৯৭তম অধ্যায়
নারদ কর্ত্তৃক মাতলির বরুণালয়দৰ্শন
“ঐ সময় মহর্ষি নারদ বরুণের সহিত সাক্ষাৎকারের নিমিত্ত পাতালে গমন করিতেছিলেন। পথিমধ্যে মাতলিকে সন্দর্শন করিয়া কহিলেন, “মাতলে! কোথায় গমন করিতেছ? তোমার কি কোন প্রয়োজন আছে অথবা সুররাজের আজ্ঞানুসারে যাত্রা করিয়াছ?” মাতলি তাঁহার বাক্য শ্রবণান্তর সমুদয় বৃত্তান্ত কীর্ত্তন করিলেন। তখন নারদ কহিলেন, “হে মাতলে! আমি বরুণসন্দর্শনার্থ সুরলোক হইতে আগমন করিতেছি; অতএব চল, উভয়ে মিলিত হইয়া গমন করি। আমি তোমাকে পাতালতল দর্শন করাইয়া সমুদয় বৃত্তান্ত বৰ্ণনা করিব এবং উভয়ে তত্ৰত্য একজন উপযুক্ত বর অন্বেষণ করিয়া মনোনীত করিতে পারিব।”
“এইরূপ স্থির করিয়া তাঁহারা উভয়ে পাতালতলে প্রবেশপূর্ব্বক লোকপাল বরুণকে সন্দর্শন করিলেন। তথায় নারদ দেবর্ষির উপযুক্ত ও মাতলি ইন্দ্রের সদৃশ পূজা প্রাপ্ত হইলেন। অনন্তর তাহাঁরা উভয়ে বরুণের নিকট আপনাদের উদ্দেশ্য অবগত করাইয়া তাহার অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্ব্বক নাগলোক ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন।
“মহর্ষি নারদ পাতালতলনিবাসী প্রাণীগণের বৃত্তান্ত অবগত ছিলেন, এক্ষণে মাতলির নিকট তৎসমুদয় কীর্ত্তন করিতে আরম্ভ করিলেন, “হে সূত! তুমি পুত্রপৌত্রসমাবৃত বরুণদেবকে অবলোকন করিয়াছ; এক্ষণে তাঁহার সর্ব্বসমৃদ্ধিসম্পন্ন অত্যুৎকৃষ্ট স্থানসমুদয় অবলোকন কর। এই দেখ, উদকপতি [জলাধিপ] বরুণের কমললোচন মহাপ্রাজ্ঞ পুষ্করনামা পুত্র; উনি রূপ, গুণ, সদাচার ও শৌচদ্বারা সকলকে অতিক্ৰম করিয়াছেন। লক্ষ্মীর ন্যায় রসসম্পন্না জ্যোৎস্নাকালীনামে সোমের কন্যা উহাকে পতিত্বে বরণ করিয়াছেন। ঐ অদিতির জ্যেষ্ঠপুত্র সুরশ্রেষ্ঠ দেবরাজের কাঞ্চনময় সুরাগৃহ শোভা পাইতেছে, দেবগণ ঐ স্থানে আগমন করিয়া সুরত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন [সুরাগৃহে-বারুণীমদ্যের গৃহে আগমন করিয়া সুরগণের সুরত্ব সার্থক হইয়াছে]; ঐ দেখ হৃতরাজ্য দৈত্যগণের অস্ত্রশস্ত্রসমুদয় দেদীপ্যমান রহিয়াছে; ঐসকল অক্ষয়প্রহরণ [অস্ত্রশস্ত্ৰ] নিক্ষেপ করিলে কাৰ্য্যসাধন করিয়া পুনরায় প্রহর্ত্তার [নিক্ষেপকর্ত্তার] নিকট সমাগত হয়; দেবগণ অসুরদিগকে পরাজিত করিয়া ঐ সকল শস্ত্ৰ আনয়ন করিয়াছেন। এই স্থানে দিব্যাস্ত্ৰসম্পন্ন রাক্ষস ও দৈত্যগণ দেবগণকর্ত্তৃক বিনির্জিত হইয়াছে।
“ ‘এই বারুণ হ্রদে [বরুণালয়ে] প্ৰদীপ্তশিখাসম্পন্ন অনল [বাড়বাগ্নি] জাজ্বল্যমান রহিয়াছে এবং ধূমরহিত বহ্নি বৈষ্ণব-চক্ররুদ্ধ [পাহারা দিয়া রক্ষা] করিয়া রাখিয়াছেন। ঐ যে লোকসংহারকারী, গণ্ডারপৃষ্টবংশসম্ভূত [গণ্ডারের চর্ম্মযুক্ত মেরুদণ্ডদ্বারা নির্মিত] নিরন্তর দেবগণকর্ত্তৃক রক্ষিত বিপুল শরাসন রহিয়াছে, উহার নাম গাণ্ডীব। ব্ৰহ্মবাদী ভগবান ব্ৰহ্মা প্রথমে ঐ প্রচণ্ড শরাসন নির্ম্মাণ করেন। কাৰ্য্যকাল সমুপস্থিত হইলে উহার বল অন্য শরাসন অপেক্ষা শতসহস্ৰগুণে পরিবৰ্দ্ধিত হইয়া থাকে। ঐ কামুক রাক্ষস সদৃশ অশাস্য [শাসনের অযোগ্যদুর্দান্ত] রাজগণকে শাসন করে। ভগবান শুক্র ঐ শরাসন সর্ব্বাপেক্ষা মহৎ বলিয়া কীর্ত্তন করিয়াছেন। সলিলরাজ বরুণের পুত্ৰগণ উহা ধারণ করিয়া থাকেন।
“ঐ দেখ, সলিলরাজ বরুণের ছত্ৰগৃহে [যে গৃহে রাজচ্ছত্র থাকে] বিপুল ছত্র রহিয়াছে; উহা মেঘের ন্যায় চতুর্দ্দিকে সুশীতল বারি বর্ষণ করিতেছে। ঐ ছত্র হইতে পরিভ্রষ্ট নিশাকরের [চক্রের] ন্যায় নির্ম্মল সলিল অন্ধকারে আবৃত হইয়াছে বলিয়া দৃষ্টিগোচর হইতেছে না। হে মাতলে! এই স্থানে অনেক দর্শনীয় বস্তু আছে; কিন্তু তোমার কাৰ্য্যানুরোধে তৎসমুদয় দর্শন না করিয়া অতিশীঘ্রই আমাদিগকে গমন করিতে হইবে।