গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

০৯. তিলক বর্মা

নবম পরিচ্ছেদ – তিলক বর্মা

পরদিন প্রাতঃকালে সচিব চতুর ভট্ট রাজভবনে চিত্রকের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। স্বস্তিবাচন করিয়া বলিলেন— ‘কাল রাত্রে আপনি পুরভূমিতে আক্রান্ত হইয়াছিলেন শুনিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছি। আপনার দেখিতেছি মন্দ দশা চলিয়াছে, পদে পদে বিপন্ন হইতেছেন। গভীর রাত্রে অরক্ষিত অবস্থায় বাহির হওয়া নিরাপদ নয়, রাজপুরীর মধ্যেও বিপদ ঘটিতে পারে।’

কঞ্চুকী উপস্থিত ছিল; সে বলিল— ‘সেই কথাই তো আমিও বলিতেছি। কিন্তু দূত-প্রবরের বয়স অল্প, মন চঞ্চল—’ বলিয়া মুখ টিপিয়া হাসিল।

চতুর ভট্ট জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘রাত্রে কি নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিয়াছিল?’ প্রশ্নের অন্তর্নিহিত প্রকৃত প্রশ্নটি চিত্রক বুঝিতে পারিল; সচিব জানিতে চান কি জন্য রাত্রির মধ্যযামে সে একাকী বাহিরে গিয়াছিল। এই প্রশ্নের জন্য চিত্রক প্রস্তুত ছিল, সে মনে মনে একটি কাহিনী রচনা করিয়া রাখিয়াছিল, এখন তাহাই সচিবকে শুনাইল।

— গভীর রাত্রে চিত্রকের ঘুম ভাঙ্গিয়া যায়। ঘুম ভাঙ্গিয়া সে দেখে একটা লোক বাতায়ন পথে তাহার কক্ষে প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিতেছে। তখন চিত্রক তরবারি লইয়া দূরভীষ্ট ব্যক্তির দিকে অগ্রসর হয়। চোর তাহাকে জাগ্রত দেখিয়া পলায়ন করে; চিত্রকও বাতায়ন উল্লঙঘন করিয়া তাহার পশ্চাদ্ধাবন করে। কিছুদূর পশ্চাদ্ধাবন করিবার পর সে আর চোরকে দেখিতে পায় না। তখন ইতস্তত অন্বেষণ করিতে করিতে তোরণ সন্নিকটে উপস্থিত হইলে গুহ তাহাকে অতর্কিতে আক্রমণ করে— ইত্যাদি।

কাহিনী অবিশ্বাস্য নয়। চতুর ভট্ট মন দিয়া শুনিলেন; মনে মনে ভাবিলেন, ইহা যদি মিথ্যা গল্প হয় তবে দূত মহাশয়ের উদ্ভাবনী শক্তি আছে বটে। মুখে বলিলেন— ‘যা হোক, আপনি যে উন্মাদের আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইয়াছেন ইহাই ভাগ্য। আপনি মগধের মহামান্য দূত; আপনার কোনও অনিষ্ট হইলে আমাদের সান্ত্বনা থাকিত না।’ কঞ্চুকীকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন— ‘লক্ষ্মণ, দিবারাত্র দূত মহাশয়ের রক্ষার ব্যবস্থা কর। তিনি এখন কিছুদিন রাজ-অতিথিরূপে থাকিবেন; তাঁহার অনিষ্ট হইলে দায়িত্ব তোমার, স্মরণ রাখিও।’

চিত্রক উদ্বিগ্ন হইয়া বলিল— ‘কিন্তু আমি শীঘ্রই চলিয়া যাইতে চাই। আতিথ্য রক্ষা তো হইয়াছে, এবার আমাকে বিদায় দিন।’

সচিব দৃঢ়ভাবে বলিলেন— ‘এত শীঘ্র যাওয়া অসম্ভব। চষ্টন দুর্গে মহারাজের নিকট মগধের লিপি প্রেরিত হইয়াছে মহারাজ সম্ভবত আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিবেন। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎকার না করিয়া আপনি চলিয়া যাইতে পারেন না।’— গাত্রোত্থান করিয়া চতুর ভট্ট নরম সুরে বলিলেন— ‘আপনি ব্যস্ত হইতেছেন কেন? রাজকার্য একদিনে হয় না। কিছুদিন বিশ্রাম করুন, আরাম উপভোগ করুন; তারপর বিটঙ্ক রাজ্যের দূত যখন পত্রের উত্তর লইয়া পাটলিপুত্রে যাইবে তখন আপনিও তার সঙ্গে ফিরিতে পারিবেন। সকল দিক দিয়া সুবিধা হইবে।’

