০৯. দরজাটা ধাক্কা দিতেই

দরজাটা ধাক্কা দিতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল। ঘরের ভেতরে ভ্যাপ। এক ধরনের গন্ধ। আবছা অন্ধকারে দেখা যায় সারি সারি তাক, সেই তাকের উপর অসংখ্য বই। বইগুলো অযত্নে পড়ে আছে, ধূলায় ধূসর।

রুহান একটু এগিয়ে গিয়ে একটা বই টেনে নেয়। পৃষ্ঠা খুলে কী নে? আছে পড়ার চেষ্টা করে, মাছ যেমন করে পানি থেকে অক্সিজেন নেয় সেখানে। তার একটা ব্যাখ্যা লেখা রয়েছে। রিদি একটু অবাক হয়ে রুহানের দি তাকিয়েছিল, জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করছ?

বইয়ে কী লেখা আছে সেটা পড়ার চেষ্টা করছি।

রিদি বিস্ফারিত চোখে বলল, কী বললে? পড়ার চেষ্টা করছ?

হ্যাঁ।

তুমি পড়তে পার?

খুব ভাল পারি না। শিখছি।

রিদি ভুরু কুঁচকে বলল, এত কাজ থাকতে তুমি পড়া শিখছ কেন? এটা যেন অনেকটা অনেকটা–

রুহান মুখে হাসি টেনে বলল, অনেকটা কী?

অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে শেখার মতো। তুমি যখন দুই পায়ে হাঁটতে পারো তখন হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে শেখার চেষ্টা করবে কেন? ক্রিস্টাল রিডার দিয়ে সব রকম তথ্য বিনিময় করা যায় তখন কাগজে বর্ণমালা লিখে তথ্য বিনিময় করতে চাইছ কেন?

রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না। তবে—

তবে কী?

আমার কী মনে হয় জান?

কী?

রুহান বলল, আমার মনে হয় কিছুদিন পর আমাদের কাছে আর ক্রিস্টাল রিডার থাকবে না। পৃথিবীতে এত মারামারি কাটাকাটি হচ্ছে যে নতুন করে কেউ ক্রিস্টাল রিডার বানাতেও পারবে না। তখন কী হবে জান?

রিদি কেমন যেন বিচিত্র দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। খানিক্ষণ পর বলল, তুমি সত্যিই এটা মনে করো?

রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমি মনে করি। শুধু যে ক্রিস্টাল রিডার থাকবে নাম তা না। অস্ত্র থাকবে না। গাড়ি থাকবে না। কাপড় থাকবে না। খাবার থাকবে না!

কী বলছ তুমি?

আমি ঠিকই বলছি। রুহানের মুখটা অকারণেই গম্ভীর হয়ে যায়। সে থেমে থেমে বলল, আমাদের খুব দুর্ভাগ্য আমরা পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়ে জন্মেছি। যখন সবকিছু ধ্বংস হচ্ছে। চারপাশে সবাই ডাকাত। জ্ঞান-বিজ্ঞান নেই লেখাপড়া নেই–

রিদি বাধা দিয়ে বলল, সে কী! তুমি দেখি বুড়ো মানুষদের মতো কথা বলতে শুরু করেছ।

রুহান হেসে বলল, ঠিকই বলেছ। আমি মনে হয় বুড়ো হয়ে গেছি। কিন্তু কথাগুলো তুমি খুব ভুল বলে নি।

রুহানের চোখ কেমন জানি চকচক করে ওঠে, সে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমি তো ইতিহাস খুব বেশি জানি না কিন্তু যেটুকু জানি সেখানে কী দেখেছি জান?

কী দেখেছ?

যখন মানুষের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায় তখন তারা আবার মাথা সোজা করে দাঁড়ায়। এখানেও নিশ্চয়ই দাঁড়াবে। যখন দাঁড়াবে তখন তো আবার জ্ঞান চর্চা করতে হবে। জানতে হবে, শিখতে হবে–তখন যদি ক্রিস্টাল রিডার না থাকে তখন তারা এই বই থেকে পড়বে।

রিদি কয়েক মুহূর্ত রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর হঠাৎ শব্দ করে হাসতে শুরু করল।

রুহান ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি বোকার মতো হাসছ কেন?

