০৯. একটি ছোট দলের জন্যে

একটি ছোট দলের জন্যে চৌদ্দ জন সংখ্যাটি খারাপ নয়। খুব বেশি নয় যে সবার সাথে সবাই যোগাযোগ রাখতে পারে না, আবার খুব কমও নয় যে, মোটামুটি একটা দুরূহ কাজ সবাই মিলে শুরু করা যায় না। খুব কাছাকাছি থাকতে হয় বলে খুব অল্প সময়েই আমরা সবার সাথে সবাই পরিচিত হয়ে উঠেছি। কার কোন বিষয়ে কোন ধরনের ক্ষমতা এবং কোন ধরনের দুর্বলতা রয়েছে আমরা দ্রুত জ্বেলে ফেলেছি। যেমন ইশি মানুষটির রসিকতাবোধ প্রবল নয় কিন্তু মানুষটি এক কথায় অসাধারণ। কোনোকিছুতেই সে নিরুৎসাহিত হয় না, যে ব্যাপারটিকে অতিদর্শনে একটা ভয়ঙ্কর মন খারাপ করা অবস্থা বলে মনে হয় তার মাঝেও সে চমৎকার আশাব্যঞ্জক কিছু একটা খুঁজে বের করে ফেলে। তার বিশেষ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নেই কিন্তু মানুষজনকে নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা অসাধারণ।

        রাইনুককে আমি দীর্ঘদিন থেকে চিনি কিন্তু এখানে তাকে আমি একেবারে নূতনভাবে আবিষ্কার করলাম। তাকে একটা কোনো সমস্যা সমাধান করতে দেয়া হলে সে তার পিছনে খ্যাপার মতো লেগে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্যাটার সমাধান না হচ্ছে সে ঘুম খাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দেয়। ক্লড হাসিখুশি মানুষ, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল তাই তার সত্যিকার চেহারাটি কেমন জানি না। সে সবসময় কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলছে। দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু কম্পিউটারের হার্ডওয়ারে তার অসাধারণ জ্ঞান। গণিতবিদ দ্রুন ক্লডের ঠিক উল্টো, প্রয়োজনের কথাটিও বলতে চায় না, কম্পিউটার নিয়ে সে বিশেষ কিছু জানত না কিন্তু গত কয়েকদিনে সে এ ব্যাপারে মোটামুটি পারদর্শী হয়ে এসেছে। লাল চুলের মেয়েটি–যার নাম নাইনা, তার অসম্ভব একটা যান্ত্রিক দক্ষতা রয়েছে। যে কোনো যন্ত্রকে খুলে ফেলে সে চোখের পলকে জুড়ে দিতে পারে। গত কয়েকদিনে সে আমাদের জন্যে গোটা চারেক বাই ভার্বাল দাঁড় করিয়েছে। কয়েকটি প্রাচীন রবোটকেও যোগাড় করা হয়েছে, সে তার মাঝে কিছু পরিবর্তন করে আমাদের ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত করবে। একজন মানুষের মাঝে এ রকম প্রাণশক্তি আমি কখনো দেখি নি।

টিয়ারাকে দেখেও আমি অবাক হয়ে যাই, আমাদের কোনো চিকিৎসক রবোট নেই। কিন্তু টিয়ারা আশ্চর্য দক্ষতা নিয়ে আমাদের ছোটখাটো শারীরিক সমস্যার সমাধান করে ফেলছে। কয়েকদিন আগে একটা উঁচু দেয়াল থেকে পড়ে এলুজ তার হাত কনুইয়ের কাছে ভেঙে ফেলল, ক্রিশির এক্স–রে সংবেদন চোখ ব্যবহার করে সে কীভাবে কীভাবে জানি এলুজের হাতকে ঠিক করে দিল। এখনো সেটি বুকের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে কিন্তু বোঝ যাচ্ছে সেটি নিয়ে আর কোনো সমস্যা হবে না।

আমি নিজেকে দেখেও মাঝে মাঝে একটু অবাক হয়ে যাই। এতদিন আমি নিজেকে খুব সাধারণ একজন মানুষ বলে জানতাম কিন্তু গত কিছুদিন থেকে আমি নিজের একটা ক্ষমতা আবিষ্কার করছি। খুব কঠিন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে আমি তার অত্যন্ত বিচিত্র একটা সমাধান বের করে ফেলি। সবসময় সেটি কাজ করে সেটা সত্যি নয় কিন্তু যখন আর কিছুই করার থাকে না তখন সেইসব সমাধান হঠাৎ করে খুব আকর্ষণীয় মনে হতে থাকে।

দলের বেশিরভাগ সদস্যের সত্যিকার অর্থে কোনো দক্ষতা ছিল না, এখন অন্যদের সাথে পাশাপাশি কাজ করে সবাই কোনো–না–কোনো বিষয়ে মোটামুটি দক্ষ হয়ে উঠেছে। তাদেরকে জটিল একটি দায়িত্ব দেয়া যায় এবং তারা প্রায় সবসময়েই সাহায্য ছাড়াই সেইসব দায়িত্ব পালন করে ফেলে।

চৌদ্দ জন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মানুষ পাশাপাশি থাকার কিছু সমস্যাও রয়েছে, যখন দীর্ঘ সময় কষ্টসাধ্য কাজ করে যেতে হয় তখন খুব সহজেই একে অন্যের ওপর রেগে ওঠে। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মন কষাকষি শুরু হয় এবং হঠাৎ হঠাৎ চরিত্রের দুর্বল দিকগুলো প্রকাশ পেয়ে যায়। সমস্যাটি সবারই চোখে পড়ছে, সেটা নিয়ে মাঝে মাঝেই আলোচনা করা হয় যদিও ইশির ধারণা এটি সত্যিকারের কোনো সমস্যা নয়, নিজেদের ভিতরে ছোটখাটো বাকবিতণ্ডা করে ভেতরের ক্ষোভ বের করা মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যে অত্যন্ত জরুরি!