সচিব প্রস্থান করিলেন। চিত্রক হতাশা-পূর্ণ হৃদয়ে বসিয়া রহিল। তাহার মনশ্চক্ষে কেবলই শশিশেখরের সগুম্ফ মুখ ভাসিয়া উঠিতে লাগিল।

দিনটা প্রায় নিষ্ক্রিয়ভাবেই কাটিল। কঞ্চুকী লক্ষ্মণ যদি বা এ পর্যন্ত চিত্রককে কদাচিৎ চক্ষের অন্তরাল করিতেছিল, এখন একেবারে জলৌকার ন্যায় তাহার অঙ্গে জুড়িয়া গেল; স্নানে আহারে নিদ্রায় পলকের তরে তাহার সঙ্গ ছাড়িল না।

অপরাহ্ণের দিকে উভয়ে অক্ষক্রীড়ায় কাল হরণ করিতেছিল। বিনা পণের খেলা, তাই চিত্রকের বিশেষ মন লাগিতেছিল না; এমন সময় অবরোধ হইতে রাজকুমারীর স্বকীয়া এক দাসী আসিল। দাসী কৃতাঞ্জলিপুটে দাঁড়াইতেই কঞ্চুকী ঈষৎ বিস্ময়ে বলিল— ‘বিপাশা, তুমি এখানে কি চাও?’

বিপাশা বলিল— ‘আর্য, দেবদুহিতার আদেশে আসিয়াছি।’

কঞ্চুকী ত্বরিতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল— ‘দেবদুহিতার কী আদেশ?’

বিপাশা বলিল— ‘দেবদুহিতা উশীর-গৃহে অবস্থান করিতেছেন, সঙ্গে সখী সুগোপা আছেন। দেবদুহিতা ইচ্ছা করিয়াছেন মগধের দূত মহোদয়ের সহিত কিছু বাক্যালাপ করবেন। অনুমতি হইলে তাঁহাকে পথ দেখাইয়া লইয়া যাইতে পারি।’

কঞ্চুকী বিপদে পড়িল। কোনও রাজদূতের সহিত অবরোধের মধ্যে সাক্ষাৎ করা রাজকন্যার পক্ষে শোভন নয়, নিয়মানুগও নয়। কিন্তু রাজকুমারী একে স্ত্রীজাতি, তায় হূণকন্যা; অবরোধের শাসন তিনি কোনও কালেই মানেন না। উপরন্তু, গণ্ডের উপর পিণ্ড, ঐ সুগোপা সখীটা আছে। সুগোপাকে কঞ্চুকী স্নেহের চক্ষে দেখে না। সুগোপার সহিত মিশিয়াই রাজকন্যার মর্যাদাজ্ঞান শিথিল হইয়াছে। কিন্তু উপায় কি? এদিকে অবরোধের শালীনতা রক্ষা করিতে হইবে; নহিলে কঞ্চুকীর কর্তব্যে ত্রুটি হয়। আবার দূত প্রবরকেও একাকী ছাড়িয়া দেওয়া যায় না—

লক্ষ্মণ কঞ্চুকী চট্‌ করিয়া কর্তব্য স্থির করিয়া ফেলিল; বিপাশাকে বলিল— ‘তুমি অগ্রবর্তিনী হও, আমি দূত মহাশয়কে লইয়া স্বয়ং যাইতেছি।’

কঞ্চুকী সঙ্গে থাকিলে অবরোধে পুরুষ প্রবেশের দোষ অনেকটা ক্ষালন হইবে, অধিকন্তু দূত মহাশয়ও চোখে চোখে থাকিবেন।

অবরোধের পশ্চিম প্রান্তে উশীর-গৃহ। সারি সারি কয়েকটি কক্ষ; দ্বারে গবাক্ষে সিক্ত উশীরের জাল। গ্রীষ্মের তাপ বর্ধিত হইলে পুরস্ত্রীরা এই সকল শীতল কক্ষে আশ্রয় লইয়া থাকেন।

একটি কক্ষে শুভ্র মর্মর পট্টের উপর কুমারী রট্টা উপবিষ্টা ছিলেন; সুগোপা তাঁহার কাছে কুট্টিমের উপর তালবৃন্ত হাতে লইয়া বসিয়া ছিল। কঞ্চুকী ও চিত্রক দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলে সুগোপা তাড়াতাড়ি উঠিয়া একটি গৌড়দেশীয় মসৃণ পট্টিকা পাতিয়া দিল।

