অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথে ঠান্ডা পড়ে গেল। আমাদেরকে একটা খাঁচার ভেতরে ভরে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখেছে, সেখানে কনকনে ঠান্ডা বাতাসে আমি আর টিশা শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি। গত কয়েক ঘণ্টায় এত কিছু ঘটে গেছে যে আমাদের ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা মনেই থাকার কথা ছিল না কিন্তু কী কারণ কে জানে আমাদের ভয়ানক খিদে পেয়েছে। কেউ আমাদের মনে করে কোনো খাবার দেবে কি না বুঝতে পারছিলাম না। উপায় না দেখে নিচে দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা দস্যুকে ডেকে তাকে খাবারের কথা বলার চেষ্টা করলাম। দস্যুটা নিচে দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনল, তারপর রাস্তা থেকে একটা পাথর তুলে আমাদের দিকে ছুঁড়ে মারল, খাঁচার শিকে লেগে পাথরটা ভেঙে টুকরো টুকরো না হয়ে গেলে আমাদের কপালে দুঃখ ছিল।
আমরা তখন আর কাউকে কিছু বলার সাহস পেলাম না। খাঁচার ভেতরে শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে গুটিশুটি মেরে একজন আরেকজনকে ধরে একটু উষ্ণ হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বসে রইলাম। রাত একটু গম্ভীর হওয়ার পর আকাশে একটা বড় চাঁদ উঠল। একসময় চাঁদ দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিতাম, এখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। চাঁদ কেন ওঠে, কেন বড় হয় ছোট হয়, কেন চন্দ্রগ্রহণ হয়, কেন চাঁদের একটি পৃষ্ঠই আমরা দেখি অন্যটা কেন দেখি না, এই সবকিছু কিছু বই পড়ে শিখেছি। এখন চাঁদ দেখতে ভালো লাগে। চাঁদের নরম আলোতে নিচে দস্যুদলের কনভয়টাকেও অন্য রকম দেখাচ্ছিল, কেন জানি মোটেও ভয়ংকর মনে হচ্ছিল না।
আমি টিশাকে ডাকলাম, “টিশা।”
“বলো।”
“কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখেছ?”
“দেখেছি।”
“একটা গান গাইবে?”
ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, আতঙ্কিত, শীতার্ত অবস্থায় একটা খাঁচায় আটকা থেকে শূন্যে ঝুলতে ঝুলতে কেউ কখনো গান গাইবার কথা চিন্তা করে না। এটা বড়জোর একটা উৎকট রসিকতা হতে পারে। আমার কথা শুনে টিশা আমার নাকের উপর একটা ঘুষি মেরে বসলেও আমি অবাক হতাম না। কিন্তু টিশা আমার নাকে ঘুষি মারল না, জোছনার আলোতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সত্যি সত্যি খুবই মৃদু স্বরে গান গাইতে লাগল। একজন মহাকাশচারী তার প্রেমিকাকে পৃথিবীতে রেখে চাঁদের দিকে উড়ে যাচ্ছে, প্রেমিকা সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে জোছনার আলোকে বলছে তার প্রেমিকার কাছে একটা খবর পৌঁছে দিতে। খুবই করুণ একটা গান, টিশার গলায় সেটা আরো করুণ শোনাতে লাগল।
আমাদের খাঁচার নিচ দিয়ে একজন দস্যু যাচ্ছিল, গান শুনে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, টিশা ভয় পেয়ে সাথে সাথে গান বন্ধ করে দিল।
নিচ থেকে দস্যুটি বলল, “কী হলো? থামলে কেন? গাও।” একজন মেয়ের কণ্ঠস্বর।
টিশা বলল, “গাইব?”
“হ্যাঁ। গাও। তোমার কণ্ঠস্বরে কম্পনের সুষম অবস্থান খুব ভালো।”
টিশা তখন আবার গাইতে শুরু করল। দস্যু মেয়েটি খাঁচার নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গানটি শুনল। তারপর একটা গাড়িতে হেলান দিয়ে বসে বলল, “এই মেয়ে, আরেকটা গান গাও।”
টিশা তখন আরেকটা গান শুরু করল, দস্যু মেয়েটি সেই গানটিও শুনল, কনকনে ঠান্ডা বাতাসে টিশা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিল, দস্যু মেয়েটি সেটাও লক্ষ করল। গান শেষ হবার পর জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কি খেয়েছ?”
টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “না।”
দস্যু মেয়েটি বলল, “তোমরা দাঁড়াও, আমি তোমাদের জন্য একটু খাবার, পানীয় আর দুটো গরম পোশাক নিয়ে আসি।”
কিছুক্ষণ পর দস্যু মেয়েটি সত্যি সত্যি আমাদের জন্যে শুকনো খাবারের প্যাকেট, পানীয়ের বোতল আর দুটো গরম পোশাক নিয়ে এল। আমাদের খাঁচাটা নিচে নামিয়ে সে শিকের ফাঁক দিয়ে খাবারের প্যাকেট, পানীয়ের বোতল আর গরম পোশাক দুটো ঢুকিয়ে দিল। আমরা উষ্ণতার ডায়ালে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ঠিক করে তাড়াতাড়ি পোশাক দুটো পরে নিলাম। খাবারের প্যাকেটটা খুলতে খুলতে আমি বললাম, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”
“তোমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল নেই, এই খাবার তোমাদের কাছে খুব বিস্বাদ মনে হবে।”
টিশা জিজ্ঞেস করল, “তোমরা খাবার সময় ক্রেনিয়াল দিয়ে মস্তিষ্কে খাবারের স্বাদের অনুভূতি তৈরি করে নাও?”
দস্যু মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আমাদের জীবন খুব আনন্দের, আমরা ক্রেনিয়াল দিয়ে যখন ইচ্ছা তখন মস্তিষ্কে আনন্দের অনুভূতি তৈরি করতে পারি।”
টিশা বলল, “তুমি ইচ্ছে করলেই তোমার ক্রেনিয়াল দিয়ে তোমার মস্তিষ্কে অপূর্ব একটা সঙ্গীতের অনুভূতি তৈরি করে নিতে পারতে। সেটা না করে তুমি কেন আমার গলায় গান শুনতে চাইলে?”
দস্যু মেয়েটি একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি জানি না। মনে হয় আমার স্মৃতিতে এরকম একটা মধুর স্মৃতি ছিল। মায়ী মায়ীর দলে যোগ দেবার পর সব পুরোনো স্মৃতি মুছে দিয়ে দস্যু হওয়ার স্মৃতি ঢোকানো হয়েছে, তারপরেও মনে হয় মস্তিষ্কের কোথাও এই ধরনের কিছু স্মৃতি লুকিয়ে আছে।”
টিশা বলল, “তুমি মোটেও অন্য দস্যুদের মতো নও।”
“আমার ক্রেনিয়াল দিয়ে সিস্টেম পাঁচ ডাউনলোড করেছে। সিস্টেম সাত ডাউনলোড করলে আমি অন্য দস্যুদের মতো হয়ে যাব।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি অন্য দস্যুদের মতো হতে চাও।”
দস্যু মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “হ্যাঁ। হতে চাই। সিস্টেম পাঁচ দিয়ে আনন্দের তীব্রতা বেশি করা যায় না। সিস্টেম সাত আট নয় দিয়ে আনন্দের তীব্রতা অনেক বেশি। মায়ী মায়ীর সিস্টেম হচ্ছে সতের। আমাদের আর কারো সতের নেই।”
টিশা জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেমন করে দস্যুদলে যোগ দিয়েছ?”
দস্যু মেয়েটি বলল, “আমার মস্তিষ্ক থেকে সেই স্মৃতি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি কোথা থেকে এসেছি আমি জানি না।” মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “তোমাদের মাথায় যদি ক্রেনিয়াল থাকত তাহলে তোমাদের স্মৃতিও মুছে দেওয়া হতো। এতক্ষণে তোমরাও দস্যু হয়ে যেতে।”
ঠিক কী জন্য জানি না আমি কেমন জানি শিউরে উঠলাম। মেয়েটা বলল, “তোমরা খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো। কাল সকালে তোমাদের নিশ্চয়ই অনেক ধকল সহ্য করতে হবে। ক্রেনিয়াল থাকলে কোনো সমস্যা হতো না।”
মেয়েটি যখন আমাদের খাঁচাটি উপরে তুলছে তখন টিশা জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”
“আমার নাম প্রিমা তিন। প্রিমা এক আর দুই আগে এসেছে, তাদের সিস্টেম এগারো।”
টিশা বলল, “প্রিমা তিন, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।” মেয়েটি বলল, “আমি যখন তোমার গান শুনছিলাম তখন খুব আশ্চর্য একটা ব্যাপার ঘটেছে। হঠাৎ করে আমার আগের নামটি মনে পড়েছে।”
“তোমার আগের নাম কী?”
