নবনবতিতম অধ্যায়
বসুগণের শাপ-বৃত্তান্ত
শান্তনু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘”হে সুরনদি! বশিষ্ঠ কে? বসু-দেবতারা কি দুস্কর্ম্ম করিয়ছিলেন যে, তাঁহারা মহর্ষি বশিষ্ঠের শাপে মনুয্যযোনি প্রাপ্ত হইলেন এবং আপনা কর্ত্তৃক প্রদত্ত এই পুৎত্র কি অপরাধ করিয়াছিলেন যে, তাঁহাকে যাবজ্জীবন মনুয্যলোকে বাস করিতে হইবে? আর বসুগণই বা সর্ব্বলোকের অধীশ্বর হইয়া কি নিমিত্ত মনুষ্যত্ব প্রাপ্ত হইলেন, তাহা সবিশেষ বর্ণন কর।” জাহ্নবী কহিলেন, ”মহারাজ! শ্রবণ করুন। মহর্ষি বশিষ্ঠ বরুণদেবের পুৎত্র। তাঁহার আর একটি নাম আপব। তিনি গিরিবর সুমেরু-সন্নিহিত এক পরম রমনীয় অরণ্যে তপস্যা করিতেন। সেই তপোবন সকল ঋতুতেই নানাজাতীয় কুসুমসমুহে বিকশিত হইয়া থাকে এবং পশুপক্ষিগণ অসঙ্কুচিত্তে সর্ব্বদাই ইতস্ততঃ বিচরণ করে। সেই আশ্রমপদ সচ্ছজল জলাশয়ে অলঙ্কৃত এবং অশেষ প্রকার সুস্বাদু ফলমূলে পরিপূর্ণ।
দক্ষ প্রজাপতির সুরভিনাম্নী এক নন্দিনী ছিলেন। সেই সর্ব্বকামপ্রদা সুরভি জগতের হিতার্থে গোরূপধারণ করিয়া কশ্যপের ঔরসে ভূমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করিয়া মহাতপাঃ বশিষ্ঠের হোমধেনু হয়েন। তিনি মুনিজনসেবিত সেই পরম-রমনীয় তপোবনে নির্ভয়ে বিচরণ করিতেন। পৃথু প্রভৃতি বসুদেবতারা বনবিহারার্থে সস্ত্রীক হইয়া তথায় আগমন করিলেন। তাঁহারা স্ব স্ব পত্নী সমভিব্যহারে তত্রত্য সুরম্য পর্ব্বতে ও বনে বনে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। তন্মধ্যে কোন বসুপত্নী তথায় ভ্রমণ করিতে করিতে সেই নন্দিনীনাম্নী ধেনুকে নয়নগোচর করিয়া বিস্মিত ও চমৎকৃত হইলেন। পরে দ্যু নামক বসুকে সর্ব্বলক্ষণাক্রান্ত পীনোধ্নী [পীবরস্তনী−বড় পালানওয়ালা], সুগন্ধী, সুন্দরবালধী [দোহনকালে শান্তভাবাপন্না] ও বিচিত্র-খুরবিশিষ্টা সেই ধেনু দর্শন করাইলেন। দ্যু নন্দিনীকে নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার অশেষ প্রকার গুণকীর্ত্তনপূর্ব্বক দেবীকে কহিলেন, ”দেবি! যে মহর্ষির তপোবন, নন্দিনী সেই বারুণির হোমধেনু। মর্ত্ত্যলোকনিবাসী যে ব্যক্তি এই ধেনুর সুস্বাদ দুগ্ধ পান করেন, তিনি দশ সহস্র বৎসর স্থির যৌবন হইয়া জীবিত থাকেন।’ এই কথা শ্রবণ করিয়া বসুপত্নী আপন স্বামীকে কহিলেন, ‘মহাভাগ ! মর্ত্ত্যলোকে জিতবতি-নাম্নী আমার এক সখী আছেন। সেই রূপবতী যুবতী রাজা উশীনরের দুহিতা। তাঁহার অসামান্য রূপলাবণ্য পৃথিবীর মধ্যে সর্ব্বত্র সুবিখ্যাত আছে। আমি অভিলাষ করি, আপনি সত্বর হইয়া তাহার নিমিত্ত বৎসের সহিত ঐ ধেনুকে আনয়ন করুন। তিনি উহার দুগ্ধ পান করিয়া যাবজ্জীবন অজরা ও অরোগিণী হইয়া থাকিবেন, ইহার পর আহ্লাদের বিষয় আর কি আছে? হে নাথ ! অভিলাষসম্পাদনে তৎপর হওয়া আপনার সর্ব্বতোভাবে বিধেয় ।’ দ্যু পত্নীবাক্য শ্রবণ করিয়া পৃথু প্রভৃতি ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে সেই ধেনু ও তাহার বৎস অপহরণ করিলেন। ভার্য্যার প্রবর্ত্তনা-পরতন্ত্র হইয়া, মহর্ষির অসামান্য তপঃপ্রভাব সবিশেষ পর্য্যালোচনা না করিয়া ধেনু অপহরণ করিলেন বটে, কিন্তু তন্নিমিত্ত যে ঘোরতর অনিষ্টপাত হইবে, তাহা কিঞ্চিন্মাত্রও বিবেচনা করিলেন না ।
