতে। তাঁরা বেশ পবিত্র ও ভাল। আমি থাউজ্যাণ্ড আইল্যাণ্ড থেকে ডেট্রয়েটে এবং সেখান থেকে চিকাগোয় যাচ্ছি।
নিউ ইয়র্কে আমার ক্লাস চলছে। আমার অনুপস্থিতিতেও তারা বেশ সাহসের সঙ্গে ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছে। ভাল কথা, ডেট্রয়েট থেকে যে দু-জন মহিলা এসেছেন, তাঁরা ক্লাসে যোগদান করেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁদের ভূতের ভয়। তাঁদের কে শিখিয়েছে, জ্বলন্ত এলকোহলের শিখায় একটু নুন দিলে কাল তলানি পড়ে, তাহলে সেটা হবে ভূতের অস্তিত্বের প্রমাণ। যা হোক, মহিলা দুটি বেশ ভূতের ভয় পেয়েছিলেন। লোকে বলে, এই রকম ভূত বিশ্বজগতে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। পিতা লেগেট আপনার অনুপস্থিতিতে নিশ্চয়ই খুব নিরুৎসাহ হয়েছেন। কারণ আজ পর্যন্ত তাঁর কোন চিঠি পাইনি। বেশ, দুঃখ আসে আসুক, বিচলিত না হওয়াই শ্রেয়। কাজেই তা নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছি না।
জো জো-র সমুদ্রযাত্রা খুবই ভয়ঙ্কর হয়ে থাকবে। শেষ রক্ষাই রক্ষা।
শিশুরা৭৮ জার্মানীতে বেশ আনন্দে আছে, নিশ্চয়। তাদের জাহাজ-ভর্তি ভালবাসা জানাবেন।
এখানকার সকলের ভালবাসা জানবেন। ভবিষ্যৎ বংশধরদের নিকট আপনার জীবন আলোক-বর্তিকার মত হোক—এই কামনা করি।
আপনার পুত্র
তোমাদের বিবেকানন্দ
২০৪*
19W, 38th St., নিউ ইয়র্ক
৩০ জুলাই, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তুমি ঠিক করেছ। নাম আর ‘মটো’ (motto)৭৯ ঠিকই হয়েছে। বাজে সমাজসংস্কার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো না, প্রথমে আধ্যাত্মিক সংস্কার না হলে সমাজসংস্কার হতে পারে না। কে তোমায় বললে, আমি সমাজসংস্কার চাই? আমি তো তা চাই না! ভগবানের নাম প্রচার কর, কুসংস্কার ও সমাজের আবর্জনার পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলো না।
‘সন্ন্যাসীর গীতি’৮০ এইটিই তোমাদের কাগজে আমার প্রথম প্রবন্ধ। নিরুৎসাহ হয়ো না—তোমার গুরুতে বিশ্বাস হারিও না—ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিও না। হে বৎস! যতদিন তোমার অন্তরে উৎসাহ এবং গুরু ও ঈশ্বরে বিশ্বাস—এই তিনটি জিনিষ থাকবে, ততদিন কিছুতেই তোমায় দমাতে পারবে না। আমি দিন দিন হৃদয়ে শক্তির বিকাশ অনুভব করছি। হে সাহসী বালকগণ, কাজ করে যাও।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