গোড়াতেই আমরা নিজেদের ভেতরে কয়েকটা জিনিস ঠিক করে রেখেছি। গ্রুস্টান নিশ্চয়ই আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে সে কারণে আমরা কখনোই এক জায়গায় দু–এক দিনের বেশি থাকি না। ব্যাপারটি সহজ নয় সবাই সেটা নিয়ে অল্পবিস্তর অভিযোগ করা শুরু করেছে কিন্তু এখনো নিয়মটি ভাঙা হয় নি। দলের সবাই কোনো–না–কোনো ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা শিখেছে এবং সবসময় অস্ত্রটি হাতের কাছে রাখা হয়। এমনিতে খাবার পানীয় এবং ওষুধ খুঁজে বের করে বিভিন্ন নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। চলাফেরা করার জন্যে কিছু বাই ভার্বাল থাকায় আমরা বেশ দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে পারি। আমরা আমাদের নূতন জীবনে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, সবসময়েই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে খানিকটা উত্তেজনা থাকে এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ব্যাপারটি সবাই উপভোগ করা শুরু করেছে।

আমাদের প্রথম কাজ তথ্য সগ্রহ করা। গ্রুস্টান তার নানা কম্পিউটারের যোগাযোগ রাখার জন্যে নানাভাবে তথ্য পাঠায়। সেই তথ্যগুলো মাইক্রোওয়েভ রিসিভার ব্যবহার করে শোনার চেষ্টা করা হয়। তথ্যগুলোতে খুব প্রয়োজনীয় কিছু থাকবে কেউ আশা করে না কিন্তু কোথায় কোথায় অন্য কম্পিউটারগুলো রয়েছে তার একটা ধারণা হয়। সপ্তাহখানেক চেষ্টা করে আরো প্রায় এক শ নূতন কম্পিউটারের অবস্থান বের করা হয়েছে, কাজটি খুব সময়সাপেক্ষ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এভাবে চলতে থাকলে সব কম্পিউটারের অবস্থান বের করতে করতে আমাদের পুরো জীবন পার হয়ে যাবার কথা কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য ঠিক এ রকম সময়ে আমাদের হাতে একটি অভাবিত সুযোগ এসে গেল।

ভোরবেলা আমি আর ক্লড বের হয়েছি, আমাদের সাথে একটা হাতে তৈরি করা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি মনিটর। দক্ষিণে প্রায় চার শ কিলোমিটার দূরে কোনো একটি জায়গা থেকে নির্দিষ্ট সময় পরে পরে মাইক্রোওয়েভের একটি ছোটখাটো বিস্ফোরণ হয়, ব্যাপারটি কী নিজের চোখে দেখে আসার ইচ্ছে। বাই ভার্বালে করে মাটির কাছাকাছি আমরা উড়ে যাচ্ছি, আমি হালকা হাতে কন্ট্রোল ধরে রেখেছি, কুড ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছে। একজন মানুষ যে বিনা কারণে এত কথা বলতে পারে ক্লডকে না দেখলে আমি কখনো বিশ্বাস করতাম না।

যে জায়গাটি থেকে মাইক্রোওয়েভের বিস্ফোরণ হচ্ছে আমরা কিছুক্ষণেই সেখানে পৌঁছে গেছি। একটা ধূসর দালান, তার বেশিরভাগই ভেঙে গিয়েছে। তবুও বাইরে থেকে তাকিয়ে বোঝা যায় ভিতরে বড় অংশ এখনো মোটামুটি দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে কী আছে আমরা জানি না, কাছে গেলে আমাদের কোনো কিছু দেখে ফেলবে কি না বা অন্য কোথাও খবর পৌঁছে যাবে কি না সে ব্যাপারেও আমাদের কোনো ধারণা নেই। এ রকম সময়। সাধারণত একটা রবোটকে কাজ চালানোর মতো একটা ভিডিও ক্যামেরা হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। আজকেও তাই করা হল। রবোটটি প্রোগ্রাম করা আছে, গুটি গুটি হেঁটে ভিতর থেকে ঘুরে আসার কথা, বাই ভার্বালে বসে ছোট স্ক্রিনে আমরা দেখতে পাই কোথায় কী রয়েছে।

ভিতরে ছোট ছোট ঘর এবং তার ভিতরে চৌকোণো বাক্স, সেগুলো নানা ধরনের টিউব দিয়ে জুড়ে দেয়া আছে। আমি দেখে ঠিক বুঝতে পারলাম না কিন্তু ক্লডকে খুব উল্লসিত দেখা গেল, হাঁটুতে থাবা দিয়ে বলল, চমৎকার!

কী হয়েছে?

এটা গেটওয়ে কম্পিউটার।

তার মানে কী?

তার মানে এখানে মানুষের সাথে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই। আশপাশের অনেকগুলো কম্পিউটার এখানে এসে একত্র হয়েছে। একেবারে যাকে বলে সোনার খনি!

তুমি কেমন করে জান?

ক্লড স্ক্রিনে দেখিয়ে বলল, এই দেখ এগুলো হচ্ছে মূল প্রসেসর। কেমন করে সাজানো দেখেছ? বাইরে থেকে যোগাযোগের কোয়ার্টজ ফাইবার এসেছে এদিক দিয়ে। এখানে সাধারণত হলোগ্রাফিক মনিটর থাকে। এখানে নেই কারণ এটা গেটওয়ে কম্পিউটার। তা ছাড়া মেমোরি মডিউলগুলো দেখ কত বড়, উপরের টিউবগুলো নিশ্চয়ই ফ্রিণ্ডন টিউব, ঠাণ্ডা রাখার জন্যে দরকার। প্রসেসরের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে খুব কায়দা করে, ভালো। করে দেখ

ক্লড একটানা কথা বলে যেতে থাকে, তার বেশ কিছু আমি বুঝতে পারলাম না, কিন্তু কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হল ব্যাপারটি নিয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। সে বাই ভার্বাল থেকে নেমে বলল, চল ভিতরে যাই।

তুমি নিশ্চিত আমাদের কোনো বিপদ হবে না?

আমি নিশ্চিত।

কতটুকু?

শতকরা এক শ ভাগ!

আমি ক্লডের পিছু পিছু ঘরটির মাঝে ঢুকি। চারদিক ধুলায় ধূসর, কত দিন কোনো মানুষের পায়ের চিহ্ন পড়ে নি। কয়েকটা ছোট ছোট দরজা পার হয়ে বড় একটা ঘরে এসে দাঁড়ালাম। অসংখ্য চৌকোণো বাক্স পাশাপাশি রাখা আছে, সেখান থেকে নিচু এক ধরনের ধাতব শব্দ হচ্ছে। ঘরে এক ধরনের কটু গন্ধ।

ক্লড ঘরের ভিতর হাঁটাহাঁটি করতে থাকে। বিভিন্ন চৌকোণা তার এবং টিউবগুলো দেখতে দেখতে সে আবার নিজের মনে কথা বলতে শুরু করে। আমি একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে ক্লডের মোটামুটি অর্থহীন এবং প্রায় ছেলেমানুষি কথা শুনতে থাকি।

ক্লড হঠাৎ কী একটা দেখে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, কুশান!

