০৯. নৰ্থ পোল

॥ ৯ ॥

ফেলুদা পরদিন সকাল আটটায় বেরিয়ে আড়ইটেয় ফিরল। ও নাকি বাইরেই লাঞ্চ সেরে নিয়েছে। কাজ হল কিনা জিজ্ঞেস করতে ঠিক ভরসা পাচ্ছিলাম না। কারণ ওর মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা লক্ষ করছিলাম; তার মানে সাক্সেস না ফেইলিওর সেটা বুঝতে পারছিলাম না।

ফেলুদা সোফায় বসার আগে দুটো ফোন করল, একটা শঙ্কর মুনসীকে, অন্যটা ইন্‌স্পেক্টর সোমকে। দুজনকেই একই ইনস্ট্রাকশন, আগামীকাল সকাল দশটায় সুইনহো স্ট্রীটে বৈঠকে সবাই যেন উপস্থিত থাকে।

এবার একটা চারমিনার ধরিয়ে ফেলুদা সোফায় বসে সামনের টেবিলের উপর পাটা ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমারও মুনসীর মতো বলতে ইচ্ছা করছে, কী ভুলই করেছিলাম!…রহস্য উদ্ঘাটনের চাবি সবকটা চোখের সামনে পড়ে আছে, অথচ দেখতে পাচ্ছিলাম না।’

আমি একটা কথা না জিগ্যেস করে পারলাম না।

‘অপরাধীকে আমরা চিনি তো?’

‘নিশ্চয়ই’, বলল ফেলুদা। ‘তোর যখন এত কৌতূহল, তখন আমি তোকে কয়েকটা প্রশ্ন করছি যেগুলোর উত্তর ঠিকমতো দিতে পারলে হয়ত তুই নিজেই সমস্যার সমাধান করতে পারবি।’

আমি চুপ, বুক ঢিপ ঢিপ।

‘এক, নতুন ডায়রিটায় লক্ষ করার মতো বিশেষ কিছু দেখলি?’

‘একটা ব্যাপারে খটকা লাগল।’

‘কী?’

‘খুনের আগের রাত পর্যন্ত ডায়রি লিখে গেছেন ভদ্রলোক, কিন্তু “আর” আসার কোনো উল্লেখ নেই।’

‘এক্সলেন্ট! দুই, বিসর্জন কথাটা বলতে প্রথমেই কী মনে হয়?’

‘নাটক। রবীন্দ্রনাথ।’

‘হল না।’

‘দাঁড়াও দাঁড়াও! জল…জলে কিছু ফেলে দেওয়া।’

‘গুড। তিন, নেমেসিস কাকে বলে জানিস?’

‘নেমেসিস?’

‘হ্যাঁ।’

‘ইংরিজি কথা?’

‘উঁহু। গ্রীক।’

‘ওরে বাবা, সে কী করে জানব?’

‘তাহলে শিখে নে। অপরাধ করে যে শাস্তি সাময়িকভাবে এড়িয়ে গেলেও একদিন-না-একদিন ভোগ করতেই হয়, তাকে বলে নেমেসিস। এই নেমেসিস-এরই ভয় পাচ্ছিল “এ”, “জি” আর “আর”।’

আমার ব্যাপারটা খুবই ইন্টারেস্টিং লাগছিল, তাই ফেলুদা চুপ করে আছে দেখে বললাম, ‘আরো আছে?’

‘আর একটা বলব। বেশি বললে কালকের নাটকটা জমবে না।’

‘ঠিক আছে।’

‘ফিজিশিয়ান হীল দাইসেল্‌ফ, মানে জানিস?’

‘এ তো ইংরিজি প্রবাদ, ডাক্তার, আগে নিজের ব্যারাম সারাও।’

‘আরেকটা শেষ কথা বলে দিচ্ছি তোকে, “সাজা” কথাটার অনেকগুলো মানে পাবি অভিধানে, তার মধ্যে দুটো মানে নিয়ে আমাদের কারবার।’

‘বুঝেছি।’

চা দেবার মিনিট দশেক আগে জটায়ু এসে হাজির। কাউকে বসেই প্রথম প্রশ্ন হল, ‘আমরা কোন স্টেজে আছি?’

