৯৭তম অধ্যায়
প্রজাপালনে নৃপতির যুদ্ধহিংসাদি পাপনাশ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! ক্ষাত্ৰধৰ্ম্ম অপেক্ষা পাপজনক আর কিছুই নাই। নরপতি যুদ্ধকালে সৈন্যমধ্যস্থিত বৈশ্যদিগকেও নিপাতিত করিয়া থাকেন। যাহা হউক, ভূপতি কিরূপ কৰ্ম্ম করিলে পুণ্যলোকে গমন করিতে পারেন, এক্ষণে তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! ভূপালগণ যজ্ঞানুষ্ঠান, দান এবং পাপাত্মাদিগের নিগ্রহ ও সাধুদিগের প্রতি অনুগ্রহদ্বারা পবিত্র ও নিস্পাপ হইয়া থাকেন। তাঁহারা বিজয়ার্থী হইয়া প্রাণীদিগকে নিপীড়িত করেন বটে, কিন্তু জয়লাভ করিয়া পুনরায় তাহাদের শ্রীবৃদ্ধিসাধনে যত্নবান হয়েন। দান, যজ্ঞ ও তপস্যাদ্বারা তাঁহাদিগের পাপ ধ্বংস এবং প্রাণীদিগের প্রতি অনুগ্রহদ্বারা পুণ্য বৰ্দ্ধিত হইয়া থাকে। কৃষক যেমন ক্ষেত্রসংস্কারে ব্যাপৃত হইয়া ধান্য বিনষ্ট না করিয়া তৃণসমুদয় উম্মলিত করে, তদ্রূপ শস্ত্রপ্রহারকর্ত্তা শস্ত্রনিক্ষেপপূৰ্ব্বক কেবল বধাদিগেরই প্রাণসংহার করিয়া থাকেন। প্রজারক্ষণদ্বারাই ভূপতির পাপ বিনষ্ট হইয়া যায়। যে রাজা প্রজাগণকে বধ ও ক্লেশ হইতে রক্ষা করিয়া তাহাদিগের দস্যুভয়াদি-নিবারণে প্রবৃত্ত হয়েন, সকল লোকেই তাঁহাকে ধনদাতা, সুখদাতা ও অন্নদাতা বলিয়া নির্দেশ করে। ধর্ম্মাত্মা ভূপতি প্রজাগণকে অভয়দান ও যজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক ইহলোক মঙ্গললাভ ও পরলোকে স্বর্গসুখ অনুভব করিয়া থাকেন। যে রাজা ব্রাহ্মণের পরিত্রাণার্থ জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া অরাতিগণের সহিত সংগ্রাম করেন, তাঁহার অনন্তদক্ষিণ[বহু দক্ষিণাযুক্ত] যজ্ঞের ফললাভ হয়। যে নরপতি অকুতোভয়ে শত্ৰুদিগের উপর শরবর্ষণ করেন, দেবগণ পৃথিবীমধ্যে তাঁহাকেই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করিয়া থাকেন।
সমরে অপরাঙ্মুখ রাজার প্রশংসা
“ভূপতির যাবৎসংখ্যক অস্ত্র অরাতিগণের চর্ম্ম ভেদ করে, তিনি তাবৎসংখ্যক সর্ব্বকামপ্রদ অক্ষয়লোকলাভে অধিকারী হয়েন। সংগ্রামসময়ে রাজার গাত্র হইতে যে রুধির নিঃসৃত হয়, তিনি সেই শোণিতের সহিত সমুদয় পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া । থাকেন। ধৰ্ম্মবিৎ পণ্ডিতেরা কহেন যে, সমরক্কেশ সহ্য করাই ক্ষত্রিয়গণের প্রধান তপস্যা। ভীরুভাব পুরুষেরাই মেঘ হইতে জললাভের ন্যায় শূরগণের শরণ[আশ্রয়] লাভের বাসনা করিয়া সংগ্রামের পশ্চাদ্ভাগে অবস্থান করে। বীরপুরুষ যদি ভয়ের সময়ে তাঁহাদিগের পরিত্রাণার্থ স্বয়ং অগ্রসর হইয়া তাঁহাদিগকে পশ্চাদ্ভাগে অবস্থাপনপূৰ্ব্বক রক্ষা করেন, তাহা হইলে তাহার সমধিক পুণ্যলাভ হয়। আর যেসকল ব্যক্তি বীরগণের বাহুপ্রভাবে