খেয়ে ওঠার পর আবার বসা হল বৈঠকখানায়। কামাল একটা পান মুখে পুরলেন, কাকাবাবু পান খান না, খেলেন খানিকটা মৌরি-মশলা। মুখোমুখি দুটো সোফায় বেশ হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে বসা যায়।
কামাল বললেন, হ্যাঁ। আমরা যে পাহাড়টায় পৌঁছলাম, তার নীচে একটা গ্রাম আছে, সেটার নাম তৈমুরডেরা। গ্রামটা ছোট, মাত্র তিরিশ-পঁয়তিরিশটি পরিবার। আমাদের দেখে সেখানকার লোকেরা খুব অবাক হল না, আরও কিছু কিছু বিদেশি নাকি সেই পাহাড়ে কীসব খোঁজাখুঁজি করে গেছে। তারা অবশ্য সবাই সাহেব। শুনে আমরা একটু দমে গিয়েছিলাম। আমরা যা খুঁজতে এসেছি, তা কি আগেই কেউ নিয়ে গেছে?
জোজো বলল, অশোকের শিলালিপি? অন্য কেউ নিয়ে যাবে কী করে?
সন্তু বলল, অশোকের শিলালিপি নয়। অন্য কিছু! চুপ করে শোন না।
কামাল বললেন, সেই গ্রাম থেকে আমরা কিছু চাল-আটা, আলু-পেঁয়াজ আর নুন কিনে পাহাড়ের ওপরে উঠে গেলাম। পাহাড়টা বেশ দুর্গম, ওপরদিকে কোনও জনবসতি নেই। গাছপালাও খুব কম। ভয়ঙ্কর খাদ আর দু-একটা গুহা আছে। ওদেশে তো আর সাধু-সন্ন্যাসী নেই, তাই গুহাগুলো ফাঁকা। আমরা আশ্রয় নিলাম সেইরকম একটা গুহায়। দিন তিনেক আমরা প্রায় চুপচাপ বসে রইলাম। আমাদের কেউ অনুসরণ করছে কি না সেটা বোঝা দরকার ছিল। আমি দুবেলা রুটি পাকাতাম কিংবা খিচুড়ি বানাতাম।
কাকাবাবু বললেন, তুমি রোজ রাঁধোনি। আমিও রাঁধতে জানি। একদিন কীরকম তেল ছাড়া শুধু নুন আর পেঁয়াজ দিয়ে আলুসেদ্ধ মেখেছিলাম!
জোজা বলল, আলুসেদ্ধ আবার রান্না নাকি? সবাই পারে!
কাকাবাবু বললেন, ওইরকম জায়গায় খিদের চোটে শুধু আলুসেদ্ধই অমৃত মনে হয়।
কামাল বললেন, তিনদিন পর শুরু হল খোঁজাখুঁজি।
জোজো বলল, এবার বলতেই হবে কী খুঁজছিলেন!
কাকাবাবু বললেন, আমরা যা খুঁজছিলাম, তা খুবই দামি জিনিস। সম্রাট কনিষ্ক একবার এক তুর্কি সুলতানের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে হেরে যান। জোজো বেশি ইতিহাস শুনতে ভালবাসে না, তাই সংক্ষেপে বলছি। অনেক বড় রাজার পক্ষেও হঠাৎ কোনও ছোট রাজার কাছে হেরে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এরকম অনেকবার হয়েছে। কনিষ্ক হেরে গেলেন বটে, কিন্তু আত্মসমর্পণ করেননি, পালিয়ে যান। পরে আবার সৈন্যবাহিনী গড়ে সেই সুলতানের সঙ্গে লড়াই করেন এবং জিতেও যান। প্রথম যুদ্ধটা হয়েছিল এই কাছাকাছি অঞ্চলে, দ্বিতীয় যুদ্ধটা হয়েছিল কাবুলের কাছে। এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় কনিষ্ক ছদ্মবেশ ধরেছিলেন, সেইজন্য তিনি নিজের রাজমুকুট ও আরও কিছু কিছু সম্পদ লুকিয়ে রেখে যান মাটিতে গর্ত পুঁতে। সেই জিনিসগুলো রাখার ভার দিয়েছিলেন তাঁর এক অতি বিশ্বাসী সেনাপতিকে। সে ছাড়া জায়গাটার সন্ধান অন্য কেউ জানত না। কাবুলে পৌঁছবার আগেই সেই সেনাপতিটি একটি দুর্ঘটনায় মারা যায়। সেইজন্য রাজা কনিষ্কর সেই গুপ্ত সম্পদ আর কোনওদিন উদ্ধার করা যায়নি।
জোজো বলল, তার মানে, গুপ্তধন?
কাকাবাবু বললেন, অনেকটা তাই। তবে আমাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল সম্রাট কনিষ্কের মুকুটটা খুঁজে বার করা। বুঝতেই পারছ, যে-সম্রাটের মুখোনা কেমন দেখতে ছিল তাই-ই আমরা জানি না, তাঁর একটা মূর্তিরও মুণ্ডু নেই, সেই সম্রাটের মুকুটখানারও ঐতিহাসিক মূল্য সাঙ্ঘাতিক।
জোজো বলল, এতকাল কেউ জানতে পারেনি, আপনারা কী করে জানবেন সেগুলো কোথায় লুকনো আছে?
