কিছু-একটা হয়েছে রূপাদের বাড়িতে।
সবার মুখ হাসি হাসি। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা। বড় ধরনের আনন্দের কোনো ঘটনা। এ-বাড়িতে ঘটে গেছে কিংবা ঘটতে যাচ্ছে। তবে এই ঘটনা নিয়ে কেউ আলোচনা কবীতে চাচ্ছে না। আলোচনা করতে না চাইলেও রূপার ধারণা সে ব্যাপারটা আঁচ করতে পারছে।
বিকেলে মিনু বলল, বরূপা শুনে যাও তো। এসো আমার সঙ্গে।
কোথায়?
ছাদে।
কোনো গোপন কথা?
গোপন কথা কিছু না, প্রকাশ্য কথা–ছাদে তোমার চুল বাঁধতে বাঁধতে বলব।
রূপা ছাদে গেল। মিনু তার চুল বাঁধতে বাধতে বলল, তানভিব জায়গাটা ঘুবে ফিরে দেখতে চায়। তুমি তাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোবে।
এটাই তোমার প্রকাশ্য কথা?
না এটা প্রকাশ্য কথা না। প্রকাশ্য কথা হলো–তানভির কাল রাতে মুজিকের আসর শেষ হবার পরে তোমার ভাইয়াকে বলেছে–সে তোমাকে পছন্দ করেছে। শুধু পছন্দ না, অসম্ভব পছন্দ করেছে।
ও আচ্ছা!
ঘটনা এইখানেই শেষ না। আজ ভোরে সে বলেছে, সে এই বাড়িতেই তোমাকে বিয়ে করতে চায়। তারপর বউ নিয়ে চলে যাবে।
এত তাড়া কেন?
তাড়া না। কথা এমনই ছিল। সে খুব খেয়ালি ছেলে। আমাদের এখানে আসার আগে তার বাবা তোমার মেজো ভাইকে খবর দিয়ে নিয়ে যান এবং বলেন–আমার ছেলে যদি কোনো মেয়েকে পছন্দ করে ওকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে। এই ছেলে বড় যন্ত্রণা করছে। কিছুতেই তাকে বিয়ে করাতে রাজি করানো যাচ্ছে না।
রূপা বলল, বিয়েটা হচ্ছে কবে? আজই না-কি?
বিয়ে দিয়ে দেয়া। তা তো সম্ভব না। সবাইকে খবর দিতে হবে। ছেলের আত্মীয়স্বজনদের জানাতে হবে। দিন সাতেক তো লাগবেই।
এই সাতদিন আমি ভদ্রলোককে নিয়ে গ্রাম দেখাব, নদী দেখাব?
হ্যাঁ, বন্ধুর মতো পাশাপাশি থাকবে। প্ৰেম প্রেম খেলবে।
রূপা সহজ গলায় বলল, আচ্ছা।
মিনু বলল, তোমার ভাগ্য দেখে আমার ঈর্ষা হচ্ছে রূপা।
রূপা বলল, আমার নিজেরই ঈর্ষা হচ্ছে, তোমার তো হবেই। আমি বৃশ্চিক রাশির মেয়ে। বৃশ্চিক রাশির মেয়েদের ঈর্ষা না করে উপায় নেই। এরা হয় খুব উপরে উঠবে। কিংবা ধুলার সঙ্গে মিশে যাবে। এদের কোনো মধ্যম পন্থা নেই।
কে বলেছে?
রাশিচক্র বলে একটা বই পড়ে সব জেনে বসে আছি।
রূপা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল। এই হাসি মিনুর ভালো লাগল না। তবে সে সাজগোজ করতে মোটেই আপত্তি করল না। আকাশী রঙের একটা শাড়ি পরল। যা কখনো করে না। তাই করল, মার কাছ থেকে চেয়ে গয়না পরল। দীর্ঘ সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। জেবা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। জেবাকে বলল, কেমন দেখাচ্ছে জেবা?
জেবা হাসল। জবাব দিল না।
বলো তো আমাকে ইন্দ্ৰাণীর মতো লাগছে কি-না?
জেবা এই প্রশ্নোবও জবাব দিল না। আবারো হাসল। যেন সে রূপার ছেলেমানুষিতে খুব মজা পাচ্ছে।
রাস্তায় নেমেই রূপা বলল, আপনি কোন দিকে যেতে চান?
