০৯. কাকাবাবু ভাল করে চোখ চাইতে পারছেন না

কাকাবাবু ভাল করে চোখ চাইতে পারছেন না, সবই অস্পষ্ট দেখছেন।

যা দেখছেন, তার মানে বুঝতে পারছেন না। একবার মনে হল, উলটো দিকে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, তার চেহারা অবিকল তার মতন। যেন আর একজন রাজা রায়চৌধুরী। ঠিক তার মতন গোঁফ, তার মতন দুবগলে ক্রাচ।

কাকাবাবু ভাবলেন, তার তো কোনও যমজ ভাই ছিল না কখনও। তা হলে এ লোকটা এল কোথা থেকে?

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লোকটা যেন কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল।

আবার সব কিছু অন্ধকার।

সেই অন্ধকারের মধ্যে একজন কেউ গম্ভীর গলায় বলল, ওয়েক আপ! ওয়েক আপ! মিস্টার রায়চৌধুরী, অনেক ঘুমিয়েছেন, এবার উঠুন!

আবার আলো জ্বলে উঠল। কে যেন একবাটি জল ছিটিয়ে দিল কাকাবাবুর মুখে। কনকনে ঠাণ্ডা জল। এবার তিনি জোরে মাথা ঝাকুনি দিলেন। তাকালেন পুরো চোখ মেলে।

ফের আলো নিভে গিয়ে জ্বলে উঠেছে একটা স্পটলাইট। তাতে দেখা যাচ্ছে মস্তবড় একটা সাপের ফণা। সেটা দুলছে আর ফোস ফোস শব্দ হচ্ছে।

সেই সাপ মানুষের মতন কথা বলে উঠল। তাও ইংরেজিতে। ফোস ফোস করতে করতে বলল, মিস্টার রায়চৌধুরী, মিট শঙ্খচূড়।

কাকাবাবু হাত তুলতে গিয়ে টের পেলেন তাঁর দুটো হাত পেছন দিকে বাঁধা।

কয়েক মুহূর্ত পরেই জায়গাটা ভরে গেল ঝলমলে আলোয়।

এবার দেখা গেল, সেটা একটা বড় ঘর। তার চারদিকে কয়েকটা কম্পিউটার আর অন্য নানারকম যন্ত্রপাতি। মাঝখানে একটা চেয়ারে সেই মস্তবড় সাপের ফণা।

সেটা যে আসল সাপ নয়, একটা মুখোশ, তা বুঝতে কাকাবাবুর অসুবিধে হল না।

তিনি ভাবলেন, তিনি যে দ্বিতীয় একজন রাজা রায়চৌধুরীকে দেখেছিলেন, সে কোথায় গেল? নাকি সেটা চোখের ভুল?

টেবিলের ওপাশের লোকটি এবার মাথা থেকে সাপের ফণার মুখোশটা খুলে ফেলে রাখল টেবিলের ওপর। একটা চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল।

লোকটির বয়েস চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে। রং ফরসা। খুব মোটা ভুরু, সেরকমই অনেকখানি লম্বা জুলপি। হরতনের গোলামের মতন তার মোটা গোঁফ মিশে গেছে জুলপির সঙ্গে। মাথায় বাবরি চুল। চোখের মণিদুটো নীল।

লোকটিকে দেখলে বাঙালি বলে মনে হয় না।

সে মাথার চুল আঁচড়াবার পর ভুরু আর গোঁফও আঁচড়ে নিল।

তারপর চওড়াভাবে হেসে বলল, আপনার সঙ্গে একটু ছেলেমানুষি করছিলাম, তাই না? মাঝে মাঝে এরকম ছেলেমানুষি করতে আমার ভাল লাগে।

কাকাবাবুর মাথাটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। তিনি কোনও কথা না বলে সোজা তাকিয়ে রইলেন লোকটির দিকে।

