দিল্লি থেকে আমস্টারডাম আসবার পথে এক মধ্যবয়স্কা ভারতীয় মহিলার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। তিনিই ডেকে আলাপ করেছিলেন আমার সঙ্গে। বিমানসেবিকা সেই ভদ্রমহিলার কথা কিছুই বুঝতে পারছিল না, সেই জন্য ভদ্রমহিলা আমায় ডেকে হিন্দিতে অনুরোধ করেছিলেন যে, তিনি নিরামিষ ছাড়া আর কিছু খান না, সেকথা ওই মেম-মেয়েটিকে বুঝিয়ে দিতে।
ভদ্রমহিলা একা চলেছেন এবং একবর্ণ ইংরেজি জানেন না। ওঁর হিন্দিও এত দুর্বোধ্য যে আমার পক্ষে সব কথার মর্মোদ্ধার করা শক্ত। তাঁর পাশের সিটটা খালি ছিল বলে তিনি বারবার ডেকে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন।
তাঁর বৃত্তান্ত যেটুকু আমি বুঝলুম, তাতেই আমি চমৎকৃত হলুম।
ভদ্রমহিলার বাড়ি পাঞ্জাবের একটি গ্রামে। ওঁর তিন ছেলের মধ্যে একজন সাত বছরের মেয়াদে জেল খাটছে, সে আছে দিল্লির তিহর জেলখানায়। বাকি দু’ ছেলের মধ্যে একজন লন্ডনে অন্যজন কানাডায়। ওঁর স্বামী মারা গেছেন এক বছর আগে। এক মেয়ে আছে বিবাহিতা। শরিকদের অত্যাচারে উনি নিজের বাড়িতে একা-একা আর টিকতে পারছিলেন না, তাই কিছুদিন ছিলেন মেয়ের কাছে। কিন্তু মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে অনেক লোক, সেখানে তাঁর বেশিদিন থাকা ভালো দেখায় না বলে তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন প্রবাসী পুত্রদের কাছে। এর মধ্যে সাড়া পাওয়া গেছে এক ছেলের কাছ থেকে, যে লন্ডনে থাকে। সে একটি বিমানের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছে।
ভদ্রমহিলার এক ছেলে কেন জেল খাটছে, সেকথা আমি জিগ্যেস করিনি তবু, সাত বছরের মেয়াদ যখন, তখন পেটিকেস নিশ্চয়ই নয়, রক্তারক্তির ব্যাপার আছে মনে হয়।
মেয়ের দেওরকে ভজিয়ে, তাকে নিয়ে ভদ্রমহিলা এসেছিলেন দিল্লি। জীবনে তাঁর সেই প্রথম দিল্লি আসা। তিহর জেলে গিয়ে ছোট ছেলের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। তারপর মেয়ের দেওর তাঁকে তুলে দিয়েছে এই বিমানে।
অবস্থায় পড়লে মানুষ কত কী করতে পারে। আমাদের বাংলার কোনও গ্রামের ইংরেজি না জানা প্রৌঢ়া মহিলা একা-একা প্লেনে চেপে বিলেত যাচ্ছেন, এ কথা কল্পনা করতেই আমাদের কষ্ট হয়।
ভদ্রমহিলা শাড়ি পরেননি, পরেছিলেন সালোয়ার-কামিজ। বিলেত যাওয়ার জন্য বিশেষ কিছু সাজপোশাক করেছেন এমন মনে হয় না। পাঞ্জাবের ট্রেনের থার্ড ক্লাসে এরকম পোশাক ও চেহারার মহিলা আগে অনেক দেখেছি। বয়েস পঞ্চান্নর কম নয়, আবার পঁয়ষট্টিও হতে পারে। মনে হয়, ওঁর স্বাস্থ্য এই কিছুদিন আগেও বেশ মজবুত ছিল, সদ্য ভাঙতে শুরু করেছে। সঙ্গের হাতব্যাগটি এমনই ক্যাটকেটে সবুজ রঙের যে সেদিকে তাকানো যায় না। আমাদের ভারতীয় ব্যবসায়ীরা অধিকাংশই বর্ণ-কানা। বেশিরভাগ জিনিসপত্রের ডিজাইনেই রঙের এমন অসামঞ্জস্য যে চক্ষুকে পীড়া দেয়।
