৯৭তম অধ্যায়
ইরাবানের বধে পার্থের খেদ-সক্রোধ যুদ্ধযাত্রা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাবীর ধনঞ্জয় স্বীয় পুত্ৰ ইরাবানের নিধনবার্ত্তাশ্রবণে যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়া ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গমের ন্যায় নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক বাসুদেবকে কহিতে লাগিলেন, “হে মধুসূদন! মহামতি বিদুর পূর্ব্বেই কৌরব ও পাণ্ডবগণের এই মহাভয়ের বিষয় অবগত হইয়া আমাদিগকে ও ধৃতরাষ্ট্রকে নিবারণ করিয়াছিলেন। দেখ, কৌরবগণ আমাদের পক্ষীয় বহুসংখ্যক বীরকে ও আমরা কৌরবদিগকে সংহার করিয়াছি; সংসারে অর্থের নিমিত্তই লোকে দুষ্কর্ম্ম করিয়া থাকে; আমরাও সেই অর্থের নিমিত্ত এই জ্ঞাতিবধরূপ অতি কুৎসিত কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইয়াছি; অর্থে ধিক্! ধনহীন ব্যক্তির জ্ঞাতিবধদ্বারা অর্থোপার্জ্জন করা অপেক্ষা মৃত্যুই শ্রেয়। হে কৃষ্ণ! এই সমাগত জ্ঞাতিসমুদয়কে সংহার করিয়া আমাদের কি লাভ হইবে? দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন ও শকুনির অপরাধে এবং কর্ণের কুমন্ত্রণায় ক্ষত্ৰিয়গণ নিহত হইতেছেন। এক্ষেত্রে বুঝিলাম, মহারাজ যুধিষ্ঠির পূর্ব্বে দুৰ্য্যোধনের নিকট রাজ্যার্দ্ধ বা পঞ্চগ্রাম প্রার্থনা করিয়া উত্তম কাৰ্য্য করিয়াছিলেন; কিন্তু দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন তৎকালে যুধিষ্ঠিরের সেই প্রার্থনায় সম্মত হয় নাই। এক্ষণে এই ক্ষত্ৰিয়গণকে ধরণীতলে নিপতিত দেখিয়া আপনাকে সাতিশয় নিন্দা করিতেছি; ক্ষত্ৰিয়বৃত্তিতে ধিক! আমার জ্ঞাতিবর্গের সহিত যুদ্ধ করিবার বাসনা নাই; কিন্তু আমি যুদ্ধে নিরস্ত হইলে ক্ষত্ৰিয়গণ আমাকে অসমর্থ জ্ঞান করিবেন, এইহেতু অগত্যা সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইতেছি। অতএব হে কৃষ্ণ! তুমি সত্বর ধৃতরাষ্ট্রসৈন্যাভিমুখে অশ্বসঞ্চালন কর; আমি ভুজদ্বারা সমরসাগর উত্তীর্ণ হইব। আর ক্লীবের ন্যায় বৃথা কালক্ষেপ করা কর্ত্তব্য নহে।”
“অরতিনিপাতন মহাত্মা মধুসূদন অর্জ্জুনের বাক্যশ্রবণ করিয়া বায়ুবেগগামী শ্বেতবর্ণ অশ্বগণকে সঞ্চালিত করিতে লাগিলেন। তখন কৌরবসৈন্যমধ্যে বায়ুবেগোদ্ধূত পার্ব্বণ-পয়োনিধির [সমুদ্রের] শব্দের ন্যায় মহাকোলাহল সমুত্থিত হইল। অপরাহ্ণে পাণ্ডবগণের সহিত ভীষ্মের তুমুল সংগ্রাম হইতে লাগিল। বসুগণ যেমন বাসবকে পরিবেষ্টন করেন, তদ্রূপ ধাৰ্তরাষ্ট্রগণ দ্রোণাচাৰ্য্যকে পরিবেষ্টন করিয়া ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর শান্তনুনন্দন ভীষ্ম, কৃপ, ভগদত্ত ও সুশর্ম্মা অর্জ্জুনের অভিমুখে, হার্দ্দিক্য ও বাহ্লীক সাত্যকির অভিমুখে, ভূপতি অম্বষ্ঠক অভিমন্যুর অভিমুখে এবং অন্যান্য মহারথীগণ অন্যান্য মহারথগণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন।
