দরজা খুলেই বড় ফুপু আনন্দে চিৎকার করে বললেন, “দেখে যা কারা এসেছে।”
তারপর টোটন আর তিতুনিকে জাপটে ধরে আদর করলেন, নাকে-মুখে চুমো খেলেন। যদিও বড় ফুপুর জানার কোনো উপায় নাই যে তিতুনি ভেবে যাকে ল্যাটা-প্যাটা করে চুমু খেলেন সেটা বহু দূর গ্যালাক্সি থেকে আসা একটা এলিয়েন এবং তার চুমু খাওয়াটা ছিল পৃথিবীর মানুষ দ্বারা একটা এলিয়েনকে প্রথমবার ল্যাটা-প্যাটা করে চুমু খাওয়া।
বড় ফুপুর আনন্দের চিৎকার শুনে তার ছেলে-মেয়েরা নিজেদের ঘর থেকে বের হয়ে এলো। সবাই নাদুসনুদুস, ফর্সা এবং গোলগাল, তাদের কেউই টোটন কিংবা তিতুনিকে দেখে এমন কিছু আনন্দের ভাব করল না। মুখে হালকা একটা তাচ্ছিল্যের বাঁকা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আব্বু আর আম্মু তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন, বললেন, “কী খবর তোমাদের নাদু দিলু মিলু?”
নাদু দিলু মিলু আব্বুর কথা শুনল কি না বোঝা গেল না, কারণ তারা যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। বড় ফুপুর ছেলে মেয়েদের মাঝে নাদু বড়, বয়সে টোটনের সমান কিন্তু চোখে চশমা আর মোটাসোটা বলে তাকে আরো অনেক বড় দেখায়। তার নাকের নিচে হালকা গোঁফ দেখা দিতে শুরু করেছে, গলার স্বর পরিবর্তন হচ্ছে বলে সেটাতে কন্ট্রোল নেই, তাই আজকাল বেশি কথা বলে না। দিলু দ্বিতীয় ছেলে, একেবারে তিতুনির বয়সী, চোখে চশমা, নাদুর মতোই মোটাসোটা কিন্তু সাইজে তিতুনি থেকে ছোট বলে আরো বেশি মোটা দেখায়। তিতুনি মেয়ে বলে তাকে পাত্তা না দেয়াটা টোটন আর নাদুর কাছে শিখেছে, কাজেই সেও তিতুনিকে পাত্তা দেয় না। সবচেয়ে ছোট জনের নাম মিলু, বয়স নয়, সে তিতুনিকে বেশ পছন্দই করে কিন্তু বড় দুই ভাই এবং টোটন যেহেতু সব সময় তিতুনিকে হাসি তামাশা ঠাট্টা টিটকারি করে তাই সে ধরে নিয়েছে এটাই নিয়ম। বড় দুই ভাইয়ের কারণে সে বেশি কম্পিউটার গেম খেলায় সুযোগ পায় না বলে চোখে এখনো চশমা ওঠেনি। বড় ফুপু টোটন আর অন্য তিতুনিকে ধরে ভেতরে আনলেন, আব্বু আর আম্মু পিছনে পিছনে ভেতরে ঢুকলেন। বড় ফুপু বললেন, “ওমা। দেখো, টোটন কত বড় হয়ে গেছে। তিতুনিও দেখি লম্বা হয়েছে।”
আব্বু বললেন, “বুবু, তোমার ওদের সাথে তিন মাস আগে দেখা হয়েছে-তুমি এমন ভাব করছ যে কয়েক বছর পরে দেখছ।”
ফুপু বললেন, “চিন্তা কর, পুরো তিন মাস পরে দেখছি। আর মাঝেমধ্যেই এক-দুই দিনের জন্যে দেখা আর না দেখার মাঝে কোনো পার্থক্য আছে নাকি?”
