উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী তার টেবিলে আঙুল দিয়ে ঠোকা দিতে দিতে বলল, “ব্লগের লেখাটা পড়েছ?”
লিডিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “পড়েছি। এনিম্যানকে নিয়ে যত লেখা বের হয় তার সব কিছু সিস্টেম পাঠানো হয়। আমাদের সুপার কম্পিউটার ক্র্যাগনন সেটা বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট পাঠায়।”
“আমি জানি।” উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী বলল, “যখন গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয় সেটা আমাকেও জানানো হয়। এটা আমাকে জানানো হয়েছে, আমি ব্লগটা পড়েছি। ব্লগটা লিখেছে পনেরো বছরের একটা মেয়ে। নাম তিষা আহমেদ।”
লিডিয়া মাথা নাড়ল, “মেয়েটার সব খোঁজ খবর নেয়া হয়েছে।”
“এখন কী করবে?”
“সবচেয়ে সহজ সমাধান হচ্ছে মেয়েটাকে মেরে ফেলা। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“এই মেয়েটা সাধারণ একটা মেয়ে না। তার এলাকায় সে ছোটখাটো সেলিব্রেটি। সাসকুয়ান হ্রদের উপরে বরফের আস্তরণ ভেঙ্গে নিচে পড়ে গিয়ে অক্সিজেন ছাড়া সাতাইশ মিনিট ছিল। মেয়েটা বেঁচে গেছে, ব্রেনের কোনো ক্ষতি হয়নি। লোকাল নিউজে তাকে অনেকবার দেখিয়েছে। ন্যাশনাল নিউজেও এসেছে। স্কুলে সে অসম্ভব পপুলার।”
“তার মানে কী দাঁড়াল?”
লিডিয়া বলল, “এখন তাকে হুট করে মেরে ফেলা যাবে না। খুব সাবধানে মারতে হবে যেন কেউ কোনো রকম সন্দেহ করতে না পারে।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী কোনো কথা না বলে লিডিয়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, হঠাৎ করে লিডিয়া এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। সে শুকনো গলায় বলল, “এরকম কিছু হতে পারে আমরা কখনো ভাবিনি।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী এবারেও কোনো কথা বলল না, লিডিয়া বলল, “আমরা ব্যাপারটা সামলে নেব। এই মেয়েটা যে কথা লিখেছে তার বিপরীতে অসংখ্য ব্লগ লেখা হচ্ছে। আমরা মোটামুটিভাবে সবাইকে বুঝিয়ে দেব লেখাটি সত্যি নয়।
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী এবারেও কোনো কথা বলল না। যতক্ষণ পর্যন্ত সে কোনো কথা বলছে না ততক্ষণ লিডিয়া স্বস্তি পাচ্ছে না। সে এক ধরনের। অনুনয়ের স্বরে বলল, “আমার উপর বিশ্বাস রাখো বিল। আমি ব্যাপারটা সামলে নেব।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “তুমি বুঝতে পারছ লিডিয়া, এই মেয়েটি যে কথা লিখেছে যদি পৃথিবীর মানুষ সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করে তাহলে আমাদের এই পুরো প্রজেক্ট চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে? কতো বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট তুমি সেটা জান?”
লিডিয়া দুর্বল গলায় বলল, “জানি।”
“যে কোনো অবস্থায় আমি সবার আগে দুটো বিষয় দেখি। সবচেয়ে ভালো কী হতে পারে আর সবচেয়ে খারাপ কী হতে পারে। এই টিনএজ মেয়েটির ব্লগ পড়ে আমি দুটো বিষয়ই ভেবে দেখেছি। সবচেয়ে ভালো হচ্ছে মেয়েটিকে কোনো ঝামেলা ছাড়া মেরে ফেলা। আর সবচেয়ে খারাপ কী জান?”
লিডিয়া নিচু গলায় বলল, “জানি।”
“না, জান না। তুমিও জান না আমিও জানি না। আমাদের সেই ক্ষমতা নেই। কারণ আমরা হচ্ছি সাইকোপ্যাথ। সাধারণ মানুষের মাঝে যে পুরোপুরি অর্থহীন একটা ব্যাপার আছে যেটাকে তারা মায়া-মমতা বলে, স্নেহ বলে, ভালোবাসা বলে আমাদের মাঝে সেটা নেই। তাই এই বিষয়গুলো কীভাবে কাজ করে, আমরা সেটা বুঝতে পারি না। আমরা সেটা অনুমান করার চেষ্টা করি কিন্তু আমাদের অনুমান ভুল হতে পারে।”
লিডিয়া আস্তে আস্তে বলল, “আমাদের সুপার কম্পিউটার ক্র্যাগননে সব তথ্য দিয়ে আমরা নিখুঁতভাবে মানুষের মন বিশ্লেষণ করতে পারি।”
“করে কী দেখেছ?”
লিডিয়া মাথা নিচু করে বলল, “খুব ভালো ফল দেখিনি। পৃথিবীর মানুষ বেশির ভাগই নির্বোধ। যুক্তি থেকে তারা আবেগের উপর নির্ভর করে বেশী। তাই যত সুন্দর যুক্তিই দেখানো যোক মানুষ এই নির্বোধ মেয়েটির
“তুমি কেমন করে জান মেয়েটি নির্বোধ?”
