কিরীটী ডাঃ সানিয়ালের ঘরে আবার ফিরে এল।
ডাঃ সমর সেনই প্রথমে কথা বলেন, এই যে মিঃ রায়, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? দালাল সাহেব চলে গেলেন যে আপনার জন্যে অপেক্ষা করে করে!
কখন আসবেন কিছু বলে গেছেন? কিরীটী প্রশ্ন করে!
হ্যাঁ, বিকেলের দিকে আবার আসবেন বলে গেলেন। কিন্তু আমি তো আর দেরি করতে পারছি না মিঃ রায়। আজ আবার আমার একটা অপারেশন আছে। জবাব দিলেন ডাঃ সেন।
কিরীটী যেন আপন মনে কি ভাবছিল। ডাঃ সমর সেনের প্রশ্নে ওঁর মুখের দিকে চেয়ে বলে, কি বললেন ডাঃ সেন?
আমার একটা অপারেশন ছিল! ডাঃ সেন আবার কথাটা পুনরাবৃত্তি করলেন।
নিশ্চয়ই। আপনি যাবেন বৈকি। আপাততঃ আপনাকে আর আমাদের প্রয়োজন নেই।
ডাঃ সেন বলেন, কিন্তু দালাল সাহেব যে বলে গেলেন তিনি না ফিরে আসা পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে!
না, তার আপাততঃ কোন প্রয়োজন নেই। তবে যাবার আগে আমার যে কয়েকটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করবার ছিল ডাঃ সেন।
কিরীটীর শেষের কথায় যেন একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই ডাঃ সমর সেন তার মুখের দিকে তাকান।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, কথাটা অবিশ্যি একটু ব্যক্তিগত।
কি রকম?
আপনি এই বাড়িতে কি কাল রাত্রেই সর্বপ্রথম এলেন–না আগেও এ বাড়িতে দু-একবার এসেছেন?
না, কাল রাত্রেই সর্বপ্রথম এ বাড়িতে আমি পা দিয়েছি।
ও। তাহলে এ বাড়ির কাউকেই আপনি পূর্বে চিনতেন না?
ডাঃ সেন যেন এবারে একটু চমকেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকান। বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই আমার কথাটা?
আমি—মানে—
বলুন, লজ্জা বা দ্বিধার এতে কিছু নেই।
না, তা ঠিক নয়। রুচিরার সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। তবে—
জানতেন না বোধ হয় কালকের রাতে এখানে এসে তাকে দেখার আগে পর্যন্ত যে সে এ বাড়িরই একজন। তাই কি?
হ্যাঁ। বছর দুয়েক আগে কলকাতায় থাকবার সময়ই আলোছায়া সঙ্ঘের একটা চ্যারিটি থিয়েটার পারফরমেন্সের সময় রুচিরার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়।
তারপর?
তারপর অবিশ্যি একটু ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।
হুঁ। এখন বুঝতে পারছি—
কি, মিঃ রায়?
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, না, বিশেষ কিছু নয়। তারপর একটু থেমে কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, আপনি কি কখনও শোনেননি রুচিরা দেবীর মুখে, সমীরবাবুর সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথাবার্তা, চলেছে?
না।
আশ্চর্য!
কি বললেন মিঃ রায়?
কিছু না। রুচিরা দেবীর সঙ্গে কতদিন আগে আপনার শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল?
দিন পনের আগেও কলকাতায় দেখা হয়েছে। মধ্যে মধ্যে আমি কলকাতায় যাই তো, তখন দেখা হয়।
ক্ষমা করবেন, আর একটা কথা।
বলুন!
আপনি তো অবিবাহিত, তাই না?
হ্যাঁ।
বিয়ে সম্পর্কে কিছু ভেবেছেন?
না।
কেন?
সত্যি বলব? মৃদু জবাব দেন ডাঃ সেন।
বলুন না।
এখনও জবাব পাইনি।
সে কি! এখনও জবাব পাননি?
না।
তাহলে আমি বলব মা ভৈষী। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন ডাঃ সেন।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়!
পরে বুঝতে পারবেন। আচ্ছা এবারে তাহলে আপনি যেতে পারেন।
কিন্তু ডাঃ সেন একটু ইতস্ততঃ করতে থাকেন তবু।
তখন কিরীটী বলে, যা বলবার তাঁকে আমিই বলবখন। আপনি যান।
ডাঃ সমর সেন উঠে দাঁড়ালেন বোধ হয় ঘর ত্যাগ করবার জন্যই। ডাঃ সানিয়াল ইতিমধ্যে আবার কিরীটীর জন্য এক কাপ চা তৈরী করে চামচের সাহায্যে চিনিটা গুলছিলেন। এবার তাঁর দিকে চেয়ে কিরীটী বলে, আচ্ছা ডাঃ সানিয়াল, রায়বাহাদুরের যে attending nurse সুলতা কর, তার সম্পর্কে আপনার ঠিক কি ধারণা বলুন তো?
