কৃষ্ণা বলে, যা বলিলে সব আমি জানি।
আজি রক্ষা পেলে, পিছে হব ঠাকুরাণী।।
যদি তুমি কীচকে না দিবে আজি দণ্ড।
লোকে কবে, সৈরন্ধ্রী যে কহিয়াছে ভণ্ড।।
আমি কহিয়াছি সর্ব্বলোকের গোচর।
আমার আছয়ে পঞ্চ গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর।।
গন্ধর্ব্বের নাম শুনি করে উপহাস।
বলে, লক্ষ গন্ধর্ব্বেরে করিব বিনাশ।।
সকল শোভিল তার যতেক কহিল।
এত অপমান করি দণ্ড না পাইল।।
প্রভাত হইলে পুনঃ দ্বারেতে আসিবে।
পরিহাস করি মোরে বচন কহিবে।।
সে বাক্য শুনিতে মোরে যেতে বল ঘরে।
এখনি ত্যজিব প্রাণ তোমার গোচরে।।
জয়দ্রথ ভয় হৈতে করিলে উদ্ধার।
জটাসুর বিনাশিয়া কৈলে প্রতিকার।।
এখন কীচক-ভয়ে কর পরিত্রাণ।
তোমা বিনা রাখে ইথে, নাহি দেখি আন।।
যুধিষ্ঠির আজ্ঞা হেতু বিচারিছ চিতে।
আজ্ঞা করেছেন তিনি কীচকে দণ্ডিতে।।
তখনি বিদিত হৈত পূর্ণ সভামাঝ।
ধর্ম্মভয় করি ক্ষমা করে মহারাজ।।
এত শুনি চিন্তি ভীম বলিল বচন।
না কর ক্রন্দন দেবি স্থির কর মন।।
এত বলি ক্রোধে ভীম কহেন তখন।
কীচকে অবশ্য আমি করিব নিধন।।
সময় করহ এক কিন্তু তার সনে।
উপায়ে মারিব, যেন কেহ নাহি জানে।।
আজিকার মত তুমি যাহ নিজালয়ে।
কালি প্রাতে তার সঙ্গে করিহ সময়।।
নৃত্যশালে যথা কন্যাগণ নৃত্য শিখে।
রজনীতে শূন্য তথা, কেহ নাহি থাকে।।
তথায় নির্ব্বন্ধ কর শয্যা করিবারে।
সে ঘরে পাঠাব দুষ্টে শমন-আগারে।।
ভীমের আশ্বাস পেয়ে সম্বরি ক্রন্দন।
নয়ন মুছিয়া কৃষ্ণা করিল গমন।।
রজনী প্রভাত হৈল, কীচক উঠিল।
যথা রাজগৃহে কৃষ্ণা শীঘ্রগতি গেল।।
দ্রৌপদীর প্রতি তবে দম্ভ করি বলে।
ধাইয়া যে গেলে তুমি রাজ সভাস্থলে।।
রাজ-বিদ্যমানে তোরে প্রহারিনু লাথি।
কি করিল মোরে বল বিরাট নৃপতি।।
মোর বাহুবলে রাজ্য ভুঞ্জে নরপতি।
কি করিতে পারে মোর, কাহার শকতি।।
ভজহ সৈরন্ধ্রী মোরে, ক্ষম দোষ মোর।
এই দেখ দন্তে তৃণ, দাস হৈনু তোর।।
কৃষ্ণা বলে, তব বশ হইলাম আমি।
আছয়ে গন্ধর্ব্ব কিন্তু মোর পঞ্চস্বামী।।
তাহা সবাকারে বড় ভয় হয় মনে।
এমন করহ, যেন কেহ নাহি জানে।।
নৃত্যশালা রজনীতে থাকে শূন্যাগার।
তথা নিশা তব সঙ্গে করিব বিহার।।
এত শুনি দৃষ্টমতি হৈল হৃষ্টমন।
শীঘ্রগতি নিজগৃহে করিল গমন।।
নানা গন্ধ চন্দনাদি অঙ্গেতে লেপিল।
দিব্য রত্ন অলংকার অঙ্গেতে ভূষিল।।
সৈরন্ধ্রী চিন্তা করি বিরহ-হুতাশে।
ক্ষণে ক্ষণে দিনকর নিরখে আকাশে।।
কতক্ষণে হবে অস্ত দেব দিবাকর।
পুনঃ বাহিরায়, পুনঃ প্রবেশয়ে ঘর।।
হেথা কৃষ্ণা বৃকোদরে কহে সমাচার।
রাত্রিতে আসিবে নৃত্যালযে দুষ্টাচার।।
যথোচিত ফল আজি দিবে তার প্রতি।
প্রভাত না হয় যেন আজিকার রাতি।।
এমতে আসিয়া হৈল সন্ধ্যার সময়।
বৃকোদর আগে চলি গেল নৃত্যালয়।।
অন্ধকার করি বৈসে পালঙ্কের মাঝ।
মৃগ মারিবারে যথা সাজে মৃগরাজ।।
আনন্দিত চিত্ত হয়ে কীচক চলিল।
একক হইয়া, সঙ্গে কারে না লইল।।
যথায় পুরুষ-সিংহ আছে বৃকোদর।
কীচক বসিল গিয়া পালঙ্ক উপর।।
অনঙ্গ দহনে দুষ্ট মোহিত হইয়া।
না বুঝিল, আছে যম পালঙ্কে বসিয়া।।
অতীব হরষেতে হইয়া পুলকিত।
হাসিয়া বলিছে অঙ্গে বৃকোদর কায়।