উত্তরে ফেলুদা ‘মিনার্ভা’ বলে লালমোহনবাবুকে অসম্ভব ভ্রূকুটি করতে দেখে বলল, ‘পেনালটিমেট।’

‘পেনালটি, কী বললেন?’

‘আপনার ইংরিজিটা আর রপ্ত হল না কিছুতেই। পেনালটিমেট মানে লাস্ট বাট ওয়ান।’

‘লাস্ট স্টেজে পৌঁছাচ্ছি কবে?’

‘কাল সকাল দশটায় মুনসী প্যালেসে সর্বসমক্ষে যবনিকা উত্তোলন।’

‘আর পতন?’

‘ধরুন, তার আধ ঘন্টা বাদে।’

‘চারজনের উপর তো সন্দেহ—’

‘হ্যাঁ, ইনি, মিনি, মাইনি, মো।’

‘উঃ, কথায় কথায় আপনার এই প্রগল্‌ভতা অসহ্য। এইটে অন্তত বলুন যে শঙ্কর, সুখময়, রাধাকান্ত—’

ফেলুদা হাত তুলে বাধা দিয়ে বলল, ‘আর স্পিক-টি-নট। এইখানেই দাঁড়ি।’

‘আপনি দিন দাঁড়ি। আমার বলা শেষ হয়নি। নাটকের ক্লাইম্যাক্স আমার হাতে, আপনার হাতে নয়। এটা ওয়ার্নিং দিয়ে দিলুম।’

‘আপনি যে ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন।’

‘ভয়ের কিস্যু নেই। আপনার সিংহাসন কেউ টলাতে পারবে না। আর তারিফের সিংহভাগ আপনিই পাবেন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সিংহাসনের পাশে একটি ছোট্ট স্পেশাল আসন, আর তারিফের পাশে একটি মিনি-তারিফ, এ দুটো আমার বরাদ্দ থাকবেই।’

পরদিন ভোরে এক পশলা বৃষ্টি হওয়াতে আমাদের পাড়াতে কিছুটা জল জমেছিল, তাও ঠিক সাড়ে নটার সময় বগলে ছাতা, কাঁধে ঝোলা আর মুখে হাসি নিয়ে লালমোহনবাবু এসে হাজির। ‘তপেশ ভাই’, কাউচে বসে বললেন ভদ্রলোক, ‘জগন্নাথকে বোলো যেন আজ খিচুড়ি করে। নাটকের পর মধ্যাহ্নে ভোজনটা এখানেই সারব।’

চা খেয়ে দশটার পাঁচ মিনিট আগেই আমরা সুইনহো স্ট্রীটে পৌঁছে গেলাম। আমাদের আগেই পুলিশ হাজির; ইন্‌স্পেক্টর সোম ফেলুদাকে গুড মর্নিং করে বললেন, ‘আমি আপনার মেথড তো জানি। তাই সকলকেই বৈঠকখানায় জমায়েত হতে বলে দিয়েছি, বেয়ারা বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, কেবল মিসেস মুনসীরও থাকার দরকার কিনা সেটা জানার ছিল।’

ফেলুদা মাথা নেড়ে বলল, ‘উনি না থাকাটাই বাঞ্ছনীয়।’

সবাই যে যার জায়গা নিয়ে বসতে না বসতে একতলায় বড় ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটা বাজল। ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়ে একবার চারদিকে দেখে নিয়ে ঘড়ির শেষ ঢং-এর রেশটা মিলিয়ে যেতেই কথা আরম্ভ করে দিল।

‘আমি প্রথমেই শঙ্করবাবুকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।’