কাকাবাবু বললেন, অনেক ঐতিহাসিক নানারকম অনুমান করেছেন। এব্যাপারে আমার নিজের বিশেষ কিছু জ্ঞান ছিল না। কিন্তু সেই সময় প্রভাকরন নামে একজন খুব বড় ইতিহাসের পণ্ডিত ছিলেন দিল্লিতে। সেই প্রভাকরন কিছু পুঁথিপত্তর আর মুদ্রা থেকে একটা থিয়োরি খাড়া করেছিলেন। সেটা মিলতেও পারে, না মেলার সম্ভাবনাই বেশি। প্রভাকরন অবশ্য দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন তিনি ঠিক জায়গাটা আবিষ্কার করেছেন। প্রভাকরন তখন বৃদ্ধ, তার ওপর তাঁর হাঁপানি রোগ। তিনি নিজে তো আর আফগানিস্তানে এসে পাহাড়-পর্বতে খোঁজাখুঁজি করতে পারবেন না, তাই একদিন আমাকে বলেছিলেন, রাজা রায়চৌধুরী, তোমার বয়েস কম, শরীরে শক্তি আছে, মনের জোরও আছে, তুমি একবার চেষ্টা করে দেখবে নাকি? যদি ব্যর্থ হও, সেটা তোমার দুর্ভাগ্য, আর যদি সার্থক হও, ইতিহাসে তোমার নাম থেকে যাবে!
কামাল বললেন, তোমরা কি জানো, কাবুলের মিউজিয়ামে রাজা রায়চৌধুরীর ছবি আছে?
কাকাবাবু বিরক্তভাবে বললেন, আঃ, ওসব কথা বাদ দাও। গল্পটা বলো!
কামাল বললেন, সত্যি ঘটনাটা তো ঠিক গল্পের মতন বলা যায় না। পরের কথা আগে এসে পড়ে। অন্য কথা মনে পড়ে যায়!
সন্তু বলল, তার মানে আপনারা সেই মুকুট খুঁজে পেয়েছিলেন!
কামাল বললেন, হ্যাঁ। প্রভাকরনের তত্ত্ব কেউ বিশ্বাস করেনি, শুধু আমরা দুজনে বিশ্বাস করে অত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। প্রভাকরন একটা ম্যাপ এঁকে দিয়েছিলেন, সেই ম্যাপ ধরে-ধরে আমরা ইঞ্চি-ইঞ্চি করে খুঁজেছি। চারদিন না পাঁচদিন লেগেছিল।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কোথায় পাওয়া গেল? কোনও গুহার মধ্যে? কাকাবাবু বললেন, গুহাগুলো তো অন্যরা খুঁজতে বাকি রাখেনি। না, কোনও গুহার মধ্যে নয়। জলের নীচে। একটা গভীর খাদের নীচে বহুকাল ধরে জল জমে আছে। দড়ি বেঁধে আমরা সেই খাদে নেমেছিলাম। ম্যাপে যেখানে পিন পয়েন্ট করা সেখানে দেখি যে জল। তখন সেই জলেই ড়ুব দিলাম অনেকবার। সেখানে অনেক কিছু ছিল, সব আমরা নিতেও পারিনি। একটা হাতির দাঁতের তৈরি বাক্স পেয়েছিলাম, হাতির দাঁতের তৈরি বলেই এতযুগ পরেও সেটা পচেনি। সেই বাক্সের মধ্যে ছিল রাজমুকুট। তোরা শুনে অবাক হয়ে যাবি, মুকুটটা কিন্তু সোনার তৈরি নয়। ভারত জয় করার আগে তো কনিষ্ক সম্রাট ছিলেন না, ছিলেন সাধারণ রাজা। মুকুটটা তামার তৈরি। তার ওপরে লাল ও সবুজ পাথর বসানো, সেগুলো চুনি আর পান্না। সব মিলিয়ে মুকুটটার দাম খুব বেশি নয়, কিন্তু ইতিহাসের দিক দিয়ে দাম অনেক।
জোজো জিজ্ঞেস করল, কী করে প্রমাণ হবে যে ওটা কনিষ্করই মুকুট?
কাকাবাবু বললেন, যে-কোনও জিনিসই কতদিন আগে তৈরি, তা এখন প্রমাণ করা যায়। তা ছাড়া কিংবদন্তির সঙ্গে মিলে গেছে। ওই বাক্সটা পেয়ে আমাদের কী যে আনন্দ হয়েছিল! জল-কাদা-মাখা ভূতের মতন চেহারা নিয়ে আমি আর কামাল সেই খাদের মধ্যে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছি। এতদিনের পরিশ্রম সার্থক।
কামাল বললেন, ওই বাক্সটা ছাড়াও আমরা কিছু সোনা রুপোর গয়নাও পেয়েছিলাম। সেগুলো বোধ হয় রানিদের। কোনও অভিজ্ঞ ড়ুবুরিকে এনে খোজাখুঁজি করলে আরও অনেক কিছু পাওয়া যেত, কিন্তু আমাদের কাছে ওই মুকুটটাই ছিল যথেষ্ট।
কাকাবাবু বললেন, আইন অনুযায়ী ওইসব জিনিসই আফগানিস্তান সরকারের প্রাপ্য। যদিও আবিষ্কার করেছি আমরা, ওরা কিছুই করেনি, তবু এক দেশের সম্পদ অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া যায় না। কাবুলে গিয়ে গভর্নমেন্টকে সব জমা করে দিতে হবে, আমরা শুধু ছবি তুলে নিয়ে যেতে পারব।
কামাল বললেন, আমি অবশ্য ভেবেছিলাম, মুকুটটা অন্তত লুকিয়ে দিল্লিতে নিয়ে আসব। কিছুদিন রেখে, বড়-বড় পণ্ডিতদের দেখিয়ে তারপর এ-দেশকে ফেরত দেব। দাদা রাজি হননি। যাই হোক, এত কষ্টের পর ওই জিনিসগুলো পেয়ে আমরা এমন আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম যে, অন্য কোনও কথা মনেই পড়েনি। দাদা বারবার বলছিলেন, সম্রাট কনিষ্কের মুকুট! সত্যি-সত্যি আমাদের হাতে। প্রভাকরন কত খুশি হবেন! কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি! একটা গাছতলায় বসে আমরা এই সব বলাবলি করছি, তখন বিকেল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমাদের গুহা সেখান থেকে অনেকটা দূরে। একটু চা খাওয়া দরকার, তবু আমরা উঠি-উঠি করেও উঠছি না। অতখানি খাদে নামা আর ওঠা, জলে বারবার ড়ুব দেওয়া, পরিশ্রম তো কম হয়নি, আনন্দের চোটে সেসব ভুলে গেছি, এই সময় এল বিপদ! সেই নির্জন পাহাড়ে হঠাৎ কোথা থেকে দুজন লোক আমাদের পেছন দিক থেকে হঠাৎ হাজির হল। একজনের হাতে রাইফেল, অন্যজনের হাতে রিভলভার! আমরা সাবধান হওয়ারও সময় পেলাম না। একজন আমার বুকে রাইফেলের নল ঠেকাল, আর একজন রাজাদাদার মাথার দিকে উঁচিয়ে রইল রিভলভার!
