৯৯তম অধ্যায়
বিন্দ ও অনুবিন্দ বধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় দিনমণি অস্তাচল শিখরাভিমুখী হইলে দিবস ক্ৰমে অবসন্ন হইতে লাগিল এবং দিনকরের প্রচণ্ড কিরণ মন্দীভূত হইল, তখন যোদ্ধৃবর্গের মধ্যে কেহ কেহ সংগ্রামে প্রবৃত্ত, কেহ কেহ যুদ্ধে বিরত, কেহ কেহ পুনর্ব্বার সমাগত হইল এবং কেহ কেহ রণস্থলেই অবস্থিত হইতে লাগিল। এইরূপে সেই দিনাবসান সময়ে জয়াভিলাষী সেনাগণ পরস্পর সংগ্রামে সংশক্ত হইলে মহাত্মা বাসুদেব ও অর্জ্জুন সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। মহাত্মা জনার্দ্দন যে যে স্থলে রথ চালন করিলেন, মহাবীর ধনঞ্জয় নিশিত শরনিকরে সৈন্যগণকে অপসারিত করত সেই সেই স্থানে রথ গমনের পথ করিতে লাগিলেন। মহাবীর অর্জ্জুনের রথ যে যে স্থানে গমন করিল, সেই সেই স্থানে কৌরব সৈন্যগণ তাঁহার শাণিত শরে বিদীর্ণ হইয়া গেল। বলবীৰ্য্য সম্পন্ন বাসুদেব উত্তম মধ্যম ও অধম এই ত্রিবিধ মণ্ডল প্ৰদৰ্শন পূর্ব্বক স্বীয় রথ শিক্ষা নৈপুণ্য প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। কালাগ্নি তুল্য, স্নায়ুনদ্ধ, নামাঙ্কিত, বায়ুবেগগামী বৈণব ও আয়স শরসমুদায় পক্ষিগণ সমভিব্যাহারে বিপক্ষদিগের রুধির পান করিতে লাগিল। মহাত্মা মধুসূদন এরূপ বেগে রথ সঞ্চালন করিতে লাগিলেন যে, রথারূঢ় অর্জ্জুনের ক্রোশগামী শরনিকর অরাতিগণের বক্ষস্থল বিদীর্ণ করিবার পূর্ব্বেই তিনি এক ক্রোশ অন্তরে উপনীত হইলেন । বাসুদেব সঞ্চালিত অশ্বগণকে গরুড় ও বায়ুর ন্যায় বেগে গমন করিতে দেখিয়া সমুদায় লোক বিস্ময়াপন্ন হইল। মহাবীর অর্জ্জুনের মনোমারুতগামী রথ সংগ্রামস্থলে যেরূপ বেগে গমন করিতে লাগিল; সূৰ্য্য, ইন্দ্র রুদ্র ও কুবেরের রথও সেরূপ বেগে গমন করিতে সমর্থ নহে। এইরূপে শত্রু নিপাতন কেশব সমরাঙ্গনে রথ সমানীত করিয়া সেনা, মধ্যে অশ্বগণকে পরিচালিত করিলেন। অশ্বগণ সমরবিশারদ বীরগণের অস্ত্রাঘাতে ক্ষত বিক্ষত ও ক্ষুৎপিপাসায় নিতান্ত কাতর হইয়াছিল, সুতরাং রণভূমিস্থ রথ সমুদায়ের মধ্যস্থলে সমুপস্থিত হইয়া অতি কষ্টে স্যন্দন আকর্ষণ করিয়া বিচিত্র মণ্ডলে বিচরণ এবং নিহত মনুষ্য, নাগ অশ্ব ও রথ সমূহের উপরিভাগ দিয়া ক্রমে ক্রমে গমন করিতে লাগিল।
হে মহারাজ! ঐ সময় অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ মহাবীর অর্জ্জুনকে ক্লান্তবাহন দেখিয়া সেনাগণসমভিব্যাহারে তাহার সম্মুখীন হইয়া তাঁহাকে চতুঃষষ্টি, বাসুদেবকে সপ্ততি এবং তাঁহাদের অশ্বগণকে শত বাণে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন কোপান্বিত হইয়া তাঁহাদের উপর মর্ম্মভেদী নতপর্ব্ব নয় বাণ নিক্ষেপ করিলেন। মহাবল পরাক্রান্ত বিন্দ ও অনুবিন্দ অর্জ্জুনের শরাঘাতে নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে ও কেশবকে শরবর্ষণে সমাচ্ছন্ন করত সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীব অর্জ্জুন