শঙ্করবাবু ঘরের উল্টোদিকে বসেছিলেন। তাঁর দৃষ্টি ফেলুদার দিকে ঘুরল। ফেলুদা বলল, ‘আমি সেদিন যখন বললাম যে ডাঃ মুনসী তাঁর ডায়রিতে অনেকবার আপনার উল্লেখ করেছেন, তা শুনে আপনি বিস্মিত হন। এবং আমি যখন বললাম যে তিনি আপনার সম্বন্ধে নিশ্চয় সত্যি কথাই বলেছেন তখন আপনি বেশ বিরক্ত হয়েই বললেন, “বাবা আমাকে চিনলেন কবে, কীভাবে, তিনি তাঁর তো রুগী নিয়েই পড়ে থাকতেন।” শঙ্করবাবু আপনি কেন ধরে নিলেন যে বাবা আপনার সম্বন্ধে অপ্রিয় কথাই বলেছেন? আমি তো কিছুই বলিনি।’

‘কারণ বাবা সামনা-সামনি আমার কখনো প্রশংসা করেননি।’

‘নিন্দে করেছেন কি?’

‘না, তাও করেননি।’

‘তাহলে আপনিই বা আপনার সম্বন্ধে ডাঃ মুনসীর প্রকৃত মনোভাব কী করে জানলেন?’

‘ছেলে তার বাবার মন জানবে না কেন? সে তো অনুমান করতে পারে।’

‘বেশ, এবার আরেকটা কথায় আসি। আমি গতকাল দুপুরে একবার আপনাদের এখানে এসেছিলাম। এ বাড়িতে ভৃত্যস্থানীয় যারা আছে তাদের ডেকে ডেকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করি। একটা প্রশ্ন আপনাকে নিয়ে; সেটার উত্তর দেয় আপনাদের মালি গিরিধারী। প্রশ্নটা ছিল, আপনার বাবার খুনের দিন সে আপনাকে ভোরে বেরোতে দেখেছিল কিনা। মালি বলে, হ্যাঁ দেখেছিল। তখন আমি জিগ্যেস করি আপনি খালি হাতে বেরোন কিনা। উত্তরে মালি বলে, না। আপনার হাতে একটা কালো চামড়ার ব্যাগ ছিল। বর্ণনায় বুঝি সেটা ব্রীফকেস বা পোর্টফোলিও জাতীয় ব্যাগ। এই ব্যাগে কী ছিল সেটা বলবেন কি?’

শঙ্করবাবু চুপ। তাঁর নিশ্বাস জোরে জোরে পড়তে শুরু করেছে।

‘আমি বলব কী ছিল?’ বলল ফেলুদা। শঙ্করবাবু নিরুত্তর। ফেলুদা বলল, ‘ব্যাগে ছিল আপনার বাবার ডায়রির পাণ্ডুলিপি। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে, বা করার আগে, আপনি সেটা লেকের জলে বিসর্জন দেন তবে তার কারণ’, ফেলুদার গলা চড়ে ওঠে, ‘আপনি ডায়রিটা পড়ে দেখেছেন যে আপনার বাবা আপনার সম্বন্ধে একটিও প্রশংসাসূচক কথা বলেননি। তিনি—’

ফেলুদার গলা ছাপিয়ে শঙ্করবাবু বলে উঠলেন, ‘ইয়েস, ইয়েস! এই বই ছাপা হলে আমার রোজগারের রাস্তা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যেত। অলস, উদ্যমহীন, ইরেসপন্‌সিব্‌ল, অস্থিরমতি, কী না বলেননি উনি আমাকে!’

‘রাইট’, বলল ফেলুদা। ‘তাহলে এটাও স্বীকার করুন যে সেদিন গলার স্বর পালটিয়ে “আর”-এর ভূমিকা নিয়ে আপনিই আমাকে ফোনটা করে আপনার বাবা সম্বন্ধে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলেছিলেন, সন্দেহ যাতে আপনার উপর না পড়ে?’