রিদি কষ্ট করে হাসি থামিয়ে বলল, তুমি বোকার মতো কথা বললে দোষ নাই কিন্তু আমি বোকার মতো হাসলে দোষ?

আমি কখন বোকার মতো কথা বলেছি?

রুহান মুখ শক্ত করে বলল, আমি বলি নি এই ঘরের এই পোকা খাওয়া বইগুলো পড়বে।

তাহলে কী বলেছ?

বলেছি দরকার হলে এই রকম বই পড়বে। ক্রিস্টালে যেরকম তথ্য রাখা যায় সেরকম বইয়েও তথ্য রাখা যায়। ক্রিস্টাল রিডার যদি না থাকে তাহলে বইয়ের তথ্য দিয়ে কাজ চালানো যাবে। সবাইকে আবার বর্ণমালা শিখতে হবে–

রিদি আবার হাসতে শুরু করল। রুহান চোখ পাকিয়ে বলল, তুমি আবা। বোকার মতো হাসছ কেন?

তোমার কথা শুনে। আমি এবারে কোন কথাটা হাসির কথা বলেছি?

এই যে বলছ সবাইকে বর্ণমালা শিখতে হবে। তারপর বলবে সবাই গাছের বাকল পরে থাকতে হবে। গুহার ভেতরে কাঁচা মাংস আগুনে ঝলসে খেতে হবে–বিবর্তনে বানর থেকে যেরকম মানুষ হয়েছে, সেরকম আবার উল্টো বিবর্তনে আমরা সবাই মানুষ থেকে বানর হয়ে যাব। আমাদের সবার ছোট ছোট লেজ গজিয়ে যাবে!

এবারে রুহানও হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে বলল, তোমার সাথে কথা বলার কোনো অর্থ নেই। তুমি কোনো কিছুকে গুরুত্ব দাও না।

রিদি রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো ভবিষ্যতে অনেকদূর তাকাতে পার তাই সবকিছুকে গুরুত্ব দিতে পার। আমার সমস্যাটা কী জান?

কী?

আমি একদিন একদিন করে বেঁচে থাকি। তাই কোনো কিছুকে গুরুত্ব দিতে পারি না।

রুহান কিছুক্ষণ রিদির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমারও কী মনে হয় জান?

কী?

তুমি খুব একটা অদ্ভুত মানুষ।

রিদি চোখ বড় বড় করে বলল, কী আশ্চর্য! আমার ঠিক তাই মনে হচ্ছিল।

ঠিক কী মনে হচ্ছিল?

যে তুমি খুব আজব একজন মানুষ।

ঠিক কী কারণ জানা নেই হঠাৎ করে দুজনেই অকারণে হেসে ওঠে। পুরনো বিধ্বস্ত একটা ঘরে আবছা অন্ধকারে ধূলি ধূসরিত বইয়ের স্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা দুইজনের হাসির শব্দটি অত্যন্ত বিচিত্র শোনায়।

 

দুপুরবেলা একটা ছোট খাবার দোকানে রিদি আর রুহান এক বাটি গরম স্যুপের শুকনো রুটি চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে, তখন রুহান প্রথমে বিষয়টা লক্ষ করল। তাদের টেবিল থেকে দুই টেবিল দূরে বসে থাকা একজন মানুষ তাদের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। রুহানের সাথে চোখাচোখি হওয়া মাত্রই মানুষটি চোখ সরিয়ে নিল। রুহান চোখের কোনা দিয়ে মানুষটাকে লক্ষ্য করে, খাওয়া শেষ না করেই মানুষটি উঠে গেল। সম্ভবত তাদের চিনে ফেলেছে—এত বড় একটা কাণ্ড করে এসেছে তাদের পরিচয়টা কেউ জানবে না সেটা তো হতে শারে না। আগে হোক পরে হোক এটা জানাজানি হবেই।

রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে রিদিকে বলল, রিদি আমাদের পরিচয় কিন্তু এখানে জানাজানি হয়ে যাবে।

রিদি বলল, এখনও হয়নি সেটাই আশ্চর্য।

একটা মানুষ খুব সন্দেহজনক ভাবে উঠে গেল।

আবার ফিরে না আসা পর্যন্ত খেতে থাক। হালকা অস্ত্রটা খুলে রাখা যাক। দরকার হলে ব্যবহার করা যাবে।

রুহান বলল, যদি আমাদের পরিচয় জেনে থাকে তাহলে কিছু করার আগে অনেকবার চিন্তা করবে।

তা ঠিক।

রুহান চোখের কোনা দিয়ে চারদিকে এক নজর দেখে বলল, আমি এভাবে থাকতে পারব না।

কীভাবে থাকতে পারবে না?

এই যে সবসময় সতর্ক হয়ে, চোখ কান খোলা রেখে একটা হাত ট্রিগারের পর রেখে।

রিদি হেসে বলল, এখন বেঁচে থাকার এটাই হচ্ছে নিয়ম।

আমি এভাবে বেঁচে থাকতে চাই না।

তাহলে তুমি কীভাবে বেঁচে থাকতে চাও?

আমি আমার গ্রামে ফিরে যেতে চাই। সেখানে থাকতে চাই।

তোমার গ্রামে কে আছে রুহান?

আমার মা। আমার ছোট দুটি বোন। নুবা আর ত্রিনা।

রিদি কিছু না বলে কিছুক্ষণ রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রুহান জিজ্ঞেস। করল, তোমার কে আছে রিদি?

আমার কেউ নেই।

কেউ নেই?

না।

কেন নেই সেটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে রুহান থেমে গেল। সে নিজে থে যদি বলতে না চায় তাহলে হয়তো জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। রুহান বল, তাহলে তুমিও চল আমার সাথে। আমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর, তোমার ভালো লাগবে।

রিদি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রুহা। বলল, সারা পৃথিবীর সবাই বলছে যার জোর বেশি সে যেটা বলবে সেটাই হচ্ছে নিয়ম। মানুষ আর পশুর মধ্যে এখন কোনো পার্থক্য নেই। আমরা বলল সেটা ভুল। আমাদের গ্রাম দিয়ে সেটা শুরু করব। ছোট একটা স্কুল বানাব। ছেলে-মেয়েরা সেখানে পড়বে। ক্রিস্টাল রিডার না থাকলে আমরা বর্ণমা! শেখাব, বই বানাব, বই পড়াব। আবার জ্ঞান চর্চা শুরু করব। একজন মানুষ আরেকজনকে ভালোবাসবে-

রুহান হঠাৎ থেমে গেল। রিদি জিজ্ঞেস করল, কী হলো? শুনতে তো ভালোই লাগছিল, থামলে কেন?

ঐ লোকটা ফিরে এসেছে সাথে আরো দুইজন। একজন পুরুষ অন্য মহিলা।

রিদির শরীরটা একটু শক্ত হয়ে যায়। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, কী করতে ওরা?

কিছু করছে না, দেখছে। আমাদের দেখছে।

রুহান আর রিদি নিঃশব্দে বসে থাকে। মানুষগুলো কিছুক্ষণ তাদের দেখে আবার বের হয়ে গেল। রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ভালো লাগে না। আমার একেবারেই ভালো লাগে না। এভাবে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই।

রিদি কিছু না বলে নিঃশব্দে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল।

 

সন্ধ্যেবেলা দুজন আবার বের হয়েছে। গান বাজনার বিকট সুর থেকে সরে গিয়ে তারা মূল বাজারটার দিকে এগিয়ে যায় উজ্জ্বল আলোতে বিচিত্র পোশাক পরা মানুষজন হাঁটাহাঁটি করছে, জিনিসপত্র দরদাম করছে কিনছে। এখানে এলে ঠাৎ করে মনে হয় পৃথিবীতে বুঝি কোনো সমস্যা নেই।