কাকাবাবু বললেন, সেই দুজনের মধ্যে একজনকে চিনতে পারলাম। সে কে হতে পারে বল তো?
জোজো বলে উঠল, জাভেদ দুরানি! সেই ডাকাতের সর্দার!
কাকাবাবু বললেন, না, ওই পাহাড়ি লোকরা খুব হিংস্র হলেও একবার কথা দিলে কথা রাখে। সে আমাদের পাঞ্জা দিয়েছে, আর সে আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করবে না। সে হচ্ছে ওই অবোধরাম পেহলবান। সে গোপনে আমাদের অনুসরণ করেছিল। সে ঠিক সন্দেহ করেছিল যে, আমরা কোনও দামি জিনিসের সন্ধানে এসেছি। তার সঙ্গে মাত্র একজন লোক, আমরাও দুজন, যদি একটু আগে টের পেতাম, তা হলে ওদের খপ্পরে অমনভাবে পড়তে হত না।
কামাল বললেন, দাদার মাথার দিকে রিভলভার উঁচিয়ে অবোধরাম দাঁতে দাঁতে চেপে বলল, রাজা রায়চৌধুরী, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, ওই বাক্সটা আমার হাতে তুলে দাও! দাদার কোলের ওপর সেই বাক্স। ওই লোকটা যেমন নিষ্ঠুর, আমরা কোনওরকম চালাকি করতে গেলেই ও নির্ঘাত গুলি চালাবে! আমি তো ভাবলাম, যাঃ, সব গেল! এখন প্রাণে বাঁচবার জন্য বাক্সটা দিয়ে দিতেই হবে। কিন্তু দাদা অন্য ধাতুতে গড়া!
কাকাবাবু বললেন, ভুল, কামাল, ভুল। ওই অবস্থায় সবকিছু দিয়ে দিলেও প্রাণে বাঁচা যায় না। অবোধরাম আমাদের কাছ থেকে বাক্সটা নিয়ে নেওয়ার পরও ঠিক গুলি চালাত। প্রমাণ রাখবে কেন, আমাদের মেরে রেখে চলে যেত।
অংশু কৌতূহল দমন না করতে পেরে বলে উঠল, আপনারা কী করে বাঁচলেন? দুজনের দিকেই রাইফেল আর রিভলভার?
কামাল বললেন, আমি ঘাবড়ে গেলেও ওই অবস্থায় দাদার মাথার ঠিক ছিল। উনি করলেন কী, বললেন, বাক্সটা চাও, এই নাও বলেই বাক্সটা ছুড়ে দিলেন ডান দিকে। সেদিকে পাহাড়টা ঢালু হয়ে গেছে। বাক্সটা গড়াতে লাগল, আর একটু হলেই পড়ে যেত অনেক নীচে। অবোধরাম দৌড়ে গিয়ে কোনওরকমে ধরে ফেলল বাক্সটা। দাদা করলেন কী, সেই সুযোগে লাফিয়ে উঠে অন্য লোকটার ঘাড়ে এসে পড়লেন। আমার দিকে যে রাইফেল উঁচিয়ে ছিল, সে দাদার দিকে পেছন ফিরে ছিল তো। দাদা তাকে মাটিতে পেড়ে
ফেলে কেড়ে নিলেন রাইফেলটা।
জোজো বলল, দারুণ! আমি হলেও ঠিক এইরকমই করতাম!
কামাল বললেন, তাতেও কিন্তু শেষরক্ষা হল না!
জোজো বলল, কেন? ওই লোকটার কাছে রিভলভার, আপনাদের কাছে রাইফেল। রিভলভারের চেয়ে রাইফেলের শক্তি বেশি!
কামাল বললেন, তা ঠিক। কিন্তু বিপদ এল অন্যদিক থেকে। ওইরকম ব্যাপার দেখে অবোধরাম লুকিয়ে পড়ল একটা বড় পাথরের আড়ালে। আমাদের এদিকে সেরকম কিছু ছিল না। আমরা দাঁড়ালাম গাছটার পেছনে। ও গুলি চালালে আমাদেরও গুলি চালাতে হল। দুবার এরকম গুলি বিনিময়ের পরেই অবোধরাম হাসতে-হাসতে সামনে চলে এল। তারপর বলল, রায়চৌধুরী, ওটা ফেলে দাও, ওটাতে আর কোনও কাজ হবে না! রাইফেলটায় মাত্র দুটোই গুলি ছিল, আর গুলি নেই। অবোধরামের কাছে অনেক গুলি রয়েছে। অন্য লোকটা এবার উঠেই দাদার মুখে এক ঘুসি চালাল। আমাদের আর কিছুই করার নেই। অবোধরাম বলল, তোমাদের মারতে আমার দুটোর বেশি গুলি খরচ হবে না। আর ত্যান্ডাই-ম্যান্ডাই কোরো না। রায়চৌধুরী, তুমি খুব চালাক, তাই না? পাথরের ওপর কীসব লেখাটেখার ছবি তোলার জন্য এতদূর এসেছ, এ কথা আমি বিশ্বাস করব? এইসব পুরনো জিনিস বিলেত-আমেরিকায় বহু দামে বিক্রি হয়, তোমরা সেই লোভে এসেছ। এবার মনো!