আমি বারবার উঠে গেলেও উনি আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই হাতছানি দিয়ে ডেকে এটা ওটা জিগ্যেস করছিলেন। ওঁর প্রতিটি বাক্য আমি দু-তিনবার জিগ্যেস না করে বুঝতে পারছিলুম মা। সেই বিমানে অন্য আরও কয়েকজন ভারতীয় যাত্রী ছিল। আমার হিন্দিতে অল্প-জ্ঞানের জন্য আমার মনে হচ্ছিল, উনি আমার বদলে অন্য কোনও হিন্দি জানা কারুকে ডেকে ওঁর মনের কথা বলতে পারতেন। কিন্তু উনি আমায় ডাকলে তো আমি অন্য লোক ভজিয়ে দিতে পারি না।
একবার উনি একটা খাম খুলে ওঁর ছেলের ঠিকানা দেখিয়ে জিগ্যেস করলেন, আমি লন্ডনের এই রাস্তাটা চিনি কি না।
আমাকে উনি কেন লন্ডন বিশেষজ্ঞ ভেবে বসলেন কে জানে! যাই হোক, ঠিকানাটা সাসেক্সের। এইটুকু জানি, লন্ডন শহর থেকে বেশ দূরে। আশা করি, ওঁর ছেলে ঠিক সময় হিথরো বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকবে।
জিগ্যেস করলুম, ছেলেকে চিঠি দিয়েছেন তো?
এমনই ভাষার ব্যবধান যে উনি আমার এ প্রশ্নটাও বুঝতে পারছিলেন না। বারবার জিগ্যেস করতে লাগলেন, কেয়া দিয়া? কেয়া দিয়া?
তখন আমার মনে পড়ল, খত। চিঠির হিন্দি খত। বললুম, খত ভেজ দিয়া তো?
এবার উনি বললেন যে, হ্যাঁ, তাঁর মেয়ের দেওর একটা তার ভেজে দিয়েছে লন্ডনে।
আমি আবার মনে-মনে প্রার্থনা করলুম, মেয়ের দেওরটি আশা করি ঠিকানা ঠিক লিখেছে এবং ভারতীয় ডাক ও তার বিভাগ সুপ্রসন্নভাবে তারটি যথাসময়ে পাঠিয়েছে।
এরপর ভদ্রমহিলা আর একটি চমকপ্রদ কথা বললেন। লন্ডন-প্রবাসী সেই ছেলেকে তিনি আট বছর দেখেননি। তিনি শুনেছেন যে, সে একটি আংরেজি মেয়েকে বিয়ে করেছে।
আমি জিগ্যেস করলুম, আপনার স্বামী মারা যাওয়ার পরও আপনার ছেলেরা কেউ দেশে আসেনি?
উনি বললেন, না। এবং এমনভাবে বললেন যে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
হয়তো ওঁদের সমাজে পিতৃশ্রাদ্ধের ব্যাপারে অনুষ্ঠানের বাড়াবাড়ি নেই।
অনেকে বলে পাঞ্জাবে এখন এমনই সমৃদ্ধি এসেছে যে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আলাদাভাবে পাঞ্জাবকে ইটালি বা স্পেনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তা হয়তো ঠিকই। ভদ্রমহিলার ছেলেরা তো বেশ সাহেবই হয়ে গেছে মনে হয়। বাঙালি ছেলেরা বোধহয় এখনও বিধবা মাকে একা বিদেশের প্লেনে চাপাতে সাহস পায় না।
একটা চিন্তা মনের মধ্যে খচখচ করছিল। আট বছর যে ছেলে দেশে ফেরেনি এবং যে মেম বিয়ে করেছে, তার বিলেতের সংসারে কী করে সে এই ইংরেজি না জানা গ্রাম্য মাকে মানিয়ে নেবে? আশা করি, ভদ্রমহিলা সুখেই থাকবেন।
আমস্টারডাম এয়ারপোর্টে নামবার জন্য তৈরি হচ্ছি, ভদ্রমহিলা আমাকে জিগ্যেস করলেন, লন্ডন এসে গেছে?
