০৯. নিঃশব্দ গতিতে জনহীন রাস্তা ধরে

নিঃশব্দ গতিতে জনহীন রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি হু-হু করে ছুটে চলল। গাড়িতে বসে আনমনে ভাবছিলাম। আজ রাত্রের সমগ্র ব্যাপারগুলো একটার পর একটা এখনো যেন চোখের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে ছায়াছবির মত। এবং আমার সমস্ত চিন্তাকে আবর্তিত করে একটা দৃশ্য মানসপটে কেবলই ভেসে উঠতে লাগল-লাল রক্তস্রোতের যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছে, আর সেই রক্তের ঢেউয়ের মধ্যে কালো অক্ষরে একটা নাম মাথা তুলে জেগে উঠছে, আবার পরীক্ষণেই মিলিয়ে যাচ্ছে!…কালো ভ্ৰমর! কালো ভ্রমর!

আজ দীর্ঘ আট বছর ধরে একটা বিভীষিকার মতই ঐ নামটা যেন আমাদের পিছনে পিছনে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে।

কারও মুখেই কোন কথা নেই।

কিরীটী আনমনে কি ভাবছে তা সে-ই জানে।

আমাকে আমহাস্ট স্ট্রীটে নামিয়ে দিয়ে ‘শুভরাত্ৰি’ জানিয়ে কিরীটী চলে গেল। নিজেকে কেন জানি বড় ক্লান্ত ও অবসন্ন লাগিছিল। কোনমতে গায়ের পোশাকগুলো খুলে সোজা এসে শয়নকক্ষে প্রবেশ করলাম, রাজু বোধ হয় জেগেই ছিল, আমার পদশব্দে সে শয্যায় পাশ ফিরে শুতে শুতে বললে, এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি রে সুব্রত?

বিছানার ওপরে গা-টা এলিয়ে দিতে দিতে বললাম, বন্ধু, আমাদের পুরনো বন্ধু শ্ৰীযুক্ত কালো ভ্রমর আবার যে আবির্ভূত হলেন নাট্যমঞ্চে!

কে? চমকে রাজু শয্যার ওপরে উঠে বসল। —কে আবির্ভূত হয়েছে?

কালো ভ্ৰমর। কেন, এর মধ্যেই নামটা ভুলে গেলি নাকি?

রাজু আবার শয্যার ওপরে গা এলিয়ে দিল, ঠাট্টা করবার আর সময় পেলি না! এই শেষরাত্রে এসে…যা বাথরুম থেকে মাথায় চোখে মুখে ভাল করে ঠাণ্ডা জল দিয়ে আয়। কোথায় ঘুরিস এত রাত পর্যন্ত? বলতে বলতে রাজু বেশ ভাল করে পালকের লেপটা টেনে পাশ ফিরে বোধ করি চোখ বুজল।

আমিও আর কোন কথা না বলে খোলা জানলার দিকে ফিরে শুলাম। চোখের পাতায় যেন ঘুম আসছে না।

খোলা জানলাপথে শীতের অন্ধকার রাতের একটুকরো আকাশ চোখে পড়ল। শুকতারাটা দপদপ করে জ্বলছে।

ঝিরঝির করে রাত্রিশেষের শীতল হাওয়া ঘরে এসে ঢুকছে।

ঢং ঢেং ঢেং-দালানের ওয়াল-ক্লকটা রাত্রি তিনটে ঘোষণা করল।

উঃ, রাত্রি তিনটে বাজে!

চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলাম।

কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, পরদিন—

এই সুব্রত, ওঠু ওঠু! কিরীটীর ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল।

কখন এলে কিরীটী? লজ্জিত স্বরে বললাম।

***

আকাশে বাতাসে নাকি সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এক মহাযুদ্ধের কালো ইশারা জেগে উঠেছে। ইংলণ্ড, জার্মান ও রাশিয়ার যে যুদ্ধ আজ সমগ্র ইউরোপকে তোলপাড় করছে, শীঘ্রই নাকি সারা পৃথিবীতে সেই যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়বে। রাজু আর সনৎদা তাই ব্যবসায় নেমেছে। এত বড় সুবৰ্ণ সুযোগ!

বড়বাজারের মোড়ে প্রকাণ্ড লোহার কারবার-রায় অ্যাণ্ড রায় কোম্পানী। দিবারাত্র ওরা দুজন তাই নিয়েই ব্যস্ত।

আমার ওসব ব্যবসা-ট্যাবসা ভালও লাগে না, আনন্দও পাই না ওতে, তাই কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গেই ফিরি।

বসবার ঘরে এসে আমি আর কিরীটী দু কাপ চা ঢেলে নিলাম। চা পানের পর কিরীটী আমার দিকে তাকিয়ে বললে, চল সুব্রত, আমার সঙ্গে একটু বেরুতে হবে।

কোথায়? চলই না দেখবেখন। আচ্ছা সুব্রত গত রাত্রের ঘটনা সম্পর্কে তোমার নিজস্ব মতামত কী।

গত রাত্রে ঘটনাটা যে আমি তেমন বুঝে উঠতে পেরেছি একথা বললে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথাই বলা হবে কিরীটী। তাছাড়া আমার যেন কেমন সন্দেহ হয়, গত রাত্রের ঘটনার মধ্যে এমন কোন একটা ব্যাপার সত্যিই লুকিয়েছিল যা হয়তো আমাদের কারও নজরে পড়েনি এবং অনেক ঘটনাই থাকা সম্ভব যা কারও নজরে পড়ছে না। আপাততঃ।

তাহলে নিশ্চয়ই এমন ধরনের কোন একটা ব্যাপার তোমার মনে উকি দিয়েছে সুব্রত কালকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে—বল না-বলছি না কেন?

