ডাইনি-পুরতরাই সম্ভবত আদি পৃথিবীর পরম্পরাগত জীবন্ত নিদর্শন। সারা গায়ে জন্তুজানোয়ার, ফুল, লতাপাতা, গাছপালার উল্কি আঁকা, গলায় শাঁখের মালা, মাথায় পশুললামের টুপি, কানে মস্ত হাড়ের মাকড়ি—এই হলো ডাইনি-পুরুতের চেহারা। প্রত্যেকটা দলের মধ্যে এদের ক্ষমতাই সবচেয়ে বেশি। রাজারা পর্যন্ত এদের ভয় পায়, এদের হুকুম নিঃশব্দে তামিল করে। পুরুতদের নামকরণের রীতিটা বড়ো অদ্ভুত : বেশির ভাগেরই নাম কোনো-না-কোনো জন্তুর নামে, অবশ্য ফুলের নাম বা গাছের নামও বাদ যায় না। কেননা পুরুতের নাম হরিণ, কারুবা নাম ভালুক, কেউ আবার নিজের পরিচয় দেয় দাঁড়কাক বলে, আবার কারু-বা নাম সূর্যমুখী। ব্যাপরটা বেশ-একটু রহস্যে ভরা। নাম দিতে চাচ্ছে মানুষের দলের পুরুতের, অথচ নামটা নিচ্ছে জন্তু-জানোয়ারদের কাছ থেকে। এ-আবার কোন ধরনের ব্যাপার?
ব্যাপারটার রহস্য পরিষ্কার হয়, যদি কয়েকটি মূল সূত্রের দিকে নজর রাখা যায়। লক্ষ করলে দেখা যায়, তাদের গায়ে যে-সব উল্কি থাকে, বা যে-সব নাম তারা নেয়, তার বেশির ভাগই হলো খাবার জিনিশ। পশুপাখি, গাছগাছড়াই বেশি—আর এগুলো খেয়ে পেট ভরানো সম্ভব। অবশ্য এমন কিছু-কিছু নাম আছে যা কিনা খাবার জিনিশ নয়, যেমন বৃষ্টি, পাথর ও ঐ জাতীয় কিছু। কিন্তু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় এগুলো আদি ও অকৃত্রিম নয়, অনেক পরের ব্যাপার, আদি যুগের অখাদ্য নকল বা অনুকরণ মাত্র। কাজেই এই সূত্র থেকে সন্দেহ হয় যে, আদি মানুষের খাবার জোগানোর সঙ্গে এই নামগুলির কোনো যোগাযোগ ছিলো—নামের ফর্দ দেখে সেই সন্দেহ আরো দৃঢ় হয়। কিন্তু তা ছাড়াও আরেকটি খুব জরুরি সূত্র আছে। প্রতিটি দলের মধ্যে একটা উৎসব আছে, যেটা সবচেয়ে জরুরি ও বড়ো; সেই উৎসবের সময় পুরো দলটা এক জায়গায় জমায়েং হয়—কিন্তু যেখানে-সেখানে নয়, আর যখন-খুশি তখনও নয়। জড়ো হবার জায়গাটা বাঁধা-ধরা, সময়টাও তাই। যেমন, কোনো দলের পুরুতের নাম যদি কাছিম হয়, তাহলে উৎসবের জন্য গোটা দল জমায়েৎ হবে কাছিমদের ঘাঁটিতে, আর কাছিমেরা যে-সময়টায় বাচ্চা পাড়ে, সেই সময়টায়। প্রশ্ন ওঠে, কেন ওরা জড়ো হচ্ছে, মৎলবটা কী ওদের। উত্তর হলো, ওরা জমা হচ্ছে কাছিম ধরার জন্যে; কাছিম ধরে খাবে, খেয়ে প্রাণ বাঁচাবে। এই ব্যাপারটা শুরু হয়েছে এমন-এক আদিম যুগে যখন আদি মানুষেরা খাবারের সন্ধানে হন্যের মতো সবখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের অস্ত্রশস্ত্র তখন এতই বাজে যে তা দিয়ে হরেক রকম খাবার জোগাড় করার কথাই ওঠে না। বন-জঙ্গলের যে-এলাকায় ওরা হন্যে হয়ে ঘুরছে, সেই অঞ্চলে কেবলমাত্র যে-খাবার সহজে পাওয়া