প্রলয়ের কালে যেন উথলে সাগর।
মার মার শব্দে ডাকে যত নৃপবর।।
চতুদ্দিকে সবাকার মুখে এই রব।
মারহ এ দুষ্ট মতি দ্বিজগণ সব।।
সিংহনাদ শঙ্খনাদ মুখে ঘোরনাদ।
শুনিয়া ব্রাহ্মণগণ গণিল প্রমাদ।।
যুধিষ্ঠিরে চাহিয়া বলয়ে দ্বিজ সব।
হের দেখ অন্তে যেন উথলে অর্ণব।।
উঠ উঠ দ্বিজ সব, চলহ সত্বর।
নির্ভয়ে আছহ মনে, নাহি কিছু ডর।।
মরিবার হেতু দুষ্ট সঙ্গে এসেছিল।
আপনি মরিল, সব দ্বিজে দুঃখ দিল।।
ক্ষত্র-রাজগণ সহ হইল বিবাদ।
থাকুক দক্ষিণা প্রাণে পড়িল প্রমাদ।।
পলাহ পলাহ দ্বিজ, চলহ সত্বর।
অনর্থ করিল আজি এই দ্বিজবর।।
ক্ষত্রিয়ের কর্ম্ম কি ব্রাহ্মণগণে শোভে।
রাজকন্যা দেখি লক্ষ্য বিন্ধিলেক লোভে।।
হেথায় রহিয়া আর নাহি প্রয়োজন।
ওই শুন দ্বিজে মার ডাকে ক্ষত্রগণ।।
পলাহ পলাহ দ্বিজ, চলহ চত্বর।
এত বলি পলায় যতেক দ্বিজবর।।
প্রাণ লয়ে পলাইল যতেক ব্রাহ্মণ।
ঊর্দ্ধমুখ হইয়া পলায় মুনিগণ।।
বিংশতি-সহস্র শিষ্য লইয়া মার্কণ্ড।
পঞ্চদশ-সহস্র লয়ে পলাইল কৌণ্ড।।
বাইশ-সহস্র শিষ্য লৈয়া যান ব্যাস।
ধাইল পুলস্ত্য মুনি, বহে ঊর্দ্ধশ্বাস।।
ষষ্টিদশ শত শিষ্যে পলায় দুর্ব্বাসা।
দ্বাদশ সহস্রে গর্গ নাহি স্ফুরে ভাষা।।
পঞ্চবিংশ সহস্রেতে পরাশর মুনি।
চতুর্দ্দিকে ধায় সবে, নাহি সরে বাণী।।
দ্বন্দ্ব দেখি হরষিত দ্বন্দ্বপ্রিয় ঋষি।
ঘন করতালি দিয়া নাচেন উল্লাসী।।
লাগ লাগ বলিয়া সঘনে ডাক ছাড়ে।
ক্ষণে ক্ষণে সকল রাজারে গালি পাড়ে।।
ব্যর্থ ক্ষত্রকুলে জন্ম ব্যার্থ তোরা সব।
একা দ্বিজ করিল সকলে পরাভব।।
কন্যা লৈয়া যায় যদি দরিদ্র ব্রাহ্মণ।
কোন্ লাজে লোকে তোরা দেখাবি বদন।।
এত বলি ঊর্দ্ধবাহু নাচে তপোধন।
বাধিল তুমুল যুদ্ধ, না যায় লিখন।।
সবাকার অস্ত্র কাটি ইন্দ্রের নন্দন।
প্রহার করেন নিজ অস্ত্রে রাজগণ।।
কাহার কাটিল ধনু, কারো কাটে গুণ।
কাহার কাটিল খড়্গ, কারো কাটে তূণ।।
কাহার কাটিল রথ, কাহার সারথি।
কাহার কাটিল শর, শেল শূল শক্তি।।
নিরস্ত্র করিয়া তবে যত রাজচয়।
দশ দশ বাণে বিন্ধে সবার হৃদয়।।
