০৯. ঘরের দরজায় কার যেন ছায়া

ঘরের দরজায় কার যেন ছায়া পড়ল। কায়ীরা মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে কমবয়সী কয়েকজন ছেলেমেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ছেলেমেয়েগুলোকে সে চিনতে পারে। এরা সবাই নিহনের বন্ধু। ডলফিনের ওপর চেপে যে দলটি সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায় এরা সেই দলের ছেলেমেয়ে।

কায়ীরা তার হাতের কাগজটা টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?

আমরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, কায়ীরা।

হ্যাঁ, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। এস ভেতরে এস।

ছেলেমেয়েগুলো কায়ীরার ছোট ঘরটাতে ঢুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে পড়ে। তারা কী জন্য এসেছে কায়ীরা সেটা ভালো করেই জানে। তাই সে কোনো কথা না বলে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে। ছেলেমেয়েগুলোর ভেতরে যে একটু বড়, সুদর্শন ক্ৰিহা ভণিতা না। করে কথা বলতে শুরু করে, কায়ীরা, আমাদের নিহনকে স্থলমানবেরা ধরে নিয়ে গেছে।

কায়ীরা নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। ক্ৰিহা বলল, ঘটনার সময় নাইনা সেখানে ছিল, সেখানে কী ঘটেছে আমরা সেটা নাইনার মুখে শুনেছি।

কায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, আমরা সবাই সেটা শুনেছি।

এটা কেমন করে হতে পারে-স্থলমানবেরা ইচ্ছা করলেই আমাদের কাউকে খুন করে। ফেলবে? আমাদের কাউকে ধরে নিয়ে যাবে?

কায়ীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, এটা হতে পারে না, কিন্তু তবুও হচ্ছে। আমি এ রকম আরো অসংখ্য উদাহরণ দিতে পারি যেগুলো হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়, কিন্তু হচ্ছে।

নাইনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, আমরা কি সেগুলো চুপচাপ মেনে নেব?

কায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, নাইনা, তুমি আমাকে একটা খুব কঠিন প্রশ্ন করেছ। নিহনকে ধরে নিয়ে যাবার পর থেকে আমি একা একা এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি।

ক্ৰিহা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি কোনো উত্তর খুঁজে পেয়েছ?

কায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, না। পাই নি।

ক্ৰিহা কঠিন মুখে বলল, আমরা পেয়েছি। আমরা তোমাকে সেটা বলতে এসেছি।

কায়ীরার মুখে খুব সূক্ষ্ম মলিন একটা হাসি ফুটে উঠল, সেই হাসির মাঝে কোনো আনন্দ নেই, আছে অনেকখানি বেদনা। সে বলল, তোমরা কী বলবে আমি সেটা অনুমান করতে পারছি।

তুমি কেমন করে সেটা অনুমান করতে পারছ?

একসময় আমি তোমাদের বয়সী ছিলাম, তখন আমি তোমাদের মতো করে চিন্তা করতাম। কায়ীরা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তবু আমি তোমাদের মুখ থেকেই শুনি।

ক্রিহার ছেলেমানুষি মুখটা এবার আরো কঠিন হয়ে গেল, সে বলল, আমরা স্থলমানবের এ রকম অত্যাচার মেনে নেব না। আমরা তার প্রতিশোধ নেব।

প্রতিশোধ?

হ্যাঁ। প্রতিশোধ।

কায়ীরা মৃদু গলায় বলল, তোমরা কীভাবে প্রতিশোধ নিতে চাও?

ছেলেমেয়েগুলো কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, পেছন থেকে একজন বলে, স্থলমানবেরা যদি আমাদের একজনকে ধরে নিয়ে যায় তা হলে আমরাও তাদের একজনকে ধরে নিয়ে আসব। স্থলমানবেরা যদি আমাদের একজনকে খুন করে তা হলে আমরাও তাদের একজনকে খুন করব।

কায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মানুষ দু কারণে প্রতিশোধ নেয়। এক প্রতিশোধ নিয়ে এক ধরনের মানসিক শান্তি পাওয়া। দুই : প্রতিশোধ নিয়ে এক ধরনের সঙ্কেত পাঠানো যে ভবিষ্যতে কিছু একটা করলে তোমাদের এই অবস্থা হবে। তোমরা কী জন্য প্রতিশোধ নিতে চাইছ?

ক্ৰিহা একটু ইতস্তত করে বলল, মনে হয় দুই কারণেই। আমরা দুটোই করতে চাই।

তোমাদের কি সেই ক্ষমতা আছে?

একজন সোজা হয়ে বসে বলল, আছে।

তুমি জান, স্থলমানবদের কত রকম অস্ত্র আছে?

জানি। আমি অস্ত্রকে ভয় পাই না। আসলে-

আসলে কী?

আসলে আমি মৃত্যুকেও ভয় পাই না। দরকার হলে আমি প্রাণ দেব-

কায়ীরা এবার হেসে ফেলল, বলল, প্রাণ যে কী মূল্যবান একটা জিনিস সেটা তোমরা জান না। এত সহজে প্রাণ দেওয়ার কথা বোলো না। প্রাণটুকু থাকলে ভবিষ্যতে এক শ একটা কাজ করা যায়।

হ্যাঁ কিন্তু প্রাণ খুব শক্তিশালী জিনিস। একজন মানুষ যদি প্রাণ দিতে ভয় পায় তা হলে সে একাই কিন্তু অনেক কিছু করে ফেলতে পারে।

কায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ ক্রিহা। একজন মানুষ যদি নিজের প্রাণটুকু দিতে রাজি থাকে তা হলে সেটা দিয়ে অনেক কিছু করতে পারে।

ক্ৰিহা এবার একটু এগিয়ে আসে, উত্তেজিত গলায় বলে, আমরা একটা পরিকল্পনা করেছি কায়ীরা। আমরা সেই পরিকল্পনাটার কথা তোমাকে বলতে এসেছি।

বলবে? আমি মনে হয় অনুমান করতে পারছি তোমরা কী বলবে। তবু বল, শুনি।

ক্ৰিহা একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমরা স্থলমানবের দেশে গিয়ে তাদের একজনকে ধরে আনতে চাই। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিহনকে ছাড়বে না আমরাও সেই স্থলমানবকে ছাড়ব না।

তোমরা সত্যি একজন স্থলমানবকে ধরে আনতে পারবে?