আমি বললুম, না, এখান থেকে আপনাকে প্লেন পালটাতে হবে।
তিনি জিগ্যেস করলেন, তবে কি এই জায়গাটার নাম পারস?
ভদ্রমহিলা লন্ডনকে বলেন লোন্দন আর কানাডাকে বলেন কান্ডা। সুতরাং পারস যে প্যারিস হবে, তা আমি বুঝতে পারলুম একবারেই।
আমি জানালুম যে প্যারিস নয়, আমরা এক্ষুনি পৌঁছচ্ছি আমস্টারডামে।
এতক্ষণে ভদ্রমহিলার চোখ মুখে ভয়ের ছাপ দেখা দিল। তিনি বললেন, আমি তো লোন্দন যাব, তবে কি আমি ভুল হাওয়াই জাহাজে উঠেছি?
ভুল বাস বা ভুল ট্রেনের মতন ভুলে বিমানে চড়া অত সহজ নয়। অনেকগুলো চেকিং হয়। তবু আমি সিট বেল্ট খুলে ভদ্রমহিলার কাছে এসে বললুম, দেখি আপনার টিকিট।
টিকিট কে এল এম-এরই বটে। এবং ওই বিমান কোম্পানির সব প্লেন আমস্টারডামে থামবেই। ভদ্রমহিলাকে এখান থেকে অন্য প্লেন ধরতে হবে লন্ডনের জন্য। কিন্তু উনি এবার আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। উনি লন্ডনে যাবেন, অন্য কোথাও নামবেন না। ওঁকে তো কেউ এই জায়গায় নামবার কথা আগে বলে দেয়নি। মেয়ের দেওর ওঁকে বলেছে যে একবার হয়তো পারসে নামতে হতে পারে। কিন্তু এটা কোন জায়গা?
হয় দেওর মশাই ভুল করেছে কিংবা আমস্টারডাম একটু শক্ত নাম বলে ভদ্রমহিলা ভুলে গেছেন। আমি দু’-তিনবার বোঝাবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু উনি আমায় বেশ সন্দেহ করতে লাগলেন।
তখন আমি ভাবলুম, দূর ছাই। আমার কী দায়িত্ব! যাদের প্যাসেঞ্জার, সেই কোম্পানি বুঝবে কী করে ওঁকে পাঠাতে হবে লন্ডনে।
আমি নেমে পড়লুম।
তারপর কোন দিকে কাস্টমস, কোন দিকে ইমিগ্রেশন এই সব খোঁজাখুঁজি করছি, সেই সময় ভদ্রমহিলা ভিড়ের ভেতর থেকে দৌড়ে এসে আমার হাত চেপে ধরে বললেন, এ বেটা! তুমি কোথায় চলে যাচ্ছ? আমি এখন কোথায় যাব?
অন্য দেশের বিমানবন্দরে সদ্য নেমে অন্য কারুর ব্যাপারে মাথা ঘামাবার সময় থাকে না। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। মালপত্র ছাড়াবার জন্য উদ্বেগ, বাইরে যদি কেউ অপেক্ষা করে থাকে তার সঙ্গে দেখা করার তাড়াহুড়ো তো থাকবেই। তবু একজন বয়স্কা মহিলা বেটা বলে ডেকে যদি বিপদের সময় কোনও সাহায্য চান, তবে কি এড়িয়ে যাওয়া যায়?
ওঁকে সঙ্গে নিয়ে আমি বিমান কোম্পানির কাউন্টারে গিয়ে ওঁর টিকিটের এনডোর্সমেন্ট করিয়ে ফ্লাইট নম্বর জেনে নিলুম। তারপর নির্দেশ অনুযায়ী সেই ফ্লাইটের বিমানের রাস্তাটা দেখিয়ে বললুম, এবার এদিকে চলে যান, ওরা আপনাকে লন্ডনে পৌঁছে দেবে।
তিনি তখনও আমার হাত ধরেছিলেন। এরপর একটা অদ্ভুত কথা বললেন, তুমিও আমার সঙ্গে লোন্দন চলল। এখান থেকে কতদূর?