কী হল?

কাছে এসে দেখ।

আমি এগিয়ে গেলাম, সে হলুদ রঙের কী একটা তার ধরে রেখেছে, আমাকে দেখিয়ে এমন একটা ভঙ্গি করল যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী এটা?

এই দেখ! মূল প্রসেসর থেকে মেমোরি মডিউলের যোগাযোগ। একেবারে সোনার খনি!

কেন?

কোয়ার্টজ ফাইবার, সেকেন্ডে লক্ষ টেরাবিট তথ্য যাচ্ছে। আমরা যদি চাই তাহলে কী তথ্য যাচ্ছে বের করে ফেলতে পারি?

কেমন করে?

মনে নাই আগে বলেছিলাম তোমাদের? একেবারে পানির মতো সহজ। প্রথমে উপরের আবরণ সরিয়ে ভিতর থেকে কোয়ার্টজের মূল ফাইবারটা বের করতে হবে। তারপর সেটা যদি একটু বাঁকা করে ধর, ভিতর থেকে খুব অল্প অবলাল রশ্মি বের হয়ে আসবে। সেখানে একটা ভালো ফটোডায়োড আর কিছু ভালো এমপ্লিফায়ার–ব্যস হয়ে গেল।

হয়ে গেল?

তথ্যটা বোঝার জন্যে কিছু মনিটর লাগবে। একটা ছোট সমস্যা–ক্লড ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আবার কথা বলতে শুরু করে। মানুষটি মনে হয় জোরে জোরে চিন্তা করে।

আমি ক্লডের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম সে যেটা করতে চাইছে ব্যাপারটি অসম্ভব কিছু নয়। দীর্ঘদিন থেকে আমরা যে তথ্যগুলো বের করার চেষ্টা করছি এই কম্পিউটার গেটওয়ে থেকে দু–তিন দিনে সেইগুলো বের করে নিতে পারব। গ্রুস্টান যদি একজন মানুষ হত তাহলে তার মস্তিষ্কে উঁকি দিয়ে মনের কথা শুনে ফেলার মতো ব্যাপারটি।

আমি আর ক্লড জায়গাটি ভালো করে পরীক্ষা করে ফিরে গেলাম। ঠিক কী করতে চাইছি শোনার পর দলের সবাই খুব উৎসাহী হয়ে ওঠে। হঠাৎ করে পুরো দলের মাঝে এক নূতন ধরনের উদ্দীপনা ফিরে আসে। আমরা পুরো দলবল নিয়ে পরের দিনই গেটওয়ে কম্পিউটারে পৌঁছে কাজ শুরু করে দিলাম।

.

ক্লড দাবি করেছিল দুই দিনের মাঝে আমরা কম্পিউটারের মেমোরিতে উঁকি দিয়ে তথ্য বের করতে শুরু করব। কিন্তু দেখা গেল ব্যাপারটি এত সহজ নয়। দলের সবাই রাতদিন কাজ করার পরও বড় একটা মনিটরে আবছা আবছাভাবে কিছু ত্রিমাত্রিক ছবি দেখা ছাড়া বিশেষ কোনো লাভ হল না। আমরা পালা করে সেই ত্রিমাত্রিক ছবিগুলোই পরীক্ষা করতে থাকি–সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য বের হয়ে যাবে সেই আশায়।

এভাবে আরো কয়েকদিন কেটে যায়। ইশি ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। একদিন রাতে আমি যখন বিশ্রাম নেবার জন্যে শুতে যাচ্ছি ইশি বলল, আমরা ঠিক করেছিলাম এক জায়গায় খুব বেশি সময় থাকব না। কিন্তু এখানে আমরা প্রায় দুই সপ্তাহের মতো কাটিয়ে দিয়েছি। ব্যাপারটা ভালো হল না।

ক্লড কাছেই বসেছিল। মাথা চুলকে বলল, ফটোডায়োডের ব্যান্ড উইডথ ভালো নয়। অনেক তথ্য নষ্ট হচ্ছে। যেটুকু অবলাল রশ্মি পাচ্ছি সেটা যথেষ্ট নয়। আরেকটু যদি পেতাম!

দ্রুন বলল, কিন্তু তাহলে গ্রুস্টান বুঝে ফেলবে।

ইশি মাথা নেড়ে বলল, না না, সেটা খুব বিপজ্জনক কাজ হবে।

আমি বললাম, ক্লড, তোমরা সবাই মিলে যে কাজটুকু করছ, বলা যেতে পারে সেটা এক রকম অসাধ্য সাধন। কোনোরকম ঝুঁকি নিয়ে কাজ নেই।

দ্রুন বলল, আমরা তথ্য মোটামুটি খারাপ বের করি নি। যেমন ধরা যাক কম্পিউটারের অবস্থান। আমাদের আগের লিস্টে–অন্তত আরো কয়েক হাজার কম্পিউটার যোগ হয়েছে।

চমৎকার। ইশি মাথা নেড়ে বলল, চমৎকার।

আমি বললাম, আমরা এখানে যদি আরো কিছুদিন থাকি হয়তো আরো কিছু তথ্য বের করতে পারব। কিন্তু যদি গ্রুস্টানের হাতে ধরা পড়ে যাই সর্বনাশ হয়ে যাবে।

আমারও তাই ধারণা। ইশি মাথা নেড়ে বলল, এক জায়গায় দুই সপ্তাহ থাকা খুব বিপজ্জনক। আমার মনে হয় আমাদের এখন এখান থেকে সরে যাওয়া দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

ক্লড বলল, আর এক দিন। মাত্র এক দিন। মেমোরির মূল ব্যাংকে প্রায় পৌঁছে যাব মনে হচ্ছে, এক ধাক্কায় তখন অনেক কিছু বের হয়ে আসবে।

দ্রুন বলল, যদি দুই সপ্তাহ এক জায়গায় থাকতে পারি তাহলে আর এক দিন বেশি থাকলে ক্ষতি কী?

বিপদের আশঙ্কার কথা যদি বল তাহলে খুব বেশি পার্থক্য নেই।

ইশি বলল, ঠিক আছে তাহলে আমরা আরো একদিন থাকছি কিন্তু তারপর সরে পড়ব।

আমি বললাম, তোমাদের সবার কাছে একটা অস্ত্র রয়েছে না?