দুই ভল্ল দ্বারা অবিলম্বে তাঁহাদিগের বিচিত্র শরাসন হয় ও কনকোজ্জ্বল ধ্বজ যুগল ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবল বিন্দ ও অসুবিন্দ তৎক্ষণাৎ অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া ক্রোধভরে অর্জ্জুনের উপর শরবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। পাণ্ডুনন্দন তদ্দর্শনে ক্রোধে কম্পিত কলেবর হইয়া পুনরায় দুই শরে তাঁহাদের দুই জনের শরাসন ছেদন করিলেন এবং সুবর্ণপুঙ্খ শিলাশিত বিশিখজালে তাঁহাদিগের সারথি, পদাতি, পৃষ্ঠরক্ষক ও অশ্ব সকল সংহার করত ক্ষুরপ্ৰাস্ত্র দ্বারা বিন্দের মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর বিন্দ অর্জ্জুনের শরে, গতাসু হইয়া বাতভগ্ন পাদপের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইলেন। তখন রথিপ্রধান মহাবল-পরাক্রান্ত অনুবিন্দ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বিন্দের নিধন দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া সেই হতাশ্ব রথ পরিত্যাগ পূর্ব্বক গদা হস্তে অর্জ্জুনাভিমুখে গমন করিয়া মধুসূদনের ললাটে গদাঘাত করিলেন। মহাত্মা বাসুদেব অনুবিন্দের গদাঘাতে অণুমাত্রও কম্পিত না হইয়া মৈনাক পর্ব্বতের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন সব্যসাচী ধনঞ্জয় ক্রোধভরে ছয় বাণে অনুবিন্দের ভুজদ্বয়, পদদ্বয়, মস্তক ও গ্রীবা ছেদন করিয়া ফেলিলেন।
এইরূপে মহাবীর বিন্দ ও অনুবিন্দ নিহত হইলে তাঁহাদের অনুগামিগণ ক্রোধভরে শরবর্ষণ করিয়া অর্জ্জুনের অভিমুখে ধাবমান হইল। মহাবীর ধনঞ্জয় অবিলম্বে তীক্ষ্ণ শরে তাঁহাদিগকে সংহার করিয়া নিদাঘকালীন অরণ্যদহন হুতাশনের ন্যায়, মেঘনির্ন্মুক্ত দিবাকরের ন্যায় শোভা প্রাপ্ত হইতে লাগিলেন। কৌরব পক্ষীয় বীরগণ অর্জ্জুনকে অবলোকন করিয়া প্রথমত নিতান্ত ভীত হইলেন, কিন্তু পরিশেষে তাঁহাকে শ্রান্ত ও জয়দ্রথকে দূরস্থ অবধারিত করিয়া প্রসন্নচিত্তে সিংহনাদ পরিত্যাগ পূর্ব্বক চতুর্দ্দিক হইতে পার্থকে আক্রমণ করিতে লাগিলেন। পুরুষর্ষভ অর্জ্জুন তাঁহাদিগকে ক্রোধভরে আগমন করিতে দেখিয়া কৃষ্ণকে মৃদুবচনে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিলেন, “হে মাধব! আমাদিগের অশ্ব সকল শরার্দ্দিত ও ক্লান্ত হইয়াছে; জয়দ্রথও অতি দূরে অবস্থান করিতেছে। অতএব এক্ষণে তোমার মতে কি করা কর্ত্তব্য, তুমি সর্ব্বাপেক্ষা প্রাজ্ঞতম ও পাণ্ডবগণের নেত্রস্বরূপ; পাণ্ডবেরা তোমার বুদ্ধি কৌশলেই সংগ্রামে শত্রুগণকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবে। যাহা হউক, এক্ষণে আমার মতে অশ্বগণকে বন্ধন করিয়া বিশল্য করা কর্ত্তব্য।” জনার্দ্দন অৰ্জ্জুনের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “ভ্রাত! তুমি যাহা কহিতেছ, তাহাতে আমার সম্পূর্ণ সম্মতি আছে।” তখন অর্জ্জুন কহিলেন, “হে সখে! তুমি এই স্থানে অবস্থান পূর্ব্বক আপনার কর্ত্তব্য কর্ম্ম সম্পাদন কর; আমি সমুদায় সৈন্যগণকে নিবারণ করিতেছি।”
যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জ্জুনকর্ত্তৃক জলাশয় নির্ম্মাণ
মহাবীর অর্জ্জুন এই বলিয়া অসম্ভ্রান্ত চিত্তে রথ হইতে অবতরণ পূর্ব্বক গাণ্ডীবশরাসন ধারণ করিয়া অচলের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন বিজয়াকাঙ্ক্ষী ক্ষত্রিয়গণ ধনঞ্জয়কে ধরণীতলস্থ দেখিয়া এই আক্রমণ করিবার উপযুক্ত সময়, এইরূপ বিবেচনা করত অসংখ্য রথ সমভিব্যাহারে শরাসন আকর্ষণ ও বিচিত্র অস্ত্র সমুদায় নিক্ষেপ পূর্ব্বক মত্তমাতঙ্গগণ যেমন সিংহের অভিমুখে ধাবমান হয়, তদ্রূপ তাঁহার অভিমুখে গমন ও তাঁহাকে অবরোধ করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন ক্ষত্রিয়গণের শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া মেঘাচ্ছাদিত দিবাকরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। ঐ সময় রণস্থলে অরাতি নিপাতন পার্থের অদ্ভুত ভুজবল লক্ষিত হইল। তিনি স্বীয় অস্ত্র প্রভাবে বিপক্ষাস্ত্র নিরাকৃত ও সমুদায় যোধগণকে সমাচ্ছন্ন করিয়া সৈন্যগণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। বাণের প্রগাঢ় সঙ্ঘর্ষণে আকাশমার্গে প্রজ্বলিত পাবকের আবির্ভাব হইল। অসংখ্য বীরগণ জয়াভিলাষী হইয়া ক্রুদ্ধচিত্তে বহুসংখ্যক শোণিতক্ষিত মদস্রাবী মাতঙ্গ ও অশ্বগণ সমভিব্যাহারে একমাত্র অর্জ্জুনকে পরাজয় করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের রথ সমুদায় সাগরের ন্যায় দৃষ্ট হইল। শরনিকর উহার তরঙ্গ, ধ্বজ আবৰ্ত্ত, হস্তী নক্র, পদাতি মৎস্য, উষ্ণীষ, কমঠ এবং ছত্র ও পতাকা সমুদায় ফেনের ন্যায় শোভ পাইতে লাগিল। মহাবীর ধনঞ্জয় বেলাস্বরূপ হইয়া সেই অক্ষোভ্য রথসাগর নিবারণ করিলেন। তখন মহাত্মা বাসুদেব অশঙ্কিত চিত্তে পুরুষ প্রধান অর্জ্জুনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “সখে! অশ্বগণ জলপানের নিমিত্ত নিতান্ত উৎসুক হইয়াছে; ইহাদিগের জলপান করা নিতান্ত আবশ্যক, অবগাহনের তাদৃশ আবশ্যকতা নাই, কিন্তু সমর ক্ষেত্রে একটিও কূপ দেখিতে পাই না, ইহারা কোথায় জলপান করিবে?”
মহা বীর অর্জ্জুন কৃষ্ণের এই কথা শ্রবণে এই জলাশয় রহিয়াছে বলিয়া তৎক্ষণাৎ অশ্বগণের জলপান নিমিত্ত অস্ত্র দ্বারা অবনি বিদারণ পূর্ব্বক হংস-কারণ্ডবচক্রবাক-সুশোভিত মৎস্য-কূৰ্ম্ম-সমাকীর্ণ ঋষিগণ সেবিত নিৰ্ম্মল সলিল সম্পন্ন বিকশিত কমল দলোপশোভিত সুবিস্তীর্ণ সরোবর প্রস্তুত করিলেন। দেবর্ষি নারদ সেই তৎক্ষণ বিনির্মিত সরোবর সন্দর্শনার্থ তথায় সমাগত হইলেন। তখন বিশ্বকর্ম্মা সদৃশ অদ্ভুতকৰ্ম্মা অর্জ্জুন তথায় শরবংশ, শরস্তম্ভ ও শরাচ্ছাদন সম্পন্ন অদ্ভুত শরগৃহ নির্ম্মাণ করিলেন। মহাত্মা কৃষ্ণ পার্থের এই আশ্চর্য্য কাৰ্য্য সন্দর্শনে চমৎকৃত হইয়া হাস্য করিয়া তাঁহাকে ভূয়োভূয়ঃ সাধু বাদ প্রদান করিতে লাগিলেন।”