হাঁটতে হাঁটতে সামনে একটু ভিড় দেখে দুজনে এগিয়ে যায়, একটা খাঁচার ভেতরে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে। পাশে একটা ছোট মঞ্চ, সেখানে একজন কিশোর দাঁড়িয়ে আছে। কিশোরটি এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, দেখে মনে হয় তার চারপাশে কী ঘটছে সে বুঝতে পারছে না। কিশোরটির পাশে একজন মানুষ হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে কথা বলছে।

রুহান এবং রিদি শুনল, মানুষটি বলছে, এর নাম কিসি। কিসির বয়স বারো কিন্তু তোমরা দেখতে পাচ্ছ তার বাড়ন্ত শরীর। একদিন সে যে একজন হাট্টাকাট্টা জোয়ান হবে সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা আমাদের নিজস্ব ডাক্তার দিয়ে কিসিকে পরীক্ষা করিয়েছি। কিসি একেবারে সুস্থ। সবল এবং নিরোগ তার শরীরে কোনো রোগ-জীবাণু নেই। কিসির পরিরারের জিনিসপত্র আমাদের কাছে আছে, ডি.এন.এ প্রোফাইলও আছে, ইচ্ছা করলে তোমরা দেখতে পার।

মানুষটি দম নেবার জন্যে একটু থামল, তখন রুহান আর রিদি বুঝতে পরল এখানে মানুষ বেচা-কেনা হচ্ছে। তারা আগে কখনো এটি দেখে নি, দুজনেই এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে যায়। মানুষটি মাইক্রোফোনটা গুখের কাছে নিয়ে আবার কথা বলতে শুরু করে, এই ছেলেটাকে আমরা এনেছি দক্ষিণের অঞ্চল থেকে। অনেক কষ্ট করে আনতে হয়েছে, তোমরা জান সারা পৃথিবীতে মারামারি কাটাকাটি চলছে। এর মধ্যে মানুষ ধরে আনা সোজা কথা না। যেভাবে চলছে তাতে মনে হচ্ছে কিছুদিন পর সাধারণ মানুষ আর মানুষের বাজারে হাত দিতে পারবে না, দাম কমপক্ষে তিন-চার গুণ বেড়ে যাবে। এখনই সময় আমি অনেক কম দামে ছেড়ে দিচ্ছি, এই বাড়ন্ত কিশোরটি মাত্র দুই ইজার ইউনিট!

পাশে থেকে একজন বলল, দুই হাজার ইউনিট কী মাত্র হলো নাকি? এই দমে একটা গাড়ি কেনা যায়।

মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা বলল, গাড়ি আর মানুষ কী এক জিনিস? আস্ত একটা মানুষ পেয়ে যাচ্ছ। যদি এর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খোলা বাজারে বিক্রি করো তাহলে কত দাম পাবে জান? আজকাল ভালো একটা হৃৎপিণ্ডই পাঁচশো ইউনিটের কমে পাওয়া যায় না। হৃৎপিণ্ড ছাড়া আছে কিডনি, লিভার, লাংস। চোখের কর্ণিয়া, ব্রেন আর রক্ত। একেবারে ফ্রেশ রক্ত। তুমি যদি মানুষটাকে সারা জীবন পালতে না চাও কেটেকুটে বিক্রি করে দিতে পারো। তাতে লাভ হবে আরো বেশি। কিনবে কেউ?