হ্যাঁ।

আমার মনে হয় অস্ত্রটি ভালো করে পরীক্ষা করে আজকে সবাই ঘুমাতে যেও। যদি গভীর রাতে রবোটেরা হানা দেয় মনে রেখো লক ইন না করে গুলি করবে। লক ইন করা হলে অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ হয় কিন্তু রবোটেরা টের পেয়ে যায়। রবোটেরা খুব সহজেই অন্য রবোটদের খুঁজে বের করতে পারে কিন্তু মানুষদের খুঁজে বের করা তাদের জন্যে খুব সহজ নয়।

উপস্থিত যারা ছিল সবাই চুপ করে আমার কথা শুনল, কেউ কিছু বলল না। আমি বুঝতে পারলাম হঠাৎ করে সবাই এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করেছে।

গভীর রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি চোখ খুলে তাকালাম, আমার মাথার কাছে ক্রিশি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যখন ঘুমাই সে সবসময় আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু আজকে তাকে দেখতে একটু অন্য রকম লাগল। ঘুমের মাঝে আমি যখন হঠাৎ করে চোখ খুলে তাকাই ক্রিশি সবসময় আমাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু এবারে সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। আমি ঘুম চোখে ফিসফিস করে ডাকলাম, ক্রিশি।

ক্রিশি আমার কথার কোনো উত্তর দিল না, সাথে সাথে আমি হঠাৎ করে পুরোপুরি জেগে উঠলাম। ক্রিশির কপোট্রন কোনোভাবে জ্যাম করে দেয়া হয়েছে। যার অর্থ কোনো ধরনের রবোটেরা এসে আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। রবোটেরা মানুষকে বিশেষ কিছু করতে পারে না কিন্তু নিচু স্তরের রবোটদের খুব সহজেই জ্যাম করে দিতে পারে। আমি লাফিয়ে উঠে বসতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। মাথার কাছে রাখা অস্ত্রটি টেনে নিয়ে আমি গড়িয়ে বড় একটা কক্রিটের চাইয়ের পিছনে শুয়ে পড়ি। আমার পায়ের কাছে ইশি শুয়েছিল, আমি চাপা গলায় তাকে ডাকলাম, ইশি–

ইশির ঘুম খুব হালকা, সে সাথে সাথে জেগে বলল, কী হয়েছে কুশান?

মনে হয় গ্রুস্টানের রবোটেরা এসেছে। সবাইকে জাগিয়ে দাও। বল অস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকতে।

ইশি গুড়ি মেরে পিছনে সরে গেল, কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই জেগে উঠে বড় বড় কংক্রিটের চাঁই, ধাতব সিলিন্ডার বা ধসে পড়া দেয়ালের পিছনে আড়াল নেয়। আমি চাপা গলায় বললাম, মনে রেখো সবাই, লক ইন না করে গুলি করবে

আমার কথা শেষ হবার আগেই মাথার উপর দিয়ে শিস দেয়ার মতো শব্দ করে কী একটা উড়ে গেল। পর মুহূর্তে পিছনে একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। সাথে সাথে প্রচণ্ড আলোর ঝলকানিতে চারদিকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আমি আগুনের একটা গরম। হলকা অনুভব করি। উপর থেকে কী একটা জিনিস ভেঙে পড়ে ধুলায় ধূসর হয়ে যায় চারদিক।

আমি অস্ত্রটা তাক করে উবু হয়ে শুয়ে থাকি। আবছা অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো কিছু একটা এগিয়ে এল, হাতে একটা ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্র। সেটি উপরে তুলে রবোটটি ধাতব গলায় উচ্চৈঃস্বরে বলল, আমি ক্লিও প্রজাতির প্রতিরক্ষা রবোট। ক্রমিক সংখ্যা দুই শ নয়। মহামান্য গ্রুস্টান আমাদেরকে এখানে পাঠিয়েছেন। তোমরা মানুষেরা আমার বন্দি। দুই হাত উপরে তুলে এক জন এক জন করে বের হয়ে আস।

রবোটটি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আমি তার আগেই অস্ত্রটি তাক করে ট্রিগার টেনে ধরলাম। রবোটটির শরীরের উপরের অর্ধেক বাষ্পীভূত হয়ে গেল সাথে সাথে। কোনোকিছু ধ্বংস করার জন্যে বাহাত্তরের এই অস্ত্রটির কোনো তুলনা নেই।

চমৎকার কাজ কুশান!

কথাটি কে বলল ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজনও নেই। আমি আমার জায়গাটি থেকে পিছিয়ে সরে যাচ্ছিলাম কিন্তু টের পেলাম ঠিক আমার পিছনে কেউ একজন গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আমি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কে?

আমি! আমি টিয়ারা।

টিয়ারা?

হ্যাঁ কুশান–সে গুড়ি মেরে আমার পাশে এসে হাজির হয়। আবছা অন্ধকারে আমি তার দিকে তাকালাম, ভীতমুখে সে সামনে তাকিয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, আমার ভয় করছে কুশান। ভীষণ ভয় করছে।

আমার বুকের ভিতর হঠাৎ যেন ভালবাসার একটি প্লাবন ঘটে গেল। আমি হাত দিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে বললাম, তোমার কোনো ভয় নেই টিয়ারা। কোনো ভয় নেই।

টিয়ারা একটি শিশুর মতো আমার গলা জড়িয়ে ধরে মুখে মুখ ঘষে তৃষিতের মতো আমাকে চুম্বন করতে করতে বলল, বল তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না। বল।

আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না–

আমার কথা শেষ হবার আগেই মাথার উপর দিয়ে শিসের মতো একটি শব্দ হল এবং সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারদিক কেঁপে ওঠে। আমি মাথা উঁচু করে সামনে তাকালাম। অন্ধকার থেকে সারি বেঁধে রবোটের দল হাজির হচ্ছে। একটি দুটি নয়, অসংখ্য। সবার হাতে ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্র। রবোটগুলো বৃত্তাকারে আমাদের ঘিরে ফেলার চেষ্ট করছে। কাছাকাছি এগিয়ে আসা একটি রবোট ধাতব গলায় বলল, মহামান্য গ্রুস্টান তোমাদের মৃত কিংবা জীবিত ধরে নেয়ার আদেশ দিয়েছেন। তোমরা হাত তুলে

অন্য পাশ থেকে কেউ একজন তার এটমিক ব্লাস্টার টেনে ধরে। লেজার রশ্মির নীল আলো দেখা গেল এবং মুহূর্তের মাঝে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে রবোটদের একটা বড় অংশ ভস্মীভূত হয়ে যায়। রবোটগুলো সাথে সাথে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে তাদের অস্ত্র তুলে ধরে গুলি করতে শুরু করে। আমি চিৎকার করে বললাম, সাবধান! কাছে আসতে দিও না।

ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে পুরো এলাকাটি নারকীয় হয়ে ওঠে। আমি প্রাণপণে গুলি করতে থাকি, রবোটগুলো একটার পর আরেকটা বিধ্বস্ত হতে থাকে কিন্তু তবু তাদের থামিয়ে রাখা যায় না। সেগুলো তবু মাথা উঁচু করে গুলি করতে করতে সোজা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মনে হতে থাকে রবোটগুলো যে কোনো মুহূর্তে আমাদের রক্ষণব্যুহ ভেঙে ঢকে যাবে। শুনতে পেলাম ইশি চিৎকার করে বলল, পিছিয়ে যাও–পিছিয়ে যাও সবাই।

টিয়ারা আমার কনুইয়ের কাছে খামচে ধরে, আমি তার হাত স্পর্শ করে বললাম, ভয় পেয়ো না টিয়ারা, ভয় পেয়ো না–পিছিয়ে গিয়ে ওই বড় দেয়ালটার পিছনে আড়াল নাও।

তুমি?

আমি আসছি।

টিয়ারা মাটিতে নিচু হয়ে শুয়ে পিছনে সরে যেতে থাকে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে হঠাৎ চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠে, আমি আগুনের গরম হলকা অনুভব করলাম, বিকট শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। উপর থেকে কী যেন ভেঙে পড়ল, চারদিক ধুলায় অন্ধকার হয়ে গেল মুহূর্তের জন্যে। আমি মাথা উঁচু করে দেখলাম সবাই গুলি করতে করতে পিছনে সরে যাচ্ছে। আমি নিজেও তখন পিছনে সরে যেতে শুরু করলাম, রবোটগুলো কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে আসতে থাকে। আমাদের কয়েকজন হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে ছুটতে থাকে, রবোটগুলো অস্ত্র হাতে গুলি করতে করতে ছুটে যাচ্ছে, চিৎকার, চেঁচামেচি, ভয়ঙ্কর শব্দে এখানে হঠাৎ যেন নরক নেমে এল।

আমি বুঝতে পারছিলাম এভাবে আর কিছুক্ষণ চলতে থাকলে সবাই মারা পড়বে। দু এক জনকে রবোটগুলোকে যেভাবে হোক আটকে রাখতে হবে, অন্যেরা যেন পালিয়ে যেতে পারে। পিছনে বাই ভার্বালগুলো আছে সেগুলোতে করে দ্রুত সরে যেতে হবে। আমি ইশিকে সেরকম কিছু বলার জন্যে মাথা উঁচু করেছি ঠিক তখন রবোটগুলো তাদের অস্ত্র নামিয়ে নিল। গোলাগুলি থেমে গেল হঠাৎ এবং আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলাম রবোটগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই বাই ভার্বালের শব্দ শুনতে পেলাম, সত্যি সত্যি সেগুলো দিয়ে তারা ফিরে যেতে শুরু করেছে।

আমরা ধীরে ধীরে আড়াল থেকে বের হয়ে আসি। ধুলায় ধূসর হয়ে আছে একেকজন, ভালো করে না তাকালে চেনা যায় না। ক্লডের কপালের কাছে কোথায় কেটে গেছে, রক্তে মুখ মাখামাখি হয়ে আছে। দ্রুনকে দেখতে পেলাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে মুখ বিকৃত করে। মাটিতে বসে পড়ল। ইশি উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, কী অবস্থা আমাদের! সবাই কি ঠিক আছে?

আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম আমাদের মাঝে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই মারা গেছে, কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম ধ্বংসস্তূপের মাঝে থেকে এক জন এক জন করে সবাই বের হয়ে আসতে থাকে। কারো হাতপা বা মাথা কেটে রক্ত বের হচ্ছে, কেউ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে

কিন্তু সবাই যে বেঁচে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সবার চোখেমুখে এক ধরনের অবিশ্বাস্য আতঙ্ক, মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা এখনো যেন বুঝে উঠতে পারছে না। ইশি আবার জিজ্ঞেস করল, সবাই কি ঠিক আছে?

ক্লড তার কপালের ক্ষতটি হাত দিয়ে ধরে রেখে বলল, মনে হয়। ছোটখাটো আঘাত আছে, কিন্তু বড় আঘাত মনে হয় নেই। অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, না এটা অবিশ্বাস্য নয়। এর পিছনে কারণ আছে। কী কারণ?

আমরা গেটওয়ে কম্পিউটারকে ঘিরে ছিলাম, সে জন্যে সোজাসুজি আমাদের দিকে গুলি করে নি। এই রবোটগুলোর জন্যে সোজাসুজি গুলি করে আমাদের বাতাসে মিশিয়ে দেয়া খুব কঠিন না। তার মানে এই কম্পিউটারটা গ্রুস্টানের জন্যে মনে হয় খুব গুরুত্বপূর্ণ।

মনে হয়।

ইশি আবার সবার দিকে তাকিয়ে বলল, সবাই কি সত্যিই এখানে আছে? নাইনা কোথায়?

অন্ধকার এক কোনা থেকে বলল, এই যে এখানে।

রাইনুক?

এই যে

এলুজ?

এই যে–

ক্লড হঠাৎ যন্ত্রণার মতো একটু শব্দ করে বলল কপালের কাটাটা থেকে রক্ত বন্ধ করতে পারছি না। টিয়ারা একটু দেখবে—

কেউ কোনো কথা বলল না। আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে বললাম, টিয়ারা? টিয়ারা কোথায়?

সবাই চারদিকে ঘুরে তাকাল। কোথাও নেই টিয়ারা। একসাথে অনেকে চিৎকার করে ওঠে, টিয়ারা! টিয়ারা!

কেউ কোনো উত্তর দিল না। ভয়ঙ্কর একটা নৈঃশব্দ্য নেমে আসে হঠাৎ, আমি বুকের ভিতরে আশ্চর্য এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। আমি প্রায় হাহাকারের মতো করে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ ক্রিশি একটু নড়ে উঠে–আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মহামান্য কুশান। একটা খুব জরুরি ব্যাপার।

কী?