মুখে পঞ্চ ভুজে চারি হৃদে চারি পায়।
মূর্চ্ছিত হইয়া সবে গড়াগড়ি যায়।।
রথ ফিরাইল যত রথের সারথি।
ভঙ্গ দিল চতুর্দ্দিকে যত নরপতি।।
পাছু পানে চাহি পার্থ কষ্ণারে আশ্বাসে।
পিছে থাকি কর্ণবীর খল খল হাসে।।
কি কর্ম্ম করিস্ দ্বিজ মুখে নাহি লাজ।
পরনারী সম্ভাষহ কেন সভামাঝ।।
আপনার ভার্য্যা আগে করহ ব্রাহ্মণ।
তবে কৃষ্ণা সহ কর কথোপকথন।।
এ অদ্ভুত কারে কহি উপহাস-কথা।
ভিক্ষুক হইয়া ইচ্ছে রাজার দুহিতা।।
নেউটিয়া দেখি পার্থ রাধার নন্দনে।
কহিলেন, কহ কর্ণ আছত জীবনে।।
আরে কর্ণ দুরাচার ধন্য তোর প্রাণ।
জীয়ন্তে আছিস্ যে খাইয়া মম বাণ।।
কর্ণ বলে, দ্বিজবর বুঝি ভাষা কহ।
কোন্ দেশে ঘর তোর, আমা না জানহ।।
ব্রাহ্মণ বলিয়া আমি করি উপরোধ।
কার প্রাণ জীয়ে আমি করিলে রে ক্রোধ।।
কর্ণ বাক্য শুনি পার্থ কহিলেন তারে।
দ্বিজ আমি, এই কথা কে বলিল তোরে।।
যুদ্ধভয় করি বুঝি কহ এই কথা।
দুর্য্যোধনে ভাণ্ডি রাজ্য খাও তুমি বৃথা।।
ক্ষত্রনীতি আছে হেন শাস্ত্রের বিহিত।
নাহি যুদ্ধ তার সনে যেই রণে ভীত।।
বীরগণে আছে এই শাস্ত্রের বিধান।
যুদ্ধেতে ব্রাহ্মণ গুরু একই সমান।।
তুমি বড় ধর্ম্মপর ব্রহ্মবধে ভয়।
তেঁই এক জনেরে বেড়িলা রাজচয়।।
হারিয়া এখন বল করি উপরোধ।
কে বলিল তোমারে করিতে শান্ত ক্রোধ।।
যত শক্তি আছে তব নাহি কর ক্ষমা।
ব্রাহ্মণ বলিয়া তুমি না জানিও আমা।।
অর্জ্জুনের বাক্য শুনি কর্ণ কোপে জ্বলে।
নানাবর্ণ অস্ত্র বীর পার্থোপরি ফেলে।।
কর্ণ-ধনঞ্জয় যুদ্ধ নাহি পাঠান্তর।
হাতে বৃক্ষ উপনীত বীর বৃকোদর।।
মার মার বলি অস্ত্র ফেলায় চৌদিকে।
আষাঢ় শ্রাবণে যেন বরিষয়ে মেঘে।।
মুষল মুদগর শেল শূল শক্তি জাঠি।
গদা চক্র পরশু ভূষণ্ডি কোটি কোটি।।
মার মার বলি সবে চতুর্দ্দিকে ডাকে।
বৃষ্টিবৎ নানা অস্ত্র ফেলে ঝাঁকে ঝাঁকে।।
শরজালে আচ্ছাদিল বীর বৃকোদর।
কুজ্বটীতে আচ্ছাদয়ে যেন গিরিবর।।
বায়ুর নন্দন ভীম মহা-পরাক্রম।
অজাযুদ্ধে ক্রুদ্ধ যেন ব্যাঘ্র করে ক্রম।।
পরম আনন্দ যার পাইলে সংগ্রাম।
