৯ম অধ্যায়
অশ্বত্থামাদির দুৰ্য্যোধন সমীপে গমন—বিলাপ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে সেই তিন মহারথ দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র ও পাঞ্চালগণকে বিনাশ করিয়া রণনিপতিত রাজা দুর্যোধনের নিকট আগমন ও রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক দেখিলেন, কুরুরাজ বিচেতনপ্রায় হইয়া অনবরত রুধির বমন করিতেছেন এবং তাঁহার জীবন অতি অল্পমাত্র অবশিষ্ট আছে। বৃক প্রভৃতি ঘোরদর্শন শাপদগণ তাঁহাকে ভক্ষণ করিবার অভিলাষে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে। তিনি গাঢ়তর বেদনায় নিতান্ত কাতর ও ভূতলে বিলুণ্ঠিত হইয়া অতি কষ্টে উহাদিগকে নিবারণ করিতেছেন। তদ্দর্শনে সেই হতাবশিষ্ট বীরত্রয় নিতান্ত শোকাকুল হইয়া ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিলেন। কুরুরাজ সেই রুধিরোক্ষিত তিন মহারথ কর্ত্তৃক পরিবেষ্টিত হইয়া হুতাশনত্রয়-পরিশোভিত যজ্ঞবেদীর ন্যায় অপূর্ব্ব শোভা প্রাপ্ত হইলেন।
অনন্তর সেই বীরত্রয় কুরুরাজকে ধরাশয্যায় শয়ান দেখিয়া দুর্বিষহ দুঃখে অনর্গল অশ্রুবিসৰ্জন করিতে লাগিলেন এবং হস্ত দ্বারা দুৰ্য্যোধনের মুখমণ্ডল হইতে রুধিরধারা মোচন করিয়া বিলাপ ও পরিতাপপূর্ব্বক কহিলেন, হায়! দৈবের অসাধ্য কিছুই নাই। কুরুরাজ দুৰ্য্যোধন একাদশ অক্ষৌহিণীর অধিপতি ছিলেন, এক্ষণে উনি নিহত হইয়া রুধিরলিপ্ত-কলেবরে ধরাতলে শয়ন করিয়া আছেন। এই গদাপ্রিয় মহাবীর সমীপে সুবর্ণজালজড়িত ভীষণ গদা নিপতিত রহিয়াছে। ইনি কোন যুদ্ধেই গদা পরিত্যাগ করেন নাই। এক্ষণে প্রিয়তমা ভাৰ্য্যা যেমন হলে নিদ্রিত ভর্ত্তার সহিত একত্র অবস্থান করে, তদ্রূপ এই গদা কুরুরাজের সহিত অবস্থান করিতেছে। উহা এই স্বর্গারোহণকালেও ইঁহাকে পরিত্যাগ করিতেছে না। হায়! কালের কি বিচিত্র গতি! যিনি সমস্ত ভূপালগণের শ্রেষ্ঠ, আজ তিনি সমরে নিপতিত হইয়া রজোরাশি গ্রাস করিতেছেন। যিনি বহুসংখ্যক শত্রুকে নিহত করিয়া ভূতলশায়ী করিয়াছিলেন, আজ তিনি বিপক্ষের বলবীর্য্যে বিনষ্ট হইয়া সমরাঙ্গনে শয়ন করিয়াছেন। অসংখ্য ভূপতি ভীতমনে যাঁহার চরণে প্রণত হইতেন, আজ তিনি সমরশায়ী হইয়া শৃগাল-কুক্কুরে পরিবৃত রহিয়াছেন। পূর্বে ব্রাহ্মণগণ অর্থের নিমিত্ত যাঁহার নিকট সতত প্রার্থনা করিতেন, আজ মাংসাশী জন্তুগণ মাংসলভার্থে সেই মহাবীরের উপাসনা করিতেছে।
অনন্তর মহারথ অশ্বত্থামা কুরুরাজকে সম্বোধনপূর্ব্বক অতি করুণস্বরে বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া কহিলেন, মহারাজ! লোকে আপনাকে ধনুর্দ্ধরাগ্রগণ্য বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকে। তুমি হলধারী বলদেবের প্রিয়শিষ্য ও যুদ্ধে ধনাধিপতি কুবেরের অনুরূপ। দুরাত্মা ভীম রণস্থলে কিরূপে তোমার রন্ধ্র প্রাপ্ত হইল। কালকে অতিক্রম করা নিতান্ত সুকঠিন। ভীম তোমাকে সংহার করিয়াছে, ইহাও আমাদিগকে দেখিতে হইল! সেই পাপাত্মা মুখ ছল