উভয়ে উপবিষ্ট হইলে রট্টা মুখ টিপিয়া একটু হাসিলেন। কঞ্চুকীকে চিত্রকের সঙ্গে দেখিয়া তিনি ব্যাপার বুঝিয়াছিলেন, কৌতুক-তরল কণ্ঠে বলিলেন— ‘এই অবরোধের প্রতি আর্য লক্ষ্মণের যেমন সতর্ক স্নেহ-মমতা, শিশু সন্তানের প্রতি মাতারও এমন দেখা যায় না।’

লক্ষ্মণ অতিশয় অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। চিত্রক রাজকুমারীর বাক্যে স্ফোটন দিয়া বলিল — ‘কঞ্চুকী মহাশয় আমার প্রতিও বড় স্নেহশীল, তিলার্ধের জন্যও চোখের আড়াল করেন না।’

বিড়ম্বিত কঞ্চুকী নতমুখে হেঁ হেঁ করিয়া হাসিবার চেষ্টা করিল। তাহার উভয় সঙ্কট; কর্তব্য করিলে বাক্য যন্ত্রণা, না করিলে মুণ্ড লইয়া টানাটানি।

যা হোক, অতঃপর কুমারী রট্টা চিত্রককে বলিলেন— ‘দূত মহাশয়, আমার সখী আপনাকে কিছু কথা বলিতে চায়, তাই আপনাকে কষ্ট দিয়াছি। সুগোপা, এবার তোর কথা তুই বল্‌।’

সুগোপা কোলের উপর দুই যুক্ত হস্ত রাখিয়া নতচক্ষে বসিয়া ছিল, এখন ধীরে ধীরে বলিল— ‘আর্য, আমি আপনার অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, প্রতিদানে আপনি আমার ইষ্ট করিয়াছেন। আপনার প্রসাদে আমার মাতাকে ফিরিয়া পাইয়াছি।’

চিত্রক অবহেলাভরে হস্ত সঞ্চালন করিয়া এমন ভাব প্রকাশ করিল যে মনে হয় এই সব ইষ্টানিষ্ট চেষ্টা তাহার কাছে অকিঞ্চিৎকর। সুগোপা তখন বলিল— ‘আপনি উদার চরিত্র। তাই সাহস করিয়া আপনার নিকট একটি অনুগ্রহ ভিক্ষা করিতেছি। আমার অভাগিনী জননী—’ সুগোপার চক্ষু ছলছল করিয়া উঠিল— ‘উদ্ধার পাইবার পর শয্যা লইয়াছেন। তাঁহার শরীর অতি দুর্বল, যে-কোনও মুহূর্তে প্রাণবায়ু বাহির হইতে পারে। কিন্তু তাঁহার সংজ্ঞা সম্পূর্ণ সুস্থ আছে। তাঁহার বড় সাধ আপনাকে একবার দেখিবেন, নিজমুখে কৃতজ্ঞতা জানাইবেন—’

চিত্রক বলিল— ‘কৃতজ্ঞতা জানাইবার কোনই প্রয়োজন নাই। কিন্তু তিনি যদি আমাকে দেখিলে সুখী হন আমি নিশ্চয় দেখা করিব। কোথায় আছেন তিনি?’

সুগোপা বলিল— ‘আমার গৃহে। আমার কুটির রাজপুরীর বাহিরে কিছু দূরে। যদি অনুগ্রহ করেন, এখনি লইয়া যাইতে পারি।’

চিত্রক উঠিয়া দাঁড়াইল— ‘চলুন। আমি প্রস্তুত।’

কঞ্চুকী ত্রস্তভাবে লাফাইয়া উঠিল— ‘অ্যাঁ— রাজপুরীর বাহিরে! তা— তা— আমি সঙ্গে দুইজন রক্ষী দিতেছি—’

চিত্রক বলিল— ‘নিম্প্রয়োজন। আমি আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ।’

বিব্রত কঞ্চুকী বলিল— ‘কিন্তু তাহা কি করিয়া হইতে পারে! আর্য চতুর ভট্ট-অর্থাৎ আপনার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমার উপর—’

