অর্জ্জুন-কর্ণেতে যুদ্ধ লোকেতে ভীষণ।
করিলেন যুদ্ধ যেন শ্রীরাম-রাবণ।।
যেন বৃত্র বৃত্রহা মাধব-উমাধব।
বালি-সুগ্রীবের কিবা গজেন্দ্র কচ্ছপ।।
নানা অস্ত্র দুইজন দোঁহারে মারয়।
দূরে রহি রাজগণ দাণ্ডাইয়া চায়।।
ক্রোধে ধনঞ্জয় বীর অতুল প্রতাপ।
এক বাণে সৃজিলেন শত শত সাপ।।
মহাশব্দে আসে সর্প যুড়িয়া আকাশ।
দেখিয়া নৃপতিগণে লাগিল তরাস।।
হাসিয়া গরুড়-অস্ত্র এড়ে বীর কর্ণ।
সকল ভুজঙ্গ ধরি গরাসে সুপর্ণ।।
শত শত খগবর উড়য়ে আকাশে।
ভুজঙ্গ গিলিয়া পার্থে গিলিতে আইসে।।
অগ্নি অস্ত্র এড়ি পার্থ করেন অনল।
আগুণে পক্ষীর পক্ষ পুড়িল সকল।।
ঝাঁকে ঝাঁকে অগ্নিবৃষ্টি কর্ণের উপর।
দেখি কর্ণ এড়িলেক অস্ত্র জলধর।।
বৃষ্টি করি নিবারণ কৈল বৈশ্বানর।
মুষলধারায় জল বর্ষে পার্থোপর।।
পুনরপি ধনঞ্জয় পূরিয়া সন্ধান।
বৃষ্টি নিবারিতে এড়িলেন দিব্যবাণ।।
বায়ু-অস্ত্র মহাবীর পূরিয়া সন্ধান।
উড়াইল জল-অস্ত্র পার্থ বলবান।।
বায়ু-অস্ত্রে উড়াইল যত মেঘচয়।
মহাবাতে কাঁপাইল রবির তনয়।।
সন্ধিয়া আকাশ-অস্ত্র সংহারিল বাত।
এই মত দুইজনে হয় অস্ত্রাঘাত।।
সূচীমুখ অর্দ্ধচন্দ্র পরশু তোমর।
জাঠা জাঠি শক্তি শেল মুষল মুদগর।।
নানা অস্ত্র ফেলে দোঁহে যেবা যত জানে।
মুষলধারায় যেন বরিষে শ্রাবণে।।
ঢাকিল সূর্য্যের তেজ, না দেখি যে আর।
দিন দুই প্রহরে হইল অন্ধকার।।
আকাশে প্রশংসা করে যতেক অমর।
বিস্মিত নৃপতি যত দেখিয়া সমর।।
বিস্মিত হইয়া কর্ণ বলয়ে বচন।
কহ তুমি বেশধারী কে হও ব্রাহ্মণ।।
কিম্বা ভস্মানলে ছদ্মরূপ সহস্রাক্ষ।
কিম্বা তুমি জগন্নাথ কিম্বা বিরূপাক্ষ।।
কিম্বা তুমি ধনুর্ব্বেদী কিম্বা তুমি রাম।
কিম্বা তুমি জীবন্ত পাণ্ডর্বাজ্জুন নাম।।
এত জন মধ্যে তুমি বল কোন্ জন।
মোর ঠাঁই অন্য কে জীবেক এতক্ষণ।।
এত শুনি হাসিয়া বলেন ধনঞ্জয়।
কি হবে আমার, তোরে দিলে পরিচয়।।
মম পরিচয়ে তোর হবে কোন্ কাজ।
দরিদ্র ব্রাহ্মণ আমি তুমি মহারাজ।।
একা দেখি বেড়িলা হইয়া লক্ষ লক্ষ।
হারি পরিচয় মাগ হইয়া অশক্য।।
যদি প্রাণে ভয় হয়, যাহ পলাইয়া।
কাতরে না মারি আমি দিলাম ছাড়িয়া।।
অর্জ্জুনের বাক্য শুনি আরুণি কুপিত।
অরুণ-নয়ন-যুগ্ম ঘুরে বিপরীত।।
অরুণ-অঙ্গজ বীর অরুণ-প্রতাপে।
অরুণ-সদৃশ বাণ বসাইল চাপে।।
আকর্ণ পূরিয়া কর্ণ এড়িলেক বাণ।
অর্দ্ধপথে অর্জ্জুন করেন খান খান।।
যত অস্ত্র ফেলে কর্ণ তত অস্ত্র কাটি।
নিরস্ত্র করিয়া অস্ত্র এড়েন কিরীটি।।
চারি বাণে কাটেন রথের চারি হয়।
সারাথি কাটেন তার বীর ধনঞ্জয়।।
বিরথী হইল কর্ণ যুদ্ধের ভিতর।
দেখি হাহাকার করে যত নৃপবর।।
কর্ণরক্ষা হেতু সব বেড়িল অর্জ্জুনে।
অর্জ্জুন করেন অস্ত্র বরিষণ রণে।।
বরিষার কালে যেন বরিষয়ে মেঘে।
দিনকর-তেজ যেন সব ঠাই লাগে।।
সবাকার অঙ্গে অস্ত্র করেন প্রহার।
সহস্ত্র সহস্র বীর হইল সংহার।।
কাটার কাটেন মুণ্ড কুণ্ডল সহিত।
নাসা শ্রুতি কাটেন দেখিতে বিপরীত।।
ধনুর সহিত কাটিলেন বামহাত।
গড়াগড়ি যায় কেহ বুকে বাজে ঘাত।।
ভাদ্র মাসে পাকা তাল পড়ে যেন ঝড়ে।
পুঞ্জে পুঞ্জে স্থানে স্থানে পার্থ কাটি পাড়ে।।
ভীষণ দশন হ্স্তী পর্ব্বত-আকার।
মুষল মুদগর মারে মুণ্ডে সবাকার।।
নব-মেঘ-ঘটা যেন শোভে ভূমিতলে।
পার্থের আঘাতে সব গড়াগড়ি বুলে।।
লক্ষ লক্ষ তুরঙ্গ সারথি রথ রথী।
অর্ব্বুদ অর্ব্বুদ কত পড়িল পদাতি।।
অনন্ত ফণীন্দ্র যেন মথে সিন্ধুজল।
দুই ভাই রাজগণে মথিল সকল।।
রক্তের বহিল নদী রক্তেতে সাঁতারে।
রক্তমাংসাহারী ধায় ঘোর রব করে।।
বিস্ময় মানিয়া চিত্তে যত রাজগণ।
জানিল, মনুষ্য নহে এই দুইজন।।
এত ভাবি নিবৃত্ত হইল রাজগণ।
দুই ভাই আনন্দে করেন আলিঙ্গন।।
চতুর্দ্দিক হইতে আইল দ্বিজগণ।
জয় জয় দিয়া কহে আশিস্ বচন।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
ইহলোকে পরলোকে হিত-উপকার।।
কাশীরাম দাস কহে, পাঁচালীর ছন্দ।
সজ্জন রসিক সাধু হেতু মকরন্দ।।