বুড়ো মতো একজন মানুষ বলল, ধুর! পোলাপান দিয়ে কী করব? মেয়েমানুষ থাকলে দেখাও।

মেয়েমানুষ? মেয়েমানুষ থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে। আমাদে৷ কোম্পানির আসল বিজনেস হচ্ছে মেয়েমানুষের বিজনেস। আমাদের নেটওয়াএকেবারে গভীর গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। সারা দেশ খুঁজে আমরা সুন্দর মেয়েমানুষ ধরে আনি।

মানুষটি খাঁচা খুলে কিসি নামের কিশোরটাকে ভিতরে ঠেলে দিয়ে এ মেয়েকে হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। মেয়েটার ভাবলেশহীন মুখ। চোখে মুখে এক ধরনের বিচিত্র কাঠিন্য। মাথায় এলোমেলো চুল, শরীরে কাপড় অবিন্যস্ত। মানুষটা মেয়েটির চারপাশে ঘুরে মুখে একধরনের পরিতৃপ্তি শব্দ করে বলল, এই মেয়েটার নাম ক্রিটিনা। মেয়েটার শরীরটা একবার ভালো করে দেখ! দেখলেই জিবে পানি চলে আসে।

মানুষটার কথা শুনে উপস্থিত অনেকেই শব্দ করে হেসে উঠল। উৎসাহ পেয়ে মানুষটা বলল, একেবারে গহীন একটা গ্রাম থেকে ধরে এনেছি, যেভ। এনেছি ঠিক সেইভাবে তোমাদের সামনে হাজির করেছি। তোমরা কল্পনা করা। নাও যখন এই মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে আনবে তখন তাকে দেখতে কেমন লাগবে। মনে হবে একেবারে আগুনের খাপরা।

মানুষটি একটু দম নিয়ে বলল, এই আগুনের খাপরার বয়স উনিশ। পরিরারের কাগজপত্র, ডি.এন.এ প্রোফাইল সবকিছু তৈরি আছে। ইচ্ছে করলে দেখতে পার। ডাক্তারী পরীক্ষা হয়েছে, একেবারে সুস্থ সবল নিরোগ। অনে কষ্ট করে অনেক দূর থেকে এনেছি তাই দাম একটু বেশি কিন্তু এই জিনিস কম দামে পাবে না।

বুড়ো মানুষটা মুখের লোল টেনে বলল, কত দাম?

পাঁচ হাজার ইউনিট।

পাঁচ হাজার? বুড়ো মানুষটা প্রায় আর্তনাদ করে বলল, পাঁচ হাজার ইউনিট কী ছেলেখেলা নাকি?

মাইক্রোফোন হাতে মানুষটা বলল, আমি কী বলেছি এটা ছেলেখেলা? ভালো জিনিস চাইলে তার দাম দিতে হয়। বুঝেছ?

বুড়ো মানুষটা বলল, আমাকে আগে ভালো করে দেখতে দাও।

দেখ দেখ, যত খুশি দেখ। এর মধ্যে কোনো ভেজাল নেই।

বুড়ো মানুষটি মঞ্চে উঠে মেয়েটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তারপর সন্তুষ্টির মতো একটা শব্দ করে পকেট থেকে ইউনিটের বান্ডিল বের করে গুনে গুনে দিতে থাকে।

রুহান মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ মুখে কী গভীর একটা বিষাদের ছাপ। চোখ থেকে নেমে আসা পানি গালের উপর শুকিয়ে রয়েছে। বড় বড় চোখে এক ধরনের অবর্ণনীয় অবিশ্বাস নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে এক গভীর হতাশা।

বুড়ো মানুষটা তার ইউনিটগুলো মাইক্রোফোন হাতের মানুষটাকে ধরিয়ে দিয়ে মেয়েটার হাত ধরে টেনে আনতে শুরু করে। কী করছে বুঝতে না পেরেই রুহান হঠাৎ গলা উঁচিয়ে বলল, এই যে বুড়ো, তুমি দাঁড়াও।

বুড়ো মানুষটি দাঁড়িয়ে গেল, তার মুখে ক্রোধের একটা ছায়া পড়ে। সে কঠিন চোখে ভিড়ের মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কে তার সাথে এই অশোভন গলায় কথা বলছে। মানুষটা রুহান সেটা আবিষ্কার করে বুড়ো মানুষটা কেমন যেন থিতিয়ে যায়–তার সারা শরীর ঝুলে থাকা অস্ত্রগুলোই যে এর কারণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে শুকনো গলায় বলল,  হয়েছে?