শঙ্করবাবু দাঁড়িয়ে উঠেছিলেন, এবার ধপ্‌ করে বসে পড়লেন।

‘“আর”-এর কথাই যখন উঠল’, বলল ফেলুদা, ‘তখন ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে দেখা যাক।’

ফেলুদার দৃষ্টি এবার বাঁয়ে বসা সুখময়বাবুর দিকে ঘুরল।

‘আমি এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।’

‘করুন।’

‘ইংরিজিতে যাকে হাঞ্চ বলা হয়, সেই হাঞ্চের উপর নির্ভর করে আমি গতকাল সকালে একবার সাঁইত্রিশ নম্বর বেলতলা রোডে যাই। সকলের অবগতির জন্য বলছি। এটা হল সুখময়বাবুর বাড়ির নম্বর। আমার মনে হচ্ছিল উনি কিছু তথ্য গোপন করে যাচ্ছেন, এবং হয়ত ওঁর বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বললে কিছুটা আলোর সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।’

ফেলুদার দৃষ্টি ঘুরে গিয়েছিল, এখন আবার ফিরে এল সুখময়বাবুর দিকে।

‘আপনার মা-র সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি আপনার বাবার মৃত্যু হয় চব্বিশ বছর আগে, গাড়ি চাপা পড়ে।…এই তথ্যটি কি ডাঃ মুনসী জানতেন?’

দৃষ্টি মেঝে থেকে না তুলেই উত্তর দিলেন সুখময়বাবু।

‘জানতেন। ইন্টারভিউ-এর সময়, আমার বাবা সাঁইত্রিশ বছর বয়সে মারা যান জেনে ডাঃ মুনসী জিগ্যেস করেন কিসে তাঁর মৃত্যু হয়।’

‘খুব সতর্ক লোকেরও কেমন ভুল হয় তার একটা উদাহরণ দিই। শঙ্কর মুনসী যখন আমার বাড়িতে আসেন তখন তিনি নিজের পরিচয় দিতে বলেন যে তিনি ডাঃ রাজেন মুনসীর ছেলে। এই রাজেন নামটা আমার মাথা থেকে বেমালুম লোপ পেয়ে যায়; যেটা থেকে যায় সেটা হল “ডাঃ মুনসী”। কাল ওঁর লাল ডায়রি খুলে প্রথম পাতাতেই “আর মুনসী” দেখে আমি চমকে উঠি। তাহলে কি ডাঃ মুনসী নিজেই তাঁর ডায়রির “আর”, এবং তিনিই গাড়ি চাপা দিয়ে লোক মেরে চতুর্দিকে ঘুষ দিয়ে আইনের কবল থেকে নিজেকে বাঁচান, আর সেই মৃত ব্যক্তিরই ছেলে তাঁরই কাছে আসে চব্বিশ বছর পরে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে?’

‘ভুল, ভুল, ভুল!’ চেঁচিয়ে উঠলেন সুখময়বাবু। ‘আমার বাবাকে যিনি চাপা দেন তাঁর উপযুক্ত শাস্তি হয়।’

‘সে কথা কি ডাঃ মুনসী জানতেন?’

‘না। তাঁর ধারণা ছিল তিনিই আমার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। আসল ঘটনা তিনি জানতে পারেন মৃত্যুর আগের দিন।’

‘কীভাবে?’

‘উনি আমাকে ডেকে বলেন যে ওঁর একটা স্বীকারোক্তি করার আছে যেটা না করলে উনি শান্তি পাবেন না। স্বীকারোক্তিটা কী জানতে পেরে আমি বলি, ডাঃ মুনসী, আপনি ভুল করছেন; আমার বাবাকে যিনি চাপা দেন তাঁর শাস্তি হয়েছিল। কথাটা শুনে উনি স্তম্ভিত হয়ে যান। আর আমিও বুঝতে পারি কেন তিনি আমার উপর এত সদয় ছিলেন।’

ঘরের উল্টোদিক থেকে একটা ছোট্ট, শুক্‌নো হাসি শোনা গেল। শঙ্করবাবু।

‘কিছু বলবেন?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।

‘না বললে আপনি আরো বেশি ভুল পথে গিয়ে পড়বেন।’

‘মানে?’

‘আমার বাবা জীবনে কখনো গাড়ি চালাননি।’

‘সে তথ্য আমার অজানা নয়, শঙ্করবাবু। মালির সঙ্গে কথা বলার পর আপনার ড্রাইভারের সঙ্গে আমার কথা হল।’

‘সে কী বলে?’