এত অস্ত্র প্রহারে তিলেক নাহি শ্রম।।
অনলের তেজ যেন ঘৃত দিলে বাড়ে।
ক্রোধেতে উথলে যেন ভীম অস্ত্র পড়ে।।
জীবগণ মধ্যে যেন যুগান্তের অন্ত।
ভীম বিহরয়ে যেন দেখি সন্ধ্যাকান্ত।।
প্রলয়ের মেঘরাঝি জিনিয়া গর্জ্জন।
বৃক্ষ ঘুরাইয়া অস্ত্র করে নিবারণ।।
আথালি পাথালি বীর মারি বৃক্ষ বাড়ি।
সহস্র সহস্র চূর্ণ হয় ভূমে পড়ি।।
ভাঙ্গিয়া অনেক রথ রথী অশ্ব ধ্বজ।
সহস্র সহস্র ঘোড়া লক্ষ লক্ষ গজ।।
দক্ষিণ বামেতে বীর ধায় আগে পাছে।
মুহূর্ত্তেকে বহু সৈন্য নিপাতিল গাছে।।
মহাদাপে বৃকোদর যেই ভিতে ধায়।
পলায় সকল সৈন্য তূলা যেন বায়।।
সিন্ধুজল মন্থে যেন পর্ব্বত মন্দর।
পদ্মবন ভাঙ্গে যেন মত্ত করিবর।।
মৃগেন্দ্র বিহরে যেন গজেন্দ্র-মণ্ডলে।
দানবের মধ্যে যেন দেব আখণ্ডলে।।
দণ্ড হাতে যম যেন বজ্র হাতে ইন্দ্র।
খেদাড়িয়া লৈয়া যায় ভীম নৃপবৃন্দ।।
যেই দিকে বৃকোদর সৈন্যে যায় খেদি।
দুই দিকে তট যেন মধ্যে হয় নদী।।
যতেক আছিল সৈন্য রক্তে হৈল রাঙ্গা।
খরস্রোতা রক্ত বহে ভাদ্রে যেন গঙ্গা।।
ব্যাঘ্র যেন খেদি যায় ছাগলের পাল।
পলায় সকল রাজা নাহি বান্ধে আল।।
সঙ্গেতে থাকয়ে যার সদা নৃপবৃন্দ।
বিংশ-অক্ষৌহিণী-পতি ধায় জরাসন্ধ।।
একাদশ-অক্ষৌহিণী প্রতি দুর্য্যোধন।
সপ্ত-অক্ষৌহিণী-পতি বিরাট রাজন।।
পঞ্চ-অক্ষৌহিণী পতি ধায় শিশুপাল।
নব-অক্ষৌহিণী-পতি কলিঙ্গ-ভূপাল।।
বিন্দ অনুবিন্দ চারি অক্ষৌহিণী-পতি।
কোথা গেল রথ গজ তুরঙ্গ পদাতি।।
একা একা প্রাণ লৈয়া সবাই পলায়।
আইল আইল বলি, পাছে নাহি চায়।।
মুকুট পড়িল খসি, হাতের ধনুক।
তুলিয়া লিইতে কেহ নাহি বান্ধে বুক।।
ঊর্দ্ধশ্বাসে ধায় সবে, পাছে নাহি দেখে।
মার মার বলিয়া সে ভীমসেন ডাকে।।
শরণ লইনু বলে মারে আছাড়িয়া।
পলাইলে রক্ষা নাই মারিল তাড়িয়া।।
পলায় নৃপতিগণ না দেশে নিষ্কৃতি।
উঠিলেন গর্জ্জিয়া মদ্রের অধিপতি।।
নানা অস্ত্র প্রহারয়ে মদ্রের অধিপতি।
কোপে বৃক্ষ প্রহারয়ে বীর বৃকোদর।।
বৃক্ষের প্রহারে রথ চূর্ণ হৈয়া গেল।