আমার হাসি পেল। একি অমৃতসর থেকে লুধিয়ানা যে ওঁকে এখন আমি লন্ডনে পৌঁছে দিয়ে আসব। আমার এখন থাকার কথা আমস্টারডামে।
অনেক মিষ্টি কথায় বুঝিয়ে আমি ওঁকে ওঁর বিমানের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলুম এবং একজন কোমল-মুখ এয়ার হস্টেসকে দেখে তাঁকে বুঝিয়ে দিলুম যেন লন্ডনে নামার পর মহিলাকে একটু সাহায্য করেন। ভদ্রমহিলা জলে-পড়া মানুষের মতন মুখ করে বারবার আমার দিকে পেছন ফিরে তাকাতে-তাকাতে চলে গেলেন ভেতরে।
ভদ্রমহিলা পাঞ্জাবিনী বলেও ওঁর নাম জিগ্যেস করা হয়নি। সুতরাং ওঁর কি ধর্ম তা আমি জানি। সেইজন্য আমি মনে-মনে বললুম, হে গুরু নানক, হে হজরত মহম্মদ, হে শ্রীকৃষ্ণ, আপনারা দয়া করে এই অসহায় মহিলাকে ঠিকঠাক ওঁর ছেলের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবেন লন্ডন বিমান বন্দরে।
সেই মহিলার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ভুমধ্যসাগর পেরুবার সময়। এরপর অনেকদিন কেটে গেছে, আমি যখন আবার আটলান্টিক মহাসমুদ্র ডিঙিয়ে যাচ্ছি, সেই সময়, যাত্রার একেবারে শেষ দিকে লক্ষ করলুম যে বিমানের এক কোণে সেই মহিলা বসে আছেন।
বেশ চমকে উঠলুম প্রথমে।
এর মধ্যেই তিনি লন্ডন ছেড়ে কানাডায় চলেছেন? উনি বলেছিলেন যে দুই ছেলের কাছেই সাহায্য চেয়ে চিঠি দেওয়ায় কানাডার ছেলে উত্তর দেয়নি, লন্ডনের ছেলে টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাহলে বোধহয় কানাডার ছেলেটির সুমতি হয়েছে। মাকে সে বেশি ভালোবাসে। সে হয়তো লন্ডনের ভাইকে জানিয়েছে যে, মা তোর কাছে থাকবে কেন, আমার কাছে পাঠিয়ে দে।
কিংবা এর উলটো দিকও থাকতে পারে।
আমার গল্প বানানো অভ্যেস কি না, তাই মনে-মনে একটা অন্য রকমও ভেবে ফেললুম। লন্ডনের মেম বিয়ে করা ছেলে মাকে নিয়ে বোধহয় বিড়ম্বনায় পড়েছিল। হয়তো তার বাড়িতে খুব মদ খাওয়ার পার্টি হয়, ওঁর মেম বউয়ের বান্ধবীরা প্রায়ই এসে নাচানাচি করে, সেখানে এই গ্রাম্য মহিলার উপস্থিতি তো একটা মূর্তিমান অসঙ্গতি। বাচ্চা-কাচ্চা থাকলে অনেক সময় মা-কে কাছে রাখলে সুবিধে হয়, বুড়ি মাকে দিয়ে বিনা পয়সার ন্যানি কিংবা আয়ার কাজ চালিয়ে নেওয়া যায় বেশ। কিন্তু মেমের বাচ্চারা কি এই ইংরেজি না-জানা ঠাকুমার কাছে থাকতে চাইবে। সেইজন্যই কি তিতিবিরক্ত হয়ে তাঁর লন্ডনের ছেলে মাকে এখন ক্যানাডার ভাইয়ের কাঁধে চালান করে দিচ্ছে?
ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করব কি করব না, এই নিয়ে ইতস্তত করছিলুম। কে আর সাধ করে অন্যের সমস্যা কাঁধে নিতে চায়। আগেরবার তবু আমাদের গন্তব্য ছিল আলাদা, এবার তো নামতে হবে টরেন্টোতেই একসঙ্গে।
ভদ্রমহিলা আমাকে দেখেননি, দেখলে নিশ্চয়ই ডাকতেন। আমি কিছুক্ষণ ওই দিকটা এড়িয়ে রইলুম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গল্পটা জানবার অদম্য কৌতূহলই আমাকে ঠেলে নিয়ে গেল। কী হল লন্ডনে?
কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলুম, নমস্তে, ভালো আছেন?
ভদ্রমহিলা সাদা চোখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। চিনতে পারেননি।
মুখখানা ম্লান, তবে সেই জলেপড়া ভাবটি আর নেই। এক মাসের লন্ডনের অভিজ্ঞতা ওঁকে অনেকখানি পালটে দিয়েছে মনে হয়। পোশাক অবশ্য একই রকম, শুধু আগেরবার পায়ে সস্তা রবারের চটি দেখেছিলুম, এবারে নতুন জুতো। লন্ডনের ছেলে মাকে অন্তত একজোড়া জুতো দিয়েছে।
বললুম, সেই যে আগেরবার প্লেনে দেখা হয়েছিল, তারপর আমস্টারডাম এয়ারপোর্টে…
উনি বললেন, হাঁ হাঁ।
কণ্ঠস্বরে সেরকম কোনও উৎসাহ নেই। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টে।
আবার জিগ্যেস করলুম, লন্ডনে দেখা পেয়েছিলেন আপনার ছেলের? কোনও অসুবিধা হয়নি তো?
উনি বললেন, না। ছেলে তার পায়নি। সেইজন্য হাওয়াই আড্ডায় আসেনি। ওখানে একজন দেশি লোক নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল, পরদিন ছেলের ঠিকানায় পৌঁছে দিল।
–তা লন্ডন কি আপনার ভালো লাগল না? এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন?
আগেরবারের মতন এবারে আর গল্প করার মতন কোনও উৎসাহ নেই ভদ্রমহিলার। শুধু বললেন, এবার কান্ডায় অন্য ছেলের কাছে যাচ্ছি।
সিট বেল্ট বাঁধার নির্দেশ শোনা গেল বলে আমি ফিরে এলুম নিজের জায়গায়। তবু কৌতূহল জেগে রইল। লন্ডনের মতন অচেনা শহরে এই ভারতীয় গ্রামের মহিলা প্রথম দিন প্লেন থেকে নেমে ছেলেকে দেখতে পাননি! তখন কীরকম মনের অবস্থা হয়েছিল ওঁর?
দিল্লির টেলিগ্রাম ঠিক সময়ে লন্ডনে পৌঁছয়নি। বিলেতের টেলিগ্রাম ঠিক সময় কানাডায় পৌঁছেছে তো? কানাডার ডাকব্যবস্থার ওপরেও খুব একটা ভরসা করা যায় না। ভারতের মতন এখানেও ঘনঘন ডাক ধর্মঘট হয়। চিঠি আসতে পনেরো-কুড়ি দিন লেগে যায়। টরেন্টোর ছেলে ঠিকঠাক উপস্থিত থাকবে তো? লন্ডনে যে দিশি লোকটি ওঁকে একদিনের জন্য আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই খুব দয়ালু, এখানে যদি সেরকম দয়ালু লোক না থাকে? তা ছাড়া আগেই শুনেছি, খালিস্তানের দাবিতে অনেক পাঞ্জাবি এসে টরোন্টো বিমান বন্দরে আস্তানা গেড়ে আছে, তাদের জন্য কানাডার সরকার বিব্রত। যদি ভদ্রমহিলাকে কানাডায় ঢুকতে না দেয়?
টরেন্টো থেকে বিমান বদলে আমার এডমান্টন যাওয়ার কথা। আমার ভিসা, কাস্টমস চেকিং সেখানেই হবে। ভেবেছিলুম, টরেন্টোতে নেমে কিছুক্ষণ সময় পাব, ততক্ষণ দেখে যাব ভদ্রমহিলার কোনও গতি হয় কি না।
কিন্তু টরেন্টোতে নামামাত্র ঘোষণা শুনতে পেলুম, এডমন্টনের ফ্লাইট এক্ষুনি ছাড়বে। তার জন্য যেতে হবে ইন্টারন্যাল এয়ারপোর্টে, যেটা অন্য বাড়িতে। সুতরাং ছুটতে হল সঙ্গে-সঙ্গে। পাঞ্জাবি মহিলাটির কাহিনির শেষ পরিণতি আমার জানা হল না।