আম্মু বললেন, “আপা, আপনারাও তো মাঝে মাঝে আসতে পারেন, গ্রামে আমরা কেমন থাকি না হয় একবার দেখে আসলেন।”
বড় ফুপু বললেন, “অনেক হয়েছে। এখন আমাদের নিয়ে আর টিটকারি কোরো না। এই ঢাকা শহরে মানুষ কীভাবে থাকে মাঝে মাঝে এসে দেখে যেও।”
টোটন বলল, “না বড় ফুপু, ঢাকা শহরই ভালো। গ্রামে কোনো লাইফ নাই।”
বড় ফুপু বললেন, “থাক আমাকে আর লাইফ শিখাতে হবে না। এখন যা হাত-মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নে। একটু পরেই খেতে দেব।”
টোটন বলল, “বেশি করে খেতে দিবে তো বড় ফুপু? আমাদের তিতুনি আজকাল রাক্ষসের মতো খায়।”
তিতুনি রাক্ষসের মতো খায় কথাটা টোটন বেশ নাটকীয়ভাবে বলল আর সেটা শুনে নাদু-দিলু হি হি করে হেসে উঠল আর বড় দুই ভাইকে হি হি করে হাসতে দেখে মিলুও হাসার চেষ্টা করল। নাদু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”
টোটন বলল, “সত্যি না তো মিথ্যা নাকি? আমার কথা বিশ্বাস না করলে আম্মুকে জিজ্ঞেস করে দেখো। একদিন রাত দুইটার সময় আম্মু ঘুম থেকে উঠে দেখে তিতুনি ফ্রিজ খুলে যা পাচ্ছে তা-ই গপগপ করে খাচ্ছে। তাই না আম্মু?”
আম্মু একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “খিদে পেয়েছে তো খেয়েছে। তাতে তোর সমস্যা কী? যা এখন বিরক্ত করিস না।”
টোটন বলল, “নাদু, চলো তোমার রুমে যাই। তোমার নূতন গেমগুলি দেখি।”
মিলু বলল, “ভাইয়া যা একটা গেম–”, নাদু তখন চোখ পাকিয়ে মিলুর দিকে তাকাল আর মিলু সাথে সাথে কথা বন্ধ করে ফেলল।
.
নাদুর ঘরে টেবিলে কম্পিউটার মনিটরে একটা অর্ধসমাপ্ত কম্পিউটার গেমের দৃশ্য আটকে আছে। খুবই স্বাস্থ্যবান একজন মানুষ একটা আধা-জন্তু আধা-মানুষকে ধারালো তরবারি দিয়ে গেঁথে ফেলছে। স্ক্রিনটা দেখে টোটনের চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। মুখে লোল টানার মতো শব্দ করে বলল, “নূতন গেম?”
নাদু একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, “এইটা আর কী গেম! নূতন যে গেমটা এনেছি সেইটা খেললে তোমার কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। কিন্তু এইটা খুবই সিক্রেট। এই গেমটা আমেরিকা-জার্মানি আর ফ্রান্সে ব্যান্ড। কেউ খেললে তার এক হাজার ডলার জরিমানা।”
টোটনের চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, “সত্যি?”
“একশ’ ভাগ সত্যি। অনেক কষ্ট করে জোগাড় করেছি।”
টোটন মুখে লোল টেনে বলল, “দেখি দেখি।”
নাদু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আগে দরজা বন্ধ করতে হবে। মিলু দরজা বন্ধ কর।”
মিলু দরজা বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেল। তাদের ঘরে টোটনের সাথে তিতুনিও ঢুকেছে। তিতুনিকে কেউ তাদের খেলায় চায় না। সবাই তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল। নাদু বলল, “তিতুনি বলে দেবে।”
অন্য-তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, “বলব না।”
“খোদার কসম?”
“খোদার কসম।”
টোটন মুখ শক্ত করে বলল, “বলে দেখুক না, আমি বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিব না?”
নাদু তার কম্পিউটারের ভেতর থেকে গেমটা খুঁজে বের করে লোড করতে থাকে। দিলু অন্য-তিতুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “তিতুনি, তুমি সত্যি এখন রাত দুইটার সময় উঠে রাক্ষসের মতো খাও?”
অন্য-তিতুনি মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। খাই।”
কথাটা এত সহজে স্বীকার করে নিবে দিলু মোটেও আশা করেনি, একটু থতমত খেয়ে বলল, “কেন?”