চিত্রক রট্টার দিকে চাহিয়া করুণ হাসিল— ‘আমার উপর কঞ্চুকী মহাশয়ের বিশ্বাস নাই। তিনি বোধহয় এখনও আমাকে চোর বলিয়াই মনে করেন। তাঁহার সন্দেহ, ছাড়া পাইলেই আমি আবার ঘোড়া চুরি করিব।’

রট্টা ঈষৎ ভ্রকুঞ্চন করিলেন— ‘আর্য লক্ষ্মণ, রক্ষীর প্রয়োজন নাই। সুগোপা দূত মহাশয়কে লইয়া যাইবে, আবার পৌছাইয়া দিবে।’

পিণ্ড গলাধঃকরণ করিয়া কঞ্চুকী বলিল— ‘তা— তা— দেবদুহিতার যদি তাহাই অভিরুচি—’

চিত্রক মনে মনে ভাবিল— এই সুযোগ! সে আর রাজকুমারীর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করিল না; রট্টার চোখে কি জানি কী সম্মোহন আছে, চোখাচে্যুখি হইলে আবার হয়তো তাহার মনের গতি পরিবর্তিত হইবে। সে সুগোপার অনুসরণ করিয়া উশীর-গৃহ হইতে বাহির হইল।

রাজপুরীর তোরণ-দ্বারের সম্মুখ দিয়া যে পথ গিয়াছে তাহা দক্ষিণ দিকে কিছুদূর গিয়া নিম্নাভিমুখে অবতরণ করিয়াছে, তারপর আরও খানিকদূর গিয়া একটি বাঁকের মুখে আসিয়া আবার নীচে নামিয়াছে। এই বাঁকের উপর সুগোপার কুটির; ইহার পর হইতে রাজপুরুষ ও নাগরিক সাধারণের গৃহাদি আরম্ভ হইয়াছে।

সুগোপার কুটির ক্ষুদ্র হইলেও সুদৃশ্য, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন; চারিদিকে ফুলের বাগান। সুগোপার মালাকর স্বামী গৃহেই ছিল; সুগোপাকে আসিতে দেখিয়া সে ফুল-মাল্যাদি লইয়া বাহির হইল। বাজারে ফুল-মাল্য বিক্রয় করিয়া যাহা পাইবে তাহা লইয়া সে মদিরালয়ে প্রবেশ করিবে। লোকটি অতিশয় নীরব প্রকৃতির; আপন মনে উদ্যানের পরিচর্যা করে, মালা গাঁথে, বিক্রয় করে, আর মদিরা সেবা করে। কাঁহারও সাতে পাঁচে নাই।

সুগোপা চিত্রককে মাতার নিকট লইয়া গেল। একটি ঈষদন্ধকার কক্ষে খট্বার উপর সযত্নবিন্যস্ত শয্যায় পৃথা শুইয়া আছে। তাহার দেহ যথাসম্ভব পরিষ্কৃত হইয়াছে; নখ কাটিয়া মাথায় তৈল সেক করা হইয়াছে। কিন্তু কেশের গ্রন্থিযুক্ত তাম্রাভ বর্ণ দূর হয় নাই। মুখের ও দেহের ত্বক দীর্ঘকাল আলোকের স্পর্শাভাবে হরিদ্রাভ বর্ণ ধারণ করিয়াছে।

পৃথা শয্যার সহিত যেন মিশিয়া গিয়াছিল; কোটরগত চক্ষু ঊর্ধ্বে নিবদ্ধ ছিল; চিত্রক নিঃশব্দে তাহার শয্যাপার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইলে সে ধীরে ধীরে চক্ষু নামাইল। অনেকক্ষণ চিত্রকের মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া ক্ষীণকণ্ঠে বলিল— ‘তুমিই সেই?’

সুগোপা শয্যাপার্শ্বে নতজানু হইয়া মাতার কপালে হস্ত রাখিল, স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিল— ‘হাঁ মা, ইনিই সেই।’

আরও কিছুক্ষণ চিত্রককে দেখিয়া পৃথা বলিল— ‘তুমি হূণ নও— আর্য।’

চিত্রক হাসিয়া বলিল— ‘হাঁ আমি আর্য। যে হূণ তোমাকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছিল সে মরিয়াছে।’ বলিয়া সংক্ষেপে গুহের মৃত্যু বিবরণ বলিল।

শুনিয়া পৃথা বলিল— ‘এখন আর কী আসে যায়— আমার জীবন শেষ হইয়াছে।’