অনন্তর তপোধন বারুণি ফলমূল আহরণ করিয়া আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। তিনি তথায় ধেনু ও তাহার বৎসকে না দেখিয়া ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কুত্রাপি দেখিতে পাইলেন না। পরিশেষে জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখিলেন, অদ্য বসুদেবতারা এই বনে বিহার করিতে আসিয়া তাঁহার ধেনু অপহরণপূর্ব্বক প্রস্থান করিয়াছেন। তখন ঋষি ক্রোধপরবশ হইয়া বসুগণকে অভিসম্পাত করিলেন, ”যেহেতু তোমরা আমার সর্ব্বলক্ষণাক্রান্ত ধেনু অপহরণ করিয়াছ, অতএব মনুয্যযোনি প্রাপ্ত হইবে। মহাপ্রভাব মহর্ষি সাতিশয় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া বসুগণকে এই প্রকার শাপ প্রদান করিয়া পুনর্ব্বার তপঃসাধনে মনোনিবেশ করিলেন। এদিকে বসুদেবতারা আপন আশ্রমে উপস্থিত হইয়া, মহর্ষি বশিষ্ট তাঁহাদিগকে অভিসম্পাত করিয়াছেন, ইহা জানিতে পারিলেন। পরে তাঁহাকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্ত তৎক্ষণাৎ তাঁহার সন্নিধানে গমন করিলেন। ঋষির ক্রোধানল নির্ব্বাণ করিবার নিমিত্ত নানাপ্রকার স্তব-স্তুতি করিতে লাগিলেন। কিন্তু কোন ক্রমেই তাঁহার অনুগ্রহ লাভ করিতে পারিলেন না। মহর্ষি কহিলেন, ‘ আমি ক্রোধপরন্ত্র হইয়া যাহা করিয়াছি, তাহার অন্যথা করিতে পারিব না, তবে এইমাত্র বলিতে পারি যে তোমরা সকলেই প্রতি সংবংসর শাপমুক্ত হইবে; কিন্তু যাঁহার নিমিত্ত অভিশপ্ত হইয়াছ, তাঁহাকে স্বকৃত দুষ্কর্ম্মের ফলভোগ করিবার নিমিত্ত যাবজ্জীবন মনুয্যলোকে কালযাপন করিতে হইবে। তাঁহাকে সামান্য মনুষ্যের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিতে হইবে না। তিনি পরম ধার্ম্মিক, সর্ব্বশাস্ত্রবিশারদ ও পিতৃহিতৈষী হইয়া অকিঞ্চিৎকর দারপরিগ্রহ প্রভৃতি পার্থিব সুখসম্ভোগে পরাঙ্মুখ হইবেন।’ ঋষি এই কথা বলিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলে বসুগণ আমার নিকট আসিয়া প্রার্থনা করিলেন, গঙ্গে ! আপনি আমাদিগকে গর্ভে ধারণ করুন আর আমরা ভুমিষ্ঠ হইবামাত্র আপনি আমাদিগকে সলিলে নিক্ষেপ করিবেন। অতএব হে মহারাজ ! অভিশপ্ত বসুদেবতাদিগকে মনুয্যলোক হইতে ঝটিতি মুক্ত করিয়াছি। কেবল মাত্র দ্যু সেই মহর্ষির শাপে যাবজ্জীবন মনুয্যলোকে বাস করিবেন।” দেবী এই কথা বলিয়া অন্তর্হিতা হইলেন। রাজা তৎপ্রদত্ত পুৎত্র লইয়া শোকার্ত্ত ও বিষণ্ণমনে ভবনে প্রত্যাগমন করিলেন।
সেই পুত্রের দেবব্রত ও গঙ্গেয় হইল। দেবব্রত পিতা অপেক্ষা অধিকতর গুণসম্পন্ন হইলেন। আমি সেই মহাপুরুষের গুণরাশি কীর্ত্তন করিব এবং মহাত্মা ভারত ভুপতির সৌভাগ্যবর্ণন করিব, যাঁহার ইতিহাস পবিত্র মহাভারত নামে বিখ্যাত হইয়াছে।