“বেশি বেশি খেয়ে আমি তোমাদের মতো নাদুসনুদুস মোটাসোটা গোলগাল ফুটবলের মতো হতে চাই।”
সবাই চোখ পাকিয়ে তিতুনির দিক তাকাল, শুধু মিলু হি হি করে হাসতে শুরু করল, বলল, “নাদুসনুদুস মোটাসোটা গোলগাল ফুটবল, নাদুসনুদুস মোটাসোটা গোলগাল ফুটবল–”
দিলু মুখ খিঁচিয়ে মিলুর দিকে তাকিয়ে একটা ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর স্টুপিড।”
তারপর বড় ভাইয়ের কাছে নালিশ দিয়ে বলল, “দেখেছ ভাইয়া তিতুনি কী বলে?”
টোটন বলল, “তিতুনিটা সব সময় এই রকম বেয়াদবের মতো কথা বলে। একবার বাসায় নিয়ে যাই তো তারপর আচ্ছামতন সাইজ করব।”
দিলু নাক ফুলিয়ে বলল, “করবে তো সাইজ?”
“করব।”
অন্য-তিতুনি বলল, “কে কাকে সাইজ করবে দেখা যাবে।”
টোটন হুংকার দিয়ে বলল, “চুপ কর তিতুনি।”
নাদু বলল, “ছেড়ে দাও ওইসব। তোমার আব্বু-আম্মু তোমার বোনের নাম রেখেছ তিতুনি। তিতুনি মানে তিতা। তিতুনির কথা তো তিতা হবেই। যদি মিষ্টি কথা বলত তাহলে কি আর তিতুনি নাম রাখে? তাহলে নাম রাখত মিনি।”
যুক্তিটা সবারই খুব পছন্দ হলো তখন অন্য-তিতুনি ছাড়া সবাই হি হি করে দুলে দুলে হাসতে লাগল। ঠিক তখন কম্পিউটারের স্ক্রিনে একটা ভয়ংকর কম্পিউটার গেমের ছবি ভেসে ওঠে, তার সাথে বিদঘুঁটে মিউজিক। স্ক্রিনটা মুছে গিয়ে নূতন আরেকটা ছবি ভেসে আসে। নিচে অনেকগুলো মানুষের মুখ, উপরে অনেকগুলো অস্ত্র। নাদু বলল, “এই যে নিচে, এরা হচ্ছে ভিক্টিম। তুমি আগে ওদের একজনকে বেছে নিবে।” নাদু মাউস নাড়িয়ে একজন মেয়েকে বেছে নিল। সাথে সাথে স্ক্রিনে সেই মেয়েটাকে দেখা গেল। সে ভীত চোখে মাথা ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। খুবই জীবন্ত একটা দৃশ্য। নাদু হাসি হাসি মুখে বলল, “তারপর উপরের অস্ত্রগুলো থেকে টর্চারের একটা অস্ত্র বেছে নিবে। অনেক রকম অস্ত্র আছে, হকি স্টিক, চাবুক, নাম-চাক, ছোরা, চাপাতি, চায়নিজ কুড়াল। তুমি যেটা ইচ্ছা সেটা বেছে নিবে।” নাদু চাবুক বেছে নিতেই মেয়েটার সামনে একটা চাবুক ঝুলতে থাকে। মেয়েটার চোখে-মুখে ভয়টা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। সে দুই হাত তার সামনে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। নাদু বলল, “তারপর তুমি মারবে।” নাদু মাউস ক্লিক করতেই শপাং করে চাবুকটা মেয়েটার উপর আছড়ে পড়ল, আর মেয়েটা যন্ত্রণার মতো চিৎকার করে ছটফট করতে থাকে। নাদুর চোখ-মুখে একটা হিংস্র ভাব চলে আসে। সে শপাং শপাং করে স্ক্রিনের মেয়েটাকে চাবুক দিয়ে মারতে থাকে। মেয়েটা চিৎকার করতে থাকে। দেখতে দেখতে চাবুকের আঘাতে তার শরীরের কাপড় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
নাদু টোটনের দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখেছ কি রিয়েলিস্টিক?”