লোকটি বলল, মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী, আমি আপনার পরিচয় সবই জানি। আপনি আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আমি সংক্ষেপে জানাচ্ছি। আমার অনেক নাম। শঙ্খচূড়, কার্লোস, রুস্তম, মহাবীর সিং, ভ্যাম্পায়ার, ডেভিল ইনকারনেট, হলাকু, এইরকম আরও আছে। এখানে আমি শঙ্খচূড়, এর ঠিক আগেই ছিলাম হলাকু। আপনি আমাকে এর যে-কোনও একটা নাম ধরে ডাকতে পারেন।

টেবিলের ওপর লোকটির বাঁ হাত রাখা। কাকাবাবু দেখলেন, বুড়োআঙুল ছাড়া ওর সব আঙুলেই দুটো-তিনটে করে আংটি।

ওর মুখোশটা খুলে ফেললেও কাকাবাবু বুঝতে পারলেন, লোকটি এখনও ছদ্মবেশ ধরে আছে। ওর ভুরু, গোঁফ, মাথার চুল সবই নকল। খুব সম্ভবত চোখেও কনটাক্ট লেন্স পরা, তাই মণিদুটো নীল দেখাচ্ছে।

লোকটি বলল, আপনাকে বেশি বেশি গ্যাস দিয়ে অজ্ঞান করা হয়েছিল। আপনি কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন জানেন? পাকা চব্বিশ ঘণ্টা।

তারপর সে একটা বেল বাজাতেই পেছন দিকের দরজা খুলে ঢুকল একজন লোক। তার মুখে একটা নীল রঙের মুখোশ।

লোকটি বলল, রাজা রায়চৌধুরী চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে আছেন, না খেয়ে আছেন। ওঁকে কিছু খেতে দেবে না? আমাদের বদনাম হয়ে যাবে যে! শিগগির কফি আর কেক-বিস্কুট নিয়ে এসো!

একটা কম্পিউটারে পি পি করে শব্দ হতেই লোকটি সেটার কাছে চলে গিয়ে টেপাটিপি করতে লাগল কি-বোর্ডে।

দু মিনিটের মধ্যে নীল মুখোশপরা লোকটি একটা ট্রে-তে সাজিয়ে দুকাপ কফি আর এক প্লেট খাবার এনে রাখল টেবিলের ওপর।

শঙ্খচূড় লোকটিকে ধমক দিয়ে বলল, আরে বেওকুফ, ওঁর হাত বাঁধা থাকলে উনি খাবেন কী করে? আনটাই হিজ হ্যান্ডস্!

নীল মুখোশপরা লোকটি কাকাবাবুর হাতের বাঁধন খুলে দিল।

রক্ত জমে গিয়ে হাতদুটো প্রায় অসাড় হয়ে গেছে। কাকাবাবু হাতে হাত ঘষতে লাগলেন।

কম্পিউটারের কাছ থেকে ফিরে এসে শঙ্খচূড় বলল, আপনি আমার সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি, স্প্যানিশ, অ্যারাবিক, ফ্রেঞ্চ যে-কোনও ভাষায় কথা বলতে পারেন। আমি বাংলা কেমন বলছি, ঠিক হচ্ছে না? অবশ্য আপনাদের মতন উচ্চারণ হবে না।

কাকাবাবু এবারও কোনও মন্তব্য করলেন না।

শঙ্খচূড় বলল, নিন, খেতে আরম্ভ করুন।

সে নিজেও কফিতে চুমুক দিয়ে একটা লম্বা চুরুট ধরাল।

এতক্ষণ পরে কাকাবাবু বললেন, আপনি চুরুটটা নিভিয়ে ফেলুন। চুরুটের গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না।

লোকটি কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কাকাবাবুর দিকে। তারপর হো হো করে হেসে উঠল।

হাসতে হাসতে বলল, আপনি তো দেখছি, সত্যিই অদ্ভুত লোক! আমার ঘরে বসে আমাকেই হুকুম করছেন?