তুমি মেয়েটাকে ছেড়ে দাও।

ছেড়ে দেব? কষ্ট করেও বুড়ো তার গলায় ঝাঁঝটুকু লুকাতে পারে না, কেন ছেড়ে দেব?

রিদি হতাশ একটা ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, রুহান এখন কী করবে সে জানে না। যেটাই করুক তাকে তার সাথে থাকতে হবে। মনে হচ্ছে এটা তার ভবিতব্য–রুহান কিছু একটা করে বসবে আর তাকে সেটা সামাল দিতে হবে। রিদি সতর্ক ভঙ্গিতে পিছন থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তুলে নেয় এবং সেটা উপস্থিত কারো দৃষ্টি এড়াল না।

রুহান হেঁটে হেঁটে ছোট মঞ্চটার উপরে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, মানুষ বেচাকেনা করা যায় না।

বুড়ো মানুষটার চোখে মুখে জ্বালা ধরানো এক ধরনের বিতৃষ্ণার ছাপ পড়ল। সে মাথা ঘুরিয়ে মাইক্রোফোন হাতে মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, কী বলছে এই মানুষ?

মাইক্রোফোন হাতের মানুষটা একটু এগিয়ে এসে বলল, তুমি এই মেয়েটাকে নিতে চাইছিলে? এটা তো বিক্রি হয়ে গেছে। তুমি চিন্তা করো না আমার কাছে আরও আছে। এই দেখ আমার সাপ্লাই-

রুহান মাথা নেড়ে বলল, উঁহু। আমি মোটেও সেটা বলি নাই। আমিক বলেছি মানুষ বেচা-কেনা বন্ধ।

বন্ধ?

হ্যাঁ। বন্ধ।

কবে থেকে?

অনেকদিন থেকে। মানুষ আগে যখন অসভ্য আর জংলী ছিল তখন একজন মানুষ আরেকজনকে বিক্রি করত। এখন মানুষ সভ্য হয়েছে এখন তারা মানুষ বিক্রি করে না।

মাইক্রোফোন হাতের মানুষটিকে এবারে পুরোপুরি বিভ্রান্ত দেখায়। সে আমতা আমতা করে বলল, দেখ। তুমি নিশ্চয়ই এখানে নতুন এসেছে! এখন বাজারে নিয়মিত মানুষ, মেয়েমানুষ, বাচ্চা-কাচ্চা বিক্রি হয়। বিশাল ব্যবসা। আমি অনেকদিন থেকে করছি–

রুহান তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, ভুল করছিলে। আর করবে না। সে খাঁচার ভেতরে আটকে থাকা মানুষগুলো দেখিয়ে বলল, এদে সবাইকে ছেড়ে দাও।

মাইক্রোফোন হাতের মানুষটির চোখে মুখে এবারে একটা ক্রোধের চিহ্ন ফুটে ওঠে, সে কঠিন চোখে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কে আমি জানি না। তুমি কী জন্যে এটা করছ সেটাও আমি জানি না। আমি বলছি, তুমি এখান থেকে যাও। আমার এই ব্যবসা আমি এমনি এমনি করি না। আমার গার্ডদের ডাকলে তোমার কপালে দুঃখ আছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

তাহলে তুমি বলছ মানুষ বেচা-কেনা করা যায়?

অবশ্যই করা যায়। এই লাল পাহাড় হচ্ছে মুক্তাঞ্চল। যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো জিনিস এনে এখানে বিক্রি করা যায়। এটা হচ্ছে মুক্তাঞ্চলের অলিখিত আইন।

ভারি মজা তো।

মাইক্রোফোন হাতের মানুষটি বলল, মজা?