ডাঃ সমর সেন ঘর হতে বের হয়ে গেলেন।
চায়ের কাপটা কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে ডাঃ সানিয়াল বলেন, আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না মিঃ রায়।
ডাক্তারের হাত হতে চায়ের কাপটা নিয়ে, চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে একটা আরামসূচক শব্দ করে স্থিরভাবে কিরীটী বলে, বুঝতে পারলেন না?
না।
মানে এই বলছিলাম আর কি, নিজের ডিউটি সম্পর্কে তার সততাকে বিশ্বাস করা যায় কিনা। আপনি তো অনেকদিন থেকেই সুলতা করকে দেখছেন এ বাড়িতে।
তা তাকে বিশ্বাস করা যায় বৈকি। ডিউটির ব্যাপারে কখনও তার কোন গাফিলতি বড় একটা দেখিনি।
বলেন কি! আমার তো মনে হল বরং ঠিক তার উল্টো। নার্স হবার আদৌ উপযুক্ত নন তিনি। She has rather chosen the wrong profession!
কেন? এ-কথা বলছেন কেন? বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ডাঃ সানিয়াল কিরীটীর মুখের দিকে।
তাছাড়া আর কি বলি বলুন! ডিউটি দিতে এসে নাহলে কেউ অমন করে অঘোরে ঘুমোতে পারে কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খেয়ে!
ডাঃ সানিয়াল নির্বাক বিস্ময়ে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন।
নিঃশেষিত চায়ের কাপটা একপাশে নামিয়ে রেখে পকেট হতে পাইপটা বের করল কিরীটী এবং অন্য হাতে কিমনোর পকেট হতে টোবাকো পাউচটা বের করে খানিকটা টোবাকো পাউচ থেকে দুই আঙুলের সাহায্যে তুলে পাইপের গহুরে ঠাসতে থাকে ধীরে ধীরে। এবং পাইপটা ঠিক করতে করতে কতকটা যেন অন্যমনস্ক ভাবেই বলে, আমার কি মনে হয় জানেন ডাক্তার?
কি?
নার্স সুলতা কর শুধু যে তার ডিউটিতে গত রাত্রে মারাত্মক গাফিলতি করেছে তাই নয়, সে আমাদের সব কথা খুলে বলেনি।
সত্যি আপনার তাই মনে হয় নাকি মিঃ রায়?
হ্যাঁ। আরও অনেক কিছু সে জানে, যা ঘুমের দোহাই দিয়ে আমাদের কাছ থেকে চেপে গিয়েছে।
তাহলে আর একবার না হয় সুলতাকে ডাকি!
না। এখন তাকে আবার ডেকে এনে কোন ফল হবে না।
কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না মিঃ রায়, এ ব্যাপারে ইচ্ছে করে কোন কথা তার পক্ষে গোপন রাখবার কি কারণই বা থাকতে পারে?
কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে রহস্যময় হাসি দেখা যায়। মৃদু হেসে সে বলে, কোথায় কার স্বার্থ—এত সহজেই ঠিক ধরা যায় না। অত সহজে যাচাই করতে গেলে কিন্তু আপনি ঠকবেন ডাক্তার। স্বার্থ ব্যাপারটা এমন সূক্ষ্ম ও ঘোরালো যে, অনেক সময় তার হদিস পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ে। তারপর যেন কতকটা বেখাপ্পা ভাবেই কিরীটী ডাঃ সানিয়ালের মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, আচ্ছা বলতে পারেন ডাক্তার, আপনার ঐ নার্স সুলতা কর ও শকুনি ঘোষের মধ্যে পরস্পরের আলাপ-পরিচয়টা ঠিক কি ধরণের এবং কত দিনের?
প্রশ্নোত্তরে এবারে একটুখানি মৃদু হেসে ডাঃ সানিয়াল বলেন, কেন বলুন তো?
এমনি জিজ্ঞাসা করছি।
সুলতা কর এখানেই থাকে এবং শুনেছি শকুনিবাবুর সঙ্গে সুলতার এ বাড়িতে ডিউটি দিতে আসবার আগে থেকেই নাকি আলাপ-পরিচয় কিছুটা ছিল।
কথাটা শুনে কিরীটীর চোখের তারা দুটো যেন হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
কিন্তু হঠাৎ এ-কথা আপনার মনে হল কেন মিঃ রায়? প্রশ্ন করেন ডাঃ সানিয়াল।
কারণ অবশ্য একটা আছে, কিন্তু তারও আগে আমাদের জানতে হবে কাল রাতে সুলতা কর তার জবানবন্দিতে কতকটা ইচ্ছে করেই বিশেষ একটা মিথ্যে কথা কেন বলেছিল?