যায় তা-ই খেয়েই তাদের প্রাণ বাঁচে; তাই যারা আশপাশে কাছিম জোগাড় করতে পারে কেবল কাছিম খেয়েই তাদের প্রাণ বাঁচাতে হয়। কাছিম ছাড়া তাই ওরা নিজেদের কথা মোটেই ভাবতে পারে না; কাছিমই এদের দলের সবচেয়ে বড়ো রক্ষক, কাছিমের সঙ্গেই ওদের যত আত্মীয় সম্বন্ধ, কাছিম থেকেই ওদের প্রাণ, ওরা আর কাছিম তাই মোটেই আলাদা নয়। তারপরে কিন্তু সেই আদি মানুষের অস্ত্রশস্ত্র উন্নত হলো আর তাই তারা কেবল একরকমেরই খাবার নয়, নানারকম খাবার জোগাড় করতে পারলে। তা ছাড়া দলের মানুষ বেড়েছে, বাড়তে বাড়তে অনেকগুলি দলে ভাগ হয়ে গেছে–কিন্তু তাহলেও এক দলের সঙ্গে অন্য দলের একটি গভীর সম্বন্ধ থেকে গেছে—সেটি সহযোগিতার। অর্থাৎ বাঁচার ব্যাপারে এ-দল ও-দলের সাহায্যে আসে, ও-দল এ-দলের। কীভাবে? না, ঠিক হলো, এই দল ঐ দলের খাবরে ভাগ বসাবে না, ওই দল তাই যেন এই দলের খাবারে ভাগ না-বসায়। যেমন—আগে যাদের সঙ্গে কাছিমের আত্মীয়তা ছিলো, তারা বললে, আমরা আর কাছিম খাবো না—এ খাবার অন্য দলের খাবার হোক। আবার হরিণ-দলের লোক বললে, আমরা আর হরিণ খাবো না, এ-খাবার অন্য দল নিয়ে নিক। অর্থাৎ যে-সহযোগিতার সূত্র তাদের আটকে রাখলো তার মধ্যে কতগুলো নিয়ম হলো, কাছিম-দলের পক্ষে কাছিম খাওয়া নিষিদ্ধ, হরিণ-দলের পক্ষে হরিণ। এই সূত্র মনে রাখলেই, কেন প্রাচীন মিশরের দেবদেবীর চিত্র বা মূর্তিতে জন্তু-জানোয়ারের অঙ্গ থেকে গেছে, তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়।
কিন্তু এখানেই হলো সবচেয়ে জরুরি বিষয়, যাকে বলা যায় কুহক, জাদুবিদ্যা বা ইন্দ্রজাল। এই ইন্দ্রজালের প্রয়োগকতা হলো ডাইনি-পুরুৎ। ডাইনি কেন? না, তারা জাদু জানে। জাদু আর-কিছু নয়, প্রকৃতিকে জয় করার ব্যাপারে অনেক পেছিয়ে ছিলো আদিম মানুষ, তাই তারা সেই জয়ের অভিনয় করে কল্পনায় প্রকৃতিকে জয় করে নেবার চেষ্টা করলে—এক ধরনের ইচ্ছাপূরণকারী দিবাস্বপ্ন আর-কি! যেমন—আকাশে জল নেই, মরুভূমি এগিয়ে আসছে তার মরা ধুলোর তুমুল ঝড় তুলে, অসুবিধে হচ্ছে চাষবাসের, তাই আকাশে জল চাই। কেমন করে তা করা যায়? না, বৃষ্টির নকল করো—সবাই মিলে একসঙ্গে তালে-তালে নাচো। দল বেঁধে একসঙ্গে যে কাজ করবে, প্রকৃতি তা মানতে বাধ্য। যদি দল বেঁধে শিকারিও নাচ নাচে আর তার মূল কথাটা যদি এই হয় যে, মনের মতো শিকার জুটেছে বলে ফুর্তির কোনো শেষ নেই, তাহলে শিকার জুটবেই জুটবে। অর্থাৎ পৃথিবীকে সত্যকার জয় করার অভাবটা কল্পনায় জয় করা দিয়ে পূরণ করে নেয়া—এটাই হলো ইন্দ্রজালের প্রথম এবং আদি সূত্র। মানুষের হাতিয়ার যতদিন নেহাৎই বাজে আর অকেজো ধরনের ততদিন অব্দি পৃথিবীকে সত্যি-সত্যি আর কতটুকুই