অংশু বলল, অ্যাঁ তক্ষুনি গুলি করল?
কাকাবাবু বললেন, একটু সময় নেওয়ার জন্য আমি বললাম, ও জিনিস তুমি দেশের বাইরে নিতেও পারবে না, বিক্রিও করতে পারবে না! তা শুনে অবোধরাম আরও জোরে হেসে উঠল।
কামাল বললেন, অন্য লোকটা হাতের সুখ করার জন্য আমার মুখেও একটা ঘুসি মারল। অবোধরাম তাকে বলল, রহমত, দাঁড়া, ঘুসি মেরে কেন হাতব্যথা করছিস, ওদের আরও কঠিন শাস্তি দেব! দড়ি দিয়ে ওদের হাত-পা বেঁধে ফেল! অবোধরাম রিভলবার উঁচিয়ে আছে, আমাদের বাধা দেওয়ার উপায় নেই, রহমত নামে অন্য লোকটা আমাদের দুজনকেই বেঁধে ফেলল। অবোধরাম দাদার চুলের মুঠি ধরে টানতে-টানতে নিয়ে গেল একটু দূরে। তারপর বলল, রায়চৌধুরী, তোমাদের জন্য গুলি খরচ করে কী হবে! তোমাদের এমনভাবে রেখে যাব, যাতে একদিন ভূত হয়ে এই পাহাড়ে ঘুরবে। একটা গাছের ডালে দড়ি বেঁধে ও দাদাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিল।
অংশু আঁতকে উঠে বলল, অ্যাঁ তারপরও উনি বেঁচে রইলেন কী করে?
কাকাবাবু মুচকি হাসলেন।
কামাল বললেন, দেখছই তো আমরা ভূত হইনি, দিব্যি বেঁচে আছি। তারপর যা হল, সেটা শুধু রাজা রায়চৌধুরীর পক্ষেই সম্ভব। রহমত একটা ভুল করেছিল, সে আমাদের হাত পা বেঁধেছিল বটে, কিন্তু নিয়ম হচ্ছে, হাত দুটোকে পিঠের দিকে নিয়ে গিয়ে বাঁধা। সে বেঁধেছিল সামনের দিকে। সেই অবস্থায় হাত দুটো ওপরে তোলা যায়। দাদাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতেই আমি চোখ বুজে কেঁদে উঠলাম। ভাবলাম যে উনি শেষ হয়ে গেলেন, এবার আমার পালা! কিন্তু দাদা হাত দুটো তুলে মাথার ওপরের দড়িটা ধরে ফেললেন, তাতে গলায় টান লাগে না। সেই অবস্থায় দুলতে লাগলেন। তাতে মজা পেয়ে অবোধরাম বলল, কতক্ষণ দুলতে পারো দেখি! এ কথা ঠিক, ওই অবস্থায় বেশিক্ষণ দোলা যায় না, হাত কাঁপতে থাকে, তারপর হাত একটু আলগা হলেই গলায় ফাঁস লেগে জিভ বেরিয়ে যাবে। সঙ্গে-সঙ্গে শেষ। কিন্তু রাজা রায়চৌধুরীর অসীম সাহস। ওই অবস্থায় দুলতে-দুলতে উনি একবার জোরে দুলে এসে অবোধরামের মুখে জোড়া পায়ে একটা লাথি কষালেন। অবোধরাম ছিটকে পড়ে গেল। দাদা ধমকে বললেন, ইডিয়েট, গুলি কর। আমাকে মারতে চাস তো গুলি কর, নইলে আমি কিছুতেই মরব না!
কাকাবাবু বললেন, সাহসের ব্যাপার নয়। এটাও একটা কৌশল। ক্রিমিনালদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে হয়। আমি কিছু না বললে ও গুলি করত ঠিকই। আমি হুকুম দিলাম বলেই ও গুলি করবে না। তাতে আরও কিছুটা সময় পাওয়া যাবে!
কামাল বললেন, ঠিক তাই। লাথি খাওয়ার পর উঠে দাঁড়িয়ে অবোধরাম প্রথমে রাইফেলটা নিয়ে তার কুঁদো দিয়ে দাদার পায়ে দুবার খুব জোরে মারল। তারপর বলল, গুলি করব? মোটেই না? এইরকমভাবে থাক, আর তিলতিল করে মর। এই পাহাড়ে কেউ আসবে না, আর ওই দড়িও ছিড়বে না। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে, রহমতকে নিয়ে অবোধরাম আমাদের ওই অবস্থায় ফেলে রেখে চলে গেল!
কথা থামিয়ে কামাল বললেন, এখন এই পর্যন্ত থাক। বাকিটা আবার পরে হবে। আমার একটু কাজে বেরনো দরকার।
সন্তু-জোজো-অংশু তিনজনে একসঙ্গে বলে উঠল, না, এখানে থামলে চলবে না? আজ সবটা বলতেই হবে।
জোজো উঠে এসে কামালের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আপনাদের যেতেই দেব?
কাকাবাবু বললেন, আর তো বেশি নেই। কামাল, শেষ করেই দাও।
কামাল বললেন, হ্যাঁ, আর বেশি নেই অবশ্য।
জোজো বলল, সংক্ষেপ করলে হবে না। সব বলতে হবে। কাকাবাবু কী করে ফাঁসির দড়ি থেকে উদ্ধার পেলেন?