তানভির বলল, যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে যেতে পারি।
নদী দেখবেন? নদী?
অবশ্যই নদী দেখব? বাঙালি ছেলে হয়ে নদী দেখব না, তা-কি হয়!
হাঁটতে হবে কিন্তু। হাঁটতে হলে হাঁটব। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ঢাকা থেকে হেঁটে মানিকগঞ্জ গিয়েছিলাম। ননস্টপ হাঁটা। পথে একবার শুধু একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খেয়েছি। ভালো কথা রূপা, চা ভর্তি একটা ফ্লাঙ্ক সঙ্গে নিলে হতো না? নদীর তীরে বসে চা খাওয়া যেত।
আমি আপনাকে চা খাওয়ার ব্যবস্থা করব।
কীভাবে করবে?
আমি যেখানে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে আমার এক স্যারের বাসা। স্যারের বাসা থেকে চা বানিয়ে আনব। ঘাটে স্যারের একটা নৌকা আছে। সব সময় নৌকা বাধা থাকে। ঐ নৌকায় বসে চা খাব।
ব্ৰিলিয়ান্ট আইডিয়া।
আপনি নৌকা বাইতে পারেন?
পারি না, তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি। নৌকা চালানো খুব কঠিন হবার কথা না; নৌক তো এরোপ্লেন না।
নৌকা চালানো যথেষ্টই কঠিন। এরোপ্লেন চালানোবা জন্যে কত যন্ত্রপাতি আছে। বোতাম টিপলেই হলো। নৌকার তো কোনো বোতাম নেই।
তানভিরের কাছে মেয়েটিকে আজ অন্য রকম লাগছে। স্মাট একটি মেয়ে যে কথার পিঠে কথা বলতে পারে এবং গুছিয়ে বলতে পারে। মেয়েটি বড় হয়েছে গ্রামে অথচ কত সহজ ভঙ্গিতে হাঁটছে। গল্প করছে। বিন্দুমাত্র আড়ষ্টতা নেই।
রূপা বলল, আমার স্যারকে দেখে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।
কেন বলে তো?
খুবা জ্ঞানী মানুষ। সন্ন্যাসীদের মতো। চিরকুমার।
তানভির সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, কিছু কিছু মানুষ আছে টাকা-পয়সাব অভাবে এবং সাহসের অভাবে বিয়ে করতে পারে না। তারা হয়ে যায় চিবকুমাব। কিছু কিছু পাগলামি তাদের মধ্যে চলে আসে। এইসব দেখতে আমাদের ভালো লাগে। এর বেশি কিছু না।
স্যারের মধ্যে কোনো পাগলামি নেই। তার একটা টেলিস্কোপ আছে। তিনি এই টেলিস্কোপ দিয়ে রাতের পর রাত তারা দেখেন।
এটাই কি পাগলামি না? তিনি নিশ্চয়ই এষ্ট্ৰনমার না বা এসট্রো ফিজিসিষ্ট না। হিসাব নিকাশ করছেন না, তারাদেব গতিপথ বের করছেন না। শখের বসে আকাশ দেখছেন। সেটা তো একবার দেখলেই হয়। রাতের পর রাত হী করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রয়োজন কী?
রূপা হেসে ফেলল।
তানভির বিস্মিত হয়ে বলল, হাসছ কেন?
আপনি কেমন রাগ করছেন তাই দেখে হাসছি। যে মানুষটিকে আপনি এখনো দেখেন নি। তার উপর রাগ করছেন কেন?
তার উপর রাগ করছি না। তোমার বিচার-বিবেচনা দেখে রাগ করছি। তোমাদের মতো ব য়েসী মেয়েদের এই সমস্যা। তারা অতি অল্পতেই অভিভূত। একজন হয়তো কবিতা লেখে। তার মাথাভর্তি লম্বা চুল। ময়লা পাঞ্জাবি পরে উদাস মুখে ঘুরে বেড়ায়। তার একটি কবিতা না পড়ে শুধুমাত্র তাকে দেখেই তোমরা অভিভূত হয়ে যাবে। চোখ বড় বড় করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলবে, কবি, কবি!