বা জয় করা যায়? তাই আসল জয়ের অভাবটা এইভাবে কল্পনা দিয়ে পূরণ করে নিতে না-পারলে তখন যেন প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হতো না। আর ইন্দ্রজালে অধিকার ছিলো বলেই ডাইনি-পুরুংদের হাতে চলে এলো সব প্রভাব প্রতিপত্তি। নানারকম জিনিশ তারা জমাতো-তার ভিতর হিরে-জহরৎ, নানা রঙের চকচকে পাথর, সোনারুপোও ছিলো। এ-সব জিনিশ তারা জমাতে তাদের অলৌকিক জাদু-ক্ষমতা বাড়াবার জন্যে। তারা ভাবতো এ-সবের ভেতর ইন্দ্রজালের শক্তি লুকোনো আছে, তাই এসব সংগ্রহ করে নিজের কাছে যে রাখতে পারবে তার অলৌকিক শক্তি আশ্চর্যভাবে বেড়ে যাবে। এ-সব তাদের কাছে বিলাসের উপকরণ ছিলো না। তারা ভাবতো, চকচকে দামি পাথরের ভেতর লুকিয়ে আছে জাদুর ক্ষমতা, তাই সে-পাথর যে ধারণ করবে —গলায় ঝোলোবে কি হাতে তাবিজ করে বেঁধে রাখবে— তার মধ্যে ঐ পাথর থেকেই অলৌকিক শক্তি চলে আসবে। আর এইসবের সঙ্গে তারা ভারিক্কি চাল আনতো নানা গুরুগম্ভীর গুমগুমে আওয়াজ-তোলা অর্থহীন আবোল-তাবোল মন্তর আউড়ে এই একটানা সুরময় ধ্বনির মধ্যে তারা যেন হুকুম করছে প্রকৃতিকে। আর যেহেতু লোকের জাদুবিশ্বাস প্রবল ছিলো সেহেতু নানা কাকতালের ফলে তারা ভাবতো প্রকৃতি বুঝি পুরুদের হুকুম তামিল করছে আর তাই শেষকালে তাদের ক্ষমতা প্রচণ্ড বেড়ে গেলো, লোকে জুজুর মতো ভয় করতে লাগলো তাকে, তাকে মানতে লাগলো মাথা নুইয়ে, কারণ সে যেমন ভালো করতে পারে, তেমনি সব জড় পদার্থের ওপর তার মন্তরের জোর খাটাতে পারে বলে সে মন্দও করতে পারে লোকের! তাই কেউ পারতপক্ষে তার বিরাগভাজন হতে চাইতো না—এমনকী দলের রাজা পর্যন্ত না। যদি ধুলোপড়া ছিটিয়ে দেয় কি অন্ধকারকে হুকুম দেয়, তাহলেই তো রাজার দফারফা, সব খেল খতম, সব ক্ষমতাই উধাও।
এই পুরুতেরা যদি একবার কোনো কারণে ফার্গুসনের উপর চটে যায় তো তাঁদের আর প্রাণে বাঁচতে হবে না। তাই ফার্গুসনের সংকল্পের কথা শুনে ভিক ভয়ে-বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। যদি একবার পুরুতেরা বুঝে ফ্যালে যে তারা চাঁদ থেকে আসেননি, তাদেরই মতো পৃথিবীর মানুষ, তাহলে তাদের ঠকাবার জন্যে তারা মহা খাপ্পা হয়ে উঠবে। ডিক তাই ফার্গুসনকে বাধা দেবার জন্য কী যেন বলতে চেষ্টা করলেন কিন্তু ডিক কোনো কথা বলে ওঠবার আগেই ভাঙা-ভাঙা আরবিতে ফাণ্ডসন জনতাকে জানালেন : তোমাদের কোনো ভয় নেই। চাঁদের দেবতা তোমাদের ওপর তুষ্ট হয়ে তোমাদের রাজাকে বাঁচাবার জন্যে আমাদের পাঠিয়েছেন। তাই কোনো ভয় কোরো না—আমি সুলতানকে দেখতে যাবো।
এ-কথা শুনেই ডাইনি-পুরুতেরা গুমগুমে গলায় উল্লাস জানালে, আর জনতাও তার সঙ্গে তাদের সম্মিলিত উচ্ছ্বাস যোগ করে দিলে।