ভীমকর্ত্তৃক ব্যূঢ়োরস্কাদি ধৃতরাষ্ট্রীতনয়বধ
“অনন্তর উভয়পক্ষে ঘোরতর সংগ্ৰাম হইতে লাগিল। মহাবীর ভীমসেন ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে নিরীক্ষণ করিয়া ক্ৰোধে হুত-হুতাশনের ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। বর্ষাকালীন মেঘমণ্ডল যেমন বারিধারায় পর্ব্বত আচ্ছাদন করে, তদ্রূপ ধাৰ্তরাষ্ট্রগণ শরনিকরে, ভীমসেনকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। শার্দূলের ন্যায় বেগবান মহাবীর বৃকোদর ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের শরনিকরে সমাচ্ছাদিত হইয়া সৃক্কণী লেহন করিয়া সুতীক্ষ্ন ক্ষুরপ্র নিক্ষেপপূর্ব্বক ব্যূঢ়োরস্ককে নিপাতিত করিবামাত্র তিনি গতজীবিত হইলেন। পরে এক কৃতপান [পুনঃ পুনঃ অগ্নি ও জলসংযোগে সুদৃঢ়] সুশাণিত ভল্লদ্বারা কুণ্ডলীকে সংহার করিয়া সত্বর অন্যান্য ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের উপর সুশাণিত কৃতপান শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন; ভীমসেনপ্রেরিত ভীষণ সায়কনিচয় আপনার পুত্ৰ অনাধৃষ্য, কুণ্ডভেদী, বৈরাট, বিশালাক্ষ, দীৰ্ঘবাহু, সুবাহু ও কনকধ্বজকে রথ হইতে নিপতিত করিল। উহারা ভীমের শরে ভূতলশায়ী হইয়া ধরানিপতিত পুষ্পিত সহকার[মুকুলিত আম্রবৃক্ষের]তরুর ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন অন্যান্য ধাৰ্তরাষ্ট্ৰগণ ভীমসেনকে সাক্ষাৎ কৃতান্ত জ্ঞান করিয়া ইতস্তত পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন।
উভয়পক্ষের ভীষণ সমরে বহুলোকবিনাশ
“ভীমসেন ধাৰ্তরাষ্ট্রদিগকে সংহার করিতেছেন দেখিয়া মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য তাঁহার উপর অনবরত শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর বৃকোদর দ্রোণকর্ত্তৃক নিবারিত হইয়াও ধাৰ্তরাষ্ট্রগণকে সংহার করিয়া অদ্ভূত পৌরুষ প্রকাশ করিলেন। বৃষ যেমন গগন হইতে নিপতিত বারিধারা অনায়াসে সহ্য করে, তদ্রূপ মহাবীর ভীমসেন অক্লেশে দ্রোণবিমুক্ত শরনিকর সহ্য করিতে লাগিলেন। ঐ মহাবীর এককালে দ্রোণকে নিবারণ ও ধাৰ্তরাষ্ট্রগণকে বিনাশ করিতে আরম্ভ করিলে সমুদয় লোক বিস্ময়ান্বিত হইল। মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর মৃগমধ্যচারী ব্যাঘ্রর ন্যায় ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের মধ্যে ক্রীড়া করিতে লাগিলেন এবং পশুগণমধ্যস্থ বৃক যেমন পশুগণকে তাড়িত করে, তদ্রূপ ধাৰ্তরাষ্ট্রগণকে বিদ্রাবিত করিলেন। মহারথ ভীষ্ম, ভগদত্ত ও কৃপ ভীমসেনকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীমসেন বাণদ্বারা উক্ত বীরগণের বাণ নিরাকৃত করিয়া কৌরবপক্ষীয় প্ৰধান প্ৰধান সৈন্যগণকে শমনসদনে প্রেরণ করিতে আরম্ভ করিলেন।
“মহাবলপরাক্রান্ত অভিমন্যু অসংখ্য শরনিক্ষেপ করিয়া লোকবিশ্রুত অম্বষ্ঠকের রথ ভগ্ন করিলেন। মহাবীর অম্বষ্ঠক মহাত্মা অভিন্যুর শরে ভগ্নারথ ও নিতান্ত আহত হইয়া অবিলম্বে রথ হইতে ভূতলে অবতরণপূর্ব্বক সব্রীড়চিত্তে [লজ্জিত-হৃদয়ে] অর্জ্জুনতনয়ের উপর অসি নিক্ষেপ করিয়া হার্দ্দিক্যের রথে সমারূঢ় হইলেন। অরাতিকুলনিপাতন সমরকুশল মহাবীর অভিমন্যু অনায়াসে সেই অম্বষ্ঠকাবিমুক্ত খড়্গ খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তদর্শনে সৈন্যগণ তাঁহাকে ‘সাধু সাধু’ বলিয়া প্রশংসা করিতে লাগিল।
“হে মহারাজ! ধৃষ্টদ্যুম্নপ্রভৃতি পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ · কৌরবসৈন্যগণকে ও কৌরবপক্ষীয় বীরগণ পাণ্ডবসৈন্যগণকে দৃঢ়তর প্রহার করিয়া ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিল। উভয়পক্ষীয় যোদ্ধগণ পরস্পর কেশাকর্ষণ এবং নখ, দন্ত, মুষ্টি, জানু, তল, নিস্ত্রিংশ ও বাহুপ্ৰহারে পরস্পর যমালয়ে প্রেরণ করিতে লাগিল। রণমদে মত্ত হইয়া পিতা পুত্রকে ও পুত্র পিতাকে সংহার করিলেন। বিপক্ষ-পক্ষের শরনিকরে যোদ্ধৃগণের দেহ ক্ষতবিক্ষত হইয়া উঠিল। রণনিহত ব্যক্তিদিগের ভূতলে নিপতিত হেমপৃষ্ঠ [সোণা দিয়া মোড়া] শরাসন, মহার্হ তৃণীর ও তৈলমার্জ্জিত রজতপুঙ্খ সায়কনিচয় নির্ম্মোকনিমুক্ত ভীষণ ভুজঙ্গের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। সমরাঙ্গনে অসংখ্য হস্তিদন্তবিনির্ম্মিত মুষ্টি[বাঁট]দ্বারা বিভূষিত সুবৰ্ণমণ্ডিত খড়্গ, সুবর্ণচিত্রিত চর্ম্ম, সুবৰ্ণময় প্রাস, সুবৰ্ণবিভূষিত পট্টিশ, সুবৰ্ণময় যষ্টি, সুবর্ণসমুজ্জ্বল শক্তি, অত্যুৎকৃষ্ট বর্ম্ম, গুরুতর মুষল, পরিঘ, ভিন্দিপাল, হেমপরিষ্কৃত বিবিধ চাপ, বহুবিধ বিচিত্ৰ কম্বল, চামর ও ব্যজনসমুদয় নিপতিত হইল। সমরনিহত মহারথগণ নানাবিধ শস্ত্ৰহস্তে [অস্ত্রযুক্ত হস্তে] ভূতলে পতনোন্মুখ হইয়াও জীবিতের ন্যায় বোধ হইতে লাগিলেন। বহুসংখ্যক সৈন্য গদামথিতগাত্ৰ [গদাদ্বারা ভগ্নদেহ], মুষলনির্ভিন্ন-মস্তক [মুষলদ্বারা