বিপদ হইতে মুক্ত ও রক্ষিত হয়, তাহারা যদি তাহাদিগকে প্রাণদাতা বলিয়া প্রতিনিয়ত নমস্কার করে, তাহা হইলে তাহাদের ন্যায্য ও উপযুক্ত কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করা হয়। ইহলোকে সকলের প্রকৃতি সমান নহে, কেহ কেহ সৈন্যগণের ঘোরতর সংগ্রামসময়ে অরাতিকুলের অভিমুখীন হয়, আর কেহ ঐ সময় সমরাঙ্গন পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পলায়ন করে। যাঁহারা প্রাণ-সঙ্কট সংগ্রামে জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া বিপক্ষপক্ষের অভিমুখে গমন করেন, তাঁহারা মহাবীর; আর যাহারা ঐ সময় আত্মপক্ষীয়দিগকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পলায়ন করে, তাহারা কাপুরুষ। আত্মীয়দিগকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অক্ষতগাত্রে গৃহে গমন করা নিতান্ত নরাধমের কার্য্য। ঐরূপ পুরুষ যেন তোমার বংশে জন্মগ্রহণ না করে। যে ব্যক্তি আপনার প্রাণরক্ষাৰ্থ সহায়ভুত বীরগণকে পরিত্যাগ করে, ইন্দ্রাদি দেবগণ তাহার অমঙ্গলবিধান করিয়া থাকেন। ঐরূপ কাপুরুষদিগকে কাষ্ঠ ও লোষ্ট্র[ঢিল]দ্বারা বিনষ্ট, কটবদ্ধ[তূণে কড়ারকমের পাক দেওয়া—নারিকেল-কাতার কাছির মত সুদৃঢ় রজ্জুদ্বারা বন্ধন] করিয়া দগ্ধ অথবা পশুবৎ নিপাতিত করা কর্ত্তব্য। শয্যায় শয়ন করিয়া প্রাণপরিত্যাগ করিলে ক্ষত্রিয়কে অধর্ম্মে লিপ্ত হইতে হয়। যে ক্ষত্রিয় শ্লেষ্ম-মূত্র পরিত্যাগ ও করুণবিলাপ করিতে করিতে অক্ষতশরীরে প্রাণত্যাগ করে, পণ্ডিতেরা কখনই তাহার প্রশংসা করেন না। ক্ষত্রিয়গণের গৃহমৃত্যু প্রশংসনীয় নহে। উহারা স্বভাবতঃ শুর, অভিমানী, সুতরাং উহারা সংগ্রামে শৌর্য্য প্রকাশ না করিলে লোকে উহাদিগকে কৃপণ ও অধার্ম্মিক বলিয়া নির্দেশ করে, সন্দেহ নাই। সংগ্রামপরাঙ্মুখ মানবগণ রোগাক্রান্ত হইয়া দুর্গন্ধযুক্তমুখে ক্লেশসূচক শব্দ উচ্চারণপূৰ্ব্বক পুত্রগণকে শোকাকুলিত করিয়া আরোগ্যলাভ বা বারংবার মৃত্যু প্রার্থনা করে। অভিমানী বীরপুরুষদিগের কদাচ এরূপ মরণে অভিলাষ হয় না। জ্ঞাতিগণসমভিব্যাহারে সংগ্রামে শরবর্ষণপূর্ব্বক বিপক্ষের তীক্ষ্ণশরে নিপীড়িত হইয়া প্রাণত্যাগ করাই ক্ষত্রিয়ের উপযুক্ত কৰ্ম্ম। বীরপুরুষ কামক্রোধপ্রভাবে অরাতিকুলের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম করিয়া তাহাদের শরনিকরে নিপীড়িত হইয়াও আপনাকে ব্যথিত জ্ঞান করেন না। তিনি লোকপূজিত ক্ষাত্রধর্ম্মের অনুবৰ্ত্ত হইয়া সংগ্রামে কলেবরপরিত্যাগপূৰ্ব্বক অনায়াসে ইন্দ্রলোক লাভ করিয়া থাকেন। যে সকল মহাবীর সমরক্ষেত্রে অরাতিকুলে পরিবৃত হইয়া দীনতা প্রকাশ বা পলায়ন না করিয়া প্রাণপরিত্যাগ করেন, তাঁহাদিগের নিশ্চয়ই অক্ষয়লোকলাভ হইয়া থাকে।”