রূপা খিলখিল করে হেসে ফেলল।
তানভিরও হাসল। হাসতে হাসতে বলল, লর্ড বায়রনের কথা তুমি জানো কি-না জানি না। বড় কবি। ইংল্যান্ডের সব তরুণী কবিতা না পড়েই এই মানুষটার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিল। অথচ মানুষটা ছিলেন খোড়া, তিরিক্ষি মেজাজ। কেউ তাঁর দিকে তাকালেই রেগে যেতেন। তিনি বিয়ের দুঘণ্টা পর নববধূকে কাছে ডেকে বললেন, এই শোন, তোমাকে আমি কেন বিয়ে করেছি। জানো? তোমাকে আমি অসম্ভব ঘৃণা করি বলেই বিয়ে করেছি।
রূপা বলল, বায়রনের কোনো কবিতা কি আপনার জানা আছে?
না। তুমি পড়তে চাইলে জোগাড় করে দেব। অনেক দূর এসে পড়েছি বলে মনে হচ্ছে। আব কতক্ষণ?
ঐ যে ভাঙা বাড়িটা দেখছেন–ঐ টা।
তানভির বিস্মিত হয়ে বলল, এ বাড়ি তো যে-কোনো মুহুর্তে ভেঙে মাথার উপর পড়বে। কোনো বুদ্ধিমান প্ৰাণী এই বাড়িতে বাস করতে পারে না। অসম্ভব!
তানভিাবের কথা ভুল প্রমাণ করে ভাঙা বাড়ির ভেতর থেকে মবিনুর রহমান বের হয়ে এলেন এবং নিতান্তই সহজ গলায় বললেন, রূপা আসা। যেন তিনি রূপার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন।
রূপা বলল, স্যার ইনি মেজো ভাইয়ের বন্ধু। আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছেন। গ্রাম দেখতে বের হয়েছেন।
মবিনুর রহমান বললেন, আসুন, ভেতরে আসুন।
তানভির কিছু বলল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বইলি। রূপা বলল, স্যার আপনার নৌকাটা কি ঘাটে আছে?
হ্যাঁ আছে।
আমরা আপনার নৌকান্য বসে চা খাব। ঘরে চা পাতা আছে স্যার?
আছে, চা পাতা আছে। তবে চিনি নেই। গুড় দিয়ে চা খেতে হবে। তোমরা নৌকায় গিয়ে বাস, আমি চা বানিয়ে আনছি।
আপনাকে চা বানাতে হবে না স্যার। আমি বানাব। কোনটা কোথায় আছে আপনি শুধু দেখিয়ে দেবেন।
রূপা চা বানাতে বসল। তানভির মবিনুর রহমানের পাশে একটা চৌকিতে বসল। সে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে বাড়ির ছাদ ভেঙে মাথায় পড়বে। তবে আরো আগে যে চৌকিতে বসেছে সেই টোকিও ভেঙে টুকরো টুকরো হবে। মটমট শব্দ করছে।
তানভির বলল, রূপা বলছিল। আপী-। না-কি টেলিস্কোপ দিয়ে সারারাত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন?
মবিনুর রহমান নিচু গলায় বললেন, এটা আমার একটা শখ। তবে সবদিন দুরবিন নিয়ে বসি না। আকাশ যখন পরিষ্কার থাকে তখন বসি।
কী দেখেন।
তারা দেখি?
একই তারা বারবার দেখতে ভালো লাগে?
জি লাগে। তারা দেখি আর ভাবি।
কী ভাবেন?
বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড কী করে তৈরি হলো তাই ভাবি।
আপনার এই ভাবনা তো পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই ভেবে রেখেছেন। বিগ বেংগ-এর ফলে ইউনিভার্সের সৃষ্টি।
এটা নিয়েই ভাবি। বিগ বেংগের আগে কী ছিল? অনন্ত শূন্য ছিল? যদি তাই থাকে তাহলে তো বিগ বেংগ-এর ফলে ইউনিভার্স সৃষ্টি হতে পারে না।
অসুবিধা কোথায়?
তাহলে ধরে নিতে হবে থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র কাজ করছে না। তা তো হয় না। প্রকৃতি তার নিজের নিয়ম কখনো ভঙ্গ করে না।
আপনি তা কী করে জানেন?
কেন জানব না? আমিও তো প্রকৃতিরই অংশ।
আপনার দুরবিনটা কি খুব ভালো দুরবিন?