ভগ্নমস্তক] এবং গজ, বাজী ও রথের সংঘর্ষণে নিহত হইয়া ধরাতলে পতিত হইল। অসংখ্য অশ্ব, মনুষ্য ও গজ নিপতিত থাকাতে সমরাঙ্গন পর্ব্বতাকীর্ণ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। ঐ সময় রাশি রাশি শক্তি, ঋষ্টি, তোমর, শর, খড়্গ, পট্টিশ, প্রাস, লৌহময় কুণ্ড, পরশু, পরিঘ, ভিন্দিপাল, শতঘ্নী ও শস্ত্রনিহত নরকলেবরে ভূতল সমাচ্ছন্ন হইল। নিঃশব্দ, অল্পশব্দ ও শোণিতপরিপ্লুত, গতাসু প্রাণীগণের সকেয়ুর চন্দন সমুক্ষিত বাহুসকল, হস্তি-হস্তোপম [হস্তিশুণ্ডতুল্য] ঊরুসমুদয় এবং চূড়ামণিবিভূষিত কুণ্ডলসুশোভিত মস্তকসকল নিপতিত থাকাতে সমরক্ষেত্র অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিল। শোণিতলিপ্ত কাঞ্চনময় কবচসকল ইতস্ততঃ নিপতিত হওয়াতে সমরাঙ্গন হুতাশনসমাকীর্ণ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। সুবর্ণপুঙ্খ শর, শরাসন, তূণীর, কিঙ্কিণীজলজড়িত ভগ্নরথ, সশোণিত স্রস্তজিহ্ব [বহিষ্কৃতজিহ্ব—জিভ বাহির হইয়া পড়া] নিহত অশ্ব, অনুকর্ষ পতাকা, পাণ্ডুরবর্ণ ধ্বজ ও স্রস্তহস্ত[শুণ্ডহীন]শয়ান মাতঙ্গসমুদয় ইতস্ততঃ বিকীর্ণ থাকাতে রণভূমি নানালঙ্কারভূষিত প্রমদার ন্যায় শোভা ধারণা করিল। প্রাসবিদ্ধ মাতঙ্গগণ গাঢ়বেদনাভিভূত হইয়া চীৎকার ও শুণ্ডাস্ফালন করাতে সংগ্রামস্থল স্যন্দমান [স্পন্দিত—নড়াচড়াযুক্ত] পর্ব্বতে সমাকীর্ণ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। নানাবর্ণকম্বল, কারিগণের চিত্ৰকম্বল, বৈদূৰ্য্যমণিনির্ম্মিত, দণ্ড, অঙ্কুশ, গজঘণ্টা, রাঙ্কব, বিপাটিত চিত্ৰকম্বল, বিচিত্র গ্রৈবেয় [কণ্ঠভূষণ—গলার লম্বমান অলঙ্কার], সুবর্ণনির্ম্মিত কক্ষ, বহুধা বিচ্ছিন্ন যন্ত্র, কাঞ্চনময় তোমর, অশ্বখুরোত্থিত ধূলি-সরিৎ [নদীস্রোতের মত ধূলিপ্রবাহ], বৃহৎ ছত্র, বর্ম্ম, সাদিগণের অঙ্গদসনাথ ছিন্নভুজ [অশ্বারোহিগণের অঙ্গদযুক্ত ছিন্নহস্ত], বিমল সুতীক্ষক্ষ্ন প্রাস, যষ্টি, বিচিত্র উষ্ণীষী, সুবৰ্ণময় অৰ্দ্ধচন্দ্ৰ, অশ্বগণের মন্দিত চিত্ৰকম্বল ও রাঙ্কব, ভূপতিগণের বিচিত্র চূড়ামণি, চামর ও বীরগণের চারুচন্দ্ৰদ্যুতি, দিব্যকুণ্ডলবিভূষিত, শ্মশ্রুসমবেত মস্তকসমুদয় চতুর্দ্দিকে বিকীর্ণ থাকাতে রণস্থল গ্রহনক্ষত্রসুশোভিত নভোমণ্ডলের ন্যায় শোভা ধারণ করিল।
“হে মহারাজ! সেই উভয়পক্ষীয় সেনাগণ পরস্পর সংগ্রাম করিয়া এইরূপে নিহত হইয়াছিল। হতাবশিষ্ট সৈন্যগণ শ্ৰান্ত ও ভগ্ন হইতে লাগিল। ঘোরতর রজনী সমুপস্থিত হইল; রণস্থল অদৃশ্য হইয়া উঠিল; তখন কৌরব ও পাণ্ডবগণ অবহার করিয়া স্বস্ব শিবিরে গমনপূর্ব্বক বিশ্রাম করিতে লাগিলেন।”