চিত্রক শয্যাপার্শ্বে বসিয়া সান্ত্বনার কণ্ঠে বলিল— ‘এরূপ কেন মনে করিতেছ? তোমার শরীর আবার সুস্থ হইবে। তোমার কন্যা আছে; তাহাকে লইয়া আবার তুমি সুখী হইবে। যাহা অতীত তাহা ভুলিয়া যাও।’

পৃথার মুখে আশা বা আনন্দের রেখাপাত হইল না। সে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল— ‘আমার কথা থাক। তোমার কথা বল। তুমি আমাকে উদ্ধার করিয়াছ, তোমার কথা শুনিতে চাই। — তোমাকে দেখিয়া মনে হইতেছে তুমি অপরিচিত নও— পূর্বে যেন দেখিয়াছি।’

চিত্রক লঘু হাস্যে বলিল— ‘তুমি তো অন্ধকারে দেখিতে পাও। সে-রাত্রে কূটকক্ষে দেখিয়াছিলে— হয়তো সেই স্মৃতি মনে জাগিতেছে।’

‘তাহাই হইবে। তোমার নাম কি?’

‘চিত্রক বর্মা।’

পৃথা নীরবে তাহার ক্ষতরেখাচিহ্নিত অঙ্গে চক্ষু বুলাইল।

‘মাতা পিতা জীবিত আছেন?’

মাতা পিতা! চিত্রক মনে মনে হাসিল; তাহার মাতা পিতা থাকিতে পারে ইহাই যেন অসম্ভব মনে হয়। বলিল— ‘না, জীবিত নাই।’

‘তোমার বয়স অল্প মনে হয়—’

‘নিতান্ত অল্প নয়, পঁচিশ ছাব্বিশ বছর।’

পৃথা কিয়ৎকাল চক্ষু মুদিত করিয়া রহিল; শেষে ধীরে ধীরে বলিল— ‘আমার তিলক বাঁচিয়া থাকিলে তোমার সমবয়স্ক হইত।’

‘তিলক কে?’

‘কুমার তিলক বর্মা। আমি তাহার ধাত্রী ছিলাম। সে আর সুগোপা এক দিনে জন্মিয়াছিল; আমার দুগ্ধ দু’জনকে ভাগ করিয়া দিতাম।’

সুগোপা নিম্নস্বরে বলিল— ‘মা, ও কথা আর মনে আনিও না।’

পৃথা চক্ষু নিমীলিত করিয়া বলিল— ‘তাহার কথা ভুলিতে পারি না। নবনীতের ন্যায় সুকুমার শিশু— সেই শিশুকে হূণেরা আমার বুক হইতে ছিঁড়িয়া লইল— তারপর— তারপর’

অকালবৃদ্ধা পৃথার পাণ্ডুর গণ্ড বহিয়া বিন্দু বিন্দু অশ্রু ক্ষরিত হইতে লাগিল। সুগোপা চিত্রকের সহিত বিষণ্ণ দৃষ্টি বিনিময় করিল।

চিত্রক বলিল— ‘ক্ষত্রিয় শিশু যদি তরবারির আঘাতে মরিয়া থাকে তাহাতে আক্ষেপ করিবার কী আছে? ক্রীতদাস হইয়া বাঁচিয়া থাকার অপেক্ষা সে ভাল।’

পৃথা নিস্তেজ স্বরে বলিল— ‘রাজার ছেলে ক্রীতদাস হয় নাই সে ভাল। কিন্তু রাজজ্যোতিষী বলিয়াছিলেন, এ শিশু রাজটীকা লইয়া জন্মিয়াছে, রাজচক্রবর্তী হইবে। কই, তাহা তো হইল না! রাজজ্যোতিষীর কথা মিথ্যা হইল—’

চিত্রক মৃদুহাস্যে বলিল— ‘রাজজ্যোতিষীর কথা অমন মিথ্যা হয়। কিন্তু রাজটীকা লইয়া জন্মিয়াছে ইহার অর্থ কি?’

পৃথা ধীরে ধীরে বলিল— ‘আমি যেন চোখের উপর দেখিতে পাইতেছি। তাহার ভ্রূর মধ্যস্থলে জটুল ছিল; অন্য সময় দেখা যাইত না, কিন্তু সে কাঁদিলে বা ক্রুদ্ধ হইলে ঐ জটুল রক্তবর্ণ হইয়া ফুটিয়া উঠিত। মনে হইত যেন রক্ত-চন্দনের তিলক। তাই তাহার নামকরণ হইয়াছিল— তিলক বর্মা।’

বাতাসের ফুৎকারে ভস্মাবৃত অঙ্গার যেমন স্ফুরিত হইয়া উঠে, চিত্রকের ভ্রূমধ্যে তেমনি রক্তটীকা জ্বলিয়া উঠিল। সে ব্যায়ত চক্ষে চাহিয়া অর্ধনিরুদ্ধ কণ্ঠে বলিল— ‘কী বলিলে?’