“আমার আগের নাম রিয়ানা।”
টিশা বলল, “রিয়ানা খুব সুন্দর নাম।”
মেয়েটি খাঁচাটাকে উপরে তুলতে তুলতে বলল, “আমার মাথায় যখন আবার নতুন করে সিস্টেম ডাউনলোড করবে তখন আমি রিয়ানা নামটা ভুলে যাব। এই নামটির এখন আর কোনো গুরুত্ব নেই।”
আমি আর টিশা ছোট খাঁচাটার ভেতর বসে দেখলাম প্রিমা তিন নামের দস্যু মেয়েটি জোছনার আলোতে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখে কেমন যেন দুঃখী একটা মেয়ে মনে হতে থাকে।
.
ছোট একটা খাঁচার ভেতরে হাত-পা ছড়িয়ে বসা যায় না, কাজেই ঘুমানোর কোনো প্রশ্নই আসে না, কিন্তু শেষ রাতের দিকে আমরা দুজনেই ঘুমিয়ে গেলাম। আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বিচিত্র দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম, খাড়া পাহাড়ের উপর দিয়ে দৌড়াচ্ছি। দুই পাশে খাড়া খাদ, একটু তাল হারালেই সেই খাদে পড়ব। কিছু বুনো পশু তাড়া করছে, আমি থামতে পারছি না। হঠাৎ একটা পশু আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং আমি পা পিছলে খাদের মাঝে পড়ে যাচ্ছি। আমি চমকে উঠে জেগে উঠলাম। দেখলাম দুজন দস্যু আমাদের খাঁচাটি নিচে নামাচ্ছে। টিশা মনে হয় এতটুকু ঘুমাতে পারেনি, চোখের নিচে কালি, চেহারায় এক ধরনের উদভ্রান্ত দিশেহারা ছাপ।
দস্যু দুজন খাঁচা খুলে আমাদের বের করে সামনের দিকে ধাক্কা দেয়। আমি পড়ে যেতে যেতে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিলাম। টিশা আর আমি পাশাপাশি গা ঘেঁষে হেঁটে যেতে থাকি, সামনে একটা বড় ট্রেইলার, তার দরজা খুলে আমাদের দুজনকে ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। ট্রেইলারের ভেতরে একটা টেবিলের পিছনে মায়ী মায়ী বসে আছে, টেবিলের উপর অনেকগুলো ঘোট টিউব। মায়ী মায়ী একটা টিউব বেছে নিয়ে হাত দিয়ে তার মাথার পেছনে ক্রেনিয়ালে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। সাথে সাথে তার শরীর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে, কয়েক মুহূর্ত সে চোখ বন্ধ করে রাখে তারপর জিব দিয়ে তৃপ্তির মতো একটা শব্দ করে আমাদের দুজনের দিকে তাকাল। আমি দেখলাম তার সবুজ চোখ দুটো আস্তে আস্তে প্রথমে হলুদ, গোলাপি হয়ে টকটকে লাল হয়ে উঠল। হঠাৎ করে তাকে মানুষ মনে না হয়ে রাক্ষুসি মনে হতে থাকে।
মায়ী মায়ী বলল, “আয়, কাছে আয়।”
আমি আর টিশা ভয়ে ভয়ে কাছে এগিয়ে গেলাম। মায়ী মায়ী হিস হিস করে বলল, “চিকি চিকি চিংড়া! তোদের মাথায় কেরেনিয়াল নাই কেন?”
টিশা বলল, “আমাদের মাথায় লাগায়নি।”
মায়ী মায়ী ধমক দিয়ে উঠল “কেন লাগায় নাই? কে লাগায় নাই?”
“আমাদের শহরে ষোল বছর হলে ক্রেনিয়াল লাগায়। আমাদের বয়স এখনো ষোল হয়নি।”
মায়ী মায়ী দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “যার মগজে কেরেনিয়াল নাই তার সাথে একটা জানোয়ারের কোনো পার্থক্য আছে? নাই? একটা জানোয়ার কিছু জানে? কিছু বুঝে? তোরা কিছু জানিস? বুঝিস? তোরা জানোয়ার! কিরি কিরি কিরি কিরি…”
মায়ী মায়ীর শরীরে কেমন যেন খিচুনির মতো হতে থাকে। কিছুক্ষণ পর খিচুনিটা থেমে যায়, চোখের রং লাল থেকে হলুদ হয়ে আবার সবুজ হয়ে যায়। সবুজ রঙের চোখ দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর লোল টানার মতো একটা শব্দ করে বলল, “তোদের দিয়ে আমি কী করব? তোরা একটা মাংসের দলা ছাড়া আর কিছু না! তোরা জানিস দুই আর দুই যোগ করলে কত হয়?”