কামাল বললেন, মানুষের মনের জোর যে কতখানি হতে পারে, সেদিনই আমি বুঝলাম। তোমরা ভেবে দ্যাখো অবস্থাটা। দাদা গাছের ডাল থেকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলছেন, আমার হাত-পা বাঁধা, আমি নড়তেচড়তে পারছি না। দাদা কোনওরকমে মাথার ওপরে দড়িটা ধরে আছেন, যে-কোনও মুহূর্তে হাত আলগা হয়ে যাবে। সেই অবস্থাতেও দুলতে-দুলতে উনি কথা বলছেন আমার সঙ্গে। আমাকে বললেন, কামাল, ঘাবড়াবার কিছু নেই। কিন্তু আমি ঘাবড়াব না? চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পাবে না, কেউ আমাদের উদ্ধার করতে আসবে না। অত উঁচু পাহাড়ে কোনও লোকই আসে না। দাদা দুলতে-দুলতে গাছের ডালটা ভাঙবার চেষ্টা করলেন প্রথমে। কিন্তু সেটা খুব মজবুত ডাল, ভাঙবার কোনও লক্ষণই নেই। তখন দাদা আরও জোরে দুলে দুলে কোনওরকমে সেই ডালটায় চড়ে বসলেন।
কাকাবাবু বললেন, তারপর তো সবকিছুই সোজা হয়ে গেল। প্রথমে দাঁত দিয়ে কামড়ে-কামড়ে আমি হাতের বাঁধন খুলে ফেললাম। তারপর গলার ফাঁস আর পায়ের বাঁধন। এর পর লাফ দিয়ে নীচে নেমে এসে কামালকে মুক্ত করে দিলাম।
অংশু বলল, ততক্ষণে ওরা অনেক দূরে চলে গেছে নিশ্চয়ই?
কামাল বললেন, তা জানি না। তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। দৌড়ে ওদের তাড়া করারও বিপদ আছে। আমাদের কাছে অস্ত্র নেই। ওদের আছে। আমাদের তখন প্রথম কাজ নিজেদের গুহায় ফিরে যাওয়া। যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে সেখানে পৌঁছে গেলাম। এত ক্লান্ত লাগছিল যে, ইচ্ছে করছিল শুয়ে থাকতে। খিদেও পেয়েছিল খুব। দাদা কিন্তু বিশ্রাম নিতে দিলেন না। আমাদের সঙ্গে কিছু শুকনো খেজুর আর পেস্তাবাদাম ছিল, শুধু তাই খেয়েই আমরা নেমে গেলাম নীচের গুহায়। আমাদের ঘোড়া দুটো সেখানেই রাখা ছিল। গ্রামের লোকদের জিজ্ঞেস করলাম, তারা অবোধরাম আর রহমতের মতন দুজন লোককে দেখেছে কিনা। কেউ কিছু বলতে পারল না। অন্ধকারের মধ্যে ওরা কতটা এগিয়ে গেছে কিংবা কোথায় লুকিয়ে আছে, সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই। এদিককার রাস্তাঘাট ওরা আমাদের চেয়ে অনেক ভাল চেনে। রাত্তিরটা আমাদের সেই গ্রামেই থেকে যেতে হল।
কাকাবাবু বললেন, ইন্ডিয়ার লোক হয়ে অবোধরামের পক্ষে আফগানিস্তানের পাহাড়ে ডাকাতি করা অস্বাভাবিক ব্যাপার। অন্য ডাকাতরা তা মানবে কেন? ডাকাতির জিনিস বিক্রি করা নিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক। এটা অবোধরাম গোপনে একটা ঝুঁকি নিয়েছে। ভেবেছিল যে আর কেউ জানতে পারবে না। সেইজন্য সঙ্গে মাত্র একজন লোক এসেছিল। ওই রহমত নামের লোকটা খুব সম্ভবত বোবা কিংবা তার জিভ কাটা। সে একটা কথাও বলেনি, কোনও শব্দও করেনি। আমরা ঠিক করলাম, অবোধরামদের তাড়া করে আমরা আর ধরতে পারব না। কিন্তু বড় ডাকাতদলের সর্দার জাভেদ দুরানির সঙ্গে দেখা করে ওর নামে নালিশ জানাব। অবোধরাম ডাকাতদলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। জাভেদ দুরানি ইচ্ছে করলেই অবোধরামকে ধরতে পারবে। সম্রাট কনিষ্কের মুকুটটা সে হয়তো আমাদের ফেরত দেবে না। তবু যদি অন্তত ছবি তুলতে দেয়, তা হলেও একটা প্রমাণ থাকবে। সেই ভেবে আমরা যাত্রা শুরু করলাম, পরদিন সকালে।
কামাল বললেন, এবার কিন্তু ভাগ্য আমাদের দিকে। জাভেদ দুরানির কাছে পৌঁছবার আগেই আমরা ওদের দেখা পেয়ে গেলাম। দ্বিতীয়দিন সন্ধেবেলা। বোধ হয় ওদের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, কিংবা কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল পথে, নইলে অতটা পেছিয়ে পড়ার কথা নয়। আমরা তখন যাচ্ছি। পাহাড়ের একটা উঁচু রাস্তা দিয়ে, অনেক নীচে দেখতে পেলাম ওরা বসে আছে। আগুন জ্বেলে কিছু রান্না করছে। কীরকম জায়গাটা বুঝলে? আমরা তো অনেক উঁচুতে রয়েছি, এদিকটা খাড়া পাহাড়, নামবার উপায় নেই। সরু রাস্তা দিয়ে ঘুরে-ঘুরে নেমে ওদের কাছে পৌঁছতে অনেকটা সময় লেগে যাবে।
