যার যেবা অস্ত্র লয়ে যত রাজগণ।
জরাসন্ধ শল্য শাল্ব কর্ণ দুর্য্যোধন।।
শিশুপাল দন্তবক্র কাশী-নরপতি।
রুক্মী ভগদত্ত ভোজ কলিঙ্গ প্রভৃতি।।
চিত্রসেন মদ্রসেন চন্দ্রসেন রাজা।
নীলধ্বজ রোহিত বিরাট মহাতেজা।।
ত্রিগর্ত্ত কীচক বাহু সুবাহু নৃপতি।
অনুপেন্দ্র মিত্রবৃন্দ সুষেণ প্রভৃতি।।
যার যে লইয়া অস্ত্র ভূপতি-মণ্ডল।
নানা অস্ত্র ফেলে যেন বরিষার জল।।
খট্টাঙ্গ ত্রিশূল জাঠি ভূষণ্ডী তোমর।
শেল শূল চক্র গদা মুষল মুদগর।।
প্রলয়ের মেঘ যেন সংহারিতে সৃষ্টি।
তাদৃশ নৃপতিগণ করে অস্ত্র বৃষ্টি।।
দেখিয়া দ্রৌপদী দেবী কম্পিত হৃদয়।
অর্জ্জুনে চাহিয়া তবে কহে সবিনয়।।
না দেখি যে দ্বিজবর ইহার উপায়।
বেড়িলেক রাজগণ সমুদ্রের প্রায়।।
ইথে কি করিবে মম পিতার শকতি।
জানিলাম নিশ্চয় যে নাহিক নিষ্কৃতি।।
অর্জ্জুন বলেন, তুমি রহ মম কাছে।
দাঁড়াইয়া নির্ভয়ে দেখহ রহি পাছে।।
কৃষ্ণা বলিলেন, দ্বিজ অপূর্ব্ব কাহিনী।
একা তুমি কি করিবে লক্ষ নৃপমণি।।
হাসিয়া অর্জ্জুন বলে, দেখ গুণবতি।
একা আমি বিনাশিব সব নরপতি।।
একার প্রতাপ তুমি না জানহ সতি।
একা সিংহে নাহি পারে অজাযুথপতি।।
একেশ্বর গরুড় সকল অহি নাশে।
একেশ্বর পুরন্দর দানব বিনাশে।।
একা ব্যাঘ্র নাশ করে লক্ষ মৃগ ক্ষুদ্র।
একা শেষ বিষধর মথিল সমুদ্র।।
একা হনুমান্ যেন দহিলেক লঙ্কা।
সেই মত নৃপগণে নাশিব, কি শঙ্কা।।
এত বলি অর্জ্জুন কৃষ্ণারে আশ্বাসিয়া।
ধনুর্গুণ সন্ধান করেন টঙ্কারিয়া।।
তবে ত দ্রুপদ রাজা পুত্রের সহিত।
ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী সহিত সত্যজিৎ।।
মুহূর্ত্তেক যুদ্ধ করি নারিল সহিতে।
ভঙ্গ দিয়া সসৈন্যে পলায় চতুর্ভিতে।।
একেশ্বর অর্জ্জুনে বেড়িল নৃপগণ।
দেখি ওষ্ঠ কামড়ায় পবন-নন্দন।।
অনুমতি লইতে ধর্ম্মের পানে চায়।
দেখিয়া সম্মত হইলেন ধর্ম্মরায়।।
যুধিষ্ঠির বলে, ভাই অনর্থ হইল।
এক লক্ষ রাজা একা অর্জ্জুনে বেড়িল।।
শীঘ্র যাহ ভীমসেন আনহ অর্জ্জুনে।
দ্বন্দ্ব করিবার কিছু নাহি প্রয়োজনে।।
পাইয়া জ্যেষ্ঠের আজ্ঞা ধায় বৃকোদর।