লাফ দিয়া শল্য রাজা ভূমিতে পড়িল।।
হয় রথ চূর্ণ হৈল বৃক্ষের প্রহারে।
গদা লৈয়া শল্য রাজা ভূমির উপরে।।
গদাহস্তে শল্য রাজা তরু-হস্তে ভীম।
দোঁহাকার মহাযুদ্ধ হইল অসীম।।
কৌতুক দেখয়ে সবে থাকিয়া অন্তরে।
মণ্ডলী করিয়া দোঁহে চারিভিতে ফিরে।।
পর্ব্বত-উপরে যেন পড়িল পর্ব্বত।
সর্ব্বরাজগণ যেন জানিল অদ্ভুত।।
পর্ব্বত-উপরে যেন বজ্রাঘাত হৈল।
সেইমত দোঁহাকার শব্দেতে পূরিল।।
পর্ব্বত-উপরে যেন পর্ব্বত উপরে।
মহাশব্দে প্রহারে দোঁহার কলেবরে।।
উভ মত্তহস্তী যেন পর্ব্বত উপর।
উভ মত্তবৃষ যেন গোষ্ঠের ভিতর।।
প্রলয়ের মেঘ যেন দোঁহার গর্জ্জন।
ঘন ঘন হুহুঙ্কারে কাঁপে সর্ব্বজন।।
বিপরীত দোঁহার দন্তের কড়মড়ি।
ভূমিকম্প চরণে চলনে তড়বড়ি।।
এইমত কতক্ষণ হইল সমর।
ক্রোধে ওষ্ঠ কামড়ায় বীর বৃকোদর।।
বৃক্ষের প্রহারে রথ চূর্ণ হৈয়া যায়।
দেখিয়া সকল রাজা অমনি পলায়।।
ঘুরাইয়া বৃক্ষ প্রহালে সব্য-হাত।
খসিয়া পড়িল গদা গুরুতরাঘাতে।।
নিরস্ত্র হিইল শল্য, কিছু নাহি আর।
লাফ দিয়া ধরে তারে পবন-কুমার।।
শল্যেরে ধরিল ভীম ভূমে ফেলি বৃক্ষে।
পায়ে ধরি তাহারে ঘুরায় অন্তরীক্ষে।।
দেখিয়া হাসয়ে যত ব্রাহ্মণ-মণ্ডলী।
টিটকারী দিয়া নাচে দিয়া করতালি।।
আরে দুষ্ট ক্ষত্রগণ যে কর্ম্ম করিলা।
তাহার উচিত ফল হাতেতে পাইলা।।
দয়াযুক্ত হয়ে তব যতেক ব্রাহ্মণ।
ছাড় ছাড় বলিয়া করিল নিবারণ।।
এই মদ্রপতি সদা ব্রাহ্মণ সেবয়।
সে কারণে মারিবারে উচিত না হয়।।
শল্য যেন মরিল, হরিল তার জ্ঞান।
আর দুই তিন পাকে ছাড়িবে পরাণ।।
শুনি ভীম অনেক দ্বিজের উপরোধ।
বিশেষ মাতুল জানি ত্যাগ কৈল ক্রোধ।।
মৃতপ্রায় করিয়া শল্যেরে ছাড়ি দিল।
দেখিয়া সকল রাজা বিস্ময় মানিল।।
বাহুযুদ্ধে শল্যে জিনে নাহিক সংসারে।
এক হলধর আর বৃকোদর পারে।।
মনুষ্যের কর্ম্ম নয় জানিল নিশ্চয়।
ভীমের সম্মুখে আর কেহ নাহি রয়।।
প্রাণ লয়ে পলায় যতেক নরবর।
খেদাড়িয়া পাছে ধায় বীর বৃকোদর।।
মহাভারতের কথা সুধা-সিন্ধু-মত।
কাশীদাস কহে সাধু শুনে অবিরত।।