কাল রাত্রে মিঃ মিত্রের হত্যা সম্পর্কে যাদের জেরা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে দুজন বলেছেন—একজন বিকাশ মল্লিক, আর একজন অরুণ কর, যে মিঃ শুভঙ্কর মিত্র হিন্দী ভাষা জানতেন; লিখতে, পড়তে বলতে র্তর আটকাত না। প্রফেসার কালিদাস শর্মাকেও তুমি ঐ কথা জিজ্ঞাসা করেছিলে, কিন্তু তিনি স্পষ্টই বললেন, শুভঙ্করবাবুর হিন্দী-জ্ঞান ‘করেঙ্গ’ ‘খায়েঙ্গার বেশী নয়। অর্থাৎ তার মতে মিঃ মিত্রের হিন্দী-জ্ঞান আমাদেরই মত। এদের মধ্যে হয়। অরুণ ও বিকাশবাবু, নয় প্রফেসর শর্মা মিথ্যে কথা বলেছেন নিশ্চয়ই!

চমৎকার! বাঃ সুব্রত, সত্যই আমি দেখে সুখী হয়েছি যে দিন দিন তোমার দেখবার ও বোঝবার শক্তি প্রখর হয়ে উঠছে। তুমি একদিন সত্যিকারের রহস্যভেদী হতে পারবে বন্ধু-কিন্তু এবার বল তো বন্ধু আমার, সত্যিই যদি তোমার মতে ওদের কেউ একজন মিথ্যা কথাই বলে থাকে—কেন, কী কারণে সে মিথ্যা বললে? উদ্দেশ্য কী ছিল তারা?

কী জানি ভাই, তা তো বলতে পারছি না! সত্যি সত্যি একজন ভদ্র ব্যক্তি কি করে যে মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারেন তা সহজ বুদ্ধির বাইরে। তবে আমার যা মনে হয়েছে তাই বললাম।

কিন্তু তোমার মনে হয় কি কে এদের মধ্যে মিথ্যা কথা বলতে পারে বন্ধু?

মনে হয় প্রফেসারই যেন মিথ্যা কথা বলেছেন। তারপর ধর, হিন্দী ভাষায় অনুদিত সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে বইখানা…

চমৎকার! সত্য সত্যই যে সুব্রত তুমি ভাবতে শিখেছি! বল বল! কিরীটী উৎসাহিত হয়ে ওঠে।

দেখ আমার অনুমান হয়, কুমারসাহেবের বাড়ির খাবার ঘরটায় গতরাত্রে আমন্ত্রিত অভ্যাগতদের মধ্যে বলতে গেলে কেউই একপ্রকার ঢোকেননি। কেননা খাবার বন্দোবস্ত গতরাত্রে নীচের হলঘরেই হয়েছিল এবং সে অবস্থায় দু-একজন কেউ সে ঘরে ঢুকলেও পাশের ঘরে যে বাবুর্চি ছিল তার নজরে পড়ত; আর হয়েছিলও তাই। শুভঙ্করবাবু যখন খাবার ঘর থেকে বের হয়ে যান, বাবুর্চি দেখেছিল। সেখানে এমন বেশী লোক থাকতে পারে না যারা হিন্দীতে অনূদিত বই পড়তে সক্ষম। তাছাড়া সকলেই একবাক্যে অস্বীকার করেছেন, ও বইটা সম্পর্কে কেউ কিছু জানেন না। অথচ প্রফেসার ও শুভঙ্করবাবু দুই বন্ধু খাবার ঘরে অনেকক্ষণ উপস্থিত ছিলেন। আমার যতদূর মনে হয় শুভঙ্করবাবুই নিজে ঐ বইখানা খাবার ঘরে একটা চেয়ারের ওপর ভুলে ফেলে আসেন এবং অরুণ করের সঙ্গে দেখা করবার সময় ঐ বইখানা নিয়ে যেতেন, অরুণ করাকে উত্তেজিত করে মজা দেখবার জন্য; কেননা অরুণ কর হিন্দী ভাষা মোটেই পছন্দ করে না। সে যাই হোক, আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি না, সত্যি ব্যাপারটা যদি আমার অনুমান মতই হয়ে থাকে, তবে প্রফেসার শৰ্মা কেন বললেন না যে শুভঙ্কর মিত্ৰই বইখানা ঐ ঘরে ফেলে গিয়েছিলেন!

তাছাড়া আরও ভেবে দেখ, সত্যিই যদি মিঃ মিত্ৰই বইখানা সে ঘরে ফেলে গিয়ে থাকেন প্রফেসর শর্মা নিশ্চয় তা জানতেন, কিন্তু তিনি তা স্বীকার করলেন না, কিংবা এমনও হতে

কিরীটী কোন জবাব দিল না। চুপ করে রইল। একটু পরে বললে, দেখ সুব্রত, আমরা যতদূর জানি ও শুনেছি শুভঙ্করবাবু একটুও ঘোর-পাঁচের লোক ছিলেন না। কিন্তু ঘটনাগুলো পর পর এমন ভাবে দাঁড়াচ্ছে যে, লোকটা অত্যন্ত প্যাচোয়া ছিলেন মনে হচ্ছে। আপাততঃ চল, একবার দীনতারণ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে আসি।

বেশ চল।

দুজনে আমরা উঠে দাঁড়ালাম।