‘ত্রিশ বছর সে আপনাদের ড্রাইভারি করছে, তার মধ্যে সে মাত্র একটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। তাতে আপনার বাবার তাড়া ছিল বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও জনবহুল রাস্তায় তাকে জোরে গাড়ি চালাতে হচ্ছিল। তাই যখন দুর্ঘটনাটা ঘটে তখন ডাঃ মুনসী খানিকটা নিজেকেই দায়ী করেন। ড্রাইভারের যাতে দণ্ড না হয় তার জন্য তিনি যা করবার সবই করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ড্রাইভারের অনুতাপ আর আতঙ্ক কিছুতেই যাচ্ছিল না। তখন ডাঃ মুনসী তার চিকিৎসা করে তাকে ভালো করে তোলেন। অর্থাৎ আপনার বাবা ডায়রিতে একটুও মিথ্যে লেখেননি। এবং “আর” হচ্ছে নট রাজেন মুনসী, বাট ড্রাইভার রঘুনন্দন তেওয়ারি।’

‘বাট হু কিল্‌ড মাই ফাদার?’ অসহিষ্ণুভাবে চেঁচিয়ে উঠলেন শঙ্কর মুনসী।

‘এসব ব্যাপারে একটু ধৈর্য ধরতে হয়, মিঃ মুনসী’, গম্ভীর স্বরে বলল ফেলুদা। তারপর মুনসীর দিক থেকে তার দৃষ্টি ঘুরে একটি অন্য ব্যক্তির উপর গিয়ে পড়ল। ‘এ ঘরে একজন ব্যক্তি আছেন যাঁকে আমরা অসুস্থ বলে জানি’, বলল ফেলুদা। ‘এর আগে তিনি দুবার আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন, এবং দুবারই নানান অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে নিজেকে অসুস্থ বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। আজ তাঁকে দেখছি তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের চেহারা নিয়ে আমার ভাষণ শুনছেন। মিঃ মল্লিক—আপনি কি আপনা থেকেই সেরে গেলেন?’

রাধাকান্ত মল্লিক হঠাৎ যেন শক্ খাওয়া মানুষের মতো চমকে উঠলেন। —‘কী—কী বলছেন বলুন।’

‘বলছি যে আমার জেরায় সকলেই অল্পবিস্তর মিথ্যা বলেছেন বা সত্য গোপন করে গেছেন, কিন্তু আপনি সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন।’

মল্লিক এখনো এক দৃষ্টে ফেলুদার দিকে চেয়ে, তার মনের ভাব বোঝার কোনো উপায় নেই। ফেলুদা বলল, ‘আপনি বলেছিলেন পপুলার ইনশিওরেন্সে কাজ করেন। আমি সেটা ভেরিফাই করতে সেখানে গিয়েছিলাম। গিয়ে শুনলাম আপনি আর সেখানে নেই, চার মাস হল ছেড়ে দিয়েছেন। আপনি কি তাহলে বেকার। না অন্য কোথাও কাজ করছেন? ইনশিওরেন্সি অফিসে এ প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারল না বলে আপিস থেকেই আপনার বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। সতীশ মুখার্জি রোড, তাই না?’

মল্লিক এখনো চুপ, তার দৃষ্টি সামনের দিকে।

‘সত্য, এ মামলায় বিস্ময়ের শেষ নেই’, বলে চলল ফেলুদা। ‘আপনি ডাঃ মুনসীকে বলেছিলেন আপনার বাবা, আপনার দাদা, সকলেই আপনার মনে আতঙ্কের সঞ্চার করেছে। অথচ আপনার বাড়ি গিয়ে দেখি আপনার বাবা দাদা, কেউই নেই। বাবা মারা গেছেন প্রায় পঁচিশ বছর হল, আর দাদা বলে কেউ কোনোদিন ছিলই না। আপনার বিধবা মা-র কাছ থেকে জানি যে আপনি একটা যাত্রা কোম্পানিতে যোগ দিয়েছেন এবং বর্তমানে টুরে আছেন।’

এবার রাধাকান্ত মল্লিক মুখ খুললেন।

‘আমি যে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির এটা আমি কোনোদিনই ক্লেম করিনি। কিন্তু আপনি কী বলতে চান? আমি খুন করেছি?’