উপাড়িয়া নিল এক দীর্ঘ তরুবর।।
অতি উচ্চ তরুবরে নিষ্পত্র করিয়া।
বায়ুবেগে সৈন্যমধ্যে প্রবেশিল গিয়া।।
ক্ষত্রগণ চেষ্টা দেখি ক্রোধে দ্বিজগণ।
পাছে পাছে ভীমের ধাইল সর্ব্বজন।।
হের দেখ ক্ষত্রিয় পাপিষ্ঠ দুরাচার।
এ দ্বিজ বিন্ধিল লক্ষ্য সভার মাঝার।।
লক্ষ্য বিন্ধিবারে শক্য নহিল তখন।
এবে দ্বন্দ্ব করে কেন একা ত ব্রাহ্মণ।।
এমত অন্যায় বল কার প্রাণে সয়।
যুদ্ধ করি প্রাণ দিব, দ্বিজ সব কয়।।
মারিব মরিব আজি, করিব সমর।
হেন কর্ম্ম সহিবে কাহার কলেবর।।
এত বলি দ্বিজগণ দণ্ড লয়ে করে।
মৃগচর্ম্ম দৃঢ় করি বান্ধি কলেবরে।।
লক্ষ লক্ষ ব্রাহ্মণ ধাইল বায়ুবেগে।
হাতে ঠেঙ্গা করিয়া নৃপতিগণ আগে।।
দেখিয়া বলেন পার্থ করি কৃতাঞ্জলি।
মাথায় লইয়া দ্বিজগণ পদধূলি।।
তোমরা আইলা দ্বন্দ্বে কিসের কারণ।
দাণ্ডাইয়া কৌতুক দেখহ সর্ব্বজন।।
যাহারে করহ ভস্ম মুখের বচনে।
তাঁহার সহিত দ্বন্দ্ব নহে সুশোভনে।।
তোমা সবাকার মাত্র চরণ প্রসাদে।
দুষ্ট ক্ষত্রগণেরে মারিব অপ্রমাদে।।
যে প্রকার দুষ্টাচার করিয়াছে সবে।
তাহার উচিত শাস্তি এইক্ষণে পাবে।।
এত বলি নিবারণ করি দ্বিজগণ।
রাজগণ প্রতি ধায় ইন্দ্রের নন্দন।।
হাসিয়া বলেন রাম দেখ ভগবান।
পূর্ব্বে যেই কহিয়াছি হৈল বিদ্যমান।।
এই দেখ লক্ষ রাজা একত্র হইয়া।
বেড়িলেক অর্জ্জুনেরে সসৈন্য লইয়া।।
একা পার্থ নিবারিবে কত শত জনে।
প্রতিকার ইহার না দেখি যে নয়নে।।
প্রতিজ্ঞা করিল সব মিলি রাজগণে।
দ্বিজে মারি কন্যা দিবে রাজা দুর্য্যোধনে।।
রামের বচন শুনি দুঃখিত গোবিন্দ।
নয়নযুগল যেন বিকচারবিন্দ।।
ক্ষণেক রহিয়া কৃষ্ণ করেন উত্তর।
যা বলিলে সত্য তাহা যাদব-ঈশ্বর।।
এক লক্ষ্য নৃপতি বেড়িল এক জনে।
কোথায় জিনিবে সেই মনুষ্য-পরাণে।।
অর্জ্জুনের পরাক্রম জ্ঞাত নহ তুমি।
মুহূর্ত্তে জিনিতে পারে সসাগরা ভূমি।।
যতেক মনুষ্য আর সুরাসুর সহ।
অর্জ্জুনের সঙ্গে যদি করয়ে কলহ।।
দুর্গম বনেতে যেন মদমত্ত বাঘ।
তারে কি করিতে পারে রাজগণ ছাগ।।
কহিলা, যে প্রতিজ্ঞা করিল রাজগণে।
দ্বিজে মারি কন্যা দিবে রাজা দুর্য্যোধনে।।