আমরা মাথা নাড়লাম। মায়ী মায়ী বলল, “দিন কেমন করে রাত হয় জানিস? রাত কেমন করে দিন হয় জানিস? ইলেকট্রিসিটি কেমন করে হয় জানিস? অস্ত্র কেমন করে গুলি করে জানিস? বোমা কেমন করে ফাটে জানিস? মগজের ভেতরে কী আছে জানিস? বুকের ভেতর কী আছে জানিস? কেরেনিয়াল কেমন করে কাজ করে জানিস?”
আমরা উত্তর দেবার আগেই মায়ী মায়ী টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “কিছু জানিস না! কিছু জানিস না। চিকি চিকি চিকি চিকি…”
প্রচণ্ড রাগে তার শরীর কাঁপতে থাকে। মায়ী মায়ী আমাদের কাছে যে বিষয়গুলো জানতে চেয়েছে আমরা তার প্রত্যেকটা জানি, বই পড়ে শিখেছি কিন্তু আমরা সেটা বলার চেষ্টা করলাম না। কারণটা ব্যাখ্যা করতে পারব না কিন্তু আমার মনে হতে থাকে এই দস্যুদলের যদি ধারণা হয় আমরা কিছু জানি না, বুঝি না–পুরোপুরি অপদার্থ দুজন মানুষ তাহলে সেটাই আমাদের জন্য নিরাপদ।
মায়ী মায়ী হঠাৎ করে নিজের গলার কাছে কোথায় একটা চাপ দিল, তারপরে খনখনে গলায় বলল, “সিস্টিম পনের কোনখানে? মাজাভাঙা কানা লুলা সিস্টিম পনের আমার খাঁচার মাঝে আয়।”
এতক্ষণ আমাদের সাথে যে কথাগুলো বলছিল সেটা আমরা দুজন ছাড়া কেউ শোনেনি কিন্তু এই কথাগুলো সারা কনভয়ের সবাই শুনতে পেল। সিস্টেম পনের কথাটার অর্থ বুঝতে পারলাম, যাদের মাথায় সিস্টেম পনের ঢোকানো হয়েছে তাদেরকে সে ডাকছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই তিনজন মানুষ এসে হাজির হলো। একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা, বাকি মানুষটি পুরুষ না মহিলা বোঝা গেল না। মানুষগুলো ট্রেইলারে ঢুকে মায়ী মায়ীর পাশে এসে দাঁড়াল। মহিলা সিস্টেম পনের জিজ্ঞেস করল, “কোনো সমস্যা মায়ী মায়ী?”
মায়ী মায়ী প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাথার পেছনে হাত দিয়ে তার ক্রেনিয়াল থেকে টিউবটা বের করে, টেবিলের উপর থেকে আরেকটা টিউব নিয়ে সেটা ক্রেনিয়ালে ঢুকিয়ে দিল। সাথে সাথে তার চোখগুলো কেমন যেন ঘোলা হয়ে যায় এবং তার সারা শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। সিস্টেম পনের ললাড করা মানুষগুলো মায়ী মায়ীর এই অবস্থা দেখে মোটেও বিচলিত হলো না–মনে হলো তারা এরকম দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত। মায়ী মায়ী একটু পরেই শান্ত হয়ে চোখ খুলে তাকাল, চোখের রং এখন টকটকে লাল।
যে মানুষটিকে দেখে পুরুষ না মহিলা বোঝা যায় না, সে জিজ্ঞেস করল, “মায়ী মায়ী, কোনো সমস্যা?”
মায়ী মায়ী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “না, কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলে এই মায়ী মায়ী নিজেই সেটা সমাধান করতে পারে। পারে না?”
সিস্টেম পনের লোড করা তিনজন মাথা নাড়ল, বলল, “পারে। মায়ী মায়ী পারে।”
মায়ী মায়ী বলল, “আমি তোদের ডেকেছি একটা পরমার্শ করার জন্য।” মায়ী মায়ী তখন আঙুল দিয়ে আমাদের দুজনকে দেখিয়ে বলল, “এই দুইটার মাথায় কেরেনিয়াল নাই–তার মানে এরা কিছু জানে না কিছু বুঝে না! এদের বয়স যতই হোক বুদ্ধিশুদ্ধি চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা থেকে বেশি হবে না। হবে?”