ততক্ষণ ওরা থাকবে কিনা ঠিক নেই। কিংবা কাছাকাছি গেলে ওরা আমাদের ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ শুনে ফেলতে পারে। ওদের দেখে সেই বাক্সটা উদ্ধার করার আশায় তোমাদের কাকাবাবু একেবারে ছটফট করতে লাগলেন। কিন্তু আমরা নামব কী করে? অতদূর থেকে গুলি করলেও সুবিধে হবে না। দাদা তবু বললেন, কামাল, তুমি ঘোড়া দুটো নিয়ে রাস্তা দিয়ে নীচে নেমে এসো, আমি এখান দিয়েই নামছি। আমি বললাম, আপনার মাথাখারাপ নাকি? এই খাড়া পাহাড় দিয়ে নামতে গেলেই তো ব্যালান্স রাখা যাবে না। আপনি গড়িয়ে পড়ে যাবেন। উনি বললেন, আর্মির লোকেরা এইরকম জায়গা দিয়েও নামতে পারে। শুয়ে পড়ে বুকে ভর দিয়ে দিয়ে নামতে হয়। আমি সেরকমভাবে ঠিক নেমে যাব। জানি তো, দাদা কীরকম গোঁয়ার। আমার আপত্তি শুনবেন না। দাদাকে একা ছেড়ে দিই কী করে? ঘোড়াদুটোকে সেখানে রেখে আমরা সেই ঢালু পাহাড়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। এবার অবশ্য আমাদের সঙ্গে অস্ত্র আছে। ওদের সমান-সমান। তবু আমাদের দিক দিয়ে সুবিধে এই যে, ওরা এদিকে পেছন ফিরে বসে রাস্তার দিকে নজর রাখছে। এই পাহাড় দিয়ে যে কেউ নেমে আসতে পারে, তা ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি। এই পাহাড়টায় ঝোপঝাড় ছিল, অন্ধকার হয়ে এসেছে, আমাদের দেখাও যাবে না। দাদা বললেন, কামাল, তুমি রহমতকে তাক করবে, আমি অবোধরামকে। অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার পর আমি আর ধৈর্য ধরতে পারলাম না, গুলি চালিয়ে দিলাম। দাদাও তা অনায়াসে করতে পারতেন, তবু অবোধরামকে মারলেন না।
সন্তু বলল, আমি জানি, কাকাবাবু কাউকে গুলি করে মারেন না। যত বড় শত্রুই হোক, তাকেও মারবেন না।
জোজো বলল, তা হলে কাকাবাবু কী করলেন?
কামাল বললেন, আমার গুলি রহমতের ডান কাঁধে লেগেছিল, সে পড়ে গিয়ে কাতরাতে লাগল। তোমাদের কাকাবাবু বাঘের মতন অনেক উঁচু থেকে এক লাফে অবোধরামের ওপর গিয়ে পড়লেন। তারপর শুরু হল গড়াগড়ি আর ঘুসোঘুসি। আমি রাইফেল তৈরি রেখেছিলাম, অবোধরাম জিতলে সঙ্গে-সঙ্গে গুলি চালাতাম। তার দরকার হল না, একটু পরেই দাদা অবোধরামকে চিত করে ফেলে তার গলায় জুতোশুঙ্কু এক পা দিয়ে দাঁড়ালেন। তার আর নড়বার উপায় রইল না। হাতির দাঁতের সেই বাক্সটা কাছেই পড়ে আছে। আমি বললাম, দাদা, আর ঝুঁকি নেওয়ার দরকার নেই। এ-দুটোকে গুলি করে মেরে নদীতে ফেলে দেওয়া যাক। তা হলে আমরা নিশ্চিন্তে যেতে পারব। দাদা কিন্তু রাজি হলেন না। বললেন, আমরা ওদের শাস্তি দেব কেন? ওদের এখানেই গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে আমরা গিয়ে জাভেদ দুরানিকে খবর দেব। বিশ্বাসঘাতকদের যা শাস্তি হয় ওরা দেবে। দাদার সঙ্গে তর্ক করেও লাভ হল না। ওদের দুজনকে দুটো গাছের সঙ্গে বাঁধলাম। কিন্তু শাস্তি না দিয়ে চলে আসতে ইচ্ছে করছিল না। তাই আমি আচ্ছা করে কান মুলে দিলাম দুজনের। ইচ্ছে করছিল একটা করে কান ছিঁড়ে নিতে।
কাকাবাবু বললেন, তুমি রাগের চোটে একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিলে।
কামাল বললেন, হব না? অবোধরামের মতন অমন হিংস্র আর নিষ্ঠুর মানুষ আমি আর দেখিনি। তখন বলে কি জানো? আমরা চলে আসছি, সে বলল, রায়চৌধুরী, আমাকে এরকমভাবে বেঁধে রেখে যেয়ো না। জাভেদ দুরানির কাছে গেলে সে ওই মুকুটটা কেড়ে রেখে দেবে, তোমাদের কোনও লাভ হবে না। আমার কাছে তোমরা কী চাও বলো! তা শুনে আমি আরও রেগে গিয়ে বললাম, শয়তান, তুই আমার দাদাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে রেখে এসেছিলি। ভেবেছিলি, সে এতক্ষণে মরেই গেছে? আমারও বাঁচার আশা ছিল না। এখন তুই নির্লজ্জের মতন ক্ষমা চাইছিস? তাতে সে বলল, ক্ষমা চাইব কেন? আমাদের ছেড়ে দিলে, আমি তোমাদের দুজনকেই এক লক্ষ টাকা দেব। তোমাদের আমিই পৌঁছে দেব কাবুলে! আমি আবার ওর কান মুলে দিয়ে বললাম, তোমার মতন সাপকে আর কেউ বিশ্বাস করে? দাদা, আপনিও তখন খুব রেগে উঠেছিলেন, মনে আছে?
কাকাবাবু বললেন, আমাকে কেউ ঘুষ দিতে চাইলে আমি তাকে কিছু না কিছু শাস্তি না দিয়ে ছাড়ি না। ওই এক লক্ষ টাকার কথা শুনে আমিও ওর দুগালে দুটো থাপ্পড় কষালাম।
কামাল বললেন, তখনও অবোধরাম চাচাতে লাগল, এইভাবে আমাকে মারতে পারবে না। আমি তোমাদের দেখে নেব! পৃথিবীর যেখানেই লুকিয়ে থাকো, আমি ঠিক খুঁজে বার করে প্রতিশোধ নেব! আমরা অনেক দূরে চলে এসেও ওর চিৎকার শুনতে পেলাম!