প্রকাশপূর্ব্বক তোমার বিনাশে কৃতকাৰ্য্য হইয়াছে। ঐ দুরাচার ধর্ম্মযুদ্ধে তোমাকে আহ্বান করিয়া অধর্ম্মানুসারে গদাঘাতে তোমার উরুদ্বয় ভগ্ন করিয়াছে। সে যখন তোমাকে অধর্ম্মযুদ্ধে নিপাতিত করিয়া তোমার মস্তকে পদাঘাত করে, তৎকালে কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠির তাহার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছিল; অতএব তাহাদিগকেও ধিক্! যত দিন এই জীবলোক বিদ্যমান থাকিবে, ততদিন বৃকোদর যে শঠতাচরণপূর্ব্বক তোমার সংহার করিয়াছে, সকলেই তাহার এই অপযশ ঘোষণা করিবে, সন্দেহ নাই। মহাবল বলদেব সর্ব্বদা সভামধ্যে শ্লাঘা করিয়া থাকেন যে, ‘কুরুরাজ দুৰ্য্যোধন আমার নিকট গদাযুদ্ধ শিক্ষা করিয়াছেন, তাহা অপেক্ষা গদাযুদ্ধে আর কেহই উৎকৃষ্ট নাই।’
হে মহারাজ! মহর্ষিগণ ক্ষত্রিয়দের যাহা প্রশস্ত গতি বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন, তুমি সমরে অপরাঙ্মুখ ও নিহত হইয়া সেই গতি লাভ করিলে। অতএব তোমার নিমিত্ত, আমার কিছুমাত্র অনুতাপ হইতেছে না। কেবল তোমার বৃদ্ধ জনক-জননী দারুণ পুত্রশোক প্রাপ্ত হইলেন বলিয়া আমি তাঁহাদিগের নিমিত্তই সন্তপ্ত হইতেছি। তাহারা অতঃপর ভিক্ষুক হইয়া শোকাকুলিতচিত্তে পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করিবেন, সন্দেহ নাই। যদুকুলোদ্ভব কৃষ্ণ ও দুর্ম্মতি অৰ্জ্জুনকে ধিক্! উহারা আপনাদিগকে ধাৰ্মিক বলিয়া অভিমান করে; কিন্তু তোমাকে অধর্ম্ম-যুদ্ধে নিহত দেখিয়াও অনায়াসে উপেক্ষা প্রদর্শন করিল। অন্যান্য ভূপালগণ “দুৰ্য্যোধন কিরূপে নিহত হইয়াছে,” এই কথা জিজ্ঞাসা করিলে নির্লজ্জ পাণ্ডবগণ কি প্রত্যুত্তর প্রদান করিবে? হে কুরুরাজ! তুমি সমরে পরাঙ্মুখ না হইয়া যে ধর্ম্ম-যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিলে, এই নিমিত্ত তোমাকে অগণ্য ধন্যবাদ প্রদান করিতেছি। এক্ষণে বন্ধুবান্ধববিহীনা হতপুত্রা গান্ধারী ও প্রজ্ঞাচক্ষু অন্ধরাজের কি গতি হইবে? ভোজরাজ কৃতবর্ম্মাকে, মহারথ কৃপাচাৰ্য্যকে-ও আমাকে ধিক্! আমরা প্রজারক্ষক সর্ব্বকামপ্রদ ভূপতিকে অগ্রসর করিয়া স্বর্গারোহণ করিতে পারিলাম না। পূর্বে আমরা মহাবীর কৃপাচার্য্যের, আপনার ও আমার পিতার বীর্য্যপ্রভাবে বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে রত্নময় বিবিধ গৃহে অবস্থান ও ভূরিদক্ষিণ প্রভূত যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছি; আমরা কাহার শরণাপন্ন হইব? আপনি সমুদয় ভূপতিকে অগ্রসর করিয়া পরলোকে যাত্রা করিলেন, কেবল আমরা তিনজন আপনার অনুগমন করিতে পারিলাম না, এই নিমিত্তই নিতান্ত তাপিত হইতেছি। এক্ষণে আমাদিগকে স্বর্গহীন ও অর্থহীন হইয়া চিরকাল আপনার সুকৃত স্মরণ করিতে হইবে। আমরা জীবিত থাকিয়া আপনার কি হিতানুষ্ঠান করিব? এক্ষণে আপনি এই আশ্রিতগণকে পরিত্যাগ করাতে ইহাদের সুখ শান্তি একেবারেই উচ্ছিন্ন হইল। অতঃপর এই হতভাগ্যদিগকে অতিকষ্টে ভূমণ্ডলে পর্যটন