পৃথা চক্ষু মেলিল। সম্মুখেই চিত্রকের মুখ তাহার মুখের উপর ঝুঁকিয়া আছে; সেই মুখে ভ্রূযুগলের মধ্যে প্রবালের ন্যায় তিলক জ্বলিতেছে। পৃথার চক্ষু ক্রমে বিস্ফারিত হইতে লাগিল; তারপর সে চিৎকার করিয়া উঠিল— ‘তিলক! আমার তিলক বর্মা! পুত্র! পুত্র!’

পৃথা দুই কঙ্কালসার হস্তে চিত্রককে টানিয়া বুকের উপর চাপিয়া ধরিতে চাহিল; কিন্তু এই প্রবল উত্তেজনায় তাহার দেহের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হইয়া গিয়াছিল; সহসা তাহার হস্ত শিথিল হইয়া চিত্রকের স্কন্ধ হইতে খসিয়া পড়িল। সে চক্ষু মুদিত করিয়া মৃতবৎ স্থির হইয়া রহিল।

সুগোপা কাঁদিয়া উঠিল। চিত্রক পৃথার বক্ষের উপর করতল রাখিয়া দেখিল অতি ক্ষীণ হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন অনুভূত হইতেছে। সে সুগোপাকে বলিল— ‘এখনও বাঁচিয়া আছেন। যদি সম্ভব হয়। শীঘ্র চিকিৎসক ডাকো।’

সুগোপা ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। রাজবৈদ্য রট্টার আদেশে পৃথার চিকিৎসার ভার লইয়াছিলেন। রাজবৈদ্যের বাসভবন নিকটেই; অল্পক্ষণের মধ্যে সুগোপা বৈদ্যকে লইয়া ফিরিয়া আসিল।

নাড়ি পরীক্ষা করিয়া বৈদ্যরাজ ঈষৎ মুখ বিকৃত করিলেন, তারপর সূচিকাভরণ প্রয়োগ করিলেন।

সে-রাত্রে চিত্রক রাজপুরীতে ফিরিয়া গেল না।

সন্দিগ্ধ কঞ্চুকী অলক্ষিতে দুইটি গুপ্ত-রক্ষী পাঠাইয়াছিল, তাহারা সারা রাত্রি সুগোপার কুটিরের বাহিরে পাহারা দিল।

গভীর রাত্রে পৃথা মোহাচ্ছন্নভাবে পড়িয়া ছিল। চিত্রক তাহার শয্যাপার্শ্বে দাঁড়াইয়া সুগোপার স্কন্ধের উপর হাত রাখিল— ‘সুগোপা, তুমি আমার ভগিনী; আমরা একই স্তনদুগ্ধ পান করিয়াছি।’

সুগোপা শুধু সজল নেত্রে চাহিয়া রহিল।

চিত্রক বলিল— ‘যে কথা আজ শুনিয়াছ তাহা কাহাকেও বলিও না। বলিলে আমার জীবন সংশয় হইতে পারে।’

সুগোপা ভগ্নস্বরে জিজ্ঞাসা করিল— ‘এখন তুমি কী করিবে?’

চিত্রকের অধরে ম্রিয়মাণ হাসি দেখা দিলে— ‘ভাবিয়াছিলাম পলায়ন করিব। কিন্তু এখন — কি করিব জানি না। তুমি একথা কাহাকেও বলিও না। হয়তো তোমার মাতা ভুল করিয়াছেন; রুগ্‌ণ দেহে এরূপ ভ্রান্তি অসম্ভব নয়—’

সুগোপা বলিল— ‘ভ্রান্তি নয়। আমার অন্তর্যামী বলিতেছেন, তুমি তিলক বর্মা।’

‘তিলক বর্মা। শুনিতে বড় অদ্ভুত লাগে। কিন্তু সত্য হোক মিথ্যা হোক, তুমি শপথ কর একথা গোপন রাখিবে।’

‘ভাল, গোপন রাখিব।’

‘কাহাকেও বলিবে না?’

‘না।’

পৃথার আর জ্ঞান হইল না। রাত্রি শেষে তাহার প্রাণবায়ু নির্গত হইল।