জি। শনি গ্রহের বলয় পরিষ্কার দেখা যায়। এক রাতে সময় করে আসুন। আপনাকে 6थींद।
এখানে আসতে খুব ভরসা পাচ্ছি না। বাড়ির যা অবস্থা। যে কোনো মুহৰ্তে ছাদ মাথার উপর ভেঙে পড়বে বলে মনে হচ্ছে–তাছাড়া আমার কেন জানি মনে হচ্ছে। এ বাড়িতে বিষাক্ত সাপ আছে। ভাঙা বাড়ি সাপদের খুব প্রিয়।
মবিনুর রহমান সহজ গলায় বললেন, সাপ আছে ঠিকই। দুটো চন্দ্রবোড়া সাপ পাশের ঘরে থাকে।
সাপ আপনি টেনেন? চন্দ্ৰবোড়া বুঝলেন কী করে?
অনুমানে বলছি। সব সাপ ডিম দেয়। এই সাপটা সরাসরি বাচ্চা দিয়েছে। একমাত্র চন্দ্রবোড়াই সরাসরি বাচ্চা দেয়। একত্ৰিশটা বাচ্চা দিয়েছে।
বসে বসে গুনেছেন?
জি না। একদিন বারান্দায় বসে ছিলাম। দেখলাম, সাপটা বাচ্চাগুলি নিয়ে বের হয়েছে। তখন গুনলাম।
একত্ৰিশটা সাপের বাচ্চা এবং দুটা সাপ নিয়ে বাস করতে আপনার ভয় লাগে না?
একটু লাগে। রাতে আমি ঘরে থাকি না। নৌকায় ঘুমাই। তবে আমার মনে হয় ভয়ের কিছু নেই। আমরা সহাবস্থান নীতি গ্ৰহণ করেছি। আমি ওদের কিছু বলি না। ওরাও আমাকে কিছু বলে না। ওরা আমার গায়ের গন্ধ চেনে। আমিও ওদের গায়ের গন্ধ চিনি। আগেভাগেই সাবধান হয়ে যাই।
চা তৈরি হয়ে গেছে। মবিনুর রহমান ফ্রাঙ্ক এনে দিলেন। ফ্লাঙ্ক-ভর্তি চা নিয়ে তিনি নৌকায় রাত্রিযাপন করেন। তিনি লজ্জিত গলায় বললেন, খাবার-দাবার তো কিছু নেই রূপা। মুড়ি আছে। মুড়ি নিয়ে যাবে?
হ্যাঁ নিয়ে যাব। আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে।
রূপা, তানভিরকে নিয়ে নৌকায় উঠে খুশি খুশি গলায় বলল, সুন্দর না?
তানভির বলল, অবশ্যই সুন্দর। নৌকায় বসে চা খাওয়ার এই আইডিয়া অসাধারণ আইডিয়া। আমরা রোজ এখানে আসব। নৌকা চালানো শিখে নেব।
নদীতে কিন্তু খুব স্রোত।
হোক স্রোত। স্রোত কোনো সমস্যা না।
গুড়ের চা কেমন লাগছে?
অসাধারণ লাগছে। এই পরিবেশে সবকিছুই অসাধারণ লাগে।
আমার স্যারকে আপনার কেমন লাগল?
ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। তবে এই জাতীয় ক্যারেক্টর আমি আগেও দেখেছি। এরা কিছুটা অদ্ভুত। তবে যতটা না অদ্ভুত মানুষের কাছে তারা নিজেদের তার চেয়েও অদ্ভুত করে তুলে ধরে।
রূপা বলল, স্যার সম্পর্কে আমি আপনাকে খুব-একটা গোপন কথা বলতে পারি। বলব?
বলো!
কাউকে কিন্তু বলতে পারবেন না। অসম্ভব গোপন ব্যথা, পৃথিবীব কেউ জানে না। আমি কাউকে বলি নি। শুধু আপনাকে বলব, তবে কথা দিতে হবে আপনি কাউকে বলবেন না।
অবশ্যই আমি কাউকে বলব না।
কথাটা কী জানেন? স্যারকে আমি পাগলের মতো পছন্দ করি। সব সময় আমি উনার কথা ভাবি। রাতের পর রাত আমি ঘুমোতে পারি না। আমি ঠিক করেছি যেভাবেই হোক তাকে বিয়ে কবব। বাকি জীবন কাটিয়ে দেব তার সেবা করে।
তানভির অবাক হয়ে রূপার দিকে তকয়ে রইল। তার চোখ হয়েছে মাছের চোখের মতো। চোখে পলক পড়ছে না।