অন্য-তিতুনি দাঁতের ফাঁক দিয়ে বলল, “ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এই গেম মানুষ খেলে?”
মিলু একটু আশা নিয়ে তিতুনির মুখের দিকে তাকাল। সেও এই গেমটাকে মোটেও পছন্দ করে না। তার দেখতে ভয় লাগে, কান্না চলে আসে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না, তিতুনির কথা শুনে। প্রথমবার সে একটু সাহস পেল। বিড়বিড় করে বলল, “আমারও এটা ভালো লাগে না।”
নাদু ধমক দিয়ে বলল, “ভালো না লাগলে নাই। এখানে দাঁড়িয়ে ভ্যাদর-ভ্যাদর করবি না।”
অন্য-তিতুনি মুখ শক্ত করে বলল, “কেউ যদি এই গেম খেলে তাহলে তাকে পুলিশ না হয় র্যাবের হাতে ধরিয়ে দেয়া উচিত। তার মাথার চিকিৎসা করানো দরকার।”
সাহস পেয়ে মিলুও জোরে জোরে মাথা নাড়ল। টোটন মুখ খিঁচিয়ে বলল, “খবরদার বড় বড় কথা বলবি না। ভাগ এখান থেকে।” তারপর নাদুকে বলল, “আমাকে দাও, প্লিজ, আমি একটু টর্চার করি।”
নাদু মুখে অহঙ্কারের একটা ভাব এনে বলল, “পরের লেভেলটা আরো ভালো, সেখানে এসিড ছোঁড়া যায়।”
নাদু সরে টোটনকে বসার জায়গা করে দিল। টোটন মাউসটা হাতে নিয়ে শপাং শপাং করে মেয়েটাকে চাবুক দিয়ে মারতে লাগল আর ঠিক তখন খুবই বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটে গেল। হঠাৎ চাবুকটা একটা ফুলের মালায় পাল্টে গেল। আর সেটা দিয়ে মারার চেষ্টা করতেই ফুলগুলো ঝুরঝুর করে মেয়েটার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ভীত-আতঙ্কিত মেয়েটার মুখ হঠাৎ হাসি হাসি হয়ে যায় আর তার চারপাশে যখন ফুলগুলো ঝরে পড়তে থাকে তখন মেয়েটা আনন্দে খিলখিল করে হাসতে থাকে। সেটা দেখে মিলুও হাততালি দিয়ে আনন্দে খিলখিল করে হেসে উঠল।
নাদু অবাক হয়ে বলল, “এটা কী হলো?” টোটনের কাছ থেকে মাউসটা নিয়ে সে চেষ্টা করল, প্রত্যেকবারই চাবুকের বদলে একটা ফুলের মালা মেয়েটার দিকে ছুটে যাচ্ছে, সেখান থেকে ফুল ঝরে পড়ছে। শুধু তা-ই না, সাথে সাথে মিষ্টি একটা বাজনা হতে থাকে আর মেয়েটা আনন্দে খিলখিল করে হাসতে থাকে।
নাদু প্রায় খেপে যায়, হিসহিস করে বলল, “বাগ, নিশ্চয়ই একটা বাগ। কিন্তু আমি কালকেই খেলেছি, কোনো সমস্যা হয় নাই।”
টোটন বলল, “অন্য একটা অস্ত্র নাও। চাপাতি না হলে চায়নিজ কুড়াল।”
নাদু চায়নিজ কুড়াল বেছে নিল, সত্যি সত্যি এবারে কুড়াল সামনে দুলতে থাকে। কিন্তু কুড়ালটা দিয়ে আঘাত করতেই সেটা হঠাৎ করে একটা আইসক্রিম হয়ে গেল। মেয়েটা হাত বাড়িয়ে আইসক্রিমটা নিয়ে চেটে চেটে খেতে শুরু করে। শুধু যে খেতে থাকল তা-ই না, খুব পরিতৃপ্তির মতো শব্দ করতে লাগল।
নাদু প্রায় হুংকার দিয়ে বলল, “কী হচ্ছে এটা?”