মহামান্য টিয়ারাকে রবোটের দল ধরে নিয়ে গেছে গ্রুস্টানের কাছে। আর কয়েক মিনিটের মাঝেই তারা বসতিতে পৌঁছে যাবে। গ্রুস্টান সেখানে অপেক্ষা করছে তার জন্যে।

আমার হঠাৎ মনে হল আমি বুঝি দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। আমি এক পা পিছিয়ে এসে একটা দেয়াল স্পর্শ করে সাবধানে মাটিতে বসে পড়ি। আমি আর কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম না, আশপাশে সবাই উত্তেজিত গলায় কিছু একটা বলছে কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পারছিলাম না। আমার বুকের মাঝে এক ভয়ঙ্কর ক্রোধ আর তীব্র হতাশা জমে উঠতে থাকে। ইচ্ছে করতে থাকে ভয়ঙ্কর এক চিৎকার করে সমস্ত পৃথিবীকে ছিন্নভিন্ন করে উড়িয়ে দিই।

কুঁই কুঁই শব্দ করে কুকুরের বাচ্চাটি তখনো আমাদের পায়ের কাছে শুকতে শুকতে ঘোরাঘুরি করছে। আমি তার ভাষা জানি না কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না সে টিয়ারাকে খুঁজছে।

.

খুব ধীরে ধীরে যখন আকাশ ফরসা হয়ে ভোর হয়ে এল আমরা তখনো চুপচাপ কম্পিউটার ঘরে বসে আছি। কেউ বিশেষ কথা বলছে না শুধুমাত্র কুকুরের বাচ্চাটি তখনো ইতস্তত ঘুরে ঘুরে টিয়ারাকে খুঁজে যাচ্ছে। ইশি খানিকক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ উপরে তুলে বলল, আমরা টিয়ারাকে কেমন করে উদ্ধার করব?

কেউ কোনো কথা বলল না, কিন্তু সবাই মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালাম। আমার মাথার মাঝে মনে হয় সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে, আমি ঠাণ্ডা মাথায় কিছু ভাবতে পারছি না।

ইশি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কুশান, আমরা টিয়ারাকে কেমন করে উদ্ধার করব?

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, এতক্ষণে টিয়ারাকে নিশ্চয়ই সিলাকিত করা হয়ে গেছে। তাকে উদ্ধার করার সত্যি কোনো উপায় আছে কি না আমি জানি না।

সবাই চুপ করে বসে রইল। দীর্ঘ সময় ইতস্তত করে নাইনা বলল, কিন্তু আমরা কিছু করব না?

আমি কিছু না বলে নাইনার দিকে তাকালাম, নাইনা সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেলে। রাইনুক একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা যদি কিছু করতে চাই তাহলে এই মুহূর্তে এখান থেকে আমাদের চলে যেতে হবে। গ্রুস্টান জানে আমরা এখানে

ইশি বলল, কিন্তু জায়গাটা মনে হয় নিরাপদ। কুশান মনে হয় ঠিকই বলেছে, এই গেটওয়ে কম্পিউটারের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্যে আমাদের উপর সোজাসুজি আঘাত করবে না।

রাইনুক একটু অধৈর্য হয়ে বলল, কিন্তু এইভাবে নিজেদের একটা লক্ষ্যবস্তু হিসেবে তৈরি করে বসে থাকব কেন? কী আছে এখানে?

ক্লড তার কপালের ব্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আমার মনে হয় এই কম্পিউটারের মেমোরিতে কিছু অমূল্য তথ্য আছে। গ্রুস্টান সেজন্যেই এভাবে এটাকে আগলে রাখছে।

কিন্তু আমরা সেই তথ্য বের করতে পারছি না, দুই সপ্তাহ হয়ে গেল–

আমি ক্লডের দিকে তাকিয়ে বললাম, ক্লড।

বল কুশান

তুমি এতদিন খুব সাবধানে এই গেটওয়ে কম্পিউটারের মেমোরি থেকে কিছু তথ্য বের করতে চাইছিলে যেন গ্রুস্টান জানতে না পারে। এখন গ্রুস্টান জেনে গেছে। আমরা যে এখানে আছি সেটা আর গোপন নেই। তুমি কি এখন সোজাসুজি কোয়ার্টজ ফাইবার কেটে বা অন্য কোনোভাবে খুব তাড়াতাড়ি কিছু তথ্য বের করতে পারবে?

ক্লড মাথা নেড়ে বলল, গত দুই সপ্তাহে যেটা পারি নি দুই ঘণ্টায় সেটা বের করতে পারব।

তুমি কতটুকু নিশ্চিত?

একজন মানুষের পক্ষে যেটুকু নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।

চমৎকার। তুমি তাহলে কাজ শুরু করে দাও। তথ্যটুকু বের করার সাথে সাথে তোমরা সবাই এখান থেকে চলে যাবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

সবাই আমার দিকে তাকাল। ইশি মৃদু স্বরে বলল, কুশান তুমি “আমরা সবাই” না বলে “তোমরা সবাই” কেন বলছ? তুমি কী করবে?

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি জানি না, ইশি

এখন কি আমাদের সবার একসাথে থাকা উচিত না?

আমি জানি না। আমি খানিকক্ষণ ইশির দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, তোমরা যদি কিছু মনে না কর, আমি খানিকক্ষণ একা থাকতে চাই।

ইশি বলল, ঠিক আছে কুশান।

আমি কম্পিউটার ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। বাইরে তখন অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করছে। ভোরের এই আলোতে পৃথিবীর সবকিছু অপূর্ব মনে হয় কিন্তু আজ কিছুই আমার চোখে পড়ছে না।

.

সূর্য যখন ঠিক মাথার উপরে উঠেছে, চারদিক ভয়ঙ্কর গরমে ধিকিধিকি করে জ্বলছে, ঠিক সেরকম সময়ে হঠাৎ নাইনা ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এল। অনেক দূর দৌড়ে এসেছে তাই তখনো হাঁপাচ্ছে, কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু এত উত্তেজিত হয়ে আছে যে। কথা বলতে পারছে না। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী হয়েছে নাইনা?

নাইনা বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে কোনোমতে বলল, টিয়ারা টিয়ারা–

কী হয়েছে টিয়ারার?

দেখা যাচ্ছে টিয়ারাকে। হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে—

দেখা যাচ্ছে? টিয়ারাকে?

হ্যাঁ। নাইনা মাথা নেড়ে বলল, গ্রুস্টানের সাথে।

আমি আর কোনো কথা না বলে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে থাকি। নাইনা আমার পিছু পিছু আসতে থাকে।

আমাকে দেখে সবাই সরে দাঁড়াল, আমি পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম। দেয়ালে বড় হলোগ্রাফিক স্ক্রিন, সেখানে টিয়ারার প্রতিচ্ছবি। এত জীবন্ত যে দেখে মনে হচ্ছে আমি ইচ্ছে করলে তাকে স্পর্শ করতে পারব। টিয়ারা মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল, তার দুই চোখে এক ধরনের আতঙ্ক। হঠাৎ সে কী একটা দেখে চমকে উঠে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল, ভয় পেয়েছে সে। কী দেখে ভয় পেয়েছে?

আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি, স্ক্রিনে হঠাৎ গ্রুস্টানের চেহারা ভেসে আসে। ভয়ঙ্কর ক্রোধে তার মুখ বিকৃত হয়ে আছে। তার সমস্ত মুখ মনে হয় খুলে খুলে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো নড়তে থাকে, কাঁপতে থাকে, তার চাপা গলার স্বর হঠাৎ হিসহিস করে ওঠে, তুমি ভেবেছ আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? অর্বাচীন নির্বোধ মেয়ে।

টিয়ারা আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে যায়, সে মাথা নাড়তে থাকে, তারপর হঠাৎ হাঁটু ভেঙে পড়ে যায়। 

গ্রুস্টান হঠাৎ দুই পা এগিয়ে এসে চাপা গলায় বলল, তোমাকে আমি যেভাবে ধরে এনেছি ঠিক সেভাবে আমি এক জন এক জন করে তোমাদের সবাইকে ধরে আনব। সবাইকে। আমি জানি তারা কোথায়। মানুষের সভ্যতার বিরুদ্ধে তোমাদের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দেব আমি নিষ্ঠুর হাতে। তোমার সিলাকিত শরীর আমি বাচিয়ে রাখব লক্ষ লক্ষ বছর। তোমার মস্তিষ্কে দেয়া হবে অচিন্তনীয় যন্ত্রণা। ভয়ঙ্কর অভিশাপের মতো তুমি ধুকে ধুকে বেঁচে থাকবে, তার থেকে কোনো মুক্তি নেই। নির্বোধ মেয়ে তোমার কোনো মুক্তি নেই।

গ্রুস্টান হঠাৎ এগিয়ে এসে হাত ঘুরিয়ে আঘাত করে টিয়ারাকে। সে ছিটকে পড়ে মাটিতে, অনেক কষ্টে মুখ তুলে তাকায়, হঠাৎ মনে হয় সে বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কী কাতর সেই দৃষ্টি! আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, একটা আর্তচিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

দ্রুন আমার হাত স্পর্শ করে বলল, কুশান এটি সত্যি নয়। এগুলো সব কৃত্রিম প্রতিচ্ছবি।

কিন্তু টিয়ারার কষ্টটা তো সত্যি। সত্যি না?

দ্রুন কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ফিসফিস করে বললাম, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। কেউ একজন এই স্ক্রিনটা বন্ধ করে দেবে?

ক্লড হাত বাড়িয়ে কী একটা স্পর্শ করতেই পুরো হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে গেল। আমি কয়েক পা পিছনে সরে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। আমি চোখ বন্ধ করে বসে থাকি এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারি আমার কী করতে হবে। আমি সাথে সাথে চোখ খুলে তাকালাম। আমাকে ঘিরে বিষণ্ণ মুখে পাথরের মতো সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আমি একবার সবার ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে আনি, তারপর কষ্ট করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে এনে বললাম, আমাকে গ্রুস্টানের কাছে যেতে হবে।

সবাই চমকে ওঠে। দেখে মনে হল আমি কী বলছি কেউ ঠিক বুঝতে পারে নি। নাইনা ইতস্তত করে বলল, তু–তুমি কী বলছ?

আমি বলেছি আমাকে গ্রুস্টানের কাছে যেতে হবে।

কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলব না। ইশি কয়েকবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করে থেমে যায়। ঠিক কী বলবে মনে বুঝতে পারছে না। রাইনুক শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে বলল, তুমি সত্যি যেতে চাও?

হ্যাঁ। আমি সত্যি যেতে চাই।

নাইনা প্রায় আর্ত স্বরে বলল, কেন? তুমি কেন যেতে চাও?

আমি টিয়ারাকে রক্ষা করতে চাই। তাকে কথা দিয়েছিলাম।

কিন্তু তুমি গ্রুস্টানের কাছে গিয়ে কেমন করে তাকে রক্ষা করবে? সেটা কি খুব বড় নির্বুদ্ধিতা হবে না? আবেগপ্রবণ হয়ে তো লাভ নেই–

আমাকে তোমরা বাধা দিও না। একবার চেষ্টা করতে দাও।

তুমি কেমন করে চেষ্টা করবে?

ইশি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কেমন করে চেষ্টা করবে?

আমি জানি না।

জান না?

না। যদি আর কিছু না হয় আমি টিয়ারার কাছাকাছি থাকব।

কিন্তু টিয়ারাকে সিলাকিত করে রাখা হয়েছে।

আমাকেও সিলাকিত করবে। আমার সাথে টিয়ারার দেখা হবে সিলাকিত জগতে

আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম দাঁড়িয়ে থাকা সবাই কেমন জানি শিউরে ওঠে। আমি জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে নরম গলায় বললাম, আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। যাবার আগে তোমাদের একটা দায়িত্ব দিতে চাই।

কী দায়িত্ব?

ক্লড–তুমি নিশ্চয়ই এতক্ষণে পৃথিবীর সব কম্পিউটারের অবস্থান, তাদের মাঝে যোগসূত্র সবকিছু বের করে এনেছ?

ক্লড মাথা নাড়ল। পকেট থেকে ছোট একটা ক্রিস্টাল ডিস্ক বের করে বলল, এই যে, এখানে সব আছে। দেখ–

না, আমি দেখতে চাই না। আমি এসবের কিছুই এখন জানতে চাই না। গ্রুস্টান নিশ্চয়ই আমাকে সিলাকিত করবে, আমার মস্তিষ্কে যা আছে সব সে জেনে যাবে।

ক্লড ডিস্কটি সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। আমি বললাম, আমি এখন অন্য কিছু জানতে চাই না, কিন্তু একটি জিনিস আমাকে জানতে হবে। আমাকে সেটা বলবে–

কী জিনিস?