বিশেষ মিথ্যে কথা! ডাঃ সানিয়াল বিস্মিত ও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
হ্যাঁ, বিশেষ একটা মিথ্যে কথা। সে তার জবানবন্দিতে বলেছে, আপনার ঘরের তৈরি কফি খেয়েই নাকি সে ঘুমিয়ে পড়েছিল—কিন্তু কেন ঐ মিথ্যে কথাটা বললে!
কিরীটীর কথায় ডাঃ সানিয়াল চমকে উঠে বললেন, সে কি? কাল আমার তাকে আমি কখন কফি দিলাম?
জানি আপনি দেননি।
কিন্তু অমন একটা মিথ্যে কথা বলবার কি এমন কারণ?
এটা আর বুঝলেন না ডাক্তার! অর্থাৎ সে প্রমাণ করতে চেয়েছিল, হয়ত আপনার দেওয়া কফির মধ্যেই কোন তীব্র ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত ছিল। যার ফলে সে ঠিক হত্যার সময়টিতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কিরীটী একটু থেমে আবার বলে, কিন্তু আমি ভাবছি কি জানেন ডাঃ সানিয়াল, সে তাহলে কার দেওয়া কফি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল? কে দিল ঘুমের ওষুধ-মিশ্রিত কফি তাকে কাল রাত্রে?
আপনার তাহলে ধারণা, কাল রাত্রে কেউ-না-কেউ তাকে কফি দিয়েছিল?
হ্যাঁ।
আচ্ছা মিঃ রায়, এমনও তো হতে পারে কাল রাত্রে মিস কর আদপেই কফি পান করেনি! স্রেফ মিথ্যে কথা বলেছে।
না। মিস কর কাল রাত্রে কফি পান করেছিল এবং কফির সঙ্গে কোন তীব্র ঘুমের ওষুধও যে মিশ্রিত ছিল সে সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ।
কে তাহলে দিল তাকে কফি! ডাঃ সানিয়াল আপন মনেই যেন কথাটা উচ্চারণ করেন।
তাই তো আমিও ভাবছি। কিরীটী চিন্তান্বিত ভাবেই পুনরায় বলে, কে সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি, মানে কে সুলতা করকে কাল রাত্রে ঘুম পাড়াবার জন্য ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে কফি তৈরী করে দিয়েছিল এবং কে গিয়ে তাকে আপনার নাম করে কফিটা দিয়ে এসেছিল, সেটাই সর্বাগ্রে আমাদের এখন জানা দরকার।
কিন্তু আপনি যা ভাবছেন তাই যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমার মনে হয় মিঃ রায়, ডাঃ বলেন, মিস করকে এ ঘরে আর একবার ডেকে এনে সে কথাটা জিজ্ঞাসা করলেই তো লেটা চুকে যায়। কে তাকে কফি করে গত রাত্রে দিয়ে এসেছিল!
ডাঃ সানিয়ালের কথায় কিরীটী হেসে ওঠে এবং হাসতে হাসতে বলে, কেন, আপনি দিয়ে এসেছিলেন সে তাই বলবে!
আমি যে তাকে কফি দিইনি আপনি তো তা জানেন, তাছাড়া আপনি তো আমার ঘরেই ছিলেন সে সময়। আমরা তো সব এক জায়গাতেই ছিলাম।
ডাক্তার, এসব ব্যাপারে আপনি দেখছি একেবারে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। আপনি এটা বুঝছেন না কেন, আপনি একজন মধ্যবয়সী পুরুষ—যে বয়সটা পুরুষের পক্ষে এবং বিপত্নীক পুরুষের পক্ষে বিশেষ করে একটু আশঙ্কাজনকই। তাই ঐ চাতুরীর সাহায্য সে নিয়েছে। চালাক মেয়ে!
কিন্তু এ কথাটা কি তার বোঝবার বয়স হয়নি যে জেরার মুখে সত্যটা প্রকাশ হবেই?
এখন সে ভুল শোনবার দোহাই দিয়ে অস্বীকৃতি জানিয়ে হয়ত বাঁচবার চেষ্টা করবে।
কিন্তু তাতেই বা লাভটা কি?
লাভ! লাভ time-factor! কিরীটী হাসতে হাসতে প্রত্যুত্তর দিল।