সে আবার আঘাত করার চেষ্টা করতেই আরেকটা আইসক্রিম বের হয়ে আসে। মেয়েটা দ্বিগুণ উৎসাহে সেটাও আরেক হাতে নিয়ে নেয় আর মহানন্দে খেতে থাকে।
মিলু আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল, “আমি খেলব। আমি খেলব।”
নাদু গর্জন করে বলল, “চুপ কর পাজি মেয়ে। আমার এত সুন্দর গেমটার বারোটা বেজে গেছে আর সে খেলবে।”
নাদু অস্ত্র হিসেবে ধারালো চাপাতি বেছে নিল, সেটা প্রথমে ঠিকই একটা চাপাতি থাকলেও সেটা দিয়ে কোপ দেওয়া মাত্র সেটা এক স্লাইস চকোলেট কেক হয়ে গেল। মেয়েটা হাত বাড়িয়ে কেকটা নিয়ে খেতে থাকে। শুধু যে খেতে থাকে তা-ই নয়, হাত-পা দুলিয়ে নাচতে থাকে এবং মনে হলো একসময় নাদুর দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপে দিল।
অন্য-তিতুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “এইবার গেমটা ঠিক আছে। খুবই সুইট গেম।”
মিলু লাফাতে লাফাতে বলল, “আমি খেলব। আমি খেলব।”
নাদু ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর।”
টোটন বলল, “এটা কেমন করে হচ্ছে?”
শুধু অন্য-তিতুনিই জানে এটা কেমন করে হচ্ছে কিন্তু সে কাউকে বুঝতে দিল না, বলল, “ভাইরাস। কম্পিউটার ভাইরাস। তাই না নাদু ভাইয়া?”
নাদু মেঘস্বরে বলল, “যেটা জানো না সেটা নিয়ে কথা বলো না। কম্পিউটার ভাইরাস একটা প্রোগ্রামকে অন্য কিছু করে দিতে পারে। এটা খালি নষ্ট করে দিতে পারে, না হলে বন্ধ করে দিতে পারে।”
অন্য-তিতুনি বলল, “তাহলে কম্পিউটার ব্যাক্টেরিয়া।”
নাদু বলল, “কম্পিউটার ব্যাক্টেরিয়া বলে কিছু নাই। বোকার মতো কথা বলো না।”
অন্য-তিতুনি ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, “বোকাঁদের সাথে বোকাঁদের মতো কথা না বললে কেমন করে হবে!”
ঠিক তখন ঘরের দরজায় বড় ফুপু ধাক্কা দিলেন, বললেন, “কী হলো? দরজা বন্ধ করে তোরা কী করছিস? বের হয়ে আয়, টেবিলে খাবার দিয়েছি।”
তিতুনি দরজা খুলে বের হয়ে এলো, তার হাত ধরে মিলুও বের হয়ে গেল। ঘরের ভেতর টোটন, নাদু আর দিলু। নাদু বলল, “টোটন, তোমার এই বোনটা খুবই জ্বালাতন করে।”
টোটন বলল, “একবার বাসায় নিয়ে নিই তখন টাইট করে ছেড়ে দেব।”
“বাসাতে নিয়ে না, এইখানেই একবার টাইট করা দরকার। কী সাহস, আমাকে বোকা বলে। আমাদের ক্লাশে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধি আমার। গত সপ্তাহেই আমি ফারজানাকে মার খাইয়েছি।”
টোটন জিজ্ঞেস করল, “ফারজানা কে?”
“আমাদের ক্লাশের একটা মেয়ে। হেভি নেকু। আমি নেকু মেয়েদের দুই চোখে দেখতে পারি না।”
টোটন বলল, “আমি মেয়েদেরকেই দেখতে পারি না।”
দিলু এক টিমে থাকার জন্যে বলল, “আমিও।”
নাদু বলল, “আজকে খাবার টেবিলে একবার টাইট দেই।”
“কীভাবে?”
নাদু কয়েক সেকেন্ড মুখ সুচালো করে চিন্তা করল তারপর বলল, “খাবার সময় তিতুনির প্লেটে এক খাবলা লবণ ঢেলে দিই। নাম যেহেতু তিতুনি, একটু তিতা খাবার খেয়ে দেখুক।”
দিলু মাথা নাড়ল, বলল, “খেয়ে দেখুক।”
টোটন জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে লবণ দেবে?”