শিশু করে কোথা চন্দ্র ধরিবারে পারে।
ব্যাঘ্রমুখে আমিষ শৃগাল কেথা ধরে।।
তবে যদি অর্জ্জুনের ন্যূনতা দেখিব।
সুদর্শন-চক্রে আমি সবারে ছেদিব।।
শুনি রাম হইলেন সভয় অন্তর।
নিজ শিষ্য দুর্য্যোধন অতি প্রিয়তর।।
পাণ্ডবের শত্রু, ক্রোধ আছয়ে অন্তরে।
এই ছল করি কৃষ্ণ পাছে বধ করে।।
চিন্তিয়া বলেন কৃষ্ণ রেবতী-রমণ।
আমা সবাকার দ্বন্দ্বে নাহি প্রয়োজন।।
বিশেষ আপনি বল, পার্থ মহাবল।
মুহূর্ত্তেকে জিনিবেক নৃপতি সকল।।
সেইকথা পরীক্ষা করিব এইক্ষণে।
অন্তরে থাকিয়া যুদ্ধ দেখহ আপনে।।
গোবিন্দ বলেন, আমি না যাইব রণে।
তব আজ্ঞা লঙ্ঘন না করিব কখনে।।
একা পার্থে জিনে হেন নাহি ত্রিভুবনে।
হয় নয় এখনি দেখিবা বিদ্যমান।।
সুমেরু টলিবে শুষিবেক সিন্ধুজল।
শীতল হইয়া যদি যায় দাবানল।।
পশ্চিমে উদয় যদি দিনমণি হবে।
তথাপি অর্জ্জুনে কেহ রণে না পারিবে।।
গোবিন্দের মুখে শুনি এতেক বচন।
নিঃশব্দে রহিলা রাম হইয়া বিমন।।
এক লক্ষ নৃপতি বেড়িল চতুর্দ্দিকে।
নাহিক সম্ভ্রম পার্থ সিংহ যেন মৃগে।।
হিমাদ্রি-পর্ব্বত-প্রায় আছে মহাবীর।
সমুদ্র সদৃশ বুদ্ধি অত্যন্ত গভীর।।
জন্তুগণ মধ্যে যেন কালান্তক যম।
ইন্দ্রের নন্দন বীর ইন্দ্র-পরাক্রম।।
বৃক্ষ যেন বৃষ্টিধারা মাথা পাতি লয়।
তাদৃশ অর্জ্জুন-অঙ্গে বাণ-বৃষ্টি হয়।।
অপূর্ব্ব সমর দেখি যতেক অমর।
অর্জ্জুন কারণ হৈল চিন্তিত অন্তর।।
একা পার্থ কোটি কোটি বেড়িল বিপক্ষ।
হাতে আছে তিন অস্ত্র বিন্ধিবার লক্ষ্য।।
পুত্রের সাহায্য হেতু দেবরাজ-তূর্ণ।
পাঠাইয়া দিল তূণ অস্ত্রগণ-পূর্ণ।।
বৈজয়ন্তী-মালা ইন্দ্র দিলেন প্রসাদ।
হৃষ্ট হৈয়া অর্জ্জুন ছাড়েন সিংহনাদ।।
টঙ্কারিয়া ধনুক এড়েন অস্ত্রগণ।
নিমিষেতে শর বৃষ্টি করেন বারণ।।
যেন মহা-বাতাসে উড়ায় মেঘমালা।
সমুদ্র-লহরী যেন নিবারিলা ভেলা।।
শিশুগণ মধ্যে যেন করে গেণ্ডুলীলা।
যুদ্ধে বীর তাদৃশ করেন নানা খেলা।।
দাবাগ্নি নিবৃত্ত যেন হৈল বৃষ্টিজলে।
নিমিষে করেন পার্থ শান্ত সে সকলে।।
মহাভারতের কথা সুধা-সিন্ধুমত।
কাশীরাম কহে, সাধু পিয়ে অবিরত।।