একসাথে সবাই কথা বলতে শুরু করে, পারব, কায়ীরা। অবশ্যই পারব। একশবার পারব।

কায়ীরা আবার একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, তোমাদের নিজেদের ওপর তোমাদের আত্মবিশ্বাসটুকু দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।

নাইনা আগ্রহ নিয়ে বলল, কায়ীরা, তুমি আমাদের পরিকল্পনাটুকু শুনতে চাও।

না। এখনই শুনতে চাই না, নাইনা।

কেন?

কারণ আমার মনে হয় তোমাদের পরিকল্পনাটা কাজে লাগানোর সময় এখনো আসে নি। আমাদের আরো একটু সময় দরকার।

কেন আরো সময় দরকার?

তোমার শত্রু যখন তোমার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী হয় তখন তাকে আক্রমণ করতে হয় খুব সাবধানে। মনে রেখ দুঃসময়ে টিকে থাকাটাই হচ্ছে বিজয়।

টিকে থাকাটাই বিজয়? ক্ৰিহা মুখ বিকৃত করে বলল, পোকামাকড়ের মতো শুধু টিকে থাকব?

তুমি যদি টিকে থাকতে পার তা হলে একসময় সম্মান নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে পৃথিবীর মানুষ আমাদের পানিতে ঠেলে দেওয়ার পর প্রায় দুই শতাব্দী পার হয়ে গেছে। আমরা এখনো টিকে আছি। সুলমানবেরা আমাদের শেষ করে দিতে না চাইলে আমরা টিকে থাকব। তাই আমাদের খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাকে ভাববার একটু সময় দাও তোমরা।

কায়ীরার কথা শুনে ছেলেমেয়েগুলোর মুখে এক ধরনের আশাভঙ্গের ছায়া পড়ে, সেটা কায়ীরার দৃষ্টি এড়ায় না। সে কোমল কণ্ঠে বলল, তোমরা আমার ওপর একটু বিশ্বাস রাখ, আমার নিজের সন্তান বেঁচে নেই, সে বেঁচে থাকলে তোমাদের মতো বড় হত। বিশ্বাস কর নিহনকে ফিরিয়ে আনার জন্য যেটা করতে হয় আমি সেটা করব। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আমি আমাদের পুরো পরিবারকে বিপদের মাঝে ফেলতে চাই না। যেভাবেই হোক আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে থাকতেই হবে!

ছেলেমেয়েগুলো একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। কায়ীরা টেবিল থেকে তার কাগজটা তুলে এনে বলল, আমি খুব খুশি হয়েছি যে তোমরা আমার কাছে এসেছ। প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলছ। তোমাদের এই বয়সে তোমরা এত বড় অবিচার মুখ বুজে সহ্য করলে খুব ভুল হত। নিহনের জন্য তোমাদের এই ভালবাসাটুকুকে আমি খুব সম্মান দিচ্ছি। আমরা পৃথিবীতে বেঁচে আছি শুধুই এই একটি কারণে, মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসার কারণে।

নাইনা ভাঙা গলায় বলল, তোমার কী মনে হয়, কায়ীরা, নিহন কি বেঁচে আছে?

জানি না। ওখানে ডলফিনদের একটা দল ছিল, তারা বলেছে নিহনকে মারে নি। ধরে নিয়েছে। সেটা একটা ভালো সংবাদ।

কিন্তু ধরে নিয়ে তো কিছু একটা করে ফেলতে পারে।

হ্যাঁ। তা পারে। কিন্তু তবু আমরা আশা নিয়ে থাকব। সমুদ্রের সব ডলফিনকে খবর দেওয়া আছে-যদি তারা নিহনকে দেখে তাকে যেন সাহায্য করে।

ক্রিহা বলল, কায়ীরা।

বল, ক্ৰিহা।

আমরা কি স্থলমানবদের একটা খবর পাঠাতে পারি না? তাদের বলতে পারি না নিহনকে ফেরত দিতে?

পারি। কিন্তু সেই খবর পাঠালে লাভ হবে কি না, আমি সেটা এখনো বুঝতে পারছি না। আমাকে একটু ভেবে দেখতে দাও।

 তুমি যদি কোনো খবর পাঠাতে চাও আমাকে বোলো। আমি সেই খবর নিয়ে যাব, কায়ীরা।

ঠিক আছে, ক্ৰিহা। আমি জানি তোমার অনেক সাহস।

যদি অন্য কিছুও করতে চাও সেটাও আমাদের বোলো। নিহনের জন্য আমরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারি।

কায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তোমরা তো জান এই পৃথিবীতে এখন আমাদের বেঁচে থাকার একটাই উপায়। সেটা হচ্ছে আমাদের মেধা। আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি। আমাদের জ্ঞান। তোমরা সেটা ভুলবে না। তোমাদের শিখতে হবে। সবকিছু শিখতে হবে। জানতে হবে। বিদ্যাবুদ্ধিতে স্থলমানবদের হারাতে হবে, তা না হলে আমরা কিন্তু শেষ হয়ে যাব।