“আমার উপর ছেড়ে দাও, আমি এটার এক্সপার্ট। এর আগেরবার একটা বিয়ের দাওয়াতে করেছিলাম।”
“কার প্লেটে করেছিলে?”
“চিনি না, আমার পাশে বসেছিল, বেকুব টাইপের একটা ছেলে।”
“কীভাবে করো?”
“খুব সোজা। প্লেটের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে কিছু একটা নেওয়ার ভান করি, তখন অন্য হাতের তলা দিয়ে লবণটা ঢেলে দিই। এই যে এইভাবে–”, নাদু করে দেখাল, এবং পদ্ধতিটা দেখে টোটন মুগ্ধ হলো। নাদুর কাছে তার অনেক কিছু শেখার আছে।
নাদু বলল, “শুধু একটা জিনিস দরকার, ঠিক পাশে বসা দরকার।”
.
খাবার টেবিলে কায়দা করে নাদু তিতুনির পাশে বসে গেল। অন্য পাশে টোটন, দুই পাশে দুইজন বসেছে প্লেটে লবণ ঢেলে দেওয়া আজকে কঠিন হওয়ার কথা না।
বড় ফুপু সবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন, কথা বলতে বলতে সবাই খাচ্ছে। বড় ফুপু খুব ভালো রাঁধতে পারেন, আজকে সবাই আছে বলে অনেক কিছু বেঁধেছেন। আম্মু খেতে খেতে বড় ফুপুকে বললেন, “আপা, আপনার হাতে জাদু আছে, তা না হলে এত মজার খাবার রাঁধেন কেমন করে?”
বড় ফুপু বললেন, “জাদু না ছাই। তাড়াহুড়ো করে কী বেঁধেছি কী হয়েছে কিছুই জানি না।”
আম্মু বললেন, “খুব ভালো হয়েছে আপা। অসাধারণ।”
আব্বু বললেন, “আসলে বুবুর কোনো ক্রেডিট নাই। এটা আমাদের বংশের ধারা। আমাদের দাদা নাকি পীর ছিলেন। দোয়া করে দিয়েছিলেন এই বংশের সব মেয়ের হাতে জাদু থাকবে, যেটাই রান্না করবে সেটাই হবে অসাধারণ।“
যখন বড়দের এ রকম কথা চলছে ঠিক তখন নাদু অন্য-তিতুনির প্লেটের উপর বাম হাত দিয়ে আচারের বোতলটা নেয়ার ভান করতে করতে করতে ডান হাতে ঢেলে নেয়া এক খাবলা লবণ তিতুনির প্লেটে ঢেলে দিল। নিখুঁত কাজ। নিজের কাজ দেখে নাদু নিজেই মুগ্ধ হয়ে যায়।
তিতুনি প্লেট থেকে তার খাবার নিয়ে মুখে দিল। নাদু, দিলু আর টোটন চোখের কোনা দিয়ে তিতুনির দিকে তাকিয়ে আছে, এক মুহূর্তের জন্যে অন্য-তিতুনির ভুরু একটু কুঁচকে উঠে তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়, সে তৃপ্তি করে খেতে থাকে। লবণের জন্যে খেতে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হলো না।
একটু অবাক হয়ে টোটন তার খাবার মুখে দিয়েই চমকে উঠল, তার খাবারের মাঝে এক গাদা লবণ। যেটুকু মুখে দিয়েছে সেটা বের করতেও পারছে না আবার খেতেও পারছে না। নাদু তিতুনির প্লেটে এক খাবলা লবণ দিতে গিয়ে তার প্লেটে দিয়ে দিয়েছে? কী সর্বনাশ! কেমন করে এটা ঘটল? এখন সে কী করবে? টোটন খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকে। লবণের তেতো স্বাদ মুখ থেকে ধীরে ধীরে গলার দিকে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে ওয়াক করে বমি করে দেবে।
অন্য-তিতুনি তৃপ্তি করে খেতে খেতে টোটনের দিকে তাকাল। বলল, “ভাইয়া তুমি খাচ্ছ না কেন?”