লিডিয়া বলল, “নির্বোধ না হলে শুধুমাত্র একটা ঘটনা দেখে কেউ এরকম একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী বলল, “কিন্তু তার সিদ্ধান্তটিতে সত্যতা আছে। এনিম্যানের হাসিটি সত্যিকারের হাসি নয়।”
“ঘটনাক্রমে সঠিক। যাই হোক এখন সেটা আমাদের দেখাতে হবে। আমি যেটা বলছিলাম-সাধারণ মানুষ এই মেয়েটির কথা কোনো যুক্তি ছাড়াই বিশ্বাস করতে চাইবে। সামাজিক নেটওয়ার্ক দিয়ে সেটা যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সেটা আমাদের জন্যে বড় বিপদ হয়ে যাবে। কাজেই আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছি কতো মানুষ এই মেয়েটার ব্লগ পড়ছে। যদি দেখি সংখ্যাটা হঠাৎ করে বেড়ে যাচ্ছে আমরা কিছু একটা করব।”
“মেয়েটিকে কী করবে?”
“ওকে মেরে ফেলতে হবে। আগে হোক পরে হোক, ওকে মরতে হবে।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এতো সহজে একজন মানুষকে মেরে ফেলার কথা কী আর কেউ বলতে পারবে?
লিডিয়া বলল, “আমাদের একটা বড় সুবিধা আছে।”
“কী?”
“এনিম্যান নিজে কোনো তথ্য দিতে পারবে না। তার কোনো ভাষা নেই। হাসি ছাড়া আর কোনো শব্দ করতে পারে না। কেউ তাকে কখনো কোনো প্রশ্ন করে উত্তর বের করতে পারবে না।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী মাথা নাড়ল, সেটা সত্যি। যখন পোষা প্রাণী হিসেবে কেউ এনিম্যানকে নিয়ে যায় তখন তার বয়স কতো থাকে?”
“জৈবিক বয়স খুবই কম, মাত্র এক বছর। কিন্তু মানসিক বয়স বেশি। ছয় থেকে সাত।”
“এতো বেশী কেন?”
“এনিম্যান নিজে যদি তার দৈনন্দিন কাজ করতে না পারে তাহলে সাধারণ মানুষ এটাকে পুষতে চাইবে না। সেজন্যে তার মানসিক বয়স একটু বাড়িয়ে দিতে হয়েছে।”
“যদি এটা মানুষ হতো তাহলে তার সাথে এই বয়সে কথা বলা। যেতো?”
লিডিয়া মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ তাহলে কথা বলা যেতো। কারণ এনিম্যান আসলে মানুষ। আমরা কেউই জানতে দেই না কিন্তু আসলে এটি মানব শিশু।”
“তাহলে তাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করতো, তোমার মনে কি দুঃখ আছে? সে কী উত্তর দিতো?”
“ছয় সাত বছরের বাচ্চার মতো কিছু একটা উত্তর দিতো। কিন্তু এখন দেবে না। কারণ এখন তার কোনো ভাষা নেই। কিছু জিজ্ঞেস করলে খিল। খিল করে হাসবে। একেবারে খাঁটি অকৃত্রিম হাসি।”
উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জী কিছুক্ষণ লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, “ঠিক আছে, আমি তোমাকে এক মাস সময় দিচ্ছি। এক মাস পরে তুমি এখানে এসে আমাকে বলবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মাঝে চলে এসেছে।”
“বলব।”
“যদি সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মাঝে চলে না আসে তাহলে তোমার আসার প্রয়োজন নেই। তুমি নিশ্চয়ই জান তখন আমাকে কী করতে হবে।”
লিডিয়া ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠল কিন্তু বাইরে প্রকাশ করল না। মাথা নেড়ে বলল, “আমি জানি।”
“যাও।”
লিডিয়া উঠে দাঁড়াল, বলল, “আমি বিশেষ কাজের জন্যে কোম্পানীর সাহায্য পাব তো?”
“পাবে। যতজন মার্ডারার দরকার পাবে। পুলিশ বাহিনী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আমি কিনে রেখেছি। যেটা আমার নিয়ন্ত্রণে নাই সেটা হচ্ছে অপদার্থ পাবলিক আর তাদের মাতলামো করার জায়গা–যেটাকে তোমারা বল সাইবার ওয়ার্ল্ড ইন্টারনেট। সারা পৃথিবীর ইন্টারনেট আমি বন্ধ করে দিতে পারব না।”
“আমার তার প্রয়োজন নেই।”
“ঠিক আছে। শুভ রাত্রি।”
“শুভ রাত্রি।”
লিডিয়া ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ভাবল, কী অর্থহীন একটা কথা–শুভ রাত্রি। একজনের শুভ রাত্রির জন্যে কাউকে না কাউকে কোথাও। না কোথাও অশুভ রাত্রি পেতে হয়! ভয়ঙ্কর নিরানন্দ রাত্রি পেতে হয়।