হ্যাঁ। তার মানে আমিও ইচ্ছে করলে মানুষকে বিক্রি করতে পারব?

অবশ্যই পারবে।

ঠিক আছে, আমি তাহলে চেষ্টা করে দেখি। বলে সে খপ করে মানুষটির কলার ধরে কাছে টেনে এনে তার হাত থেকে মাইক্রোফোনটা কেড়ে নেয়। এক হাতে মানুষটাকে ধরে রেখে অন্য হাতে মাইক্রোফোনটা মুখের সামনে ধরে সে বলল, তোমাদের কাছে বুড়া হাবড়া অপদার্থ একটা মানুষ বিক্রি করতে চাই। কথা বেশি বলে এ ছাড়া এর আর কোনো সমস্যা নেই। কে কিনতে চাও?

উপস্থিত মানুষদের ভেতর থেকে একজন কৌতুকপ্রিয় মহিলা জিজ্ঞেস করল, কত দাম?

খুব সস্তায় ছেড়ে দিচ্ছি। দাম মাত্র এক ইউনিট।

উপস্থিত মানুষগুলোর ভেতরে একটা হাসির রোল উঠল। মহিলাটি বলল, এত সস্তা হলে এক ডজন কিনতে চাই।

আমার কাছে এক ডজন নেই, একটাই আছে। এরকম অপদার্থ মানুষ ডজন ডজন তৈরি হয় না।

দাও তাহলে- মহিলাটি সত্যি সত্যি তার ব্যাগ খুলে ইউনিট বের করতে শুরু করে।

রুহান কলার ধরে রাখা মানুষটাকে বলল, দিই তোমাকে বিক্রি করে?

কী করছ তুমি বুঝতে পারছ না? মানুষটি ক্রুদ্ধ গলায় বলল, সবকিছু নিয়ে তামাশা করা যায় না।

আমি মোটেও তামাশা করছি না। রুহান ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুমি যদি জোর করে ধরে এনে মানুষ বিক্রি করতে পার তাহলে আমি কেন জোর করে ধরে তোমাকে বিক্রি করতে পারব না?

মানুষটি চট করে এই যুক্তিটার উত্তরে কিছু বলতে পারল না। খানিক্ষণ আমতা আমতা করে বলল, তুমি এরকম পাগলামী করতে পার না—

রুহান তখন মানুষটিকে ছেড়ে দেয়। বলে, তুমি ঠিকই বলেছ। আমি এরকম পাগলামী করতে পারি না। মানুষ হয়ে মানুষকে বিক্রি করে দেয়া পাগলামী। এটা কেউ করতে পারে না। আমি যেমন তোমাকে করব না–তুমিও এদের করবে না। বুঝেছ?

মানুষটি কিছু অশ্লীল কথা উচ্চারণ করে উন্মত্তের মতো চিৎকার করে বলল, গার্ড!

রিদি এবারে তার অস্ত্রটা মাথার উপরে তুলে চিৎকার করে বলল, খবরদার, কেউ নড়বে না।

তার চিৎকারে যে যেখানে ছিল সেখানেই থেমে গেল।

রিদি বলল, গার্ডরা, তোমরা ইচ্ছে করলে আমাকে গুলি করার চেষ্টা করতে পার। কিন্তু আমি আগেই বলে দিচ্ছি তোমরা অস্ত্রটা তোলার আগেই তোমাদের আমি শেষ করে দিতে পারব। বুঝেছ?

কেউ কোনো কথা বলল না। মানুষগুলো নিজেদের ভেতরে চাপা গলা কথা বলতে থাকে এবং হঠাৎ কমবয়সী একটা মেয়ে এগিয়ে এসে উত্তোও গলায় বলল, তোমরা কী খেলোয়াড়? তোমরাই কী ক্ৰিভনকে ধরে নিয়েছিলে?