টোটন মুখে খাবার নিয়ে কোনোমতে বলল, “খাচ্ছি তো। খাচ্ছি।” তারপর মুখে যেটা ঢুকিয়েছিল সেটা কোনোমতে কোঁৎ করে গিলে নিল, তার মনে হলো পুরোটা এক্ষুনি উগড়ে দেবে।
নাদু একটু অবাক হয়ে একবার তিতুনির দিকে তাকাল। ইতস্তত করে বলল, “তিতুনি, খাবার ঠিক আছে?”
অন্য-তিতুনি বলল, “একেবারে ফার্স্ট ক্লাশ। আজকেও আমি রাক্ষসের মতো খাব। একদিনে মোটা হয়ে যাব।”
টোটন একধরনের আতঙ্ক নিয়ে তার প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে, খাবার মুখে দিচ্ছে না। আম্মু বললেন, “কী হলো টোটন, খাচ্ছিস কেন?”
“কে বলেছে খাচ্ছি না। খাচ্ছি তো!” বলে সে হাত দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করতে থাকে।
বড় ফুপু বললেন, “খাবার মজা লাগছে না?”
টোটন বলল, “লাগছে। লাগছে। অনেক মজা।” তারপর ভয়ে ভয়ে মুখে একটু খাবার নিয়ে মুখ বিকৃত করে বসে থাকে।
নাদু টোটনকে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
টোটন বলল, “আমাকে বড় ফুপু বেশি দিয়ে দিয়েছে। তুমি আমার কাছ থেকে একটু নাও।” বলে নাদু কিছু বলার আগেই নিজের প্লেট থেকে প্রায় পুরোটাই নাদুর প্লেটে ঢেলে দিল। নাদু কিছুক্ষণ অবাক হয়ে একবার টোটনের দিকে আরেকবার নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সাবধানে একটু মুখে দিয়ে মুখ বিকৃত করে ফেলল। অন্য-তিতুনি যখন খুব তৃপ্তি করে খাওয়া শেষ করল তখন টোটন আর নাদু দুইজনই একধরনের আতঙ্ক নিয়ে তাদের প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে। দুইজনের কেউই ধরতে পারল না যে খাবারে যেটুকু তেতো ভাব এসেছে সেটা সাধারণ লবণের তেতো না, সেটা অন্য রকম ভয়ংকর তেতো।
.
খাওয়া শেষে নাদুর ঘরে টোটনের সাথে নাদুর একটা বড় ধরনের ঝগড়া হয়ে গেল। টোটন বলল, “তোমার লবণ দেয়ার কথা ছিল তিতুনির প্লেটে, আমার প্লেটে কেন দিয়েছ?”
নাদু খানিকক্ষণ মাথা চুলকে বলল, “বুঝতে পারলাম না। আমি তো ভেবেছিলাম আমি তিতুনির প্লেটেই দিয়েছি।”
“না, তুমি দেও নাই। তুমি দিয়েছ আমার প্লেটে–”
নাদু গরম হয়ে বলল, “ঠিক আছে আমি না হয় ভুল করে তোমার প্লেটে দিলাম, তুমি কেন সেটা আমার প্লেটে ঢেলেছ? আমার খাওয়া কেন নষ্ট করেছ?”
“তুমি আমার খাওয়া নষ্ট করতে পারো আর আমি তোমার খাওয়া নষ্ট করতে পারব না?”
ঝগড়া আরো ডালপালা ছড়িয়ে আরো অগ্রসর হতে পারত কিন্তু ঠিক তখন অন্য-তিতুনি আর মিলু ঘরে ঢুকল বলে দুজনে থেমে গেল। টোটন এবং নাদু এই দুজনের কারোই জানার কোনো উপায় ছিল না তাদের কোনো কিছুই এই তিতুনির কাছে গোপন নেই। সে মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে নিউরনের সিনাক্স কানেকশন ওলটপালট করে দিতে পারে। তার কাছে একটা প্লেটের লবণ অন্য প্লেটে পাঠানো কোনো ব্যাপারই না। সেই লবণকে একশ গুণ বেশি তেতো করে দেয়াও তার কাছে পানির মতো সহজ।