করিতে হইবে। হে মহারাজ! আপনি স্বর্গারোহণপূর্ব্বক আমার বচনানুসারে মহারথগণকে যথোপযুক্ত পূজা করিয়া সর্বাগ্রে আমার পিতা ধনুর্দ্ধরাগ্রগণ্য আচাৰ্য্যকে কহিবেন যে, আজ অশ্বত্থামা দুরাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিপাতিত করিয়াছে। পিতাকে এই কথা বলিয়া মহারথ বাহ্লীক, সিন্ধুরাজ, সোমদত্ত, ভূরিশ্রবা ও অন্যান্য ভূপালগণকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক তাঁহাদের কুশল জিজ্ঞাসা করিবেন।
ধৃষ্টদ্যুম্নদিবধে দুর্য্যোধনের দুঃখাবসান
হে মহারাজ! মহাবীর অশ্বত্থামা ভগ্নোরু বিচেতন দুৰ্য্যোধনকে এই কথা কহিয়া পুনরায় তাঁহাকে নিরীক্ষণপূর্ব্বক কহিলেন, “কুরুরাজ! যদি জীবিত থাকেন, তবে এই শ্রুতিসুখকর বাক্য শ্রবণ করুন। এক্ষণে পাণ্ডবপক্ষে পঞ্চপাণ্ডব, বাসুদেব ও সাত্যকি এই সাতজন এবং আমাদের পক্ষে আমরা তিনজন, সমুদয়ে উভয় পক্ষে আমরা দশজন মাত্র জীবিত রহিয়াছি। দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্নের পুত্ৰসমুদয়, পাঞ্চালগণ ও অবশিষ্ট মৎস্যগণ আমার হস্তে নিহত হইয়াছে। আমি এই রাত্রিযোগে শিবিরে প্রবেশপূর্ব্বক পাপাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্নকে পশুর ন্যায় সংহার ও পাণ্ডবগণের সমুদয় বাহন, সৈন্য ও পুত্রগণকে বিনাশপূর্ব্বক বৈরনির্য্যাতন করিয়াছি।
হে মহারাজ! কুরুরাজ দুৰ্য্যোধন দ্রোণপুত্রের মুখে সেই প্রীতিকর সমাচার-শ্রবণে সংজ্ঞালাভ করিয়া কহিলেন, “হে বীর। মহাবাহু ভীষ্মদেব, কর্ণ ও তোমার পিতা দ্রোণাচার্য্য যে কাৰ্য্যসংসাধনে অসমর্থ হইয়াছিলেন, তুমি কৃতবর্ম্মা ও কৃপাচার্য্যের সহিত মিলিত হইয়া তাহা সম্পাদন করিয়াছ! নীচাশয় পাণ্ডবসেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডীর সহিত নিহত হইয়াছে শ্রবণ করিয়া আজ আমি আপনাকে ইন্দ্রতুল্য জ্ঞান করিতেছি; এক্ষণে তোমাদিগের মঙ্গল হউক; পুনরায় স্বর্গে আমার সহিত মিলন হইবে’, কুরুরাজ এই কথা বলিয়া বীরত্রয়কে আলিঙ্গনপূর্ব্বক প্রাণ পরিত্যাগ করিয়া, বন্ধুবিয়োগদুঃখ বিস্মৃত হইয়া স্বর্গে সমারূঢ় হইলেন; তাঁহার দেহমাত্র ভূতলে নিপতিত রহিল। হে মহারাজ! এইরূপে কুরুপতি মহাবীর দুর্য্যোধন সমরে ঘোরতর পরাক্রম প্রকাশপূর্ব্বক শক্তহস্তে কলেবর পরিত্যাগ করিলেন। অনন্তর সেই বীরত্ৰয় কুরুরাজকে আলিঙ্গন ও সস্নেহনয়নে বারংবার নিরীক্ষণ করিয়া স্ব স্ব রথে আরোহণপূর্ব্বক শোকসন্তপ্তচিত্তে সেই প্রত্যুষসময়ে নগরাভিমুখে ধাবমান হইলেন। মহারাজ! আপনার কুমন্ত্রণাই এই কুরুপাণ্ডব-সৈন্যক্ষয়ের মূলীভূত কারণ। আজ আপনার পুত্র স্বর্গারোহণ করিলে আমার ঋষিপ্রদত্ত দিব্যদশিত্ব [দিব্যদৃষ্টি—দিব্য চক্ষে সমস্ত দর্শনের শক্তি] বিনষ্ট হইয়াছে।”
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা ধৃতরাষ্ট্র এইরূপে প্রিয়পুত্র দুর্য্যোধনের নিধনবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক নিতান্ত চিন্তাকুল হইলেন।