কাকাবাবু হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ব্যস, এই তো হয়ে গেল গল্প। তারপর আমরা সেই মুকুটের বাক্সটা নিয়ে ফিরে এলাম কাবুলে। এবার চলল, যাওয়া যাক। গেস্ট হাউসে ফিরে আমাকে কয়েকটা চিঠি লিখতে হবে।
জোজো হইহই করে বলে উঠল, সে কী? সব শেষ হয়ে গেল মানে? আসল ব্যাপারটা তো জানা হল না। কাকাবাবুর পা ভাঙল কী করে?
কাকাবাবু বললেন, সেটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। একটা এমনি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।
অংশু বলল, বুঝেছি। ওই লোকটা, মানে অবোধরাম যখন কাকাবাবুকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে তারপর রাইফেলের বাঁট দিয়ে পায়ে খুব জোর মেরেছিল, তাতেই ওঁর একটা পা ভেঙে গিয়েছিল।
কামাল আস্তে-আস্তে মাথা নেড়ে বললেন, না, তাতে পায়ের মাংস কেটে অনেক রক্ত পড়েছিল, কিন্তু হাড় ভাঙেনি। সেটা হয়েছে পরে।
জোজো দাবি জানাল, আমরা সব ঘটনাটা শুনতে চাই!
কামাল বললেন, সে-ঘটনাটা কেউ জানে না। দাদা নিজের মুখে কখনও বলবেন না জানি! দাদার একটা পা নষ্ট হয়ে গেছে আমার জন্য। উনি আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্য চিরকালের মতন নিজের একটা পা নষ্ট করেছেন। পৃথিবীতে আর কোনও মানুষ বোধ হয় এ কাজ করত না।
কাকাবাবু বললেন, যাঃ, কী যে বলো! ওইরকম অবস্থায় পড়লে সবাই করত। আমার কোনও বিপদ হলে তুমি ঝুঁকি নিতে না?
কামাল বললেন, না দাদা, সবাই করে না। নিজেদের প্রাণের মায়া কজন তুচ্ছ করতে পারে?
বলতে-বলতে কামাল ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন!
ওরকম একজন বয়স্ক মানুষকে কাঁদতে দেখে জোজো-সন্তুরা আড়ষ্ট হয়ে গেল, আর কোনও কথা বলতে পারল না।
কাকাবাবু কামালের কাছে এসে তাঁর কাঁধে হাত দিয়ে স্নিগ্ধ স্বরে বললেন, কী হল, কামাল! সে তো অনেকদিন আগেকার কথা! শান্ত হও, শান্ত হও।
কামাল চোখ মুছে বললেন, সেই কথাটা যখনই মনে পড়ে, আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। আমার বাঁচার কোনও কথাই ছিল না। আপনি রক্ষা না করলে আজ আমার এই বাড়ি, ব্যবসা, বউ-ছেলেমেয়ে এসব কিছুই হত না।
কাকাবাবু বললেন, ওসব কথা আর ভাবতে হবে না। বলছি তো, আমারও হতে পারত। যথেষ্ট হয়েছে, এবার গল্প বন্ধ করো।
কামাল নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, না, বাকিটা আমি ওদের শোনাব। বুঝলে সন্তু, এর পর যা ঘটল, তা আমারই দোষে। অতি বোকার মতন, বোকার মতন একটা অ্যাকসিডেন্ট। ওদের দুজনকে বেঁধে রেখে আমরা বড়জোর আর আধঘণ্টা গেছি। অত কষ্টে আবিষ্কার করা কনিষ্কের মুকুট আবার ফিরে পেয়েছি বলে মনটা খুব উৎফুল্ল। পাহাড়ের ওপর দিয়ে রাস্তা। সেখানকার দৃশ্য খুব সুন্দর। মাঝে-মাঝে গাছপালা, দু-একটা গাছে অচেনা ফুল ফুটে আছে। অনেক নীচে আমুদরিয়া নদী। রোদুর পড়ে রুপোর মতন চকচকে দেখাচ্ছে। আমাদের ঘোড়াদুটো যাচ্ছে পাহাড়ের খাড়া পাড়ের ধার দিয়ে। এক জায়গায় আমার ঘোড়াটা পাহাড়ের একেবারে কিনারে ঘাস খাওয়ার জন্য মুখ বাড়াল। পাশেই একটা ফুলের গাছ। আমি অন্যমনস্কভাবে সেই গাছ থেকে একটা ফুল ছিড়তে যেতেই, ব্যালান্স হারিয়ে পড়ে গেলাম ঘোড়া থেকে, সঙ্গে-সঙ্গে গড়াতে লাগলাম পাহাড়ের গা দিয়ে। সেখানে একটা গাছও নেই যে, ধরে ফেলব। গড়াতে-গড়াতে পড়তে লাগলাম নদীর দিকে। নদীর বুকে বড়বড় পাথরের চাঁই আর অসম্ভব স্রোত। একটু পরেই নদীটা জলপ্রপাত হয়ে নেমে গেছে!
একটু থেমে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কামাল বললেন, নদীতে পড়ার আগেই। একটা পাথরে মাথা ঠকে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম! তারপর আর কেউ বাঁচে? ওইরকম অবস্থায় কাছে যদি নিজের মায়ের পেটের ভাইও থাকত, সে কী করত? চিৎকার করত, কাঁদত, দৌড়োদৌড়ি করত, আর তো কিছু করার ছিল না। আমাকে বাঁচাবার জন্য ওই পাহাড়ের ওপর থেকে লাফ দিলে একেবারে নিঘাত মৃত্যু!