কাকাবাবু বললেন, হুকুম নয়, অনুরোধ। আমার প্লিজ বলা উচিত ছিল। একসময় আমি খুব চুরুট খেতাম। অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি। এখন চুরুটের গন্ধই সহ্য হয় না।

লোকটি চেয়ার ছেড়ে কাকাবাবুর কাছে চলে এসে বলল, যদি আপনার হাত আবার বাঁধি আর আপনার নাকের কাছে এই জ্বলন্ত চুরুটটা ধরে রাখি, তা হলে বেশ মজা হয়, তাই না?

কাকাবাবু বললেন, ওটাকে মজা বলে না। ওটা অভদ্রতা।

লোকটি বলল, আমার নাম শঙ্খচূড়। আমি যে কত অভদ্র নিষ্ঠুর হতে পারি, আপনি তা ধারণাই করতে পারবেন না। যাক গে, এখন কাজের কথা হোক। কফিটা খেয়ে নিন।

কাকাবাবু এবার কফিতে এক চুমুক দিলেন।

শঙ্খচূড় বলল, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনার সঙ্গে আমার পার্সোনালি কোনও শত্রুতা নেই। আমি প্রফেশনাল লোক। আমি টাকার বিনিময়ে অন্যদের হয়ে নানারকম কাজ করি। সেরকম একটা কাজের জন্যই—

তাকে থামিয়ে দিয়ে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, গাড়িতে আমার সঙ্গে একটি ছোট মেয়ে ছিল। সে কোথায়?

শঙ্খচূড় ভুরু কুঁচকে বলল, ছোট মেয়ে? ছিল নাকি? ফরগেট ইট। তা নিয়ে এখন মাথা ঘামাতে হবে না। আপনাকে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে ধরে আনা হয়েছে। আমার কথামতন আপনাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, অন্যের কথামতন কিছু কাজ করার অভ্যেস যে আমার নেই!

শঙ্খচূড় বলল, এক্ষেত্রে আপনার বাঁচবার যে এই একটাই রাস্তা। অন্য কোনও উপায় নেই।

কাকাবাবু বললেন, এর আগে আরও অনেকেই আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু কেউ তো পারেনি শেষ পর্যন্ত।

শঙ্খচূড় বলল, এই রে, আপনি এখনও আমার ক্ষমতাই বুঝতে পারেননি। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করছেন? আমার সম্পর্কে আপনার কী ধারণা হয়েছে বলুন তো!

কাকাবাবু বললেন, আপনি তো বললেন, আপনি প্রফেশনাল লোক। টাকার বিনিময়ে কাজ করেন। তার মানে মারসিনারি?

শঙ্খচূড় বলল, আরে না, না। আমাকে অত ছোট ভাববেন না। মারসিনারি মানে তো ভাড়াটে সৈন্য। বিভিন্ন দেশে গিয়ে লড়াই করে। আমি লড়াই করি না, অনেক বড় বড় কাজের দায়িত্ব নিই। যেমন ধরুন, হাওড়া ব্রিজের মতন কোনও ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া, প্লেন ধ্বংস করা কিংবা কোনও দেশের প্রাইম মিনিস্টার কিংবা প্রেসিডেন্টকে খুন করা, এইসব। এখানে আমার কাজটা আরও বড়। প্রায় একশো কোটি টাকার প্রজেক্ট। সব ঠিক হয়ে যাবে, শুধু মাঝখানে ছোট একটা বাধার সৃষ্টি হয়েছে। আপনাকে দিয়ে সেই বাধাটা দূর করাব। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা বোঝেন তো!

কাকাবাবু বললেন, আপনি ধরেই নিচ্ছেন, আপনার কথা অনুযায়ী আমি কাজ করব!

শঙ্খচূড় বলল, ওই যে বললাম, আপনার অন্য কোনও উপায় নেই! এই কাজ শুরু করার আগে আমি আপনাকে খুব ভালমতন স্টাডি করেছি। এই দেখুন!