রিদি আর রুহান একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তাদের পরিচয় আর গোপন রাখার প্রয়োজন নেই। রিদি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

বিস্ময়ের একটা সম্মিলিত শব্দ শোনা গেল, এবারে অনেকেই তাদের কাজে আসার চেষ্টা করে, ভালো করে এক নজর দেখার চেষ্টা করে। কমবয়সী কয়েকটা মেয়ে আনন্দে এক ধরনের চিৎকার করতে থাকে। চারদিকে মানুষে হুঁটোপুটি শুরু হয়ে যায়।

রুহান মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তোমরা সবাই শান্ত হও। আমি তোমাদের সবাইকে সাক্ষী রেখে বলছি আজ থেকে লাল পাহাড়ে মানুষ বেচাকেনা বন্ধ। আর কেউ এখানে দূরের গ্রাম থেকে মানুষ ধরে এনে বিক্রি করতে পারবে না।

উপস্থিত মানুষগুলো উল্লাসের মতো এক ধরনের শব্দ করল। তারা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে সেরকম মনে হলো না, কোনো একটা বিষয় নিয়ে হৈ চৈ হচ্ছে সেটা নিয়েই আনন্দ!

কাছাকাছি ক্রিটিনা দাঁড়িয়ে ছিল, রুহান বলল, ক্রিটিনা তোমাকে কেউ বিক্রি করতে পারবে না। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

ক্রিটিনা কোনো কথা না বলে স্থির চোখে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রুহান বলল, তুমি মুক্ত। তুমি যেখানে খুশি যেতে পার।

ক্রিটিনা ফিসফিস করে বলল, আমি তোমাকে ঘৃণা করি। অসম্ভব ঘৃণা করি।

রুহান চমকে ওঠে বলল, ঘৃণা করো? আমাকে?

হ্যাঁ। তুমি ভেবেছ আমি তোমাদের মতো মানুষদের চিনি না? খুব ভালো করে চিনি। গলায় একটা অস্ত্র ঝুলিয়ে তোমরা মনে করো সারা পৃথিবীটা তোমাদের। যা ইচ্ছা তাই করতে পার।

রুহান কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, বিশ্বাস করো, আমি সেরকম কিছু ভাবছি না।

আমি জানি তুমি ঐ মানুষটার কাছ থেকে কেন আমাদের ছিনিয়ে নিয়েছ।

কেন?

তুমি এখন আমাদের অন্য কোথাও বিক্রি করবে।

না, ক্রিটিনা বিশ্বাস করো, তোমাদের আমি অন্য কোথাও বিক্রি করব না। তোমরা যেখানে খুশি যেতে পার। তোমরা স্বাধীন–

ক্রিটিনা হঠাৎ আনন্দহীন শুকনো হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল। হাসতে হাসতে বলল, আমরা স্বাধীন?

হ্যাঁ।

আমরা স্বাধীন হয়ে এখন কোথায় যাব? বাইরে তোমার মতো হাজার হাজার মানুষ বসে আছে আমাদের ধরে নিতে! আমরা কোথায় যাব? কী করব?

তোমাদের গ্রামে যাবে!

আমাদের গ্রাম কত দূর তুমি জান? এরা সেই গ্রামে কী করেছে তুমি জান? কত বাড়ি পুড়িয়েছে, কত মানুষ মেরেছে তুমি জান?

আমি দুঃখিত ক্রিটিনা–

ক্রিটিনা হঠাৎ চিৎকার করে বলল, খবরদার, যেটা বিশ্বাস করো না সেটা মুখে উচ্চারণ করো না।

রুহান থতমত খেয়ে বলল, আমি কী বিশ্বাস করি না?

দুঃখিত হবার কথা বলো না। কারণ তোমরা দুঃখিত না। তোমরা আমাদের লুট করে নিয়ে এখন কোথাও বিক্রি করবে। আমি জানি–

বিশ্বাস করো ক্রিটিনা—

ক্রিটিনার চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলে উঠল। সে হিংস্র গলায় বলল, খবরদার, তুমি বিশ্বাস করার কথা মুখে আনবে না। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। কাউকে না।