‘আমি ধাপে ধাপে এগোই, মল্লিক মশাই, লাফে লাফে নয়। আপনি খুনী কিনা সে ব্যাপারে পরে আসছি; প্রথমে দেখছি আপনি প্রবঞ্চক। মনোবিকারের অভিনয় করে আপনি মুনসীর কাছে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। আপনি—’

‘কেন এসেছিলাম সেটা জানেন আপনি?’ ফেলুদাকে বাধা দিয়ে জোরালো গলায় বললেন মল্লিক।

‘এটা আপনার মা-র কাছ থেকে জানি যে আপনার বাবা গাড়ি চাপা পড়ে মারা যান, যিনি চাপা দেন তাঁর কোনো শাস্তি হয়নি, এবং গাড়ির মালিক এসে আপনার মা-র হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন ক্ষতিপূরণ হিসেবে।’

‘ইয়েস!’ চেঁচিয়ে উঠলেন রাধাকান্ত মল্লিক। ‘তখনই দেখি আমি ভদ্রলোককে, আর তারপরে ছবি দেখি কাগজে এই সেদিন। সেই একই চেহারা, আর দেখেই স্থির করি যে একে বাঁচতে দেওয়া চলে না। কল্পনা করতে পারেন? একটি বারো বছরের ছেলে, বাবার পিছনে পিছনে ট্রাম থেকে নামছে। চোখের সামনে বাবা মোটরের তলায় তলিয়ে গেল! ওঃ, কী ভয়ংকর দৃশ্য! আজও মনে পড়লে শরীর শিউরে ওঠে। মাসের পর মাস ধরে মা-কে জিগ্যেস করেছি, যে লোকটা বাবাকে চাপা দিল তার শাস্তি হবে না? “বড় লোকদের শাস্তি হয় না! বাবু, বড় লোকেরা পার পেয়ে যায়।”…আর তারপর হঠাৎ খবরের কাগজে ছবি! এক মুহূর্তে মনস্থির করে ফেলি। এর শাস্তি হবে। আর সে শাস্তি দেব আমি।’

তারপরেই মনোবিকারের অভিনয় করার সিদ্ধান্ত?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু খুন করা যে এত কঠিন কে জানত? বুঝতে পারছিলাম এ জিনিস চট করে হবার নয়; সময় লাগবে আমার মনকে শক্ত করতে। শেষকালে মন শক্ত হল, অস্ত্র জোগাড় হল…মুনসীরই আপিস ঘরের একটা পেপার নাইফ। বাবার দেহ থেকে যে রক্ত বেরোতে দেখেছি। তাঁর হত্যাকারীর দেহ থেকেও রক্তপাত না হলে উপযুক্ত শাস্তি হবে না। তারপর—’

‘তারপর কী, মল্লিকমশাই?’

‘অদ্ভুত ব্যাপার, অদ্ভুত ব্যাপার! ছোরা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকেছি। পশ্চিমের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে মুনসীর উপর পড়েছে। মুখ হাঁ, আধ খোলা চোখে নিষ্প্রাণ চাউনি। নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ নেই! আমি খুন করব কি? সে লোক তো অলরেডি, ডেড, ডেড, ডেড!’

তৃতীয় ‘ডেড’ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে একটা ধুপ করে শব্দ হল।

সেটার কারণ হচ্ছে ডাঃ মুনসীর শালা চন্দ্রনাথবাবু। তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে চেয়ার থেকে উল্টে মেঝেতে পড়েছেন।

সোম তাঁর দিকে দৌড়ে গেলেন। আর সেই সঙ্গে ফেলুদা বলে উঠল, ‘দেখে নিন, মিঃ মুনসী। আপনার মামা, আপনার মা-র যমজ ভাই। হি কিল্‌ড ইওর ফাদার!’

‘মানে?’ হঠাৎ থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলেন জটায়ু, ‘মোটিভ?’