এই ভূখণ্ডের সবগুলো কম্পিউটারের অবস্থান আর তাদের যোগসূত্রগুলো যদি দেখ, আমি নিশ্চিত কয়েকটা যোগসূত্র খুব সুচিন্তিতভাবে কেটে দিতে পারলে পুরো নেটওয়ার্কটি দু ভাগে ভাগ করে ফেলা যাবে।

হ্যাঁ। ক্লড মাথা নেড়ে বলল, প্রশান্ত মহাসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে যে কয়েকটি যোগসূত্র চলে গেছে সেগুলো কেটে দিলে বলা যায় পুরো নেটওয়ার্ক দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে।

চমৎকার। তোমরা এখন ইচ্ছে করলে এই যোগসূত্রগুলো কেটে নেটওয়ার্কটি দুই ভাগে ভাগ করতে পারবে?

ক্লড ইশির দিকে তাকাল। ইশি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, পারব।

তোমাদের কতক্ষণ সময় লাগবে?

ভালো কিছু বাই ভার্বাল পেয়েছি। যোগসূত্রগুলোর নিখুঁত অবস্থানও জানি, চেষ্টা করলে আট কি দশ ঘণ্টার মাঝে করা যাঝে মনে হয়। নাইনা তুমি কী বল?

নাইনা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ এর বেশি সময় লাগার কথা নয়।

চমৎকার। আমি ক্লডের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার এই যোগসূত্রগুলোর অবস্থান জানা দরকার।

কিন্তু সেটা কি খুব বিপজ্জনক কিছু তথ্য নয়? তুমি সত্যি জানতে চাও? তথ্যটি মনে রাখাও সহজ নয়। সমুদ্রোপকূলে অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ মাটির নিচে গভীরতা কোয়ার্টজ ফাইবার কেবলের ক্রমিক সংখ্যা অসংখ্য সংখ্যা পরিমাপ

তা ঠিক, আমি মাথা নাড়ি। আমি মনে রাখতে পারব না–কিন্তু তথ্যটা আমার প্রয়োজন, তুমি ক্রিশির কপোট্রনে সেটা প্রবেশ করিয়ে দাও।

ক্রিশি?

হা ক্রিশি। ক্রিশি অত্যন্ত নিম্ন স্তরের কম্পিউটার, তার কপোট্রনের তথ্যে গ্রুস্টানের কোনো কৌতূহল নেই। আমি তার কপোট্রনে করে তথ্যটি নিয়ে যাব।

ক্লড কী একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলল, ঠিক আছে কুশান।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি এখন যাব।

কেউ কোনো কথা বলল না। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললাম, আমি যাবার পর তোমরা তোমাদের কাজ শুরু করতে পার। প্রথমে নেটওয়ার্কটি দু ভাগে ভাগ করবে। তারপর সেটিকে আরো দু ভাগ। আমরা যেভাবে ঠিক করেছিলাম।

ক্লড মাথা নাড়ল।

আমি একটু এগিয়ে যেতেই ইশি ডাকল, কুশান।

বল।

আমি জানি না তুমি কেন এটা করছ। খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে যে এটি আত্মহত্যা নয়, এটি আরো কিছু।

আমি কিছু না বলে একটু হাসার চেষ্টা করলাম।

আমাদের কি আবার দেখা হবে কুশান?

সেটা কি সত্যি জানার প্রয়োজন আছে?

ইশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, না, নেই।

আমি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, কী বলব বুঝতে পারি না। রাইনুক আমার দিকে তাকিয়ে জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমার মাঝে মাঝে একটা কথা মনে পড়ে।

কী কথা?

তুমি প্রথম যেদিন গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলে, লিয়ানা বলেছিল পাহাড়ের উপর থেকে একটা পাথর গড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

হ্যাঁ। আমি মাথা নেড়ে বললাম, লিয়ানা বলেছিল পাথরটা গড়িয়ে পড়তে পড়তে ধস নামিয়ে দেবে না ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে কেউ জানে না।

রাইনুক নরম গলায় বলল, আমরা জানি একটা ধস নেমে আসছে। কিন্তু সেই ছোট পাথরটাকে আমি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দেখতে চাই না।

ছোট পাথরটার কোনো গুরুত্ব নেই রাইনুক। কোনো গুরুত্ব নেই। বড় কথা ধস নেমেছে। সেটা কেউ থামাতে পারবে না

আমি যখন বাই ভার্বালে দাঁড়িয়ে ক্রিশিকে সেটা চালু করার আদেশ দিয়েছি তখন হঠাৎ দেখতে পেলাম দূর থেকে দ্রুন হাতে কয়েকটা ছবি নিয়ে ছুটে আসছে। আমি ক্রিশিকে থামতে বললাম, কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই দ্রুন আমার কাছে এসে দাঁড়াল। আমি তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে দ্রুন?

তুমি এই ছবিগুলো দেখ।

কিসের ছবি?

কম্পিউটারের মেমোরি থেকে বের করেছি। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার আগে বড় বড় নগরের ছবি।

এই ধরনের ছবি দেখলে বুকে এক ধরনের কষ্ট হয় কিন্তু সেগুলো এভাবে ছুটে এসে আমাকে কেন দেখানো হচ্ছে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি দ্রুনের দিকে তাকাতেই দ্রুন আমার হাতে আরো অনেকগুলো ছবি ধরিয়ে দিল, একই নগরের ছবি কিন্তু পারমাণবিক বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যাবার পর। এই ছবিগুলো দেখলে বুকের ভিতরে এক বিচিত্র ধরনের ক্রোধের জন্ম হয়। আমি খানিকক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে থেকে বললাম, দ্রুন এই ছবিগুলো তুমি আমাকে কেন দেখাচ্ছ?

তুমি ছবিগুলো কবে তোলা হয়েছে সেই তারিখটি দেখ।

আমি তারিখ দেখে চমকে উঠি, পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার দুই বছর আগের ছবি! দ্রুনের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটি কেমন করে হয়?

আমি জানি না কেমন করে হয়, কিন্তু হয়েছে। এগুলো কাল্পনিক ছবি, পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পর কেমন দেখাবে তার ছবি।

তার মানে?

তার মানে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অনেক আগেই গ্রুস্টান জানত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।

কিন্তু কেমন করে জানল সে? কেমন করে জানল ভবিষ্যতে কী হবে?

ইশি এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলল, ভবিষ্যতে কী হবে সেটি জানার একটি মাত্র উপায়।

কী?

সেই ভবিষ্যতটি যদি নিজের হাতে তৈরি করা হয়।

আমি চমকে ইশির দিকে তাকালাম, তুমি কী বলতে চাইছ ইশি?

আমি নিঃসন্দেহ কুশান। মানুষ এই পৃথিবী ধ্বংস করে নি, এই পৃথিবী ধ্বংস করেছে গ্রুস্টান।