একটা কম্পিউটারের বোতাম টিপতেই তাতে ফুটে উঠল কাকাবাবুর ছবি। পরপর অনেক। সঙ্গে সন্তু আর জোজোর ছবিও আছে। পাশে পাশে অনেক কিছু লেখা।

শঙ্খচূড় বলল, অনেক কেসে দেখেছি, আপনি ইচ্ছে করে শত্রুর ডেরায় ঢুকে পড়েন। কখনও তারা ধরে নিয়ে আসে কিংবা আপনি নিজে থেকে ধরা দেন। তারপর নানারকম বুদ্ধি খাটিয়ে বেরিয়ে আসেন সেখান থেকে, শত্রুরাও ধরা পড়ে যায়। এই তো? কিন্তু এবারে আপনাকে আর বুদ্ধি খাটিয়ে কিংবা গায়ের জোর দেখিয়ে বেরোতে হবে না।

কাকাবাবু বললেন, বেরোতে পারব না?

শঙ্খচূড় একগাল হেসে বলল, আপনাকে আমিই ছেড়ে দেব। আপনি এখান থেকে সুস্থ অবস্থায় বেরিয়ে যাবেন, হাত-পা বাঁধা থাকবে না, রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন। কিন্তু তখনও আপনি মুক্তি পাবেন না। আমার কথা অনুযায়ীই আপনাকে চলতে হবে।

কাকাবাবুও হেসে বললেন, ম্যাজিক নাকি? অথবা আমাকে হিপনোটাইজ করা হবে? তাতে কিন্তু বিশেষ সুবিধে হবে না!

শঙ্খচূড় বলল, ওসব হিপনোটিজম ফিজমের আমি ধার ধারি না। বিজ্ঞান, স্রেফ বিজ্ঞান। দেখুন তা হলে ব্যাপারটা কীরকম হবে।

টেবিলের ওপাশ থেকে সে একটা মূর্তি তুলে আনল। সেটা দেখে চমকে গেলেন কাকাবাবু। মূর্তিটা তাঁরই, অবিকল রাজা রায়চৌধুরী। সেরকম গোঁফ, সেরকম দুবগলে ক্রাচ। পুরোপুরি জ্ঞান হওয়ার আগে এটা দেখেই তিনি জীবন্ত মানুষ মনে করেছিলেন।

মূর্তিটা প্রায় দুহাত লম্বা। ফাইবার গ্লাস কিংবা ওই ধরনের কোনও হালকা জিনিস দিয়ে তৈরি।

শঙ্খচূড় সেটাকে নিয়ে রাখল ঘরের এক কোণে। একটা দরজার কাছে। কাকাবাবুর চেয়ারটাও সরিয়ে দিল অন্য এক কোণে, সে চেয়ারের পায়ায় চাকা লাগানো।

তারপর বলল, ওই হচ্ছে রাজা রায়চৌধুরীর রেলিকা। আমি যা বলব, তাই শুনবে। আর যদি না শোনে, তা হলে কী হবে? দেখুন কী হয়।

সে কম্পিউটারের কাছে গিয়ে দুবার কি-বোর্ড টিপতেই প্রচণ্ড শব্দ হল। সেই মূর্তিটা ছিন্নভিন্ন হয়ে টুকরোগুলো ছড়িয়ে গেল চতুর্দিকে। ঘর ভরে গেল ধোঁয়ায়।

সেই আওয়াজে কাকাবাবু চমকে উঠলেও মুখে কোনও রেখা ফুটল না।

শঙ্খচূড় বলল, দেখলেন তো কী হবে?

কাকাবাবু বললেন, ওটা তো একটা পুতুল। রিমোট কন্ট্রোলে বেলুন ফাটানো যায়, একটা পুতুল ধ্বংস করা যায়, কিন্তু আমি তো মানুষ। আমার কী ক্ষতি হবে?

শঙ্খচূড় এবারে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, রাজা রায়চৌধুরী, এখন থেকে তুমিও আমার হাতের পুতুল!