ফেলুদার দৃষ্টি আবার শঙ্করবাবুর দিকে গেল। ‘আপনি বলতে পারেন না, শঙ্করবাবু? আপনি তো ডায়রিটা পড়েছেন?’

শঙ্করবাবু ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।

‘মানুষকে চেনা অত সহজ নয়, শঙ্করবাবু’, বলল ফেলুদা। ‘জানোয়ারের সঙ্গে মানুষের আসল তফাত, জানোয়ার ভান করতে জানে না, অভিনয় জানে না, মনের ভাব লুকোতে জানে না। …ডাঃ মুনসী আপনার মা সম্বন্ধে মোটেই উদাসীন ছিলেন না। থাকলে ডায়রিটা তাঁকে কখনই পড়তে দিতেন না। কখনই সে ডায়রি তাঁকে উৎসর্গ করতেন না। ব্যাপারটা আসলে উল্টো। ঔদাসীন্য যদি কারুর তরফ থেকে হয়ে থাকে তিনি হলেন আপনার বিমাতা, যিনি তাঁর সমস্ত স্নেহ, ভালোবাসা, চিন্তা, ভাবনা, ঢেলে দিয়েছিলেন তাঁর অকর্মণ্য ভাইয়ের উপর।’

‘…এবার খুনের মোটিভটা কী? সেটা কি একবার সমবেত সকলকে বলবেন?’ প্রায় যান্ত্রিক মানুষের মতো কথা বেরোল শঙ্করবাবুর মুখ থেকে।

‘বাবার উইলে চার ভাগ পাবে মনস্তাত্ত্বিক সংস্থা, চার ভাগ আমি, আর আট ভাগ আমার মা।’

ইতিমধ্যে মিঃ সোমের পরিচর্যায় চন্দ্রনাথবাবুর জ্ঞান ফিরেছে। ফেলুদা তাকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করল, ‘খুন করার সিদ্ধান্ত কি আপনার?’

চন্দ্রনাথবাবু মাথা নাড়ালেন, তাঁর দৃষ্টি মেঝের কার্পেটের দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাসের পর কথা বেরোল, এত ক্ষীণ, যে বেশ কষ্ট করে বুঝতে হয়।

‘না। সিদ্ধান্ত…ডলির। ডলিই আমার হাতে…হামানদিস্তা তুলে দেয়!’

‘হুঁ, বুঝেছি।’ ফেলুদা যেন বেশ ক্লান্তভাবেই চেয়ারে বসে পড়ল। ‘শুধু একটা আপসোস, গভীর আপসোস…ডায়রিটা বেরোলে নিঃসন্দেহে সাহিত্যিক হিসাবে ডাঃ মুনসীর সুনাম হত। সেই ডায়রি এখন সলিলগর্ভে!’

‘অ্যাটেনশন! স্পটলাইট!’

ঘর কাঁপিয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন জটায়ু। সবাই তাঁর দিকে দেখছে দেখে একটা অদ্ভুত হাসি হেসে কাঁধের ঝোলা থেকে একটানে একটা ফাইল বার করে সেটাকে মাথার উপর তুলে ঝাণ্ডার মতো নাড়াতে নাড়াতে বললেন, ‘জলে যায়নি! জলে যায়নি! হিয়ার ইট ইজ!’

‘ডাঃ মুনসীর পাণ্ডুলিপি?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ফেলুদা। ‘সেটা কী করে হয়?’

‘ইয়েস স্যার! থ্যাঙ্কস টু বিজ্ঞানের অগ্রগতি। একদিনে পড়া হবে না বলে এটা জিরক্স করিয়ে রেখেছিলাম, জিরক্স! এক্স ই আর ও এক্স!…নিন সুখময়বাবু, টাইপিং শুরু করে দিন, শেষ হলে পর সোজা নর্থ পোল।’

এখানে অবিশ্যি একটা জটায়ু মার্কা ভুল হল, পেঙ্গুইন নর্থ পোলে থাকে না, থাকে সাউথ পোলে।

|| সমাপ্ত ||