মানুষ তিনজন মাথা নাড়ল, পুরুষটা বলল, “যদি ক্রেনিয়াল না লাগায় তাহলে কেমন করে বুদ্ধিশুদ্ধি লোড করবে?”
মায়ী মায়ী বলল, “এখন এই দুইটাকে কী করি। এদের আমার দলে থাকা মানেই তো যন্ত্রণা? আমি কী ভাবছিলাম জানিস?”
“কী মায়ী মায়ী?”
“এদের বয়স তো কম–এদের কেটে হৃৎপিণ্ড ফুসফুস কলিজা কিডনি বের করে নিই। আমার শরীরে আরেকটা হৃৎপিণ্ড থাকলে ভালো না?”
আমার বুকটা ধক করে ওঠে! কী সর্বনাশ! মায়ী মায়ীর পরামর্শটা মানুষগুলোর খুব পছন্দ হলো, তারা জোরে জোরে মাথা নাড়তে থাকে। পুরুষ মানুষটা বলল, “খুবই ভালো বুদ্ধি মায়ী মায়ী।”
মহিলাটা বলল, “একটা সমস্যা কিন্তু আছে।”
মায়ী মায়ী ধমক দিয়ে বলল, “কী সমস্যা?”
“অপারেশনের পরে তোমাকে কমপক্ষে দুইদিন শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। তখন যদি সিস্টেম ষোল তোমাকে কিছু করে?”
মায়ী মায়ী চিৎকার করে বলল, “কী বললি তুই? সিস্টেম ষোল আমার সাথে বেঈমানি করবে? এত বড় সাহস?”
অন্য দুজন জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না না, করবে –কিন্তু কিছু বলা যায় না। তা ছাড়া এখন কি তোমার টানা দুইদিন বিশ্রাম নেবার সময় আছে?”
মায়ী মায়ী কী একটা চিন্তা করে মাথা নেড়ে বলল, “নাই।”
তার শরীরে আবার খিচুনি হতে থাকে এবং খিচুনি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সবাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে।
পুরুষ কিংবা মহিলা বোঝা যায় না মানুষটি বলল, “আরো একটা সমস্যা আছে।”
“কী সমস্যা?”
“সার্জারি করার ক্যাপসুলে মনে হয় সমস্যা আছে।”
“কেন?”
“গত সপ্তাহে সার্জারি করার সময় একটা মারা গেল মনে নাই?”
অন্য দুজন তখন মাথা নাড়ল। বলল, “সার্জারি করার নতুন ক্যাপসুল না আনা পর্যন্ত সার্জারি করা ঠিক হবে না।”
মায়ী মায়ী বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু তাহলে এই দুইটাকে কী করব?”
পুরুষটা বলল, “কেটে হৃৎপিণ্ড ফুসফুস কিডনি মগজ বের করে রেখে দিই। পরে কাজে লাগবে।”
মহিলাটা বলল, “হিমঘরে জায়গা নাই। গত যুদ্ধে কত মারা গেল মনে নাই?”
মায়ী মায়ী চোখ পাকিয়ে বলল, “তাহলে?”
যে মানুষটাকে দেখে বোঝা যায় না পুরুষ না মহিলা, সে বলল, “মেরে না ফেলে জীবন্ত রাখা ভালো। আজকাল জীবন্ত মানুষের দাম বেশি। বিজ্ঞানী লিংলি অনেক দাম দিয়ে জীবন্ত মানুষ কিনছে।”
মায়ী মায়ী বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ মায়ী মায়ী। সত্যি।”
“কী করে জীবন্ত মানুষ দিয়ে?”
“জানি না। শুনেছি মাথায় বাই ক্রেনিয়াল লাগায়। বাই ক্রেনিয়াল হচ্ছে দুইটা ক্রেনিয়াল। একটা দিয়ে তথ্য দেয়, আরেকটা দিয়ে বের করে।” মানুষটা আমাদের দেখিয়ে বলল, “এই দুজনকে লিংলির কাছে বিক্রি করে দিলে লাভ বেশি।”
মায়ী মায়ী বলল, “ঠিক আছে তাহলে।”
আমি আর টিশা বুকের ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিলাম, আপাতত প্রাণে বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু কত দিন বেঁচে থাকব জানি না। কীভাবে বেঁচে থাকব সেটাও জানি না।