কাকাবাবু বললেন, হুঁ! মায়ের পেটের ভাই থাকলে কী করত, তুমি কী করে জানলে? সব মায়ের পেটের ভাই একরকম হয় না। কেউ ভিতু, কাপুরুষ হয়, কেউ আবার ভাইয়ের জন্য প্রাণও দেয়।
জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি লাফালেন? কী করে বেঁচে গেলেন?
কাকাবাবু বললেন, আমি তো চিন্তা করার বিশেষ সময় পাইনি। নদীর জলে পড়ার পর কামাল যেভাবে ওলটপালট খাচ্ছিল, তা দেখেই বুঝেছিলাম ওর জ্ঞান নেই। যদি জলপ্রপাতে গিয়ে পড়ে, তা হলে টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে, আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না। আমি জয় মা বলে ঝাঁপ দিলাম। ওপর থেকে জলে ডাইভ দেওয়ার সময় লোকে সাধারণত হাত দুটো সামনে রেখে, মাথা নিচু করে লাফায়। সেই অবস্থাতেও আমার মনে হল, মাথা যদি নীচের দিকে থাকে, আর নদীতে গিয়ে কোনও পাথরে আঘাত লাগে, তা হলে মাথাটা একেবারে ছাতু হয়ে যাবে। তাই আমি দাঁড়ানো অবস্থায় লাফ দিলাম সোজাসুজি। ঠিক পাথরের ওপরে গিয়েই পড়লাম, আর আমার একটা পায়ের গোড়ালির হাড়টা মট করে ভেঙে গেল।
কামাল বললেন, সেই অবস্থাতেও দাদা আমাকে জাপটে ধরে পাড়ে টেনে তুললেন।
সন্তু চোখ বুজে ফেলে বলল, ইস, সাঙ্ঘাতিক লেগেছিল নিশ্চয়ই। সেই ব্যথা নিয়েও..
কামাল বললেন, ব্যথা তো লাগবেই। দাদার পায়ের তলায় পাথরটা ভেঙে গেঁথে আছে। হুহু করে রক্ত বেরোচ্ছে। তবু দাদা মুখে একটাও শব্দ করেননি। দাঁতে দাঁত চেপে ছিলেন।
জোজো বলল, আর সেই মুকুটটা কোথায় গেল?
কামাল বললেন, সেটা তো রয়ে গেছে ওপরে। আমাদের ঘোড়া দুটো, সব। জিনিসপত্তরই তো পাহাড়ের ওপরে। দাদার হাঁটার কোনও ক্ষমতাই নেই।
আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে বটে, মাথা দিয়ে তখনও রক্ত বেরুচ্ছে, শরীর ঝিমঝিম করছে। দাদাকে কাঁধে নিয়ে পাহাড়ে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দুজনে তখনও প্রাণে বাঁচব কি না তার ঠিক নেই। জিনিসপত্র উদ্ধারের আশাও রইল না।
জোজো বলল, যাঃ, মুকুটটা আবার চলে গেল?
কামাল বলল, না, যায়নি। ভাগ্য শেষপর্যন্ত সুপ্রসন্ন হল। একটু পরেই আমরা পাহাড়ের ওপরে কিছু লোকজন আর ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। একবার ভাবলাম, তারা যদি অন্য ডাকাতদল হয়, তা হলে সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যাবে। প্রাণে বাঁচার জন্য আমাদের চুপচাপ লুকিয়ে থাকাই ভাল। আবার ভাবলাম, এখানে পড়ে থাকলে শেষপর্যন্ত কে আমাদের উদ্ধার করবে? ওপরের ওরা কোনও বণিকের দলও তো হতে পারে? নদীর স্রোতের এমন আওয়াজ যে, আমরা চিৎকার করলেও ওরা শুনতে পাবে না। দাদার কোমরে রিভলভারটা ঠিক ছিল, ওটা নিয়ে শূন্যে দুবার গুলি করলেন। তাই শুনে সেই দলটা ঘোরা পথে নেমে এল নদীর কাছে।
কাকাবাবু বললেন, সেই দলের প্রথমেই কাকে দেখতে পাওয়া গেল বল তো সন্তু?
সন্তু বলল, নরেন্দ্র ভার্মা!
কামাল বললেন, ঠিক বলেছ, নরেন্দ্র ভার্মা আবার কাবুলে এসে জাভেদ দুরানির ডাকাতের দলের কথা শুনেই ভেবেছিলেন, আমরা বিপদে পড়ে যেতে পারি। আফগান সরকারের সাহায্য নিয়ে দশজন সৈনিক ও একজন কর্নেলের সঙ্গে এসেছিলেন আমাদের উদ্ধার করতে। ওঁরা অবশ্য অবোধরামের কথা জানতেন না। অবোধরাম আর তার সঙ্গীকেও ধরে নিয়ে এলেন কাবুলে। অবোধরাম এর আগে দিল্লিতে দুটো খুন করে পালিয়ে আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। দিল্লিতে এনে তাকে জেলে ভরে দেওয়া হল চোদ্দ বছরের জন্য।
কাকাবাবু বললেন, আমরা সম্রাট কনিষ্কের সেই মুকুট কাবুলের জাদুঘরে জমা দিলাম। এখনও যে-কেউ গিয়ে দেখতে পারে। অনেক কাগজে-টাগজে ছবি ছাপা হল। ঐতিহাসিকদের মধ্যে একটা হইচই পড়ে গেল।
অংশু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবুর পায়ের চিকিৎসা হল কোথায়?
কাকাবাবু বললেন, সেসব আর শোনার দরকার নেই। আমার পা তো ঠিকই আছে। ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে কোনও অসুবিধা হয় না। শুধু দৌড়তে পারি না, এই যা। ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে, এবার ওঠো!