কামানলে দগ্ধ, বুঝে সৈরন্ধ্রীর প্রায়।।
আমার মহিমা তুমি না জান সুন্দরী।
মোর রূপ গুণে বশ যত নর নারী।।
পূর্ব্বভাগ্যে গুণবতী পেলে তুমি মোরে।
সবারে ত্যজিয়া আমি ভজিনু তোমারে।।
ভীম বলে, বড় ভাগ্য আমার আছিল।
সে কারণে তোমা স্বামী বিধি মিলাইল।।
তোমার মহিমা আমি নাহি জানি পূর্ব্বে।
সে কারণে হেলা কৈনু গন্ধর্ব্বের গর্ব্বে।।
কিন্তু এক তাপ মোর জাগিতেছে মনে।
রাজসভামধ্যে মোরে মারিলে চরণে।।
বজ্রের সমান তব চরণ প্রহার।
বড় ভাগ্যে প্রাণ রক্ষা হইল আমার।।
কমল অধিক মোর কোমল শরীর।
বেদনায় প্রাণ মোর হতেছে বাহির।।
মনোদুঃখে কিরুপেতে পাবে রতিসুখ।
এত শুনি কহে তবে কীচক দুর্ম্মুখ।।
ক্ষমহ সে সব দোষ, ত্যাজ দুঃখ মন।
প্রসন্ন হইয়া মোরে করহ বরণ।।
পদাঘাত দুঃখ যদি আছয়ে অন্তরে।
সেইমত পদাঘাত করহ আমারে।।
এত বলি দুষ্টমতি মাথা দিল পাতি।
অন্তরে হাসিয়া উঠে ভীম মহামতি।।
বজ্রাঘাত প্রায় ঘাড়ে প্রহারিল লাথি।
তথাপি নাহিক বুঝে কীচক দুর্ম্মতি।।
যে চরণাঘাতে ভীম গিরি চূর্ণ কৈল।
হিড়িম্ব কির্ম্মীর বক প্রভৃতি মারিল।।
একে একে তিনবার করিল প্রহার।
তথাপি নাহি জানে কীচক গোঁয়ার।।
ভীম বলে, আরে দুষ্ট গন্ধর্ব্বে বিবাদ।
ঘুচাইব সৈরন্ধ্রীর পত্নীত্বের সাধ।।
ভীমবাক্য শুনি জন্মে কীচকের জ্ঞান।
লাফ দিয়ে উঠি ধরে ব্যাঘ্রের সমান।।
মহাপরাক্রম হয় কীচক দুর্জ্জয়।
দশ ভীম হৈলে তার সম যুদ্ধে নয়।।
কৃষ্ণার ধরিয়া কেশ আয়ু হৈল ক্ষীন।
বিশেষ চরণাঘাতে বল হৈল হীন।।
তথাপি বিক্রমে ভীম হৈতে নহে ঊন।
পদাঘাত দৃঢ়মুষ্টি হানে পুনঃ পুনঃ।।
আঁচড়ে কামড়, মুণ্ডে মুণ্ডে তাড়াতাড়ি।
ধরাধরি করি ভূমে যায় গড়াগড়ি।।
কখন উপরে ভীম, কখন কীচকে।
শোণিত জর্জ্জের অঙ্গ, পদাঘাতে নখে।।
নিঃশব্দেতে দোঁহে যুদ্ধ ঘরের ভিতর।
এইমত যুদ্ধ হৈল তৃতীয় প্রহর।।
ঊনপঞ্চাশৎ বায়ুতেজ ধরে ভীম।
তথাপি কীচক নহে সংগ্রামেতে হীন।।
পুনঃ পুনঃ উঠে দোঁহে করয়ে প্রহার।
চরণের ঘাতে ক্ষিতি হইল বিদার।।
বসন্ত সময়ে যেন হস্তিনী কারণ।
পর্ব্বত উপরে দুই হস্তী করে রণ।।
ক্রোধে অগ্নিবৎ জ্বলে বায়ুর নন্দন।
কীচকে ফেলিয়া বুকে করিল আসন।।
দ্রৌপদীর অপমান হৃদয়েতে জাগে।
সিংহ যেন চাপি ধরে মদমত্ত মৃগে।।
আরে দুরাচার দুষ্ট কীচক দুর্ম্মতি।
এই মুখে কহ কটু সৈরন্ধ্রীর প্রতি।।
এত বলি সেই মুখে মারে বজ্রমুঠি।
ভাঙ্গিয়া ফেলিল তার দন্ত দুই পাটী।।
এই চোখে সৈরন্ধ্রীরে করিলি দর্শন।
এত বলি বজ্রনখে উপাড়ে নয়ন।।
মহারোষে বক্ষদেশে মারিলেক লাথি।
সেই ঘাতে প্রাণ ছাড়ে কীচক দুম্মতি।।
হস্ত পদ শির তার সব চূর্ণ কৈল।
কচ্ছপের প্রায় তার অঙ্গ যেন হৈল।।
মাংসপিণ্ডবৎ করি কুষ্মাণ্ড-আকার।
হাসিয়া কৃষ্ণারে ডাকে পবন কুমার।।
অগ্নি জ্বালি দেখ এবে যাজ্ঞসেনী সতী।
তোমা হিংসি কীচকের এতেক দুর্গতি।।
অপরাধ মত দণ্ড পাইল দুর্ম্মতি।
যে তোমার অপরাধী তার এই গতি।।
এত বলি বৃকোদর করিল গমন।
রন্ধনশালায় যথা শয়ন আসন।।
স্নান করি অঙ্গে দিল সুগন্ধি চন্দন।
যুদ্ধশ্রান্ত হয়ে বীর করেন শয়ন।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশীদাস কহে, সাধু শুনে কর্ণ ভরি।।